সাংবাদিক নাট্যকার আনিসুল হক " বাংরেজি" বা "ইংলা" চর্চা নিয়ে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত এবং সময়োপযোগী একটি লেখা পড়েছিলাম প্রথম আলো পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম বিষয়টি; শুধু বাংরেজি চর্চা নয় , সংবাদ পাঠক এবং রিপোর্টারদের বাংলা উচ্চারণের দুর্বলতার বিষয়টিও ভাবছিলাম। অনেকদিন আগে, যখন একুশেটিভি-চ্যানেল আই-এটিএন বাংলা প্রায় একযোগে সংবাদ প্রচার শুরু করেছিলো, তখন থেকেই বিষয়টি লক্ষ করেছিলাম। সেসময় প্রথম আলো পত্রিকায় এ নিয়ে একটি লেখাও পাঠিয়েছিলাম। আমি লিখেছিলাম, যারা সংবাদ শাখায় কাজ করছেন (তখন) তাদের অনেকেরই সাংবাদিকতায় ব্যুৎপন্ন নেই তাহলে বাংলাদেশে কি এমন ছেলেমেয়ের আকাল পড়েছে যে শুদ্ধ করে বাংলাটাও বলতে পারবে না ? যথারীতি আমার সেই লেখা অমনোনিত হয়ে ডেস্কের নিচে ডাস্টবিনে চলে গেছে।
বাংরেজি চর্চার বিষয়ে আনিসুল হকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষণ আছে। তন্মধ্যে আসলটি হল, বিদেশি বিশেষ করে ভারতীয় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর প্রভাব এবং ভারতীয় টিভি অনুষ্ঠানের ব্যর্থ অনুকরণ। স্মার্টনেস প্রদর্শনীকে আরেকটি কারণ হিসেবে হালকাভাবে উল্লেখ করলেও এটাও কম যায় না, বিশেষ করে তরুনীদের ক্ষেত্রে কথাটা একেবারে ফেলনা নয়। বাংরেজি চর্চার অন্তঃসারশূন্যতা সম্পর্কে আনিসুল হক অকাট্য যুক্তি দিয়েছেন। যেমন, এফ.এম রেডিওর উপস্থাপকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আমাদের এফ.এম রেডিওগুলো কি শ্রোতা হিসেবে বাংলাদেশের বাইরের কোন শ্রোতাগোষ্ঠিকে টার্গেট করেছে ? ভারতে দো-আঁশলা ধরণের বাংলা বা হিন্দি চালু আছে কারণ ইংরেজি চর্চা না করে সেখানে উপায় নেই । কিন্তু আমাদের পণ্যের বাজারে আমাদের ক্রেতা পটাতে কেন ইংরেজি মিশ্রিত বাংলা লাগবে তার কোন জবাব নেই। অবশ্য যদি এসব কথা জায়গামত পৌঁছায় তবেই যুক্তির কাট্যতা-অকাট্যতা যাচাইয়ের প্রশ্ন আসে।
বাংরেজি চর্চার পাশাপাশি বাংলা উচ্চারণ এবং পাঠের ক্ষেত্রে অরাজকতা চলছে সন্দেহ নেই। যাদের এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার কথা, ইলেক্ট্রনিক-মিডিয়ার সংবাদপাঠক-উপস্থাপক-রিপোর্টার, তারাই দক্ষতার সাথে বাংলা ভাষার জাতমারার কাজটি করে চলেছেন। আঞ্চলিক উচ্চারণভঙ্গী, ভুল-অস্পষ্ট উচ্চারণ বিশেষ করে বাক্যের শব্দগুলোর মধ্যে কিভাবে কতটুকু বিরতি দিয়ে পড়তে হয় ( যাকে ইংরেজিতে বলে- কনোটেশন) , এরা একদমই জানে না। ধরা যাক একটি বাক্য "সরকার বন্যার্তদের মধ্যে তিন লক্ষ ভিজিএফ কার্ড বিতরণ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ” এখানে 'সরকার কর্তা' 'সিদ্ধান্ত নিয়েছে' ক্রিয়া, বন্যার্তদের কর্ম। 'সরকার' ও 'বন্যার্তদের' শব্দদুটোর মধ্যে যেমন বিরতি প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন ক্রিয়ার স্পষ্ট উচ্চারণ এবং 'তিন' কে 'তি---ন' না বলা, বা এমনভাবে 'তিন লক্ষ' না বলা যাতে মনে হতে পারে এটি লটারির বিজ্ঞাপন। প্রয়োজন 'র' কে 'ড়' না বলা 'ছ' কে 'ছ' এর মর্যাদা দেয়া, পড়া মুখস্থ করার কায়দায় রিপোর্টিং এর সমাপ্তি না টানা। প্রয়োজন আরো অনেক কিছু। একুশে দিয়ে যাদের হাতেখড়ি , হালে এ লাইনের সিনিয়র হয়ে যারা রীতিমত কোচিং দিয়ে বেড়াচ্ছেন সেই দিমা নেফারতিতি, ডালিম, সামিয়া রহমান/জামান, তুষার-সহ আরো অনেকে মর্মান্তিক কায়দায় বাংলা পড়েন, 'কনোটেশন' জানেন না, অথবা জানলেও কারো কারো ক্ষেত্রে তা ইংরেজি ভাষার কনোটেশনের মত হয়ে যায়। উচ্চারণের ভুলের কথাতো বাদই দিলাম।
এ লাইনে হাল আমলের বেশ কিছু গায়ক/গায়িকাও আছেন। এদের নেতা হলেন মেহরিন- তারপর তিশমা সুবর্ণা তাহসান থেকে শুরু করে আরো অনেকে আছেন। তারা বাংলাকে ইংরেজির মত করে বলে আসলে কোন সুর শ্রোতার কানে পৌছাতে চান জানি না। তারা যদি এতই ইংরেজি অন্তঃপ্রাণ তবে ইংরেজিতে গান করেন না কেন ? দেখি জনপ্রিয়তা কতখানি ? ইংরেজি গানের শ্রোতাও তো দেশে কম নয়। নাকি তাতে থলের বিড়াল বেড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে ? আমাদের জেমস তো বোম্বে যাওয়ার আগে একটা গানও হিন্দিতে গায় নাই বা গাওয়ার চেষ্টায় বাংলার জাত মারে নাই। গান গাইতে গেলে কথাগুলো যে শুদ্ধ উচ্চারণে গাইতে হয় এ শিক্ষা কি তথাকথিত শিল্পীদের সংগীত গুরু দেন নি ? তবে তাদের শ্রোতা নেহাত কম নয় । এই শিল্পী,শ্রোতা এরা কারা ? ইংলিশ মিডিয়মের লেবেলধারী ? মিডিয়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের আধিপত্য আজকাল। এটা কি কারণে ? তারা বাংলাটাকে ইংরেজির ভেতর দিয়ে মোড়াতে মোড়াতে বলে এজন্য ? নাকি ইংরেজিটাকে দরকারে-বিনাদরকারে ফিট করে দিতে জানে এজন্য। কলকাতার চ্যানেল গুলোতেও এদের আধিপত্য তবে সেখানে একটা ব্যাপার সহ্য করার মত, যখন বাংলা বলে নিখাদ বাংলা বলে যায় শুদ্ধ উচ্চারণে আবার যখন ইংরেজি মেশায় তখনও অত্যন্ত চলতি ইংরেজি বলে তারা। আমাদের উপস্থাপকেরা তাদের প্রদর্শনীটি অনুকরণ করে কিন্তু রত্নটি ফেলে দেয়।
সংবাদ পাঠকে যে কোন ভাষার উচ্চারণ ও ভাষা শিক্ষার জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। ইংরেজি ভাষায় দখল আনতে হলে ভাল করে বিবিসি শুনতে হবে এ পরামর্শ আজো বিদ্বজ্জনেরা দেন। মূলত যে কোন পারফর্মিং আর্ট ফর্মেই ভাষা-উচ্চারণ-প্রজেকশান-থ্রোয়িং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটা সংবাদ পাঠই হোক বা গান-নাটকই হোক। কিন্তু বাংলা ভাষাকে বিশুদ্ধ উচ্চারণে বলা বা পড়া শিখতে গিয়ে কেউ আমাদের মিডিয়াকে অনুকরণ করলে অনুকরণকারী কোন ভাষা শিখবে তা বলা মুশকিল।
মন্তব্য
আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময় বড় ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ার সংবাদপাঠকদের ইংরেজি উচ্চারণ থেকে শেখার চেষ্টা করি।
বাংলায় একই কাজ করতে গেলে তাকে আর বাংলা বলতে হবে না।
ফূর্তি জাতীয় রেডিও তো আরো ভয়াবহ।
কথা প্রসঙ্গে, আপনাকে স্বাগতম সচলায়তনে।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
জনাব, আপনার লেখার সাথে আমার আর একটা বিরক্তির কথা বলি। বিশেষ করে খেলার খবর পড়ার সময় আমাদের পাঠক/পাঠিকারা প্রায়শই খেলোয়াড়দের নাম বিকৃত করে উচ্চারণ করে। এর কারণ, তারা ব্যক্তিগত ভাবে কোনদিনই খেলার খবর পড়ে না বা খেলা দেখেনা। সংবাদ পাঠক-পাঠিকাদের দৈনন্দিন এসব বিষয়েও কিছুটা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন বলে মনে হয়।
গুড অবজারভেশন ...
শুধু টিভি নিউজে না, খেলোয়াড়দের নামের সঠিক উচ্চারণ না জানার ঘটনা কিন্তু কিছু কিছু নিউজপেপারেও দেখা যায় ... ইত্তেফাক তো তুলনাহীন এই ব্যপারে ... একটা সিম্পল টেস্ট কইরেন ... ইত্তেফাকের খেলার পাতাটা নিয়া একটু ক্রিকেটের স্কোরশীট আর ফুটবল রিপোর্টগুলিতে চোখ বুলায়েন ... অন্তত চার-পাঁচটা ভুল পাবেন ...
একটা পত্রিকা দিনের পর দিন এই কাজ কিভাবে করতে পারে আমার মাথায় ঢুকে না ...
তোরা যে যা বলিস ভাই আমার টারজানাকে চাই।
মাহবুবুল হক, আপনাকে সচলায়তনে স্বাগতম জানাই।
হাঁটুপানির জলদস্যু
মাসুম, সচলায়তনে স্বাগতম!
আনিসুল হকের অনেক লেখাই পড়ে ভালো লাগে তবে তার দুই একটা নাটক দেখে আমার ভালো লাগেনাই। আমার মনে হইছে বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির ব্যাপারে নি যা লিখে তআ হয়তো মনে প্রাণে বিশ্বাস করেনা। আর বাংলাদেশের পত্রিকার কথা কি আর বলবো। ওই রকম সাহসী পত্রিকা দেখিনা। তোর মনে নাই যুগান্তর কি করছিলো?
রেডিও ফূর্তির একটা মজার কথা মনে পড়লো ...
এইসব চ্যানেলগুলিতে আরজেরা শ্রোতাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখে এসেমেসের মাধ্যমে ... তো একদিন দেখি এক মেয়ে এসেমেস করছে যে আজকে তার নানার জন্মদিন ... তার সম্মানে যেন "অমুক" গানটা বাজানো হয় ...
আরজে ছেলেটার উইশ করার স্টাইলটা ছিল এইরকম: "হ্যাপী বার্থডে নানাভাই ... হাগ্ হাগ্ হাগ্"
আমি আশা করি হতভাগা নানাভাই ঐসময় রেডিও শুনতেছিলেন না
নানা শুনলে বলতেন, ছেড়ে দে বাবা দৌড়ে বাঁচি।
বাংলা উচ্চারণ বিষয়ে আমার একটা পর্যবেক্ষণ।
বাংলাদেশের কিছু গায়ক-গায়িকা বাংলা অক্ষর 'ভ' উচ্চারণ করে 'V'-এর আদলে, 'ফ' তাদের উচ্চারণে হয়ে যায় 'F'।
কারণটা কী? ইংরেজির প্রভাব?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
যাক তবু না না ভাইকে বদনার কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয় নি।
আমার ইং মিডিয়াম পড়ুয়া ছাত্র বলছিলো, স্কুলে বাংলা ভুল বলাটা নাকি স্টাইল। সামগ্রিক বিচারে এখনো নগণ্য, কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলিশ জনপ্রিয় ধারায় পরিনত হচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
সচলায়তনে স্বাগতম
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
আপনার "কার্টুন নিয়ে ক'কথা" লেখাটি আপনার ব্লগে এনে দিলাম।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
জরুরী ভাবনা ।
এইসব আপাতঃ ছোট ছোট গুরুত্বহীন মনে করা ছিদ্রগুলোই বিশাল জাহাজকে ডুবিয়ে দেওয়ার শুরুর পর্ব মাত্র ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
ঠিক কঠা
ঢাকার এক নামকরা গীটার প্রশিক্ষণ সেন্টারে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক প্রেজেন্টেশান-এ গিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। তাদের প্রায় সবাই গীটারে বাজিয়ে যেসব বাংলা গান গাইছিলো সেগুলোর উচ্চারণ ছিলো তিশমা, কাণিজ, মেহরীন, তাহসান বা হালের টিভি সিরিয়ালে বিজ্ঞাপন-বাঁদরগুলো যেভাবে কথা বলে সে ধরনের। বিষয়টি খুবই আতংকের, কারণ একদিকে মোবাইল এসএমএস আমাদের শব্দগুলো ইংরেজি হরফে লেখা শেখাচ্ছে অন্যদিকে চ্যানেল আর ইংলিশ মিডিয়ামে ইংরেজির বদহজম হয়ে বাংলা উচ্চারণটাও হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বোধ হয় আরো সচেতন হওয়া উচিত। এবং নিজেদের চারপাশের মানুষগুলোকেই বোঝাতে হবে আগে। আসুন আজ থেকেই শুরু করি।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
চিঠি নয় এই বিষয়ে প্রবন্ধ লিখলে ভাল হবে।আশা করি লিখবেন।
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
এসব বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখলে লিটল ম্যাগে দেয়া ছাড়া উপায় নেই যদিও বিষয়টি দৈনিক পত্রিকার উপযোগী। আবার দৈনিক পত্রিকার (প্রথম আলোর মত) লেখক সিন্ডিকেটের সদস্য নই বলে লেখার অপমৃত্যু নিশ্চিত। তাই 'ব্লগে আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা.....'
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
নতুন মন্তব্য করুন