চলার পথে নিজ জীবন, নিজ দেশ কিংবা ভিনদেশে হওয়া কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়েই এই সিরিজ- তিন প্যারার তিনটি ছোট ছোট গল্প নিয়ে লেখা "তিন তিরিকে নয়"।
তবে, আমার মেধাবী কিন্তু ধার করে ফেরত না দেয়া বন্ধুটি নীতিযুক্ত রাজনীতিতে নাম লেখায়নি। রাজনীতি শুরু করার পর তাকে আর কখনো কারো কাছে ধার চাইতে হয়নি, চানখারপুলের হোটেলে খেয়ে কখনো বিল দিতে হয়নি, রুম থেকে বেরিয়ে হলের ক্যান্টিনে গিয়ে নাস্তা করতে হয় নি, নাস্তাই বরং চলে এসেছে তার নিজের রুমে। খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের চোখের সামনে এ-সব দেখে নিজের কাছেই খারাপ লাগতো। অন্য আরো অনেকের ক্ষেত্রেই এ-রকমটা দেখেছি, তবে খুব কাছের বন্ধু হবার কারণে, তার আচরণেই সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হতো।
বেশ কয়েকমাস পর, একদিন আমার সেই বন্ধুটি খুব ধীরস্থির ভাব নিয়ে হঠাৎ আমার রুমে এসে উপস্থিত। জিজ্ঞেস করে, "কিরে কেমন আছিস?" আমি নড়েচড়ে বসি, "কেমন আছ" হয়ে গেছে "কেমন আছিস"। বুঝতে পারি, কিছু একটা পরিবর্তনতো হয়েছেই। তারপর, সে যা বললো, তার কারণে একসময় বিরক্তি তৈরি করা সে বাক্যটিই আজ পর্যন্ত আমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে মধুরতম বাক্যগুলোর একটি। বিলাসী কিন্তু অনৈতিক জীবন ধারার ইতি টেনে, অন্ধকারের পথ থেকে বেরিয়ে এসে সে-দিন আমার বন্ধুটি আগের মত করে আবারো বলেছিলো- "তোর কাছে তিন-শো টাকা হবে?"
#২
কিছুদিন আগে এখানকার(ইউএসএ) একটা ব্যাংকে গেছি টাকা তুলতে। আমার কাছে তাদের একটা ব্যতিক্রমী ধরণের ‘ডেবিট কার্ড’ ছিলো। কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের সাথে আমার কোনো একাউন্ট নেই, কিন্তু তোমাদের একটা কার্ড আছে। তোমরা কি এই কার্ড দেখে আমাকে টাকা দিতে পারবে? লোকটা বললো, দেখি তোমার জন্য কি করতে পারি! ব্যাংক বন্ধ হয় ৬টায়। আমি গেছি ৬টা বাজার দুই মিনিট আগে। অনিচ্ছা সত্বেও, কিছুটা বাধ্য হয়েই গেছি। যে লোকটি আমাকে সার্ভিস দিচ্ছিলো, সে আমার কার্ড সোয়াইপ করলো মেশিনে। কিন্তু, আগেই বলেছি আমার কার্ডটা ব্যতিক্রম। কোনো ভাবেই মেশিন রিকগনাইজ করতে পারছে না। লোকটা একটু পাশে গিয়ে ফোন উঠালো। কার সাথে কথা বলে কিছু তথ্য জেনে নিলো। আবার চেষ্টা করলো। আবারো কাজ হলো না।
এদিকে আমি বিব্রত হতে শুরু করেছি। ঘড়িতে তখন ৬টা ২০। পুরো ব্যাংকের ৬ জন এমপ্লয়ি, বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়ীর চাবি বের করে বসে আছে। একমাত্র কাস্টমার আমি। ব্যাংকের মেইন গেইটে তালা দিয়ে দেয়া হয়েছে। পুরো ব্যাংক তাদের সবকিছু ওপেন রেখে শুধু আমাকেই সার্ভিস দিচ্ছে। আমার কিন্তু তাদের ব্যাংকে কোনো একাউন্টও নেই; বলে দিলেই পারে, তোমার কার্ড কাজ করছে না, আগামী কাল অফিস টাইমে এসো, আবার ট্রাই করে দেখবো। কিন্তু, না। লোকটা আবার আবার অন্য জায়গায় ফোন দিয়ে চেষ্টা করতে থাকলো। নিজেকে আমার খুব অপরাধী মনে হলো। ৬টার সময় ব্যাংক বন্ধ, ৫টা ৫৮ মিনিটে এসে সার্ভিস রিকুয়েস্ট করা কোনোভাবেই উচিত হয়নি আমার।
মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, সার্ভিস দেয়ার পর যত বিররক্ত হয়েই লোকটা কথা বলুক না কেন, মেনে নেব সেটা। আমার সময়জ্ঞান নিয়ে সে যদি জ্ঞানদান করতে শুরু করে, সেটাও তার অন্যায় হবে না; যাই বলুক মেনে নেব। ঘড়িতে তখন ৬টা ৩০। ছয়জন মানুষ অপেক্ষা করে আছে। এবারে প্রচেষ্টায় সফল হলো লোকটা, আমার টাকাগুলো নিয়ে এগিয়ে আসলো। আমি তার বিরক্তিমাখা উত্তপ্ত বাক্য শোনার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছি। লোকটা সামনে আসলো। তারপর, খুবই বিনয়ের সাথে বললো, "আমি অত্যন্ত লজ্জিত এবং দুঃখিত যে তোমাকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি। প্লিজ কিছু মনে করো না।" সে-সময়টা ইচ্ছে করেছিলো, লোকটার কাছে গিয়ে হ্যান্ডশেক করে একটু কোলাকোলি করি। কিন্তু, মাঝখানে থাকা পার্টিশানের কারণে পারলাম না। ...এদের কাছ থেকে এখনো কত কিছু যে শেখার বাকী।
#৩
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার সময় প্রায় সময় বিভিন্ন হসপিটালে রক্ত দিতে যেতাম। আসল ঘটনার শুরু হতো রক্ত দেয়ার পর। যার জন্য রক্ত দিতে যেতাম, তার আত্মীয়-স্বজন সবাই এমন ভাব করতো, আমি যেন সুপারম্যান; কত রকমের খাবার আর ধন্যবাদের ফুলঝুরি। চিরকৃতজ্ঞ থাকার ব্যাপারটাতো আছেই। এক সময় মনে হতো ব্যাপারটাতো মহা আনন্দের। কিন্তু, একদিন বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা মহা আনন্দের বটে, তবে, তার চেয়ে বেশি আনন্দের কিছুও আছে।
হল গেটে এসে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন একজন মা। সন্তানের চিকিৎসা করাতে ঢাকায় এসেছেন। হাতে ধরা কাগজ পড়ে বুঝতে পারি রক্তের দরকার। কিন্তু, সেটা ব্যাখ্যা করা কিংবা কোন গ্রুপের রক্ত দরকার সেটা বুঝার ক্ষমতা উনার ছিলো না। এর আগে যতদিন রক্ত দিতে গেছি মানুষজন ক্যাব, সিএনজি-তে করে নিয়ে গেছেন; আর সে-দিন গেলাম নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। রক্ত দেয়ার পর নিজেই কিনে খেয়েছি জুস্। রিক্সা ভাড়া কিংবা খাবার কিনে দেবার সামর্থ্য সেই মায়ের ছিলো না।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার, অন্য আর সব সময় মানুষের কাছ থেকে কত কত "ধন্যবাদ" শুনে এসেছি। কিন্তু, সে-দিন সেই মায়ের কাছ থেকে "ধন্যবাদ" শুনিনি। সেটা যে বলতে হবে, তা হয়তো তিনি জানেনও না। তবে, ধন্যবাদ তিনি ঠিকই দিয়েছিলেন, মুখের ভাষা দিয়ে নয়, দু-চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি দিয়ে।" …আজ পর্যন্ত যতবারই সেই ঘটনা মনে পড়ে, ততবারই মনে হয়- "সকলের-তরে-সকলে-আমরা, প্রত্যেকে-আমরা-পরের-তরে"।
আগের পর্বঃ পর্ব ১
আগের পর্বঃ পর্ব ২
অন্যান্য সব লেখা
মইনুল রাজু
ফেইসবুক[/justify]
মন্তব্য
৫ তারা
গল্পগুলো ভালো থেকে আরো ভালো হতে হতে যেখানে উঠে শেষ হল, মন্তব্য সেখানে নিতান্তই অক্ষম হয়ে পড়ল মনের অবস্থা বোঝাতে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
"বদলে যাওয়া বন্ধু" হল জীবনের বড় একটা কষ্টের জিনিস। কখনও যদি আগের 'সুরে' একটা কথা শুনতে পাই, তখন খুব ভালো লাগে।
ভালো থাকুন, রাজু।
শুভেচ্ছা
ভালো থাকুন আপনিও।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
দ্বিতীয় অংশটা ফেসবুকের কল্যাণে আগে পড়া।
তৃতীয় অংশটা অসাধারণ।
আন্ডারওয়েট হবার কারণে কখনো রক্ত দিতে পারি না। আফসোসটা ঘোচাতে পারলে হতো।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আপনার ইচ্ছটা যে আছে সেটাই আসলে দরকার। অন্যকোনোভাবে ঠিকই কারো না কারো কাজে এসে যেতে পারেন।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
আপনি অনেক ভালো লিখেন, চালিয়ে যান... ধ্রুব
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
১ নং এর বন্ধু(!) আমাদের চেনাশোনার মধ্যে আছে বলে বেশ লাগলো। কিন্তু ওই জগত থেকে ফিরে আসা তো একটা বিরল ঘটনা
২ নং এর অভিজ্ঞতা দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমাদের সেবাখাতের মানুষদের যে ওখান থেকে শেখার আছে তা মানিকের ফিলিপস বাতির মতো ফকফকা পরিস্কার।
৩ নং ঘটনায় ধন্যবাদের মতো সস্তা জিনিসের অনুপস্থিতি ঘটনাকে আরো মহৎ করে তুলেছে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
খুব সুন্দর লিখেছেন মইনুল ভাই।
আমি বেশ কয়েকবার রক্ত দিয়েছি। রক্ত দেয়ার পর কি যে একটা সুন্দর অনুভূতি হয়!!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
হ্যাঁ, খুব ভালো লাগে রক্ত দেবার পর। ধন্যবাদ আপনাকে।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
বয়সের কারণে আমার রক্ত এখন মূল্যহীন। আর আমাদের যৌবনে ঠিক এভাবে রক্ত দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। দু-একবার রক্ত দিয়েছি বটে তবে তা খুব কাছের মানুষের জন্যই।
তিন তিরিকে.... ভাল লাগলো।
প্রৌঢ় ভাবনা
আমরা যখন রক্ত দিচ্ছিলাম, তখন সবেমাত্র রক্ত দেয়ার সংস্কৃতিটা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। আমাদের সময়ে, এ-ক্ষেত্রে রক্তদাতাদের সংগঠনের 'বাঁধন'র ভুমিকা খুব প্রশংসনীয় ছিলো।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
রক্ত দেবার সৌভাগ্য আমার কখনো হয়নি........আশা রাখি হয়তো কোন এক সুন্দর দিনে মহৎ ঘটনাটা ঘটবে
সেই দরিদ্র কৃতজ্ঞ মায়ের চোখের পানি কল্পনায় যেন দেখতে পেলাম!!!
দিতে শুরু করে দেন। প্রথমে একটু আনইজি ফিল করতে পারেন। কিন্তু, দেয়ার পর দেখবেন ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক, আর মানসিকভাবে বেশ চমৎকার একটা অনুভূতি হয়।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
তিনটি গল্পই যেন কোন না কোন কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল। আমরা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে নিজেদের শিক্ষিত দাবি করি। কিন্তু আমরা কি সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত হতে পারি? এ ধরণের গল্প আমাদের বিবেগকে কিছুটা হলেও জাগরত করতে পারে। ধন্যবাদ রাজু ভাই, এমন সুন্দর করে লেখার জন্যে। এ ধরণের গল্প আরও চাই।
এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত।
ধন্যবাদ আপনাকে। এই সিরিজটা বেশ কিছু পর্ব চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
মুখের ভাষা দিয়ে নয়, দু-চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি দিয়ে। - অসাধারণ অনুভূতি হয় ভাই, যখন এরকম সত্যিকারের সাহায্যপ্রার্থী, অসহায় কারো মুখে হাসি ফোটানো যায়!!
____________________________
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
দারুণ, দারুণ।
আরো চাই। আরো আরো আরো চাই।
লিংক ধরে আগেরগুলো পড়ে এলাম আজ।
ভালো থাকবেন রাজু।
অনেক শুভকামনা।
-----------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
জ্বী, এই সিরিজটা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।ধন্যবাদ আপনাকে।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
তৃতীয় গল্পটা বেশি ভাল লেগেছে।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
নতুন মন্তব্য করুন