বাংলা প্রবন্ধের প্রস্তুতিপর্বের কুশীলবদের মধ্যে অক্ষয়কুমার দত্তের নামটি সর্বাগ্রে উচ্চারিত হলেও প্রবন্ধকে চিন্তাশীল গদ্যরচনা হিসেবে বিচার করলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রামমোহন রায় থেকে শুরু করতে হয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্য আর বাংলাদেশের সাহিত্যের মধ্যে যারা সাম্প্রদায়িক বিভাজন রেখা টেনে ধরতে চান তাদের বিবেচনায় মীর মশাররফ হোসেনকে দিয়েই এ যাত্রা শুরু। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশি সাহিত্যের উৎসমুখ চিহ্নিত করা গেলেও তা কখন থেকে এবং কেন মুসলমানের চর্চিত সাহিত্যের সমার্থক হয়ে উঠলো এবং আজো হচ্ছে তার উত্তর স্বস্তিদায়ক তো নয়ই বরং আত্মবিস্মৃত জাতি হিসেবে আমাদের দুর্নামের সাক্ষ্য। ১৯৪৭-পরবর্তী পূর্ববাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে ইসলামিকরণের যে প্রয়াস লক্ষ করা যায় তারই বিষবাষ্প এটি; যদিও এর পেছনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও ক্ষমতা ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয় নি। এসময়ের কোন কোন প্রাবন্ধিকের কাছে ইসলাম এবং মুসলিম সাহিত্য ছিল প্রিয় বিষয়। তবে অচিরেই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির সাথে পাকিস্তানি মূল্যবোধের সম্ভাব্য অনিবার্য বিরোধের প্রেক্ষিতে ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, রেনেসাঁ, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ইত্যাদি বিষয় প্রবন্ধে গুরুত্ব পেতে শুরু করলো ।
একটি আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের যে অংশ পাকিস্তানকে স্বর্গারোহনের সিঁড়ি মনে করেছিলো তাদের ভূপাতিত হতে বিলম্ব হয় নি। উদ্ভট দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যাবার পর ‘আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী সমাজ’ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিকাশমান ঢাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বাঙালী মধ্যবিত্ত খুব দ্রুত উপলব্ধি করেছিল ধর্মের আবরণে শোষণের নতুন আয়োজন। প্রান্তিক মানুষের স্তরে এই বিলোড়ন পৌঁছে যায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে। উপমহাদেশীয় রাজনীতির ঘূর্ণিজালে জড়িয়ে পরবর্তী কোন্ প্রেক্ষাপটে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নিয়েছিলো তা সবার জানা। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্মলাভের পেছনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে বাঙালির তিক্ত অভিজ্ঞতা অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল সন্দেহ নেই। উপমহাদেশের দীর্ঘকালের সাম্প্রদায়িক হানাহানির হিংসাত্মক রূপ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা আর ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে শোষক শ্রেণীর কদর্য ক্ষমতালিপ্সা প্রতিহত করার প্রত্যয়ও হয়ত ছিল এর মধ্যে। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আদর্শে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের সাহিত্য আলোচনায় কেবল মুসলমানদের সাহিত্য চর্চার ইতিহাসকে গুরুত্বের সাথে সামনে নিয়ে আসতে হবে কেন, এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ৪৭-পরবর্তী বাঙালির সামষ্টিক স্বজ্ঞা এবং মননচর্চার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন বারবার সামনে চলে আসে। কারণ এক সুদীর্ঘ, স্বতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা সাহিত্যিকগণ যখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ-লালিত দৈশিক-ভাষিক ঐতিহ্যের মুখাপেক্ষী হন তখন তাদের মননশীলতায় তা কিরূপ প্রভাব ফেলে সেটি নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ। । বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্যে ষাটের প্রাবন্ধিকদের গদ্যস্বাতন্ত্র্য বিশ্লেষণ করতে গেলে, বিশেষত অগ্রজের সাথে তাদের চেতনাগত স্বাতন্ত্র্য-দূরত্ব নির্ণয় প্রসঙ্গে, ১৯৪৭-পূর্বাপর প্রাবন্ধিকদের ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার, সংকট-সীমাবদ্ধতা এবং রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোর নানামুখী প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা আবশ্যক।
দুই।
পূর্ব-পাকিস্তানের বিশ বৎসরের (১৯৪৮-৬৮) প্রবন্ধ সাহিত্য নিয়ে বাংলা একাডেমী আয়োজিত এক আলোচনা সভার সভাপতির ভাষণে ড. এনামুল হক যথার্থই বলেছিলেনÑ
“ পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত বইগুলো থেকে প্রকাশকের নাম বা চিহ্ন তুলে যদি ভাবীকালের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যায় তবে সেকালের সমাজ বিজ্ঞানীদের তা চিনে নিতে কষ্ট হবে না যে, এ বইগুলো পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর লিখিত হয়েছিল। তাঁরা বলে দিতে পারবেন, এই সময়টাতে নূতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, তার মনে ছিল জিজ্ঞাসার অনেক বিষয়। গৌরব করার মত তার একটা ঐতিহ্য রয়েছে কিন্তু নিশ্চিন্ত জানতো না কোনটা সেই ঐতিহ্য। তাই বর্জন ও গ্রহণের বিচিত্র তরঙ্গে তারা দোদুল্যমান থাকতো।”
বাংলা সাহিত্য আর বাংলাদেশের সাহিত্যের মধ্যে তখনই শুরু হয় টানাপোড়েন যখন উভয় কালপর্বে (’৪৭ পূর্বাপর) সঞ্চরণশীল সাহিত্যিকগণ ‘না ঘাটকা না ঘরকা’ হয়ে ঠিকানাবিহীন মানসযাত্রায় হন নিরুদ্দিষ্ট। কোন জাতি তার ঐতিহ্যের খণ্ডায়ন চায় না, চায় অবিচ্ছিন্ন ঐতিহ্যের গভীরবিসারী শেকড়। কারণ ঐতিহ্যের মাধ্যমে আহৃত সংস্কৃতিই প্রকৃত সংস্কৃতি। এ ক্ষেত্রে ধর্র্মীয় বিবেচনা যে গৌণ তা-ও সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছিল । কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে মুখ্য হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিবেচনা । বাংলাদেশের ভাষা-সংস্কৃতি-সামাজিক ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য-অবমাননা করে প্রকারান্তরে বাঙালীর বহু বছরের পুরোনো স্বাধীকার চেতনার পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তাই পুরো পাঁচ-ছয় দশকে বাঙালি আত্মপরিচয় অন্বেষণের দ্বিধা-দ্বৈরথে দোদুল্যমান, ঐতিহ্যের গ্রহণ-বর্জনের বিতর্কে মীমাংসাসন্ধানী এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক-দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণের পথে আভিযাত্রিক। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে কেউ কেউ আদর্শিক মূল্যবোধকে ঐতিহ্যের চেয়ে বড় মনে করেছিলেন তবে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন অনেকেই। মুনীর চৌধুরী তো স্পষ্টই বলেছিলেন- “ বাংলা ভাষার সকল শ্রেষ্ঠ সাহিত্য আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।” আলাউদ্দিন আল আজাদ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, হাসান হাফিজুর রহমান, আব্দুল হকসহ আরও অনেকে তখন সহমতে ছিলেন সোচ্চার। এ সময়ের প্রবন্ধচর্চায় সক্রিয় ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, এস. ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, মুহম্মদ আব্দুল হাই, মুহম্মদ এনামুল হক, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, নীলিমা ইব্রাহিম, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ আলী আহসান, মুনীর চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমূখ প্রথিতযশা ও প্রাজ্ঞ সাহিত্যিকগণ। তাদের মধ্যে অনেকে ’৪৭-পূর্ব কাল থেকেই প্রাবন্ধিক হিসেবে সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। এ তালিকা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, পাঁচ-ছয়ের দশকে বাংলা প্রবন্ধ চর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে পরিচিতদেরই প্রাধান্য ছিল, ছিল ‘মারাত্মকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শাসিত’ । প্রবন্ধ রচয়িতা এবং পাঠক উভয়ই শিক্ষক-শিক্ষার্থী-শিক্ষকশোভন মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। এর সামাজিক কারণ, ড. সিরাজুল ইসলামের মতেÑ
“ উন্নয়নকামী উন্নতিশীল দেশগুলোতে শিল্প মধ্যবিত্তের সর্বপ্রধান অবলম্বন; বিদ্যার্জন বিত্তার্জনেরই বাঁধানো সড়ক। শিক্ষার আনুকূল্যেই মধ্যবিত্তের উত্থান, স্থিতি ও নিরাপত্তা। বিদ্যার্জনের সঙ্গে সাহিত্যে কিছুটা উৎসাহ, সংস্কৃতি সম্পর্কে খানিকটা কৌতূহল, সমাজ সম্বন্ধে কিয়ৎপরিমাণ জিজ্ঞাসা অনিবার্যভাবে, প্রায় নিকট-দোসরের মতই, আসে।”
এ বর্ণনা সমাজসত্যকে খানিকটা লঘু ভঙ্গিতে প্রকাশ করলেও একথা সত্য যে, মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ ছাড়া শিল্প-সাহিত্য বিকশিত হয় না। তদুপরি শিক্ষিতদের মধ্যেও নির্বাচিত, মননশীল ও সমাজসচেতন অংশই প্রবন্ধের পাঠক। বাংলাদেশের প্রবন্ধের বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে, বিভাগোত্তর কালে, ক্রমবর্ধমান শহরমুখী মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশের প্রতিনিধিত্ব করছিলো বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ। তাই পাঁচ এমনকি ছয়ের দশকের প্রবন্ধ অনেকক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষের সহায়ক হিসেবে, রচিত হয়েছিল। হয়ত এ কারণেই ড. এনামুল হক মন্তব্য করেছিলেনÑ
“ আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্যের অধিকাংশই উপদেশে ভরা। প্রবন্ধকারগণ আমাদের ঐতিহ্য কি, আমাদের সংস্কৃতি কি, আমাদের সাহিত্য কি ইত্যাদি বিষয়ে আদেশ-নির্দেশ দেওয়া ছাড়া আর কিছু দিতে পারেন নি। কিন্তু ‘এই কর আর ওই কর না’ ইত্যাকার আদেশ-নির্দেশপূর্ণ প্রবন্ধ আর যাই হোক মননশীল সাহিত্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। প্রাবন্ধিককে অবশ্যই ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতনশীল হতে হবে।”
বিভাগোত্তর বাংলাদেশের প্রবন্ধ সম্পর্কে এ মূল্যায়ণ অনেকাংশে নির্ভরযোগ্য। এ দুর্বলতার কারণও চিহ্নিত করেছিলেন তিনি Ñ
“নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করার সুযোগের অভাবে সার্থক প্রবন্ধ-সাহিত্য সৃষ্টি এখানে সম্ভবপর হয় নি’
কিন্তু প্রাবন্ধিকের দায়িত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে গুরুত্বের সাথে ধর্ম বিষয়ে সচেতনতার উল্লেখ থেকেই উপলব্ধি করা যায় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কিভাবে গ্রাস করছিল মননশীলতা ও ঐতিহ্যের জায়গাটুকু। অবরুদ্ধ সমাজে, যেখানে ‘নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করার সুযোগের অভাব’ রয়েছে সেখানে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চেতনা ও চৈতন্যের দূরত্ব বাড়তে থাকা অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। এই দূরত্বের সূত্র ধরেই প্রকাশের ভিন্ন গতিরেখা সন্ধানে অনুসন্ধিৎসু হয় ছয় দশকের প্রাবন্ধিকগণ । পরবর্তী আলোচনায় ছয়ের দশকে আবির্ভূত প্রাবন্ধিকদের স্বাতন্ত্র্যের ক্ষেত্র অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছেÑ বিষয় বিবেচনা নয়, গদ্যশৈলীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অভিনবত্ব ও স্বকীয়তার বিচারে। ফলে ষাটের কিছু প্রাবন্ধিক, যারা মেধা ও মননে কোনোক্রমেই গৌণ নন, আলোচনার প্রাসঙ্গিকতার বিবেচনায় বাইরে রয়ে গেছেন।
তিন।
সাহিত্য-শিল্প যদি সমাজের উপরিকাঠামো বলে গণ্য হয়ে থাকে তাহলে অন্তর্কাঠামোর মৃদুতম বিলোড়নেও সে-স্তর কম্পিত হওয়া স্বাভাবিক। বিভাগোত্তর বাংলাদেশের প্রবন্ধে এ কম্পনরেখার জটিল-স্তরবহুল গতিপথ এবং পূর্বসূরীদের সিদ্ধান্তহীনতা বা ‘সুবিধাভোগীর পরিতৃপ্ত মুখচ্ছবি’ , ছয়ের দশকের একঝাঁক তরুন, সৃষ্টিক্ষম ও মননশীল সাহিত্যিককে অনুপ্রাণিত করেছিলো নিরীক্ষায় নিবিষ্ট হতে। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (১৯৪০-), হায়াৎ মামুদ(১৯৪৬-), আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০৬), আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-), সৈয়দ আকরম হোসেন (১৯৪৪-), শামসুজ্জামান খান (১৯৪৪-), আবুল কাসেম ফজলুল হক (১৯৪৪-), হুমায়ূন আজাদ (১৯৪৭-২০০৫), হুমায়ুন কবির (?), গোলাম মুরশিদ (১৯৪৩-) প্রমুখের নাম প্রাবন্ধিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। উত্তুঙ্গ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আত্মপরিচয়ের পথে লক্ষাভিমুখী মধ্যবিত্ত-চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফটিকায়ন এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তি স্থাপনে তৎপর প্রগতিশীল-উদার মানবতাবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বলিষ্ঠতা এ সময়ের নবীন সাহিত্যিকগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলো মৃত্তিকাসংলগ্ন হতে আবার তাদেরই কেউ কেউ প্রাধান্য দিয়েছিলেন শিল্পমূল্যকে। তবে, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং শিল্পের প্রতি অঙ্গীকারÑ এই দ্বিবিধ চেতনাস্রোত একীভূত হয়ে উঠেছিলো ‘এক নতুন ও স্বতন্ত্র গদ্য’ নির্মাণের প্রয়াসে। যে গদ্যভাষা বিষয় ও বিষয়ীর সমবায়ে নির্মিত, পূর্বসূরীদের বর্ণনধর্মী, বিষয়মুখ্য গদ্যের নিষ্প্রাণ ভূমিতে শিল্পের সৌন্দর্য-সরোজ ফুটিয়ে তোলাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
ষাটের সাহিত্যাঙ্গনে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘কণ্ঠস্বর’ এর ভূমিকা পৃথক মূল্যায়নের পর্যায়ভুক্ত। সময়ের “নতুনত্ব-সন্ধানী, উদ্ভাবনক্ষম, তীব্র ও অগতানুগতিক” সাহিত্যিকদের চেতনার সম্মিলন ও বলয় নির্মাণে এই পত্রিকাটির অবদান গুরুত্বপূর্ণ এবং কালোত্তীর্ণ।‘কণ্ঠস্বর’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধসমূহের মধ্য থেকে নির্বাচিত বারোটি প্রবন্ধ নিয়ে পত্রিকার দশ বৎসর পূর্তিতে ‘সাম্প্রতিক ধারার প্রবন্ধ’ নামে যে সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ষাটের প্রবন্ধের গতি-প্রকৃতি অনুধাবনে তা গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড । এ গ্রন্থের ভূমিকায় সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছেনÑ
“ গত দশ বছরে ‘কণ্ঠস্বরে’র পৃষ্ঠায় রচিত হয়েছে এমন এক বিশিষ্ট গদ্যরীতি Ñ যা আজকের তরুণ লেখকদের অনিবার্য ভাষা।
বলা বাহুল্য, ‘কণ্ঠস্বরে’র গদ্য বলতে আমি ষাটের দশকের গদ্যকেই বুঝিয়েছি।এর কারণ প্রধানত হয়ত এই যে ‘কণ্ঠস্বর’-এর পৃষ্ঠাকে আশ্রয় করেই এই গদ্য প্রথম সর্বাঙ্গীন স্পষ্টতা পেয়েছিল।”
ষাটের গদ্যকে শিল্পাশ্রিত গদ্য আখ্যা দিয়ে এবং প্রথাগত গদ্যকে বক্তব্য প্রকাশের বাহন হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি দুয়ের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছেন যা ড. আনিসুজ্জামান-ও অন্যত্র উল্লেখ করেছিলেন । এই গদ্যের চারিত্র্য-ধর্ম, স্বাতন্ত্র্য ও সম্ভাবনা প্রসঙ্গে গ্রন্থের ভূমিকাংশে সম্পাদকের বিশ্লেষণÑ
“ষাটের দশকেই প্রথম একটি পরিপূর্ণ লেখকগোষ্ঠী শৈল্পিক গদ্যের চর্চায় সমবেতভাবে নিয়োজিত হয়েছিলেন। ঐ গদ্যে, তাই, স্বাভাবিক কারণেই, শিল্পের উল্লেখিত সংগ্রাম তুলনামূলকভাবে বেশি প্রত্যক্ষ। এই গদ্য প্রতিভাবান, শাণিত, নিরীক্ষাপ্রয়াসী, কবিতাক্রান্ত ও বন্ধুর; সূক্ষ্ম, কুটিল, বৈপরীত্যময় ও দ্বন্দ্বজটিল। কখনো উজ্জল সুতীব্র মননোদ্ভাসে আশ্চর্যরকম দীপ্র ও দ্যুতিময়, কখনো মগ্ন চৈতন্যের আলোছায়ায় রহস্যময়, প্রতীকী ও জটিল।স্পষ্ট বোঝা যায় : আমাদের সাহিত্যে একটা স্বতন্ত্র ও সাবলীল গদ্যভাষার জন্ম আসন্ন যার অগ্রযাত্রায় অনেক লেখকের অংশগ্রহণে সংঘটিত এ এক বিশাল নিরীক্ষা পর্যায়।”
ষাটের গদ্যের প্রবণতা চিহ্নিত করতে এ বক্তব্য লক্ষ্যভেদী হলেও ‘কণ্ঠস্বর'-এর পাতায় স্থান পাওয়া প্রবন্ধ সবক্ষেত্রে যেমন এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নয় আবার প্রবন্ধের শিল্পগুণ বিচারে অগ্রজদের মধ্যে আবদুল হক, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আহমদ শরীফ, সৈয়দ আলী আহসান প্রমূখ-এর কৃতিত্বও উপেক্ষণীয় নয়। ছয়ের দশকে যেসকল প্রাবন্ধিকের আত্মপ্রকাশ তাদেরকে বিষয় বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গি বিচারে দুটি স্রোতধারায় বিভক্ত করেছেন সম্পাদক। ধারা দুটি হলÑ
(ক) সাহিত্য শিল্পকে প্রধানত শিল্পের মানদণ্ড থেকে বিচার এবং
(খ) মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে শিল্প-বীক্ষণ।
গ্রন্থভুক্ত লেখকগণকেও এ দুধারায় চিহ্নিত করেছেন তিনি। তবে সামগ্রিকভাবে ষাটের প্রাবন্ধিকদের মানসগঠনে সমাজসত্য ও শিল্পসত্যের দিকে অন্তর্ভেদী অবলোকন প্রয়াস এবং পূর্বসুরীদের মত ঐতিহ্যের গ্রহণ-বর্জনের জিজ্ঞাসায় দ্বন্দ্ববিক্ষত হওয়ার চেয়ে মানবিক মূল্যবোধের নিরাপদ আশ্রয়ে স্থিত হওয়ার প্রবণতা দুর্লক্ষ্য নয়। নন্দনতাত্ত্বিক অভিনিবেশও এই স্বনির্মিত দূরত্বের ফলাফল। এ প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান সৈয়দের সাহিত্যচর্চার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
তিন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ, কি কবিতায় কি গদ্যে, এক দুর্জ্ঞেয়-দুরতিক্রম্য রহস্যবৃত্তে আকৃষ্ট করেন পাঠককে। এমনকি প্রবন্ধেও তিনি বিশুদ্ধ শিল্পলোক-বিচরণে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ যেন। ষাটের অবরুদ্ধ সমাজে আত্মপরিচয়জিজ্ঞাসায় ক্ষত-বিক্ষত বাঙালির সংগ্রামমুখর দিনগুলো যখন হারিয়ে যায় তখনও তার শিল্পের মনোভূমি কর্ষণ অব্যাহত থাকে আশ্চর্য উদাসীনতায়।এর মধ্যে ‘পলায়নপরতা’ কিংবা ‘প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার চোরাবালি থেকে আত্মরক্ষার’ প্রয়াস কতখানি ছিল তা লেখকের স্বাধীনতা-উত্তর সাহিত্যচর্চার গতিধারা থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। কিন্তু একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সুগভীর শিল্প-এষণা, নন্দনতাত্ত্বিক ব্যুৎপন্ন এবং সাহিত্যচর্চায় প্রশ্নাতীত নিষ্ঠা ও সততা ষাটের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে তাকে স্বতন্ত্র অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রবন্ধের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি মূলত নন্দনতত্ত্বের বিভিন্ন শাখায় সচ্ছন্দ হলেও কবি ও কবিতা এবং কাব্য-আঙ্গিক তার অভিনিবেশের ক্ষেত্র। অনেক ক্ষেত্রে তার প্রবন্ধে যুক্তি-জ্ঞান-অভিজ্ঞতার চেয়ে কবিকল্পনাই প্রাধান্য পেয়েছে। ‘শুদ্ধতম কবি’ , ‘করতলে মহাদেশ’, ‘দশ দিগন্তের দ্রষ্টা’র রচয়িতা আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধ ষাটের কাব্য-লক্ষণ গদ্যভাষার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। দুটি উদ্ধৃতির সাহায্যে তার গদ্য-স্বভাব বিশ্লেষণ করা যেতে পারেÑ
[ক]
“এমনকি গদ্যলেখকেরাও-যে কবিতার দ্বারা স্পৃষ্ট আধুনিক কাল তার সাক্ষ্য।এটা গদ্যরচনার পক্ষে সুখের কথা, কেননা কবিতা তাকে সপ্রাণ ক’রে তোলে। কিন্তু তাই ব’লে কোনো গদ্যরচনাকে কবিতা ক’রে তোলার চেষ্টাও অপচেষ্টা ব’লেই মনে করি; কেননা, গদ্য তার সমস্ত কলা-কৌশল নিয়েও শেষ পর্যন্ত গদ্য এবং কবিতা তার সমস্ত কলাকৌশল নিয়েও শেষ পর্যন্ত কবিতা; যে-কোনো গদ্যরচনায় (কবিতার কথা পরে বলছি) বক্তব্যটিকে আমরা প্রধান ব’লে মনে করি ঃ প্রবন্ধে চাই যুক্তিময় স্পর্শসহ পরম্পর বক্তব্য, কথাসাহিত্যে চাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনোন্যশ্লিষ্ট কাহিনী-‘তথাকথিত বাস্তব’ না-হ’লে ক্ষতি নেই কোনো।”
[খ]
“গগনে-গগনে ধ্বনিত হ’য়ে উঠেছে প্রথম মহাসামরিক শিঙা, গগনে-গগনে প্রতিধ্বনিত, পবনে এক সাংঘাতিক ম’দো গন্ধ প্রকীর্ণ মিশেছে, উঠেছে বিশ্ব ব্যেপে এক ধুসর ধূলিঝড়। সেই আঁধি উনিশ শতকের প্রদীপিত প্রমূল্যসমূহকে দীপ্ত ও হরিৎ ঝরা পাতার মতো শূন্যে তুলে ঝেঁটিয়ে নিয়ে চলেছে। উন্মাতাল সেই বস্তুগ্রাসের দিনে কএকজন মানুষ দৌড়ে এসে ঢুকে পড়লো মনোভুবনে। ঝোড়ো উত্তালতা ঐ মনোমৃত্তিকার তলবর্তী ঘরটিরও ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছে, কম্পনের রেখায়-রেখায় দেয়ালে ধরেছে চিড়, মেঝেয় ফাটলÑ কিন্তু আশ্রয়টিকে একেবারে ধুলিসাৎ করতে পারে নি। বিশ্বের যতো-সব আন্তু-বাস্তুহারাদের ঐ আশ্রয়টির নাম সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ।”
বাংলা গদ্যে উদ্দেশ্য-বিধেয়-ক্রিয়ার যে পরম্পরা, এ ধরনের গদ্যে প্রায়ই তা অনুসরণ করা হয় না। উপর্যুক্ত প্রথম উদাহরণের চেয়ে দ্বিতীয় উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই ভাষা কেবল বক্তব্য প্রকাশের বাহন নয়, বাচনিকতা-নান্দনিকতা সহযোগে বিষয়াতিরিক্ত এমন এক বাগভঙ্গি যা পাঠককে ‘কি বলা হলো’ নয় বরং ‘কিভাবে বলা হলো’ ভাবতে প্ররোচিত করে। প্রবন্ধের ক্ষেত্রে এমন দ্ব্যর্থক, কাব্যিক-ব্যঞ্জনাধর্মী, অলংকারবহুল ভাষারীতির ব্যবহার অভিনব না হলেও ব্যতিক্্রম তো বটেই। পরবর্তী দুটি উদাহরণের প্রথমটি হুমায়ুন কবির এবং দ্বিতীয়টি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত। এ ধারার গদ্যচর্চার সম্মিলিত প্রয়াসের প্রমাণ মেলে উদাহরণ দুটি থেকেÑ
[ক]
“বড় বেশী জাগ্রত বড় বেশী বিবেকবান কেউ নেই যার শুদ্ধসত্তার আলোকসম্পাতে বিভাবান হবে অন্তত একটি বাগান সেখানে আমরা আমাদের প্রার্থিত গন্তব্যে গমনের প্রয়োজনীয় শাস্ত্র সংগ্রহ করব, জ্বালিয়ে নেব উদ্বোধিত চৈতন্যের দীপ। থাকতেন যদি একজন সক্রেটিস আমরা তাঁকে ঘিরে থাকতামÑপ্লেটো থেকে পিন্ডারÑআমরাÑআমরা সবাই বিশ্বপাঠ নিতাম তাঁর কাছে। নির্বাণের মন্ত্রগাঁথা নয়, নয় ধ্বংসধ্বজ তন্ত্রাচার। গতিময় জীবনযাপনের, যাত্রার অন্তরে রোপন করতে শিখতাম স্থির জীবনাদর্শ।”
[খ]
“[...] মানতেই হবে, নিদারুণভাবে অভিভাবকহীন আমাদের এই সমকাল। জ্ঞানের ব্যভিচার, বুদ্ধির আলস্য, চিন্তার নি¯পৃহতা নিঃশেষ করেছে এই নিষ্ক্রিয় যুগের মেরুদণ্ড। মাংসকাম ও স্বর্ণলালসা শুদ্ধতম চৈতন্যকেও শবের দুর্গন্ধ দিয়েছে। এবং সেই অমানুষিক ক্লেশ, সেই উদ্যম, স্পৃহা, উৎসর্গ, কোনো নিশ্চিত উদ্দেশ্যে নিরাপোষ আনুগত্য ও তিতিক্ষাÑ ভারতীয় পরিভাষার সেই ‘সাধনা’Ñ শুদ্ধতম চৈতন্য যার ফসল, অনুপ্রেরণা ও সৎ অন্বেষা যার ফলদ পোষ্টাইÑ ‘ব্যবহৃত, ব্যবহৃত, ব্যবহৃত শরীর’ এই যুগেÑস্থ ূল, মুদ্রাসর্বস্ব, ব্যভিচারী। বৈশ্যের পণ্যের গর্হিত প্রেরণা সবচেয়ে অনুপ্রাণিত শিল্পীর তুলিকেও অধিকার করেছে।”
উদ্ধৃতি দুটির ভাবসাযুজ্য শুধু নয়, বাংলা গদ্যের পদক্রমকে নানাভাবে বিন্যাস্ত করে প্রাঞ্জল-গতিমুখ্য গদ্যরীতি প্রচলনের প্রয়াসও এতে লক্ষণীয়। চৈতন্যস্রোতে আত্মকথনের অনুরণন যেমন যুক্তিপরম্পরার চেয়ে আবেগের তীব্রতা ও স্বতস্ফুর্ততাকে আন্তরিক মনে করে তেমনি বহমানতা এ ভাষার। এর কাঠমোর গড়ন-ধরণকে হয়তো এ ভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারেÑ
ক. উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের ক্রম সম্প্রসারণ,
খ. কর্তৃবাচ্যের চেয়ে কর্ম ও ভাববাচ্যের প্রাধান্য
গ. ব্যঞ্জনাধর্মী শব্দের ব্যবহার এবং
ঘ. শব্দের বাচ্যার্থের চেয়ে ব্যঞ্জনার্থের প্রতি গুরুত্ব প্রদান।
শেষোক্ত বৈশিষ্ট্য প্রবন্ধের প্রথাগত ভাষারীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও বাংলাদেশের প্রবন্ধকে বর্ণনরীতির বিশুষ্কতা ও কাঠিন্য থেকে মন্ময় স্রোতস্বিনীর রসাত্মক প্রাঞ্জলতায় অভিষিক্ত করতে ষাটের প্রাবন্ধিকদের এই প্রয়াস ছিল প্রভাবসঞ্চারী। এমনকি যারা উপর্যুক্ত ধারা ও ভাষা-বৈশিষ্ট্যকে সরাসরি অনুসরণ করতেন না তারাও প্রবন্ধের ভাষা নির্মাণে ছিলেন যতœশীল। এদের মধ্যে সৈয়দ আকরম হোসেন অন্যতম।
চার।
বিষয়নিষ্ঠা ও একাগ্রতা আকরম হোসেনের প্রবন্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বিজ্ঞানমনষ্ক, যৌক্তিক শৃঙ্খলা-অনুসারী ফলত আবেগতাড়িত ভাষাবিহারী নন। শিল্পকে তিনি বিশ্লেষণ করেন শিল্পের সামাজিক-নৃতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার সাথে সামাজিক মানুষ তথা শিল্পীর মনোজগতের দ্বান্দ্বিক অবস্থানকে শিল্পসৃষ্টির কার্যকারণ সূত্রের সাথে সংগ্রথিত করে তিনি অগ্রসর হন। ফলে তার বিশ্লেষণপদ্ধতি প্রায়ই কাঠামোবদ্ধ এবং সাহিত্যসমালোচনার মার্কসবাদী ধারার সাথে মিলে যায়। পরবর্তী দুটি উদাহরণ থেকে বিষয়টি নির্ণয় করা যেতে পারেÑ
[ক]
“তবুও বলা প্রয়োজন ছয়-দশকের কবিগণ বীততিরিশ নন, তিরিশোত্তর উৎস থেকে এঁরাও উৎসারিত; কারণ অনুরূপ সমাজসংগঠনে ভিন্নরূপ চৈতন্য সৃষ্টি করার সর্বভুক প্রতিভার পরিচয় এঁদের কেউই প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। পাঁচ-এর দশকের কবিবৃন্দ যে-অবক্ষয়-চৈতন্যকে সমাজজীবনের অন্তর্লোকে প্রত্যক্ষ-করণে ছিলেন সচেষ্ট, ছয়দশকের এঁরা আত্মমগ্ন-চৈতন্য-অন্ধকারে তাকে করেন উপহাস ও পরীক্ষা। এঁরা আত্মভুক চেতনাবিলাসী; বিকৃত সমাজগঠনের চারদেয়ালে শৃঙ্খলিত, শর্ত-সপেক্ষ, ব্যক্তিপ্রতিক্রিয়াবাদী। এই চৈতন্যসামগ্রীই এ-পর্বের করিদের গৌরব এবং দৌর্বল্য। জলস্তম্ভের মত ঊর্ধ্বগামী কোন প্রতিভা শর্তমুক্ত সামগ্রিক দৃষ্টি দিয়ে রুদ্ধ অবক্ষয়, অচলতাকে চাবুকাঘাত করে তাকে সচল করেননি।এমন কি আলোক-দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কার্যকারণের সন্ধানেও তাঁদের ছিল অনীহা। পূর্ববাংলার পাঁচদশকের কবিবর্গ একালে ছিলেন সত্যান্ধ, আর ছয় দশকের কবিকূল হলেন, বলা চলে, জন্মান্ধ।”
[খ]
“অহেতুক মাজারভীতি, খালেক ব্যাপারী-ভীতি, সামজসং¯কার-ভীতি, শাসকভীতি ইত্যাদি বিশাল ভয়ানক অস্তিত্বগ্রাসী আতঙ্ক যেন এদেশের সমগ্র অস্তিত্বকে করেছে নিমজ্জিত, বিলুপ্ত-প্রায়। সেই দারুণ ভয়বিপন্ন মানবকে শাসনশোষণ করার মহাভয়-মন্ত্র বারংবার উচ্চারণ করছে দিগ¦লয়বিস্তারী কোন এক অপ-অস্তিত্বকামী ‘বিশাল মজিদ’। কণ্ঠে ধর্মভক্তির গুঞ্জরণ, কব্জিআঙ্গুলে প্রতিমুহূর্তে স্পন্দিত যার ধাতবশক্তি। এবং নির্ভীক নির্ভুল জমিলার পদসঙ্কেত উপন্যাসের অন্তিমে ঘোষণা করেছে ভয় নামক অস্তিত্বসংহারক অপদেবতাবধের আর এক মন্ত্র।‘লালসালু’তে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নৈরাশ্যবিহারী নন, বরং স্বাতিক্রমণে (ঞৎধহংপবহফবহপব) অস্তিত্বের মুক্তচৈতন্যে উন্মীলিত। এক্ষেত্রে ভয়-আতঙ্ক ‘অস্তিত্বের প্রকৃত অবস্থার নির্দয় নির্দেশক’।”
ইতোপূর্বে বর্ণিত গদ্যের সাথে এই গদ্যভঙ্গির নৈকট্য এবং স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্ট। উভয়ের লক্ষ্য অভিন্ন। একের পর এক সমাসনিষ্পন্ন শব্দযোজনায় প্রলম্বিত অথচ গতিশীল বাক্যসংগঠনে নির্মিত এক অননুকরণীয়, দৃপ্ত গদ্যভঙ্গি ষাটের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে সৈয়দ আকরম হোসেনকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছে। বিশশতকের আধুনিক শিল্পদর্শন ও চিন্তাপ্রবাহকে সাহিত্য-সমালোচনাক্ষেত্রে লক্ষণীয়ভাবে ব্যবহার করার কৃতিত্বও তাঁর প্রাপ্য। শব্দের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাকে, ষাটের প্রাবন্ধিকদের যা অন্যতম প্রবণতা, তিনি সতর্কতা ও সার্থকতার সাথে ব্যবহার করেছেন। ফলে কখনো তা ভাষার ওজস্বিকতাকে ছাড়িয়ে যায় নি। নিচের উদ্ধৃতির সাহায্যে তাঁর এ গদ্যস্বভাব স্পষ্টতর হয়Ñ
জীবন তো সময়-সমষ্টি। জন্ম-মৃত্যুর সময়সীমা-শাসিত আয়ুষ্কালও জীবনÑ সে জীবন শিল্পী-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের বিষয় নয়। রবীন্দ্রনাথের øায়ুতন্ত্রের নিজস্ব ধর্মে গ্রন্থী-কেন্দ্রের মৌল অভিজ্ঞানে জীবন হলো সমাজ ও সময়ের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, মূল্যজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ধ্র“পদী অনুষঙ্গ। সে-জীবন হলো সময়াভিজ্ঞতার ইনটেনশন বা ধ্যান, সময়-অন্তর্গত মৌল সংরাগ ও প্রবীণতম চেতনাস্তম্ভ। রবীন্দ্র-প্রতিভার প্রকৃতি চলমানতার উৎসপ্রবাহে অঙ্গীকারবদ্ধ; রবীন্দ্রসৃষ্টির প্রকৃতি এ-কারণেই চলমান বিশ্বজগতের পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষাপ্রিয়।
তত্ত্বকে, তা সে নন্দনতত্ত্বই হোক বা মার্কসীয় মতাদর্শজাতই হোক, সাহিত্যসমালোচনার ক্ষেত্রে তুল্যমূল্যে বিচার করে প্রয়োগ করার দক্ষতা তাঁর স্বভাবজাত। তাই স্বল্প-প্রকাশের মধ্যেও তাঁর প্রাবন্ধিকসুলভ বিশ্লেষণীক্ষমতা এবং একাগ্রতা ষাটের গদ্যআন্দোলনকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল বলা যায়।
পাঁচ।
গদ্যভাষার স্বকীয়তায়, নির্মাণের বিপুলতা ও বৈচিত্র্যে ছয় দশকের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে আহমদ ছফা স্বতন্ত্র ও গৌরবময়। শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি, দর্শন-সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাস সব বিষয়েই আহমদ ছফা সমান অভিনিবেশী এবং বিশ্লেষণক্ষম। তাই তার গদ্যভঙ্গিও বিচিত্র স্বাদের Ñকখনও কাব্যময়, কখনও তীর্যক বা শ্লেষাত্মক, কখনও ওজস্বিকতা-ঋদ্ধ আবার কখনও সংবাদপ্রকাশের ঢঙে শুধুই বিবৃতিমূলক। তার ‘রবীন্দ্রনাথ’(১৯৬৮) প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি পরীক্ষা করা যাকÑ
“আজীবন সুন্দরের সঙ্গে সত্যের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার দুর্মর প্রচেষ্টারই তো নাম রবীন্দ্রনাথ। এ বিষয়ে তাঁর ঐকান্তিকতা ধর্ম প্রচারকের চাইতে কোনো অংশে কম ছিল না। অত্যন্ত সুকুমার, সংবেদনশীল, স্পর্শকাতর, শ্রদ্ধার ভারে আনত একখানা মন নিয়ে তিনি যেন প্রচারকের ভূমিকায় নেমেছিলেন। কিন্তু প্রচারকের লেবাস তিনি কখনো অঙ্গে ধারণ করেননি। হৃদয়ের সত্যোপলব্ধির প্রকাশের জন্য কবিতা লিখেছেন। কবিতা লিখে তাঁর মনে হয়েছে, যা বলতে চেয়েছেন, কিছুই বলা হয়নি। গল্প লিখেছেন তাই। তার পরেও মনে হয়েছে কালির আখরে প্রাণের সুবর্ণ তরঙ্গমালা যেমনভাবে উচিত তেমনভাবে বেঁধে রাখতে পারেননি। তারপরে লিখেছেন নাটক, হয়তো প্রবন্ধ। এতগুলো মাধ্যমে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার পরেও তৃপ্তি আসেনি। শরণ নিতে হয়েছে সঙ্গীতের। দ্রাক্ষাকুঞ্জের মর্মরিত বিবাগী হওয়ায় সমস্ত অন্তর প্রাণ-মেলে ধরেও মনে হয়েছে অস্তিত্বের গোপন-গহন অন্তঃপুরে আরো সৃষ্টির বীজ বুঝি রয়ে গেল। অস্তিত্বের গভীরে যেখানে চাপ-চাপ আঁধারের নিশুতি, যেখানে মানুষের নিজের অজান্তে আদিমতার ছাপ বয়ে বেড়ায়, সেখানেও পৌঁছেছে সৌন্দর্যের ‘গন্ধহীন চামেলীর লাবণ্য বিলাসের’ আহ্বান।”
ষাটের যে গদ্যশিল্পীরা সম্মিলিত প্রয়াসে একটি নতুন গদ্যরীতি বিনির্মানের নিরীক্ষায় নিমগ্ন ছিলেন আহমদ ছফার গদ্য তা থেকে যে দূরবর্তী নয় তা উপরের উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যায়। আবার ‘লেবাস’ ‘আখর’ ‘নিশুতি’ ইত্যাদি লোকায়ত, সাঙ্গীতিক শব্দ উপলব্ধি প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততার সাক্ষ্য দেয়। এখানেই আহমদ ছফার গদ্যের স্বকীয়তা যা তার পরবর্তীকালের সাহিত্যচর্চায় আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। তার প্রবন্ধ তত্ত্ব ও তথ্যে ভারাক্রান্ত নয় অথচ চিন্তার শৈথিল্য এতে একেবারেই নেই। কথ্যরীতির প্রচল,প্রাত্যহিক এবং অনাড়ম্বর শব্দ ও বাগ্ভঙ্গি প্রায়ই তার প্রবন্ধে ব্যবহৃত হয়েছে; ফলে ভাষা হয়েছে সরস, প্রাঞ্জল, সাধারণ্যে আদরণীয়। যেমনÑ
“ইসলামের প্রাথমিক যুগের বীর এবং সাধু পুরুষদের নিয়ে যে সমস্ত পুথিঁপত্র লেখা হয়েছে তাতে তাঁদের ত্যাগ, ধর্মনিষ্ঠা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে এ জাতীয় বিস্তর আদি রসাত্মক ব্যাপার-স্যাপার স্থান লাভ করেছে। যে সকল ঐতিহাসিক চবিত্র পুঁথিলেখকরা তাঁদের বিষয়ের উপজীব্য করেছেন, তাতে করে চরিত্রের ঐতিহাসিক সত্য সম্পূর্ণভাবে খেলাপ করে নিজেদের মনের রঙে রাঙিয়ে একেবারে জবুথবু করে হাজির করেছেন। কল্পিত চবিত্র হলে তো কথাই নেই, আগাগোড়া বঙ চড়িয়ে রঙিলা না করে ছাড়েননি। তা করতে যেয়ে পুঁথিলেখকেরা পরিবেশ, সমাজ এবং সামাজিক সংঘাত, মূল্যচেতনা দুই হাতেই দেদার ব্যবহার করেছেন।”
বর্ণনার বিদ্রƒপাত্মক ও তীর্যকরীতিই আহমদ ছফার গদ্যকে ষাটের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে সহজে চিহ্নিত করে। এ ভাষারীতি বক্তব্য বিষয়কে অতিক্রম করে দ্রুত পাঠকের জন্য চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে। পরবর্তী উদ্ধৃতি এ প্রবণতার নমুনা নির্দেশকÑ
“মন্ত্রী মহোদয়েরা বাংলা ভাষার পক্ষে এসব চমৎকার যুক্তি প্রদর্শন করার পরেও যখন ইডেন বিল্ডিংয়ের খাস কামরায় প্রবিষ্ট হন, তাঁদেরই মুখ দিয়ে অনর্গল টুটাফাটা ইংরেজী বুলি নির্গত হতে থাকে। এই ইংরেজীর দাপটেই পিয়ন, বেয়ারা থেকে শুরু করে স্বয়ং সেক্রেটারী পর্যন্ত তটস্ত হয়ে ওঠেন। মন্ত্রী সাহেবরাও মনে মনে ঐ ভাষাটির গুরুত্ব তখন অস্বীকর করতে পারেন না। তিনিও তো আমাদের মতো বাঙালী। বাংলা ভাষাতে যে অধঃস্তন কর্মচারীদের আদেশ দেয়া চলে না, দিলেও ঠিক ঠিক কাজ হয় না, কোন্ বাঙালীটি অস্বীকার করবে? সেক্রেটারী সাহেবেরা মন্ত্রী সাহেবদের টুটাফাটা ইংরেজীর জবাব যথাসম্ভব বিশুদ্ধ ইংরেজীতেই দিয়ে থাকেন। আদেশ-নির্দেশ, কৈফিয়ৎ তলব, নিয়োগ-বদলী ইত্যাদি ব্যাপারে ঐ ভাষাটিকে তরতর জলের মতো ব্যবহার করে থাকেন।”
এ গদ্যরীতিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক, অপরিশোধিত বা অনানুষ্ঠানিক মনে হলেও তা আহমদ ছফার ব্যক্তিত্বেরই পরিচায়ক; তার চিরাচরিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার শব্দরূপ।
ছয়।
ছয় দশকের প্রবন্ধচর্চায় হুমায়ূন আজাদের আবির্ভাব ভাষাবিজ্ঞানী, সাহিত্যগবেষক ও সমালোচক হিসেবে। শিল্পীসুলভ গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে, বস্তুবাদী দার্শনিকের মত নির্মোহ-নিরাসক্ত অবস্থানে থেকে এবং মানবিক মূল্যবোধের সূক্ষ্ম মানদণ্ডে সমাজ-সময়প্রবাহকে বিশ্লেষণ করার মানসগঠন হুমায়ূন আজাদের ঐশ্বর্য। তার প্রজ্ঞাপরিধি প্রাতিষ্ঠানিকতা অতিক্রম করে সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাস-ধর্ম-দর্শন-নন্দনতত্ত্ব সবকিছুকে স্পর্শ করে; বলা যায় প্রকম্পিত করে। হুমায়ূন আজাদের বিশ্লেষণরীতি স্বতন্ত্র, গদ্যশৈলী অনন্য। একজন সংবেদনশীল কবি হওয়া সত্বেও তার প্রবন্ধের ভাষায় ষাটের কাব্যাক্রান্ত গদ্যভঙ্গি খুঁজে পাওয়া যায়না; অথচ সে ভাষা প্রচলিত গদ্যের অনুরূপও নয়। একটি উদাহরণ বিবেচনায় আনা যাকÑ
“রবীন্দ্রনাথ মূলত সমাজচিন্তাবিদ, গৌণত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এবং কোনো ক্রমেই রাজনীতিবিদ ন। তাঁর চিন্তার বিপুল স্থান অধিকার করে আছে সমাজ, সমাজের প্রতিই তাঁর আকর্ষণ প্রবল, রাষ্ট্রের প্রতি নয়। এ চিন্তায় বাস্তবজ্ঞানের পরিচয় প্রচুর, তবু সেখানে বোধ এবং বোধিরই প্রাধান্য।রাষ্ট্র ও সমাজ বিশ্লেষণের সময় তাঁর রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তাবিদ সত্তাটি উপস্থিত থাকে ঠিকই, তবে এদের সর্বদাই পশ্চাতে থেকে নির্দেশ দেয় একটি মহাপুরুষ সত্তা। এ সত্তাটির সাথে বাস্তবের যোগাযোগ স্বল্প, ‘আত্মা’ ‘অমৃত’ ‘সত্য’ ইত্যাদি বিমূর্ত বিষয়ের সাথেই এর যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ।”
তার গদ্যের বাক্য সংগঠন নাতিদীর্ঘ, পদক্রমে কাব্যধর্মী সংস্থাপন নেই। যেমন সরল অথচ ঋজু গদ্যে তিনি ভাষাতত্ত্বের বিশ্লেষণ করেন তেমন গদ্যেই আলোচনা করেন সমাজ-রাজনীতি বা সাহিত্য-শিল্পের নানা ক্ষেত্র। তাই এমনকি ‘বুক পকেটে জোনাক পোকা’ ‘কত নদী সরোবর’ এর মত ধ্র“পদী শিশুপাঠ্যের গদ্যশৈলী এবং ‘অর্থবিজ্ঞান’ ‘আমার অবিশ্বাস’ ‘শামসুর রাহমান:নিঃসঙ্গ শেরপা’ বা ‘নারী’র গদ্যশৈলী পাশাপাশি রাখলেও সহজেই সনাক্ত করা যায় রচয়িতা হুমায়ূন আজাদকে। পাঠকের অভিনিবেশ, তা সে যত জটিল বিষয়ই হোক, আকর্ষণ করার বিশেষ এক বাগভঙ্গি আয়ত্তে ছিল হুমায়ূন আজাদের। যার ফলে লেখক হিসেবে নিজেতো বটেই, পাঠককেও খুব সহজেই বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করা ও করানোর সামর্থ্য তার গদ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আরেকটি উদাহরণ থেকে এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবেÑ
“অর্থবিজ্ঞান সম্পর্কে একটি চমৎকার বই লিখেছেন অর্থবিজ্ঞানী জিওফ্রে লিচ; তাঁর বইটির নাম ঝবসধহঃরপং : অর্থবিজ্ঞান (১৯৭৪)। তিনি অর্থবিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানী ও দার্শনিকের মতামতের বিবরণ দেন নি বইটিতে; তিনি নিজেই অর্থ সম্পর্কে পেশ করেছেন একটি তাত্ত্বিক কাঠামো, যা সম্পূর্ণ সুষ্ঠু না হ’লেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ঝবাবহ ঞুঢ়বং ড়ভ গবধহরহম : ‘সাত রকম অর্থ’। অধ্যায়ের নামটি যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি প্রশ্নজাগানো; এর নাম শুনেই অবিলম্বে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে-অর্থ মাত্র সাত রকম? ”
বাক্যের প্রতিটি খণ্ডাংশকে বিরতি চিহ্নের শাসনে অর্থবহ করে উপস্থাপনের মাধ্যমে হুমায়ূন আজাদ দীর্ঘবাক্যকেও সুখপাঠ্য করে তোলেন। ভাষার এই প্রবহমানতা এবং স্বচ্ছতা যে কোন প্রাবন্ধিকের আরাধ্য।
বাংলাদেশের সাহিত্য এবং বাংলা সাহিত্যের মধ্যে গ্রহণ-বর্জনের দ্বন্দ্ববিক্ষত পূর্বসুরীদের যন্ত্রণা ধারণ করেই ষাটের প্রাবন্ধিকদের আবির্ভাব। তারা স্বকাল-বিচ্যুত ননÑ বিমুগ্ধও নন; স্বকাল বিনির্মাণে স্বনিয়োজিত। তাদের ব্যক্তিত্বের অভিরুচি, অভিক্ষেপ-প্রভাব এ পর্বের প্রবন্ধসাহিত্যের সর্বত্র চিহ্ন রেখে গেছে। কারণ ব্যক্তিত্বের অভিক্ষেপই শৈলী সৃষ্টি করে, যার পরিস্ফূটন ঘটে সাহিত্যের আঙ্গিক ও ভাষার মধ্য দিয়ে । জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধিক্ষণে সামুষ্টিক চৈতন্যেই যখন নিজকে চিনে নেয়ার পালা চলছিলো তখন তার অভিক্ষেপ সময় ও সমাজ-সচেতন শিল্পীর ব্যক্তিত্ব-পরিশ্র“ত হয়ে শৈলীর মধ্যে ছাপ রেখে যাবে এটাইতো স্বাভাবিক। ষাটের একঝাঁক তরুণ প্রাবন্ধিকের ব্যক্তিত্বের মধ্যে ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণ কাজ করে গেছে নিঃশব্দে।
বাংলাদেশের প্রবন্ধে মননের ঐশ্বর্যে ঘাটতি কখনও ছিলো না, ছিলো বিষয় ও বিষয়ীর দৈন্য। বিভাগ-পরবর্তী প্রাবন্ধিকগণ এক প্রশ্নবিদ্ধ বর্তমান ও শঙ্কাময় ভবিষ্যতকে ধারণ করেও প্রবন্ধ রচনায় বিষয়ের দৈন্য ঘুচাতে প্রয়াসী ছিলেন। পরবর্তীকালে ষাটের প্রাবন্ধিকদের জন্য এটি সহায়ক হয়েছিল; প্রবন্ধকে শিল্পমানে উত্তীর্ণ করার ভাষা সন্ধানে তারা মনোযোগী হতে পেরেছিলেন। বিষয়ের ক্ষেত্রেও হতে পেরেছিলেন বৈচিত্র্যসন্ধানী । একদল প্রাবন্ধিক কাব্যময় অনুপ্রাণিত গদ্যে শিল্পসন্ধান করলেন, কেউ প্রবন্ধের তাত্ত্বিক-ধ্র“পদী কাঠামোর উৎকর্ষসাধনের মধ্যে শিল্পনির্মিতির সার্থকতা খুঁজলেন, কেউ আধার-আধেয় উভয়ের বিনির্মানে হলেন উদ্যোগী Ñ তবে সবাই মিলে যা করলেন তা হল , বাংলাদেশের প্রবন্ধের জন্য শিল্পমানে উত্তরণক্ষম গদ্যরীতির বিভিন্ন সম্ভাবনা উন্মোচন। সম্ভাবনা বলা হল এ জন্য যে, ষাটের প্রবন্ধচর্চার গদ্যরীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে একমুখী নয় তা উপরের আলোচনা-উদাহরণেই স্পষ্ট। একে যদি ‘আগামী দিনের সম্পন্ন, উন্নত, মসৃণ ও সুসম গদ্যভাষার গঠন পর্ব’ বলা হয়ে থাকে তাহলে একথাও নির্দ্বিধায় বলা যায়, সেই গঠন পর্বের মননশীল চৈতন্য ছিল বৈচিত্র্যে সমগ্রতাসন্ধানী, জীবন্ময়; বিষয়-বিষয়ী উভয় দিক থেকেই।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন