হ্যাভেনলি হাওয়াইইঃ পর্ব ৩ (কামেহামেহা-কাহুমানু পর্ব)

মইনুল রাজু এর ছবি
লিখেছেন মইনুল রাজু [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০২/০৮/২০১৫ - ৬:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্বসমূহের লিঙ্কঃ
হ্যাভেনলি হাওয়াইইঃ পর্ব ১ (সৃষ্টি পর্ব)
হ্যাভেনলি হাওয়াইইঃ পর্ব ২ (ইতিহাস পর্ব)

হাওয়াইই দ্বীপপুঞ্জের প্রথম ইউরোপিয়ান, ক্যাপ্টেইন কুক’র নির্মম মৃত্যু হলেও, তাঁর জাহাজের বেঁচে যাওয়া নাবিকদের মাধ্যমে ইউরোপিয়ানদের কাছে ঠিকই পোঁছে গিয়েছিলো হাওয়াইইয়ের কাহিনী। ইতিমধ্যে, তারা জেনে গেছে হাওয়াইইয়ান এক সম্পদের কথা। পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে ব্যবসার খাতিরে ঘুরতে থাকা নাবিকরা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলো, হাওয়াইইয়ান বনের সে সম্পদ পৃথিবীর অন্য আর যে কোনো স্থানের চেয়ে উৎকৃষ্ট। মহামূল্যবান সে সম্পদের নাম “চন্দন” (sandalwoods)। চন্দনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট, এর দীর্গস্থায়ী সুগন্ধ সময়ের সাথে সাথে ফুরিয়ে যায় না; তাই, সারা পৃথিবীতে সেটির অনন্য চাহিদা। আর, সেই সুগন্ধির লোভে ইউরোপিয়ান জাহাজগুলো নিয়মিতই এসে ভীড় করতো হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জে। তবে, নাটকীয়তার শুরু হয়, আমেরিকানরা এসে যখন তাদের পদচিহ্ন ফেলতে শুরু করে।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতেই বোধ হয়, যে জায়গাতে ক্যাপ্টেইন কুক খুন হোন, ঠিক সেখানটাতেই গিয়ে নোঙর করার পরিকল্পনা করেন প্রথম আমেরিকান জাহাজ ‘ইলিনোরা’ এবং ‘ফেয়ার আমেরিকান’র কর্ণধাররা। ‘ইলিনোরা’র ক্যাপ্টেইন বাবা সাইমন মেটাক্যাল্পে এবং ‘ফেয়ার আমেরিকান’র ক্যাপ্টেইন ছেলে থমাস মেটাক্যাল্পে। পশম ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রশান্ত মহাসাগরে বের হওয়া বাপ-ছেলের হাওয়াইই যাওয়ার আগাম পরিকল্পনা ছিলো না। কিন্তু, এত বড প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যখানেতো আর টার্মিনাল নেই, সমুদ্র বন্দরও নেই। তাই, কথা ছিলো, যদি কোনো কারণে তারা হারিয়ে যায়, কেবল তাহলেই হাওয়াইই দ্বীপে গিয়ে দুটি জাহাজ একত্রিত হবে এবং সাথে সাথে হাওয়াইইয়ের দারুণ আবহাওয়ায় শীতকালটাও কাটিয়ে আসা যাবে।

কিছুদিন পর, ১৭৯০ সালের দিকে, বৃটেন এবং স্পেনের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে, স্প্যানিশরা ‘ফেয়ার আমেরিকান’ আটক করে মেক্সিকোর সীমানায় নিয়ে যায়; আলাদা হয়ে পড়ে বাবা আর ছেলে। ‘ফেয়ার আমেরিকান’কে হারিয়ে পুর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বাবা সাইমন তার ‘ইলিনোরা’ নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হয় হাওয়াইই উপকূলে। সেখানকার হাওয়াইইয়ান প্রধান ‘কামেইইয়ামকু’ ব্যাপক সমাদরের সাথে অভ্যর্থনা জানালেন দলবলসহ আসা এই আমেরিকান আগুন্তুককে। কিন্তু, হাওয়াইইয়ান প্রধানের কোনো এক আচরণের অসন্তুষ্ট হয়ে, তার পিঠে চাবুক চালালেন ক্যাপ্টেন সাইমন। এক যুগ আগে ঠিক একই ভুল করে হাওয়াইইয়ানদের হাতে প্রাণ হারিয়ে চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেইন কুক।

এরপর ক্যাপ্টেইন সাইমন তার ‘ইলিনোরা’ জাহাজ এবং দলবল নিয়ে পাড়ি জমালেন হাওয়াইইয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত পার্শবর্তী দ্বীপে। আবারো, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কুক’র জাহাজ থেকে নৌকা চুরি করার কারণে যে খুনোখুনির যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো, নৌকা চুরির সে একই ঘটনা ঘটলো ক্যাপ্টেইন সাইমনের সাথেও। হাওয়াইইয়নদের নৌকা চুরির কারণ খুব সামান্য। নৌকা থেকে তারা বড় বড় সব পেরেকগুলো খুলে নিতো। তারপর সেটা দিয়ে বর্শা, বল্লম বানিয়ে শিকারের জন্য ব্যবহার করতো। অথবা, হাওইইয়ান গোত্রে-গোত্রে কিংবা দ্বীপে-দ্বীপে যে অন্তঃকলহ বিরাজমান ছিলো, সেগুলোতে অস্ত্র বানিয়ে ব্যবহার করতো।

হাওয়াইইয়ান যে লোক ‘ইলিনোরা’ থেকে নৌকা চুরি করে, সে শুধু চুরিই করেনি, নৌকার পাহারাদারকে খুনও করে গেছে। ক্রোধে উন্মত্ত ক্যাপ্টেন সাইমন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, নৌকা চুরিকারী লোকটি ‘ওলোওয়ালু’ নামক জায়গার অধিবাসী। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে, আমেরিকান এই ক্যাপ্টেইন যেটা করলেন, সেটা নিদারুণ এক গণহত্যা। ‘পণ্য বিনিময়ের নাম করে ‘ওলোওয়ালু’র সব মানুষকে তীরে এসে জড়ো হতে বলে সাইমন। সবার আগে এত্ত বড় জাহাজ আর সাদা সাদা মানুষ দেখার জন্য তীরে এসে জড়ো হয় ‘ওলোওয়ালু’র ছোট-ছোট শিশুরা। তীরের কাছাকাছি জাহাজ ভীড়িতেই কামানের মুখ উন্মুক্ত করে দেন ক্যাপ্টেইন সায়মন। বুম্‌ বুম্‌ বুম্‌। নিহত হয় শতাধিক নিরপরাধ মানুষ, শিশু; আহত হয় আরো শতাধিক।

এদিকে যে জায়গায় ‘ফেয়ার আমেরিকান’ নিয়ে ছেলে থমাসের আসার কথা, সেখান থেকে ইলিনোরা বেশ কিছুটা সরে এসেছে। তাই ফেয়ার আমেরিকান’র খবর নেয়ার জন্য, ক্যাপ্টেইন সায়মন সেখানে পাঠান ‘জন ইয়ং’কে। কিন্তু, হাওয়াইইয়ান দলপতি কর্তৃক আটক হবার আগে ‘ওলোওয়ালু’ গণহত্যার সাক্ষী জন ইয়ং জানতেও পারলো না, ফেয়ার আমেরিকান ঠিকই নোঙ্গর করেছিলো। কিন্তু, ‘আইজ্যাক ডেভিস’ নামক একজন ছাড়া, ‘ফেয়ার আমেরিকান’র বাদবাকী সবাইকে হত্যা করে কিছুদিন আগে ক্যাপ্টেইন সাইমন’র হাতে চাবুক খাওয়া সেই হাওয়াইইয়ান প্রধান ‘কামেইইয়ামকু’। ক্যাপ্টেইন সাইমন জানতেও পারলো না, তারই নির্বুদ্ধিতার কারণে খুন হয়ে গেলো তার নিজের ছেলে। কামেইইয়ামকু ‘ফেয়ার আমেরিকান’র একমাত্র জীবন্ত ব্যক্তি ডেভিস’কে নিয়ে সমর্পণ করেন অন্য দলপতির কাছে, যার নিকট ইতিমধ্যে আটক আছেন ‘জন ইয়ং’। বুদ্ধি কিংবা শক্তিমত্তায় অন্য আর সব দলপতির চেয়ে এগিয়ে থাকা হাওয়াইয়ান সে প্রধানতম দলপতি আর কেউ নয়- কামেহামেহা। এই সেই কামেহামেহা, যার কথা মৃত্যুর আগে স্বয়ং ক্যাপ্টেইন কুক নোট হিসেবে লিখে গেছেন, লিখে গেছেন- “স্থানীয়দের মাঝে রয়েছে জ্ঞানস্পৃহাসম্পন্ন, সাহসী এক বুদ্ধিমান যুবক, কামেহামেহা তার নাম।”

ডেভিস এবং ইয়ং’কে না মেরে বুদ্ধিমান কামেহামেহা তাদেরকে তার উপদেষ্টা হবার প্রস্তাব দেন; ‘মৃত্যু’ অথবা ‘উপদেষ্টা’র আসন, দু’টোর একটি বেছে নিতে বলেন। ডেভিস এবং ইয়ং’ কিসের উপদেষ্টা হবেন সেটা প্রথমে বুঝতে না পারলেও, পরে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। গোত্রে-উপগোত্রে বিভক্ত হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জকে কি করে একক শাসকের অধীনে নিয়ে আসতে হবে, কামেহামেহা সেই উপদেশই আশা করছিলেন যুদ্ধ-বিগ্রহের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাইরের পৃথিবীর এই দুই ইউরোপিয়ানদের কাছে। অস্ত্রের কি শক্তি, ক্যাপ্টেইন কুক আর ক্যাপ্টেইন সায়মনকে দেখে কামেহামেহা সেটা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলো। বাইরের পৃথিবীর যে জাহাজগুলি হাওয়াইইতে আসে, তাদের সাথে সঠিকভাবে অস্ত্র লেনা-দেনা করার জন্য প্রয়োজন বাইরের পৃথিবীর মানুষ। ‘ইয়ং’ আর ‘ডেভিস’ কামেহামেহার সেই দুই বাইরের পৃথিবীর মানুষ মানুষ। শুরু হয় বাণিজ্য। দিনে দিনে হাওয়াইই থেকে বাইরে চলে যেতে থাকে সুগন্ধি ‘চন্দন’, আর হাওয়াইইতে আসতে থাকে প্রাণঘাতী ‘অস্ত্র’।

যত বুদ্ধিমানই হোক না কেন, ক্ষমতালোভী মানুষ, পৃথিবীর ইতিহাসে যা করে গেছে কামেহামেহাও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিলো না। ১৭৯৪ সালে ব্রিটিশ এবং আমেরিকানদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র, জাহাজ, নিজের অনুগত ও বিশ্বস্ত বাহিনী, এবং উপদেষ্টাদের নিয়ে কামেহামেহা শুরু করলো অভিযান। এতদিন শুধু হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের সবচের বড় দ্বীপ ‘বিগ আইল্যান্ড’য়ের অধিপতি ছিলো কামেহামেহা, এবার শুরু করলো অন্য সব দ্বীপ জয়ের অভিযান। প্রথমে দখল করলো ‘মাউইই’ এবং তার কাছকাছি ছোট্ট আরেকটি দ্বীপ। এরপর, ১৭৯৫ সালে যাত্রা শুরু করলো হাওয়াইইয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবসতিপূর্ণ দ্বীপ ‘ওয়াহু’-তে। সেখানে, কামেহামেহা ও তার দলবল যে হত্যাযজ্ঞ সাধন করেছিলো, সেটি হাওয়াইইয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা। কামেহামেহা ‘ওয়াহু’ অধিবাসী, যোদ্ধা, নারী, পুরুষ, এমনকি শিশুদেরও তিনপাশ থেকে ঘিরে ধরে, তাড়িয়ে নিয়ে যায় সমুদ্র তীরবর্তী উঁচু পর্বতের চূড়ায়। আর, সেখানে থেকে তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে শতশতফুট নীচে থাকা সমুদ্রের পানিতে। মৃত্যু হয় হাজার হাজার মানুষের, সঠিক সংখ্যা অজানা। ইতিহাসে এটি ‘নুউয়ানুর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

এক পর্যায়ে ছোটো দুটি দ্বীপ ছাড়া অন্য সব দ্বীপ দখল করা হয়ে যায় কামেহামেহার। প্রথমবারের প্রচেষ্টায় ঝড়ের কবলে পড়ে এবং তার যোদ্ধাবাহিনীর মাঝে মহামারী ছড়িয়ে পড়ায়, সে দ্বীপ দু’টি আক্রমণ করে দখল করার পরিকল্পনা বাদ দেয় কামেহামেহা; আশ্রয় নেয় কূটনীতির। একসময় কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় সেগুলো চলে আসে কামেহামেহার নিয়ন্ত্রণে। যে উদ্দেশ্যে ক্ষমতালোভী কামেহামেহা, এত-এত অভিযান আর গণহত্যার আশ্রয় নিয়েছিলো, তার সে উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় ১৮১০ সালে। প্রতিষ্ঠিত হয় অখণ্ড এক হাওয়াইই সাম্রাজ্যের, প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন এক ‘হাওয়াইইয়ান’ জাতিগোষ্ঠীর। কামেহামেহা নতুন করে সৃষ্টি হওয়া সে-সাম্রাজ্যের সম্রাট, নতুন জন্ম নেয়া সে-জাতির নির্মাতা।

এরপর, ইতিহাসের অপরাপর ধূর্ত সম্রাটগণ যাই করেছিলো, কামেহামেহাও তার ব্যতিক্রম করেনি- সকল অশান্তির সৃষ্টি করে, নিজের স্বার্থ যখন পুরোপুরি উদ্ধার হলো, অন্যদের কাছে তখন দিলো ‘শান্তি প্রস্তাব’। ঘোষণা করলো, যুদ্ধ-বিগ্রহের মতন এমন সৃষ্টিছাড়া কাজ তার রাজ্যে আর চলতে পারে না। এছাড়া, তাঁর আর উপায়ও ছিলো না। কারণ, ইতিমধ্যে তাঁর নেতৃত্ব হত্যা করা হয়েছে অন্য অনেক দলপতি এবং তাঁদের সাথে সম্পর্কযুক্ত অসংখ্য মানুষদের। শান্তির বুলি না আওড়ালে, স্বভাবতই, তাদের অনুসারীরা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকবে।

নতুন রাজত্ব গঠন করার কিছুদিনের মধ্যেই বহিঃশত্রুর আক্রমণের হুমকিতে পড়ে কামেহামেহা। তবে, হাওয়াই দখল করার জন্য রাশিয়ান অস্ত্রবোঝাই জাহাজের এক ক্যাপ্টেন থেকে পাওয়া সে হুমকি বিচক্ষণতার সাথেই মোকাবিলা করা হয়। এরকম আক্রমণ আরো আসতে পারে ভেবে, তার পরপরই কামেহামেহা সিদ্ধান্ত নেয় হাওয়াইইয়ান পতাকা তৈরির। চরম ধূর্ত এই রাজনীতিবিদ সে-সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তারকারী আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, এই তিনিদেশের পতাকা জোড়া লাগিয়ে তৈরি করে হাওয়াইইয়ের পতাকা। মানেটা দাঁড়ালো- তোমরা তিন দেশই হাওয়াইইয়ের বন্ধু, আমাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দাও এবং কেউ আমাদেরকে আক্রমণ করতে এলে প্রতিরোধের দায়িত্ব নাও।

এদিকে, জীবন-যাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিম থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করলেও, হাওয়াইইয়ের নিজস্ব যে ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্বিক রীতি-নীতিগুলো ছিলো, কামেহামেহা কখনোই সেগুলো ত্যাগ করেনি। স্থানীয় এই সমস্ত রীতি-নীতিগুলোকে বলা হতো ‘কাপু’। ‘কাপু’ মূলত বর্তমান যুগের ট্যাবু (taboo) অর্থ্যাৎ সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ কার্যকলাপের সাথে সমতুল্য। রাজার সাথে স্থানীয়দের আচরণ কেমন হবে, সেটা নিয়ন্ত্রিত হতো কাপু’র মাধ্যমে। সে অনুযায়ী, সাধারণ অধিবাসীরা কখনোই রাজার পরিধেয় বস্ত্র কিংবা অন্য যে কোনো ব্যাক্তিগত সামগ্রী স্পর্শ করতে পারতো না, রাজার চোখে তাকিয়ে কথা বলতে পারতো না, আনতমুখে নত হয়ে বলতে হতো তাদের।

শুধু তাই নয়, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘কে-কখন-কিভাবে-কি’ করতে পারবে, সেটিও নির্দেশিত হতো কাপু’র মাধ্যমে। কে মাছ ধরতে পারবে, কখন ধরতে পারবে, কী চাষ করা যাবে, কীভাবে চাষ করা যাবে, মানুষ কি খাবে, কখন খাবে, কখন ঘুমাবে, কীসের পূজো করবে স-সবকিছুই নির্ধারিত হতো কাপু’র মাধ্যমে। এর মধ্যে আবার বিশেষ ধরণের কাপু ছিলো ‘আইকাপু’। ‘আইকাপু’ অনুযায়ী পুরুষ এবং নারীরা কোনো অবস্থাতেই একসাথে বসে খাবার খেতে পারবে না। এ-নিয়মের ব্যতিক্রম হলে শাস্তি ছিলো সরাসরি মৃত্যুদণ্ড। বলতে গেলে কামেহামেহার শাসনামলে হাওয়াইইয়ানদের জীবন-যাপনের পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত হতো ‘কাপু’র মাধ্যমে।

১৮১৯ সালে ষাটোর্ধ কামেহামেহা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে-সময় রাজ্যের অন্য সব কবিরাজ-চিকিৎসকদের সাথে সাথে, সবসময় অসুস্থ কামেহামেহার পাশে থাকতেন তার বিশ জনেরও বেশি স্ত্রীর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ‘কাহুমানু’। ‘কাহুমানু’ প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। কাহুমানুর পিতা কিংবা ভ্রাতাগণ প্রতাপশালী যোদ্ধা ও সম্রাটের বাহিনীর জেনারেল।

হাওয়াইইয়ান শাজাহান-মমতাজ এই কামেহামেহা-কাহুমানু’র গভীর প্রণয় নিয়ে হাওয়াইইতে প্রচলিত আছে অনেক কাহিনী। কাহুমানুর শরীরের উপরও ‘কাপু’ জারি করেছিলো কামেহামেহা; অর্থ্যাৎ, সম্রাটব্যতীত অন্য আর কেউ ‘কাহুমানু’র শরীর স্পর্শ করতে পারবে না। তবে, তার শরীরের উপর জারি করা ‘কাপু’ কেবলমাত্র নিরেট ভালোবাসা থেকে আসেনি; এসেছে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেও। কাহুমানু অন্য কারো হয়ে যাওয়া বা কাহুমানুকে হারানোর মানে হলো তার প্রভাবশালী পরিবারের সমর্থন হারানো। আর, সে পরিবারের সমর্থন হারানো মানে সিংহাসন রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়া। তবে, কাহুমানুর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন কামেহামেহা ঠিকই রেখে গেছেন তার মৃত্যুশয্যায়। নিজ সন্তান ‘লিহোলিহো’কে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার সাথে সাথে, কাহুমানুকে ঘোষণা করেন পরবর্তী সম্রাট লিহোলিহো’র প্রধান উপদেষ্টা। উল্লেখ্য, লিহোলিহোর মা ছিলেন কামেহামেহার আরেক স্ত্রী ‘কিয়োপুয়োলানি’ ।

শাজাহান-মমতাজের মত কামেহামেহা-কাহুমানুর প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে বিশাল বিশাল গীতিকাব্য রচিত হয়নি; তাই বলে, তাদের সে কাহিনী হারিয়েও যায়নি। তবে, কোনটা যে ভালোবাসা, কোনটা যে স্বার্থ, এক মানুষের মনের সে-খবর অপর মানুষ বুঝবে, সে সাধ্য যে মানুষের নেই। কামেহামেহার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কারণ সুনিশ্চিত নয়; রোগ-ব্যাধি থেকে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হতে পারে; তবে, সাথে সাথে সন্দেহ করা হয়, কাহুমানুর প্রয়োগকৃত বিষে অসুস্থ হয়েই মারা যান হাওয়াইইয় সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট ‘কামেহামেহা’।

মৃত্যুর পর সম্রাট কামেহামেহার সমাধির উপর কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি, পাশে নির্মাণ করা হয়নি কোনো মহল। কারণটা, খুব স্বাভাবিক। কেউ জানে না, কোথায় সম্রাটের মৃতদেহ। হাওয়াইইয়ানদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র এক জিনিস ছিলো ‘মানা’ বা মানুষের অধ্যাত্বিক শক্তি। আর, ‘মানা’র পবিত্রতা রক্ষার জন্যই মৃতদেহকে লুকিয়ে রাখতে হয়। হাওইইয়ান রীতি অনুযায়ী, কামেহামেহার বিশ্বস্ত কয়েকজন বন্ধু, গোপন জায়গায় নিয়ে, লুকিয়ে তার মৃতদেহ সমাধিস্থ করে।

মইনুল রাজু
ফেইসবুক
অন্যান্য কিছু লেখা


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মইনুল রাজু এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

মইনুল রাজু এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
।।।।।।।।।
অনিত্র

মইনুল রাজু এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হাওয়াইয়ের ছবি দেখলেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে। আপনি ভাগ্যবান।

লেখা, ছবি যথারীতি আগের মতোই উপাদেয় হয়েছে। ইতিহাসকে সাধারণের গ্রহনযোগ্য ভাষায় তুলে ধরা কঠিন কাজ। আপনি সেটা সফলভাবে করতে পেরেছেন।

এতো দীর্ঘ দীর্ঘ বিরতি না দিয়ে আরেকটু নিয়মিত হতে পারেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মইনুল রাজু এর ছবি

এই সিরিজটি লিখতে যত না সময় যাচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় যাচ্ছে হাওয়াইইয়ের ইতিহাস পড়তে আর ডকুমেন্টারি দেখতে। তাই, এক পর্ব থেকে আরেকপর্বের সময় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। লিখতে গিয়ে টের পাচ্ছি, কাহিনীর ধারা অব্যাহত রেখে, সঠিকভাবে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখাটা বেশ কঠিন।

আমার বহুদিনের স্বপ্ন ছিলো হাওয়াইই যাওয়ার। হ্যাঁ, আমি আসলেও ভাগ্যবান, সেটা সম্ভব হয়েছে। হাসি

অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

শিশিরকণা এর ছবি

হাওয়াইইতে দেখেছিলাম রাস্তার দু'ধারে জমে যাওয়া কালো লাভার পাথরের গায়ে সাদা প্রবাল সাজিয়ে মানুষ নিজের নাম কি কোন মেসেজ লিখে রেখেছে। আপনার কাছে কি ছবি আছে তার? আমি বাংলায় নিজের নাম লিখে রেখে এসেছিলাম হাসি

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

মইনুল রাজু এর ছবি

হাওয়াইইতেতো বেশ কয়েকটা আইল্যান্ড আছে, আপনি কোনটাতে দেখেছেন? আমার সক্রিয় আগ্নেয়গিরি দেখার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিলো, তাই, আমি গিয়েছিলাম বিগ আইল্যান্ড। অনেক ধরণের লাভাই দেখলাম। কয়েকশো বা হাজার বছরের পুরোনো লাভা থেকে শুরু করে, একেবারে তৎক্ষণাত বের হয়ে আসা কয়েক সেকেন্ড আগের লাভা পর্যন্ত। কিন্তু, না, কেউ নাম/মেসেজ লিখে রেখেছে ওরকমটা চোখে পড়েনি।

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

শিশিরকণা এর ছবি

হাওয়াই ( বিগ) -ই ( আইল্যান্ড) এই গিয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, কনা থেকে হিলো যাবার পথেই ছিল। ছবি খুঁজছি। এটা আগ্নেয়গিরির পার্কের কাছে না। আইল্যান্ডের মাঝামাঝি আড়াআড়ি কোন পথে। আর নতুন লাভা নয়। পুরনো ঠান্ডা হয়ে যাওয়া লাভা কেটে পথ বানানো হয়েছে তেমন জায়গায়।

গুগল ম্যাপে খুঁজে পেলাম। স্ট্রিট ভিউ দেখুন । https://goo.gl/maps/0SZ15

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

মইনুল রাজু এর ছবি

নাহ! এটা দেখিনি আমরা, মিস্‌ করেছি কোনো কারণে। যদিও, কনা থেকে হিলোতে আমরাও ড্রাইভ করেছিলাম।

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চমৎকার লাগছে আপনার এই সিরিজ, হাওয়াই চপ্পলের মতই নির্ভার, ঝরঝরে।

মইনুল রাজু এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।