লুজান থেকে জেনেভা আসার ট্রেন আসতে দুই মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় আছে এরই মাঝে টিকিট কাটতে হবে। থিউডোরাকে বললাম তুমি দাড়াও আমি দৌড়ে গিয়ে ঠিকই এই সময়ে টিকিট কেটে চলে আসব। থিউডোরা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে আমার সাথে যেতে তোমার টিকিট লাগবেনা। আমি বললাম আরে না না গরিব দেশের লোক হতে পারি অন্তত টিকিট কাটার টাকা আছে আমার, বলতে বলতে টিকিট কাউন্টারের দিকে ছুটে যাব এমন সময় থিউডোরাগোলা উঁচু করে বলে [I am telling you believe me! You dont need a ticket if you are with me!Come back please]
জানতে চাইলাম কি স্টোরি! সে বলে আগে ট্রেনে উঠ তারপর বলছিট্রেনে উঠলাম টিকিট ছাড়া! কিছুক্ষণ পর টিকিট চেকার আসতেই থিউডোরা তার ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে দেখাতেই চেকার হাসি মুখে ‘বন ভইয়াজ’ বলে চলে গেল। আমার কৌতুহল আরও এক দফা বেড়ে গেল। জানতে চাইলাম কি রহস্য। তোমার কার্ডে এমন কি আছে যে সাথে কেউ থাকলেও তার ভাড়া লাগেনা। সে বলে আগে বল গল্প শোনার পর কোন রকম করুনা করতে পারবানা, আমি বললাম করুনা !! তাও আবার তোমাকে! তুমি তো সুইজারল্যান্ডের লেডি ডন। সে হাসি দিয়ে গল্প শুরু করলো এরই মাঝে ট্রেন ও ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো
ছোট বেলা থেকেই ‘আরসেন’ কে থিউডোরার ভাল লাগে! বিশেষ করে আরসেন ক্লাসের অন্য সব ছেলেদের চেয়ে অনেক আলাদা, ডার্টি জোকস-ক্লাসের মেয়েদের ফুসলিয়ে নাইট ক্লাবে নিয়ে যাওয়া এইসবে আরসেনের তেমন কোন আগ্রহ নেই। আরসেনের ভাল লাগে গিটার বাজাতে, স্কি করতে আর হাতে গোনা অল্প কিছু বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে। থিউডোরার ঠিক একই বিষয় ভাল লাগে তবে গিটার তার কাছে কঠিন লাগে বলে ভায়লিন বাযাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।কোন এক বিকেলে আরসেন থিউডোরাকে একটা সঙ্গীত সংঘে নিয়ে যায়। দর্শকদের গ্যলারিতে থিউডোরাকে রেখে হঠাৎ আরসেন উধাও। থিউডোরা এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে আরসেনকে। হঠাৎ আবিস্কার করে সঙ্গীত শিল্পীদের মাঝে লিড গিটার নিয়ে আরসেন বসে আছে! এটা ছিল থিউডোরাকে দেয়া আরসেনের প্রথম সারপ্রাইজ। সঙ্গীত সন্ধ্যা শেষে জানিয়ে দেয় এই জাতীয় সারপ্রাইজ আরও অনেক পেতে চায় সে! আরসেন বলে তা হলে তো আমাদের একই সাথে থাকতে হবে। দু দিন সময় নিয়ে থিউডোরা জানিয়ে দেয় তার বাবা মাকে, সে আরসেনের সাথে থাকতে চায়। তারপর শুরু এক সাথে পথ চলা। হাসি কান্না মান অভিমান সারপ্রাইজ সহ আরও অনেক কিছু। সময় গড়ায় থিউডোরার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রস্তাব আসে ভারতের আই আই টি তে পড়তে যাবে কিনা একচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসাবে। কাছের বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে তাছাড়া ইনক্রেডীবল ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপন প্রায় দেখায় টিভিতে।
আরসেন কে ইচ্ছার কথা জানাতেই আরসেন ভাবে একটা ছোট খাট ব্রেক হলে খারাপ হয়না তাছাড়া আরসেনের ও ইচ্ছে ফ্রন্সের মার্সেই থেকে অর্কেস্ট্রার উপর একটা কোর্স করা। তবে দুজনই ঠিক করে যেকোন অবস্থাতেই হোক অন্য কোন রিলেশনশিপে জড়াবে না । এবং ফিরে এসে প্রথমে একটা বাচ্চা নিবে তারপর ইচ্ছে হলে বিয়ে না হলে নাই [ প্রসঙ্গত বলে রাখি সুইজারল্যান্ডে আশির দশকের পর বেশির ভাগ বিয়েই বাচ্চা হবার পর কিংবা বাচ্চা আছে কিন্তু বিয়ে করেনি]। ছেলে হলে ইউলিস আর মেয়ে হলে ফ্লরিয়ান এই দুইটা নাম ঠিক করে আরসেন আর থিউডোরা মিলে
২০০৯ সালের শুরুর দিকে থিউডোরা ভারত আর আরসেন মার্সেই চলে যায় যে যার কাজে। ভালই যাচ্ছিল থিউডোরার দিন গুলো। সারাদিন ক্লাস সন্ধ্যায় আড্ডা আর উইকএন্ডে ভারতীয় নাচ‘ ভাঙরা’ শিখে। মাঝে মাঝে আরসেনের সাথে কথা হয় স্কাইপে। এভাবে একদিন দীপালির উৎসবের রাতে বন্ধুদের সাথে আতশ বাজী নিয়ে আনন্দে মেতে উঠে। বেশ কটা বাজী ফুটানোর পর একটাতে কি সমস্যা ছিল যে ফুটছে না, কাছে থেকে দেখতে গিয়েই ডেকে আনে বিপদ। চোখের কাছে আনতেই বিকট শব্দ করে ফুটে উঠে আতশ বাজিটি আর সাথে সাথেই এক ধরনের তীব্র ব্যথা অনুভব করে থিউডোরা। আর বাকীটা তার মনে নেই জ্ঞান ফেরার পর দেখে সে হাসপাতালে। পাশে বন্ধুরা ছিল কিন্তু তারপরও তাদের কাউকেই সে দেখতে পায়না। ডাক্তার বেশ কিছু চেক টেক করে সুইজারল্যান্ডে রেফার করে দিল। কোর্স শেষ না করেই ফিরে আসতে হল থিউডোরাকে। সুইজারল্যান্ডের ডাক্তার দুই সপ্তা ধরে অনেক রকমের চেক করে ব্যনডেজ খুলে দিতেই ২ সপ্তাহ পর আবার এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে পায়।
সব কিছুই আগের মতো তার মানে তো আমি ভাল হয়ে গেছি! কিন্তু না, বেশ কয়েক ঘণ্টা পর মাথায় এক ধরনের ব্যথা অনুভব করে সে। ডাক্তার এটা নিয়েই খুব চিন্তিত ছিলেন। পরবর্তীতে ডাক্তার বুঝিয়ে বলেন সমস্যাটার কথা। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হবার কারনে মস্তিস্কের কোন একটা নার্ভ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই রোগটার কোন ঔষধ এখনো বের হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে খুব জোর ২/ত বছর পর থিউডোরা আর কিছুই দেখতে পারবেনা
গল্পের এই পর্যায়ে আমি জানতে চাই আরসেনের অনুভুতি কি ছিল? সে হাসি দিয়ে বলে আরসেন আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্ত মনের মানুষ। হাসপাতাল থেকে ফিরে কিছুদিন পর আরসেন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি বেশ কবার মানা করেছি। আমি নিজেও ভেবে পাইনা একটা অন্ধ মেয়েকে নিয়ে সে সারা জীবন থাকবে কি ভাবে? আরসেন নাছোড় বান্দা তাই রাজি হয়েছি। ২০১০ আর শুরুর দিকে আমরা বিয়ে করেছি। আর আমার ছেলেকে তো তুমি দেখেছই হাসপাতালে দুই মাস আগে। সুইজারল্যান্ড সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ টিকিটের ব্যবস্থা রেখেছে যা দিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষটির সাথে কেউ সাহারা হলে সেও বিনা টিকিটে চড়তে পারবে। যদিও থিউডোরা এখনো পুরপুরি অন্ধ হয়নি তারপরও সে এই সুবিধা পাবে। থিউডোরার গল্প শেষ; এদিকে ট্রেন লুজান থেকে জেনেভা চলে এসেছে। এবার বিদায়ের পালা, ‘ থাঙ্কস ফর এভ্রিথিং, উই সি ইচ আদার এগেইন বলে চলে এসেছি’
গত দুই মাস আগে থিউডোরা ছোটো একটি দেব শিশুর মা হয়েছে। শিশুটির নাম ইউলিস। আমি দুই মাস আগে ইউলিস কে দেখতে গিয়েছিলাম। তখনো জানতাম না থিউডোরা আর কয়েক বছর পর এই দেব শিশুটিকে দেখতে পাবেনা।
মন্তব্য
থিউডোরার জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল।
মানুষের কত বিচিত্র দু:খ! আর দু:খ শুরু হবার কত বিচিত্র উপায়।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
আমি সাধানরনত সিরিয়াস কিছু নিয়ে লিখিনা। হাচল হবার পর এই প্রথম কিছু একটা লিখলাম আমার বন্ধুকে নিয়ে
ভালো থাকবেন
লেখার ধরনটা বেশ লাগলো।
বি দ্রঃ প্রতিষ্ঠিত লেখকদের অনেকের কল্পনাশক্তি খুব প্রখর, কল্পনা থেকেই উনারা খুব সুন্দর গল্প তৈরি করে ফেলতে পারেন আমি তা পারিনা, তাই আসেপাশের ঘটে জাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনা গুলা এককরে আমি লিখতে চেষ্টা করি। আমার এই চেষ্টা কতটুকু সফলতা পায় তা আমার প্রিয় মানুষদের মূল্যায়নের উপর নির্ভর করবে।
সচলে আমার অনেক গুলা প্রিয় মুখ আছে । প্রিয় মানুষদের নিয়ে ভালো কিছু ভাবার, ভালো কিছু করার অদম্য ইচ্ছা সব সময় হৃদয়ে লালন করি কিন্ত হাজারো প্রতিকুলতার জোয়ারে অনেক ক্ষেত্রেই তা হারিয়ে যায়। তেমন কিছুর বিশেষ অভাব নেই আমার এই খুদ্র জীবনে শুধু উৎসাহ ছাড়া। আপনাদের এতটুকু উৎসাহ আমাকে দেবে যোজন যোজন পথ পাড়ি দেবার অসীম সাহস! ভালো থাকবেন আনিস ভাই[ আমি যতটুকু ধারনা করি আপনি কাচাপাকা দারিওলা আনিস ভাই]
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
ভালো থেকো থিউডোরা।
facebook
আমার লেখা পাবলিশ হইছে ওইটা না দেইখা আমি কালা মানিক জোড় দেইখা আইলাম
আপনে সুইজারল্যান্ড আইবেন কবে?
আপনার লগে কমপিটিশন করতে মন চায়। ফেইস বুকে দেখেন আমার যে কয়টা শহরের এলবাম আছে আমি তার তিন গুন শহরে ঘুরেছি। কিন্ত লিখতে মন চায়না
অনু ভাই আপনি ছবি ব্লগ গুলা দিয়ে একটা বই আকারে বের করতে পারন। বই মেলায় বেশ কটা দেখেছি
পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল।
আমারও খুব খারাপ লাগে কিন্ত কি আর করা!!
মাঝে মাঝে দেখা হয় আমি অবাক হয়ে থাকিয়ে থাকি। খুব চমৎকার একটা মেয়ে থিউডোরা
ছুঁয়ে গেল গল্পটা।
আপনার লেখনীও সুন্দর...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আপনার নাম স্পর্শ তাই একটু আবেগ সহ লেখা হলেই আপনাকে স্পর্শ করে ফেলে
[একটা কথার উত্তর কানে কানে দেনঃ ইচ্ছার আগুনে জলছি এই লেখাটা কি আপনি বিবাহ জনিত কারনে লিখছেন তানভির ভাই?] অন্য কেউ নাক কান গলায়েন না প্লিজ
অবশেষে আপনার লেখা পেলাম। ধন্যবাদ।
দশ বারো বছর আগে একবার ঢাকায় সুইস এম্বেসিতে গিয়েছিলাম ভিসার খোঁজ খবর নিতে। ফার্স্ট অফিসারের সাথে কথা বলার সময় উনি হঠাৎ পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। বের করে দেওয়ার পর আমাদের সাথে গল্প জুড়ে দিলেন, যখন ফিরে আসবো তখন পাসপোর্ট হাতে দিয়ে বললেন ভিসা সিল দিয়ে দিলাম, আগামিকাল অফিস আওয়ারে ২৭০০ টাকা (১৩৫০ করে) জমা দিয়ে যেও।
আমাদের সেই ফার্স্ট অফিসারের নামও ছিলো থিওডোরা। আমি মজা করে বলতাম প্রিন্সেস থিওডোরা।
সেবারে জুরিখ থেকে একদিনের সফরে লুসার্ণ, এঞ্জেলবার্গ হয়ে মাউন্ট তিতিলী পর্যন্ত গিয়েছিলাম।
...........................
Every Picture Tells a Story
মুস্তাফিজ ভাই আপনি ফেইস বুক ইনএকটিভেট করে রেখেছেন কেন?
আপনার ছবি গুলা দেখে দেখে আমরা গরীবরা ও কিছু শিখতে পারি
পরের বার সুইজারল্যান্ডে আসলে সরাসরি জেনেভা! আমি ডাউন টাউনে থাকি
গল্পটা সুন্দর।আমি যতদূর জানি অন্য কোথাও প্রকাশিত লেখা সচলায়তনে প্রকাশ করা হয়না কিন্তু এ লেখাটা ফেসবুকে ভালবাসার গল্প নামক পাতায় পূর্বে প্রকাশ করা হয়েছে।
- নীতিমালা
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
আপনাকে ধন্যবাদ!
আমি ভালবাসার গল্প পেজের কয়েক জনের অনুমতি নিয়েছি তার উপর যে কয়জন সচল কে চিনি তাদের কাছে জানতে চেয়েছি এটা ফেইস বুকের ক পাবলিশ হলে সচলে দেয়া যায় কিনা। সবাই বলেছেন আপত্তি নেই তাই দিলাম।
আমার ধারনা সচল অন্য কোন ব্লগে লেখা পাবলিশ হলে ওইটা প্রকাশ করেনা কিন্ত আপনার ব্যাক্তিগত ব্লগ কিংবা ফেইস বুক পেজে প্রকাশ হলে কোন সমস্যা নেই!
ভালো থাকবেন সব সময়
মনটা খারাপ হয়ে গেল।
শুভ কামনা থিউডোরা আর ইউলিসের জন্য।
দীপাবলি।
আপনার লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে, মাহমুদ ভাই। জেনেভার গল্প আরো শুনতে চাই, তবে এরকম মন খারাপ করা লেখা না, হাসিখুশি গল্প।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
অনেক ধন্যবাদ ফাহিম ভাই
চেষ্টা করবো কিছু গল্প দিয়ে চিয়ার আপ করতে
মাহমুদ.জেনেভা,
কত হঠাৎ করে জীবন কেমন ওলট-পালট হয়ে যায়। থিউডোরা আর ইউলিসের জন্যে রইল আকুন্ঠ ভালবাসা। আর এই ভাবে তাদের জীবনের সাথে আমাদের পরিচয় করাবার জন্যে লেখককে ধন্যবাদ।
লেখাটা পড়ার সময় '৭৪ সালে আমার লজানে অবস্থানের কথা মনে পড়ল। লেখাটা পড়ার পর আবার যেতে ইচ্ছা করছে কতটা বদলেছে দেখার জন্যে।
সাইফ শহীদ
সাইফ ভাই
আমাকে শুধু মাহমুদ বলতে পারেন
লুজান সম্ভবত আগের মতই আছে কারন এরা নতুন কিছু করতে দেয়না
অনেকটা কনজারভেটিভ ধরনের। এরা এদের কালচার নেচারকে প্রিজারভ করে রাখতেই পছন্দ করে
এই লেখাটি তোমার আগেরকার সবগুলো লেখা থেকে ভালো হয়েছে। লেখার মাঝে এক রকম যত্নের ছোঁয়া পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে তুমি তোমার প্রকৃত লেখার স্টাইল এবং বিষয় পেয়ে গেছো। সিরিজে নিয়মিত হলাম। আর হাচলত্বে অভিনন্দন
অনেক ধন্যবাদ স্বাধীন ভাই উৎসাহ দেবার জন্য
চেষ্টা থাকবে একটা পুরা সিরিজ আকারে লিখতে
ভালো থাকবেন
ভাল লেগেছে।
কাল রাতে পড়েছিলাম। খুব ভালো লেখা। মন ছুঁয়ে যায়।
বানানের ব্যাপারে আরেকটু সতর্কতার অনুরোধ করলাম। লেখা চলুক নিয়মিত।
নতুন মন্তব্য করুন