ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথমবার গিয়েই অবাক হয়েছিলাম পুরনো স্কুল-কলেজ দেখে। সেই উনবিংশ শতাব্দীর স্কুল-কলেজ- শিল্পকলা একাডেমিই বলে দেয় কতটা শিক্ষা ও সংস্কৃতিবান্ধব এই জনপদ। কতটা ঐতিহ্যবাহী এখানকার জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ। বয়স-রহস্যও আমাকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল। স্থানীয় মানুষের চেহারা-অবয়ব দেখে যা বয়স আন্দাজ করি বাস্তবে তা অনেক বেশি, এতটা বেশি যে সন্দেহ জাগে, ঠিক বললো কি না ! মানে বয়সের তুলনায় অবয়ব তরুণ। আমাকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান। যেখানে আমরা শুনেছিলাম অসাধারণ বেহালা-বাদন। অনেকবার অনুরোধের পর বিনয়ে বিনম্র হয়ে নিজকে অকিঞ্চিৎকর বাদক আখ্যা দিয়ে যিনি একটি ধূলিমলিন বাক্স থেকে বেহালা বের করে বাজিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ‘সুরসম্রাট’ খ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ভাইয়ের তৃতীয় বংশধর (নাম আজ মনে নেই)। তাঁর বেহালার তারে সুর সংযোজন করতে সে-সময় যে ছোট্ট ছেলেটি হারমোনিয়াম ধরেছিল সে দোকানে ফুটফরমায়েশ খাটে। আমাদের জন্য বিস্ময়ের আরো ছিল বাকি। সেই দোকানের দোতলায় দুই প্রকোষ্ঠের একচিলতে ঘরে থরে বিথরে পরিপাটি করে সাজানো উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত সংগীত পরিবারের গৌরবজনক ইতিহাস তিনি আমাদেরকে দেখালেন। পূর্বপুরুষের মহিমান্বিত ঘরানা দেয়ালে দেয়ালে, মেঝেতে পরিপাটি বিছানো কার্পেট, হারমোনিয়াম, সেতার, আরো কত বাদ্যযন্ত্র! কী ভীষণ যত্ন করা হয় তা সেগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়! সেই ঘরকে মসজিদের মত পবিত্র আাখ্যা দিয়েছিলেন দোকানের মালিক। ঘরের ভিতর প্রবেশে তাঁর বিনীত ভঙ্গি আমি আজও ভুলিনি। যেন দেয়ালে ঝুলানো সব ওস্তাদ সাধনায় মগ্ন, একটু আওয়াজ হলেই বিরক্ত হবেন। সেখানে যে-আসর বসল তাতে বাজারের দোকানদার, চা বিক্রেতা, তরকারিওয়ালাই শিল্পী- তারাই বাদক, তারাই গায়ক। আমরা অভিভূত হয়ে শুনলাম। সেই ঘরটি গতকাল জ্বালিয়ে দিয়েছে মাদ্রাসার উন্মাদ ছাত্ররা । শেষ হয়ে গেছে আরও এক গৌরবজনক ইতিহাস-ঐতিহ্যের ফলক। যেমনভাবে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল রামুর বৌদ্ধবিহারগুলো পুড়িয়ে ফেলায়। লক্ষ-কোটি টাকার সেতার কিনে দিলেও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান বা অন্নপূর্ণার হাতের ছোঁয়া যে যন্ত্রে পড়েছিল সেটাকে ফিরে পাওয়া যাবে না। একটি দেশের সংস্কৃতির ইতিহাস কিছু বর্বর কুশিক্ষিত উদ্ভ্রান্তের কাছে এভাবে বারবার লাঞ্ছিত হতে থাকবে আর আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো, কিছুই বলবো না? মনে আছে, ২০০১ সালের নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বিএনপির টিকেটে বিজয়ী ইসলামি শাসনতন্ত্রের এক নেতা হুমকি দিয়েছিলেন, সেখান থেকে ‘গায়েনের বংশ নির্বংশ করা হবে’। বোধ করি তার পেয়াদারা সেই প্রতিশ্রুতি পুরণ করতে শুরু করল । এমন সময় সেটা করল, যে-সময় প্রধানমন্ত্রী টিভি-ভাষণে সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছিলেন। আমরা কি এমন উন্নত দেশ চাই যেখানে বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির গৌরব করতে পারবো না? যদি হয় তো সেটা অন্য কারো দেশ হবে।
মন্তব্য
"হারমোনিয়াম, সেতার, আরো কত বাদ্যযন্ত্র রাখা ঘর মসজিদের মত পবিত্র"!! এর পরেও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বংশ এতদিনে নির্বংশ করা হয়নি, মাহবুবুল হক ভাই!!
__________
সৌমিত্র পালিত
ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামে কিন্তু এখন আর প্রায় কোনো জেলা নাই। এখন এইটা বি বাড়িয়া। জায়গাটারে পুরা মুসলমান কররা না গেলেও নামের থাইকা কিন্তু হিন্দুয়ানিটা বাদ দেয়া গেছে। তো সেইখানে খামাখা গান বাজনা জিয়াইয়া রাইখা কী লাভ?
শুনেছিলাম নামও নাকি বদলানোর চেষ্টা হ়য়েছিল ৷
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
কওমি আর আলীয়া মাদ্রাসা মিলায়ে প্রায় ৩০-৪০ লক্ষ মানুষ মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে সরাসরি জড়িত। এদের বাপ চাচার জেনারেশন হিসাব করলে প্রায় ডাবল। যে দেশের জন সংখ্যার প্রায় ৫% মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে বা হয়েছে, সেখানে এর চেয়ে ভালো কি আশা করেন।
শীঘ্রই এই ব্যাং এর ছাতার মত গজানো মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রন না করা গেলে অন্য কোন উন্নতিই কোন কামে আসবে না।
মামুনুর রশীদ
অদ্ভুত এই দেশের মানুষ আর অদ্ভুত তাদের বিশ্বাস! গায়েনের বংশ নির্বংশ না করলে বোধহয় ধর্মকর্ম কায়েম করা যাচ্ছে না ঠিকমতো।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন