৬ দিনের ভারত ভ্রমণ শেষে ২৫ ডিসেম্বর অপরাহ্নে বাংলাদেশে পা দিয়েই চা-বিক্রেতার মাধ্যমে নির্বাচনী হালচালের প্রথম যে তথ্য কানে এলো তা হলো, নির্বাচনের আগের ৩ দিন সারাদেশে গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ থাকবে এ নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। ঢাকায় এসেও অটো-চালকের কাছে এই কথাই শুনলাম কিছুটা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে। যুক্তি, অভিজ্ঞতা, বিশ^াস সবগুলোতেই খটকা লেগে গেল, এমনটি তো কখনও দেখিনি এবং তা অবিশ^াস্যও বটে। প্রাথমিক প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম সাথে সাথেই। বাসায় এসে সব খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম এরকম কোনো নির্দেশনা বা আদেশ কোনো সংবাদ মাধ্যমেই আসেনি, কোথাও প্রচারিতও হয়নি। তাহলে সীমান্ত থেকে কেন্দ্র অবধি এই মিথ্যাটি প্রচারিত হলো কী ভাবে! আরও একটি ‘নাকি’যুক্ত খবর একই দিনে ঢাকায় রীতিমত আতঙ্ক ছড়ালো, সব ব্যাচেলরদের ভাড়া-বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ। শেষ পর্যন্ত গতকাল র্যাব-পুলিশ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাতে হলো যে, এই প্রচারণাটিও মিথ্যা। তাহলে এমন প্রচারের উৎপত্তি এবং বংশবিস্তার কোথায় হয় ? নিশ্চয়ই ফেসবুক। অতীতেও তা-ই হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গুজবের সরকারি-বেসরকারি ব্যাখ্যা নিয়ে ঠাট্টা-মস্করাও কম হয়নি, শব্দটির অর্থই ঝুঁকির মুখে পড়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রধানত আমি ‘ফেসবুক’-কেই চিহ্নিত করতে চাই। এজন্য যে, অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম বলতে বাংলাদেশে মূলত ফেসবুকই বোঝায়, বাকিগুলোর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। এমনকি নির্ভরযোগ্য অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের তথ্যও সাধারণ মানুষ খুব একটা পাত্তা দেয় না যতটা দেয় ফেসবুকের স্ট্যাটাসে। এর ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা লিখছি। গত নভেম্বর আমার ভারত ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার, বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় শ’খানেক মধ্যবয়স-উত্তীর্ণ নারী-পুরুষ যারা মোবাইল ব্যবহার করেন সীমিত দক্ষতা ও মাত্রায়। কেউ কেউ একদমই জানেন না এর ব্যবহার রীতি, কেবল ছবি তোলা ও গান শোনার কাজটি একটু-আধটু করতে পারেন। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই ফেসবুক-কেন্দ্রিক যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানে খুবই উৎসাহী। ছবি ও স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মীয়-স্বজনকে জানানো, নিজের ওয়াল বা ইন্টারফেস মুষিক দিয়ে গড়িয়ে চেনা-অচেনা সবার বক্তব্য-মন্তব্য থেকে দেশের খবরাখবর নেয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ যথেষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য তারা হালনাগাদ তথ্য আহরণে দ্রুততার পরিচয় দিয়ে থাকেন, ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে। কিন্তু সমস্যা হল, তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তারা কোনোভাবেই সতর্ক নন, আগ্রহীও নন। আমাকে প্রায়ই অনলাইন পত্রিকা ও ই-পেপার পড়ে তাদের আগ্রহ মেটাতে হতো। এখানেই সুযোগ নিয়ে থাকে ফন্দিবাজ-মতলববাজ গোষ্ঠী। সংবাদপত্র বা ইপেপারের মত হাজার হাজার ফেসবুক পাতা ও অনলাইন ওয়েবসাইট ‘ক’ কে ‘ব’ বানিয়ে পরিবেশন করছে কেবল নিজের পাতা বা সাইটকে উপার্জনের তালিকায় তুলতে।
ফেসবুকে একজন ব্যবহারকারী নির্দিষ্ট খোঁচায় তার নিজ পছন্দের বন্ধুমহল বেছে নেন, লাইক-শেয়ার বোতাম চাপেন, ইমোতে জটিল অনুভূতির কথা বোঝান, নিজের স্থানিক অবস্থান ঘোষণা করেন মোটকথা নিজের কর্মকা- ও মানসিক অবস্থার একটি যান্ত্রিক রূপ রেখে যান। তার মনের ভাষাটিকে যন্ত্রের ভাষায় অনুবাদ করে নিতে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও) করার কাজে ব্যবহৃত প্রোগ্রামগুলোর অসুবিধা হয় না। তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যবহারকারীর মোটামুটি একটা চারিত্র্য বা ধরন সে তৈরি করে ফেলে। তাই ব্যবহারকারীর পছন্দের সংবাদ-সঙ্গ-সংযোগগুলোতেই দেয়ালের বেশির ভাগ আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এসব অন্তর্গত মর্মকথা সাধারণ এমনকি অনেক দক্ষ ব্যবহারকারীরাও জানেন না। তারা তাদের মনের অজান্তেই মনের খবর জানিয়ে দিয়েছেন। তবু আমরা কেউ এমন আড়ালে বেপর্দা হওয়াতে লজ্জিত নই, বরং সগর্বে উপস্থিতি ঘোষণায় উৎসাহী। তাই ফেসবুকে সরাসরি ভিডিও দেখানো এবং সরাসরি সম্প্রচার-সংযোগ এই শক্তিতে নতুন অস্ত্র যোগ করেছে। ফলে গুজবের গায়েও যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন হাত-পা। এতকিছুর পরও অনির্ভরযোগ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর আমাদের দ্রুত নির্ভরতা, যুক্তিবিচার না করেই একরোখাভাবে তা সমর্থন করা এবং ক্রমাগত শোনাকথা তথা অসমর্থিত সূত্রকে প্রত্যক্ষণের মর্যাদা দিয়ে তা আগ-পাছ না ভেবেই সবাইকে জানানোর মানসিকতার পেছনে জাতিগত সংস্কৃতি, গণ-ঐতিহ্য ও লোক-বিশ^াস (পপুলার বিলিফ) এবং সামষ্টিক নির্জ্ঞানের কোনো ভূমিকা আছে কিনা তা খুঁজে বের করা সমাজ-বিশ্লেষকের কাজ।
মন্তব্য
গুজবের জনপ্রিয়তা সারা দুনিয়া জুড়েই এবং বরাবরের। হাল আমলে সামাজিক মাধ্যমে গুজবের ছড়িয়ে পড়াটা অতি অল্প সময়ে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঘটে। ফলে তার কুফল ফলে অনেক তাড়াতাড়ি অনেক ব্যাপ্তির সাথে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সহমত
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
নতুন মন্তব্য করুন