ব‌‌র্ণাশ্রম

মাল্যবান এর ছবি
লিখেছেন মাল্যবান [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৮/০৩/২০০৯ - ৯:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

-মা, মা, একটু আসো না মা
-আসছি মা ,একটু দাঁড়া, হাতের কাজটা সেরেই আসছি।
দিবাবসান। সন্ধ্যা হয়েছে মাত্র। গাছেদের পাতায় জমে উঠেছে অন্ধকার। আকাশে একটি দুটি করে তারা উঠেছে। এইমাত্র পশ্চিম আকাশে একটি ছোট্ট তারা ফুটে উঠলো। তারাটি এ বাড়ীর জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে ।এই বাড়ীর জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। একটি ছোট্ট মেয়ে জানালার পাশের তক্তপোষে পড়তে বসেছে। গোলাপী ফ্রক, মাথায় দুটো বিনুনী বেঁধে দিয়েছে তার মা। তার সামনে খোলা ক্লাশ ফোরের ইতিহাসের বই। মেয়েটি মনোযোগী খুব আর জিজ্ঞাসু। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও তার কত কৌতুহল ! আর সব জিজ্ঞাসা তার মায়ের কাছে। আর কেই বা তার নানান প্রশ্নের জবাব দেবে ! তার বাবা ফিরবে সেই রাতে । কোনোদিন সে হয়তো ঘুমিয়েই কাদা। বক্কা আর ছোটকাও হয়তো একটু আগে পরে। কিন্তু তারা তার কোনো প্রশ্নের, জিজ্ঞাসার জবাবই দেবে না । উল্টে ধমকেই দেবে হয়তো। তাই মার কাছেই তার যত কৌতুহলের নিবৃত্তি। এঘর থেকে রান্নাঘর দেখা যায় না ঠিক কিন্তু মা রান্নাঘরে কাজ করলে সে টের পায়। এই যেমন এখন। সে মাকে ডাকে তাই।
- মা , মা শোনো না একটু
তার কাতর ডাক শোনে মা। কিন্তু মায়ের কি যো আছে কথা শোনবার ! তার কত কাজ যে ! এ বাড়ীতে আসা ইস্তক তার কি হাঁফ ফেলার অবসর আছে কিছু ? নইলে তার প্রাণ পড়ে থাকে ঐ তক্তপোষে। মেয়ের কাছে। তার মেয়ের পড়ায় উৎসাহ খুব। কত প্রশ্ন তার। “মা, ধ্রুবতারা কোনটা দেখাও না”। “ কালপুরুষ?” তার নিজের কথা মনে পড়ে যায় খুব। দরিদ্র ব্রাহ্মণ পিতার মেয়ে সে। পড়ার জন্য মাস্টার দূরস্থান, খাতার কাগজ কিনতেই তিনি হিমসিম। তাই তার আর হায়ার সেকেন্ডারী করা হোলো না। বিয়ে হয়ে গেলো। তার শ্বশুর মশাই পুরোহিত। বাবা ব্রাহ্মণ হয়েও পূজো-আর্চাকে পেশা করেননি।কীর্ত্তন গাইতেন।সে সূত্রেই জানাশোনা অনেকদিনের। বড়ছেলের বিয়ের পাত্রী হিসেবে শ্বশুরমশাই তাকেই পছন্দ করলেন। বাবা যেন হাতে চাঁদ পেলেন। নইলে আরো পড়তো সে । কলেজে পড়ার ইচ্ছেটা আর পূরণ হোলো না। বুকের ভেতরে সেই অপূর্ণ ইচ্ছেটা গুমরে থাকে। কেমন হাহাকারের মত ফাঁকা । বুদ্বুদের মত। মেয়েটা যেন সেই ইচ্ছেকে রূপ দেবার জন্যই এতো অনুসন্ধিৎসায় । তাকে সব বোঝাও। কেন হয়, কি করে হয়। তার কি এতো সময় আছে ? সকাল থেকে তার দম ফেলার সময় কই ? বৃদ্ধ শ্বশুর, স্বামী, দুই দেওর নিয়ে এই সংসারের সব সামলাতে হয় যে তাকে। সকাল থেকে যে তার শুধু কাজ আর কাজ ! একটু ফুরসত নেই তার। এত বড় বাড়ী। ঘুম থেকে উঠেই বাড়ীর সামনে পিছনে ঝাড়ু দাও। দুটো বড় বারান্দা, পাঁচটা ঘর ঝাঁট দাওরে, গুছিয়ে রাখোরে। কর্তারা সব একে একে উঠবেন তাদের বিছানা তোলোরে। একে চা দাও ওকে জলখাবার দাও । একবার রান্নাঘর, একবার মেয়ের বাবা ডাকছে এটা দাও-ওটা দাও,তো তার ঘর। এই কলপাড়ে বাসন নিয়ে বসলো তো, ওপর থেকে হাঁক এলো, ‘বৌদি চা লাগবে’ । ছুট,ছুট। দেরী চলবে না। বড় ঠাকুরপো বীমার দালালী করে। তার কোনো সময়ের ঠিক নেই। কোনোদিন সকাল ছ’টায়, বৌদি চা দাও, কোনোদিন তিনি আটটার আগে উঠলেনই না। সাড়ে আটটার মধ্যে বেরুবেন ছোট ঠাকুরপো। পুলিশের চাকরী। বংশে এই একজনই চাকরী করে । তার ভাত চাই আটটার মধ্যে, টিফিনের রুটি তরকারী।তাওয়ায় রুটি বসেছে,হাঁক এলো ‘শুনছো,দাড়ি কাটার বাটিতে জল দাওতো’।কোনো হুকুমেই দেরী সইবে না কারো।দেরী হলেই একেকজনের গোঁসা একেকরকম।সেসব ভঙ্গিমা জানে সে। তবু শ্বশুরমশাইয়ের ডাকে তটস্থ থাকে সে। একে বুড়োমানুষ,কোমরের ব্যাথায় বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেননা। তার ওপর শাশুড়ী গত হয়েছেন কত বছর হয়ে গেলো। মানুষটা ভালোও বাসে তাকে। আদর করে ডাকে, ‘মণি, মণিরে। ও মণি’ কিন্তু ডাকাডাকির পর যদি যেতে দেরী হয় একটুও, অস্থির হয়ে ওঠেন। তখন ডাকের সুর বদলে যায়। সে শুনলেই বোঝে।‘মণি ও মণি, মণিরে, ওরে ওই মণি- ই-ই-ই-ই’। তাই ছুট,ছুট,ছুট। একবার এঘর একবার ও ঘর। কখনো ওপরে দৌড়োও, কখনো কলতলায়। আর রান্নাঘর তো আছেই। বিয়ের পর ঘর বলতে এই একটিই। রান্নাঘর। এই রান্নাঘরে বাস করে করে তার মন হাঁফিয়ে ওঠে। সকালে তো মেয়ের কাছে বসতেই পারে না সে। অথচ মেয়ে তার পড়াশোনায় ভালো। সকালে উঠেই মুখ ধুয়ে নিজেই পড়তে বসে যায়। একফাঁকে ওকে রুটি তরকারী দিয়ে আসে মা। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,কোনোদিন আলতো চুমুও। কিন্তু সন্ধ্যেবেলায়ও যে একটু মেয়ের কাছে বসবে তার যো নেই। যেমন এখন। শ্বশুরমশাইয়ের জন্য রুটি তৈরী করতে করতে মেয়ের ডাক শুনে তার মন অস্থির হয়ে ওঠে। নিজেকে হারমোনিয়ম মনে হয় তার। যে যখন পারছে একটু বাজিয়ে নেয়। কেউ বিশার্পে,কেউ সি শার্পে কেউ বা জি শার্পে।
শ্বশুরমশাইকে রুটি দিয়ে প্রায় দৌড়ে মেয়ের কাছে এলো সে।
-কি হয়েছে মা, ডাকছিলি কেনো ? কি পড়ছিস ?
- ইতিহাস মা। মা বর্ণাশ্রম কি গো ?
মেয়ের অদম্য কোতুহল। সব জানতে চায়। বিশদে। কি করে মেঘ হয়,বৃষ্টি হয়। কালপুরুষ কোনটা বা সপ্তর্ষিমন্ডল চেনাবার জন্য ছাদে উঠে মেয়েকে দেখিয়েছেও সে। কিংবা বীজের অঙ্কুরোদ্গম বোঝাবার জন্য ছোলা ভিজিয়ে দেখিয়েছে সে। তার ভালোও লাগে। নিজে সে এমন কিছু খারাপ ছাত্রী ছিলো না। তার চাইতেও খারাপ রেজাল্ট করতো কাকলী, বনানী ওরাতো কলেজেও পড়েছে। সবিতা শুনেছে কোন স্কুলে এখন দিদিমনি।
- শোন, আর্যরা আমাদের দেশে পাকাপাকিভাবে বাস করতে শুরু করে । ধীরে ধীরে ভারতে আর্য সভ্যতা গড়ে উঠলো। আর্যরা করলো কি যে যেমন কাজ করে , ধর কেউ চাষবাস করে, কেউ ব্যবসা বানিজ্য করে, করেতো ? তেমনি যে যেমন কাজ করে সেরকম কাজের ভিত্তিতে সমাজটাকে ভাগ করলো। একেকটা ভাগের নাম দিলো । যেমন ধর, যারা পূজো আর্চা-যাগ যজ্ঞ করেন, তারপর ছাত্র পড়ান ,আগে তো ব্রাহ্মণরাই পড়াতে পারতেন, তারা হলেন ব্রাহ্মণ। আর যারা রাজা, সেনাপতি, সৈন্যসামন্ত, মানে যারা যুদ্ধবিগ্রহ করে তারা হল গিয়ে ক্ষত্রিয়। আর যারা ব্যবসা বানিজ্য করে বা ধর কারিগর ,শিল্পী কামার কুমোর ছুতোর এরা সব বৈশ্য। আর এই তিন শ্রেনীর মানুষকে সেবা করাই যাদের কাজ তারা সবচেয়ে নিম্নশ্রেণীর। তারা হোলো শুদ্র। এই হোলো বর্ণাশ্রম। বুঝলি ?
-মণি , ও মণি ।
শ্বশুরমশাইয়ের ডাক শোনা যায়। হয়তো আরেকটা রুটি চাই কিংবা তরকারী।
-যাই বাবা। দাঁড়া তুই পড় আমি আসছি।
-শোনো না মা, ঠাকুদ্দা হোলো ব্রাহ্মণ। ছোক্কা ক্ষত্রিয়, আর বাবা বৈশ্য
-ব্যস, ব্যস, অন্য কথা বলে না , তুমি পড়, আমি দেখে আসি কি লাগবে।
মা ওঠে। শ্বশুরমশাইয়ের ডাক শুনলে সে স্থির থাকতে পারে না । দেরী হলেই চীৎকার করে ডাক দিয়ে উঠবে। দরজার কাছাকাছি যেতেই তার কানে আসে _
-তুমি কি তাহলে শুদ্র মা ?
চমকে ওঠে সে। ঘুরে দাঁড়ায়।মেয়েকে দেখে।
-তুমি কি তবে শুদ্র মা? তুমি তো সকলের সেবা কর ।
নিস্পলক মায়ের দৃষ্টি মেয়ের চোখের ওপর। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মেয়ের দিকে। তার বুকে সেই বুদ্বুদের মত হাহাকার মুচড়ে ওঠে।

আকাশ থেকে ঐ ছোট্ট তারাটি তাকিয়ে থাকে অপলক। জানালা দিয়ে। মা মেয়েকে ধরে জড়িয়ে বসে আছে তক্তপোষের ওপর আর মেয়ের পিঠ ভিজে যাচ্ছে ।
-মণি –ই, মণি-ই, ওরে ঐ মণি , মণি-ই-ই-ই-ই-


মন্তব্য

গৌরীশ রায় এর ছবি

সুন্দর

অতিথি লেখক এর ছবি

মাল্যবান দা অবশেষে ধরা দিলেন সচলে।
ভাল লাগলো খুব।
মেঘ
মেঘের কথকতা

s-s এর ছবি

চমতকার!

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

চলুক

নিবিড় এর ছবি

শুধু একটা কথায় বলি দারুন চলুক


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

মাল্যবান এর ছবি

আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। সচলে আমার প্রথম পোস্ট আপনাদের ভালো লেগেছে দেখে উৎসাহিত বোধ করছি।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

দারুণ লাগলো...
আপনার লেখা নিয়মিত চাই।

মাল্যবান এর ছবি

হ্যা, অবশ্যই লিখবো। আপনার যে ভালো লেগেছে তাই আমাকে প্রেরণা দিচ্ছে।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

মাল্যবান- যে মালা ধারণ করে, তাইনা!

সচলে লেখা দিয়ে সবার প্রশংসার মালা ধারণ করুন আপনি। কামনা থাকলো প্রথম লেখাতেই। চলুক
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

মাল্যবান এর ছবি

আপনি যে মালা পরালেন তা আমি মাথা পেতে নিলুম।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো পড়ে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

চমৎকার লিখেছেন, মাল্যবান !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মাল্যবান এর ছবি

@নজরুল ইসলাম
@সুলতানা পারভীন শিমুল
আপনাদের ভালো লাগলো জেনে পুনরায় উৎসাহিত বোধ করছি।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অসম্ভব ভাল লাগল গল্পটা।

রানা মেহের এর ছবি

ভালো লেগেছে পড়ে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

মানবিক গল্প।

তবে, ভাই, একখান কথা আছে। দুই প্যারার মাঝখানে স্পেস দিলে চোখ আরাম পেতো।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।