দ্য অ্যালকেমিস্ট-৬

মামুন হক এর ছবি
লিখেছেন মামুন হক (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০৯/২০০৯ - ৩:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

the_alchemist

দ্য অ্যালকেমিষ্ট-৫

কী অদ্ভুৎ এই আফ্রিকা!—ছেলেটি ভাবল।
সে তাঞ্জিয়ের এর সরু অলি গলিতে ছড়ানো প্রায় একই রকম দেখতে অনেকগুলো পানশালার একটিতে বসে ছিল। পাশেই লোকেরা বিরাট লম্বা নল লাগানো গড়গড়া থেকে হাত বদল করে ধুমপান করছে। এখানে পা দেয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তার চোখে পড়েছে হাত ধরাধরি করে পুরুষ লোকেদের হেঁটে যাওয়া, ঘোমটা দেয়া মেয়েদের, মিনারের উপরে উঠে মুয়াজ্জ্বিনের আজান দেয়া আর তার পরপরই লোকেদের মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রার্থনা করা।

‘ভিন্ন ধর্মীদের আচরণ’—সে নিজেকে বলে। ছেলেবেলায় গীর্জাতে সে প্রায়ই ঘোড়ায় সওয়ার সেইন্ট সান্টিয়াগো মাতামোরসের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকত, তার খাপখোলা তলোয়ার আর বিশাল অবয়বের সামনে পড়লে বোধহয় এই লোকগুলি নিজের অজান্তেই হাঁটুগেড়ে বসে যেত। ছেলেটির হঠাৎ করে নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হতে থাকে, বিজাতীয় এই লোকগুলির চেহারায় কেমন একটা অশুভ ছাপ তার চোখে পড়ে।

এই উপরে আরেকটা ব্যাপার তাকে খুব পীড়া দিচ্ছিল। তাড়াহুড়া আর ভ্রমণের উত্তেজনায় একটা ছোট ব্যাপার তার মাথায় আসেনি। ব্যাপারটা ছোট হলেও শুধু এই কারণেই তার অভিযান অসহ্য রকমের দীর্ঘ হয়ে যেতে পারে –এই অঞ্চলে আরবী ছাড়া আর কোন ভাষা চলেনা।

পানশালার মালিককে এগিয়ে আসতে দেখে পাশের লোকদের দেখাদেখি ছেলেটিও একটা পানীয়ের অনুরোধ জানাল। এক চুমুকেই ছেলেটির মুখ ফিরে আসল—তিতিকুটে স্বাদের চা ছিল সেটা। এর চেয়ে সুরাজাতীয় পানীয় তার বেশি পছন্দ।

কিন্তু এ বিষয়ে এখন না ভাবলেও চলবে। কী করে গুপ্তধনের কাছে পৌছানো যায় সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভেড়ার পাল বিক্রি করে তার হাতে যথেষ্ট পরিমাণে টাকা এসেছে, ছেলেটি জানত যে টাকার যাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে, আর হাতে টাকা থাকলে মানুষ কখনই পুরোপুরি একেলা হয় না। অল্পদিনেই সে মিশরের পিরামিডের কাছে পৌছে যেতে পারবে। বুকে স্বর্ণের বর্ম পরিহিত এক বৃদ্ধ রাজা নিশ্চয়ই ছয়টা ভেড়ার লোভে মিথ্যে বলবেন না ।

বৃদ্ধ রাজা তাকে লক্ষণ এবং দৈব ইশারার কথা বলেছেন, সাগর পাড়ি দেয়ার সময়ে ছেলেটি সে বিষয়ে কিছুটা ভাবনা চিন্তাও করেছে। মেলশিজদেক ঠিকই বলেছেন, আন্দালুসিয়াতে রাখাল থাকার দিনগুলিতে প্রকৃতির মাঝে ফুটে ওঠা নানা ধরনের ইশারাকে বুঝে নিয়ে সে চলার পথ বেছে নিত। যেমন এক ধরনের পাখি চোখে পড়লে সে বুঝত যে আশেপাশেই সাপের আনাগোনা রয়েছে, আবার এক জাতের লতা গুল্ম দেখলে জানা হতো কাছেই কোথাও পানির উৎসের সন্ধান মিলবে। ভেড়াগুলা তাকে এইসব শিখিয়েছে।

খোদা যদি ভেড়াকে পথ দেখিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি আমাকেও পথ দেখাবেন। এটা ভাবতেই তার দুশ্চিন্তা খানিকটা দূর হলো। চায়ের স্বাদও আগের মতো আর বীভৎস লাগছিল না।

‘আপনার পরিচয়?’—হঠাৎ স্প্যানিশে কেউ তাকে প্রশ্ন করল।

ছেলেটি খুশী হয়ে গেল। দৈব ইশারার কথা ভাবতে না ভাবতেই একজন এসে হাজির।

‘আপনি স্প্যানিশ কীভাবে শিখলেন?—হতচকিত ছেলেটি প্রশ্নের জবাবে আরেকটি প্রশ্ন করল। আগন্তুক লোকটি বয়সে তরুণ, গায়ে পশ্চিমা পোষাক। কিন্তু গায়ের রং দেখে বোঝা যায় যে সে স্থানীয়। একই উচ্চতার লোকটির বয়সও তার সমানই হবে বলে মনে হলো।

-‘ প্রায় সবাই এখানে স্প্যানিশ জানে। স্পেন থেকে মাত্র দুই ঘন্টা দূরে আছি আমরা’।

‘বসুন আমার সাথে, কী খাবেন? আর দয়া করে আমাকে এক গ্লাস ওয়াইন দিতে বলুন। এই চা টা আমার কাছে অসহ্য লাগছে’।

-‘ মদ জাতীয় কিছু নেই এই দেশে। ধর্মে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে’—যুবকটি জানায়।

ছেলেটি তাকে জানালো পিরামিডের উদ্দেশ্যে তার যাত্রার কথা। গুপ্তধনের কথাও সে প্রায় বলে ফেলেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। বললে হয়তো এই আরব লোকটিও গুপ্তধনের একাংশ দাবী করে বসবে। তার মনে পড়ল বৃদ্ধ রাজা তাকে হাতে না আসা সম্পদের ভাগ-বাটোয়ার সম্পর্কে কী বলেছিলেন।

‘ যদি সম্ভব হয় আপনি আমাকে পিরামিডের কাছে নিয়ে চলুন। পারিশ্রমিক যা লাগবে আমি দেব আপনাকে’।

-‘ ওখানে কীভাবে যেতে হয় সে বিষয়ে আপনার কোন ধারণা আছে?’—আগন্তুক জানতে চাইল।

ছেলেটি হঠাৎ খেয়াল করল যে পানশালার মালিক কাছে দাঁড়িয়ে বেশ মন দিয়ে তাদের আলাপ শুনছে। ব্যাপারটা তার কাছে অস্বস্থিকর লাগলো। পথ দেখানোর মতো একজনকে যখন পাওয়া গেছে সে সেই সুযোগটা আর নষ্ট করতে চাচ্ছিল না।

-‘আমাদের সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিতে হবে। এর জন্য প্রচুর খরচপাতি লাগবে। আপনার কাছে কি যথেষ্ট টাকা-পয়সা আছে?’

প্রশ্নটা একটু আগবাড়িয়ে করা বলে মনে হলো ছেলেটির কাছে। কিন্তু তার আবার সেই বৃদ্ধ রাজার কথা মনে পড়ল , যিনি বলেছিলেন যখন তুমি আন্তরিক ভাবে কিছু চাও সমগ্র বিশ্ব-চরাচর মিলে তোমাকে সেটা পাইয়ে দিতে সাহায্য করে।

সে টাকার থলেটি বের করে লোকটিকে দেখাল। পানশালার মালিকও এসে দেখল। তারপর আগন্তুকের সাথে রীতিমতো ঝাঁঝাঁলো কন্ঠে তর্ক জুড়ে দিল।

-‘চলুন এখান থেকে বেরিয়ে যাই। উনি আমাদের এখানে বসতে দিতে চাচ্ছেন না’।

ছেলেটি নিশিন্ত বোধ করল। পানীয়ের দাম মেটাতে গেলে মালিক লোকটি তার হাত চেপে ধরে রাগী স্বরে কিছু বলতে শুরু করে। ছেলেটি ধাক্কা মেরে লোকটিকে সরিয়ে দেবে কিনা ভাবল—কিন্তু সে এখন আছে অচেনা এক দেশে। তার নতুন বন্ধুটি এসে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওখান থেকে বের হয়ে আসল।

-‘ আপনার টাকার উপরে ওর চোখ পড়েছে। তাঞ্জিয়ের আফ্রিকার অন্যান্য শহরগুলোর মতো না। এটি একটি বন্দরনগরী—চোর-বাটপারে ভর্তি’ ।

ছেলেটি তার নতুন বন্ধুকে বিশ্বাস করল। বিপদেই বন্ধুর আসল পরিচয়। সে থলে থেকে টাকা বের করে বন্ধুর হাতে দিল।

-‘ আমরা আগামী কালের মধ্যেই পিরামিডের কাছে পৌছে যাব। তবে তার জন্য আমাকে দু’টো উট কিনতে হবে’ ।

তাঞ্জিয়ের এর সরু আলি-গলি দিয়ে তারা হেঁটে পথ চলছিল। চারদিকেই জিনিষপত্রে ভরপুর ছোট ছোট দোকান। তারা বড় একটি বাজারের মাঝে এসে পড়ল। হাজার হাজার মানুষ চারদিকে। বেচা-কেনা, হৈ-হুল্লোড়, দর কষাকষি আর তর্কাতর্কিতে মগ্ন। সব্জীর দোকানের পাশে ছুরি-তরবারী, তামাকের পাশে কার্পেট—এ এক হুলস্থুল পরিস্থিতি চারদিকে। ছেলেটি কিছুতেই তার নতুন বন্ধুর উপর থেকে চোখ সরায়নি। এই মুহূর্তে সব টাকা ঐ লোকটির হাতে। একবার ভাবল ফেরৎ নিয়ে নেবে কিনা। কিন্তু ব্যাপারটা একটু দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে নতুন বন্ধুর কাছে ভেবে চাইল না। সম্পূর্ণ অজানা এই দেশের সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না।

‘আমি ওকে চোখে আড়াল হতে দেবনা’-সে নিজেকে বলে। নিজের শারীরিক শক্তির ব্যাপারেও সে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল।

হঠাৎ, ঐসব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝেই, তার চোখে চলে গেল সারা জীবনে দেখা সবচে সুন্দর তারবারীটির দিকে। খাপটিতে রুপার কারুকাজ, কুচকুচে কালো হাতলে দামী সব পাথরের নকশা কাটা। ছেলেটি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল মিশর থেকে ফিরে সে অবশ্যই এই তলোয়ারটি কিনবে।

‘দোকানদারকে জিজ্ঞেস করুন তো এই তলোয়ারটার দাম কতো’—সে তার নতুন বলল। কিন্তু তখনই তার মনে পড়ল যে কয়েক মুহূর্তের জন্য সে একটু অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। ভয়ে তার হৃদপিন্ড বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হলো। ঘুরে তাকাতেও তার সাহস হচ্ছিল না, কারণ সে জানত পেছন ফিরে সে কী দেখতে পাবে। সে আরও কিছু সময় নিয়ে তরবারীটির সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে রইল, ঘুরে তাকানোর সাহস সঞ্চয় হওয়া পর্যন্ত।

তার পাশে কেবল সে নিজেই –আর হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা, হৈ চৈ, অদ্ভুত সব খাবারের গন্ধ , শুধু নেই তার নতুন বন্ধুর কোন নাম নিশানা।

ছেলেটি নিজেকে বিশ্বাস করাতে চাইল যে বন্ধুটি নিছক দুর্ঘটনাক্রমে তার থেকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তার ফেরার আসায় সে সেখানেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। তার অপেক্ষার সময়েই মুয়াজ্জ্বিন মিনারে উঠে আজান দিল, লোকজন হাঁটু গেড়ে, মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রার্থনা করল। তারপর শ্রমজীবি পিঁপড়াদের মতো তারা দোকান পাট বন্ধ করে দলে দলে বাজার ছেড়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেল।

সূর্যও বিদায় নিতে লাগলো, ধীরে ধীরে। ছেলেটি সূর্যাস্তের পথের দিকে তাকিয়ে রইল, বাজারের পাশের সাদা দালানগুলোর আড়ালে সূর্য হারিয়ে যাওয়া পর্যন্ত। তার মনে পড়ল ঐ সকালের কথা যেদিন সূর্যোদয়ের সময়ে সে ছিল অন্য একটি মহাদেশে, একপাল ভেড়া ছিলা তার মালিকানায়, আর সে এক সুন্দরী মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল। সেই সকালে চেনা পরিচিত পরিবেশে সারাদিনে আর কী কী ঘটতে যাচ্ছে সবই তার জানা ছিল। কিন্তু আজ , এই সূর্যাস্তের সময়ে সে অন্য এক দেশে, বিদেশে পথ হারানো এক বিদেশী, যেখানকার ভাষাও তার জানা নেই। সে আর কোন রাখাল ছেলে নয়, তার সর্বস্ব খোয়া গেছে, এমন কী ফিরে গিয়ে আবার সব গোড়া থেকে শুরু করার মতো পথ খরচও তার হাতে নেই।

আজ সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্তের মধ্যেই এত কান্ড ঘটে গেল!—ছেলট্য ভাবে। করুণার দৃষ্টিতে সে নিজেকে দেখতে লাগলো, সবকিছুর এত দ্রুত বদলে যাওয়া তাকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

ক্ষোভে-লজ্জায় তার চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। সে কোনদিন তার ভেড়ার পালের সামনেও কাঁদেনি। কিন্তু শূন্য বাজারে তখন শুনশান নীরবতা, আর বাড়ি থেকেও সে এখন হাজার মাইল দূরে, তাই সে মন খুলে কাঁদল। সে কাঁদল খোদার অবিচারের কারণে , স্বপ্নকে অনুসরণ করা কাউকে এই ধরনের অন্যায় পরিস্থিতির সামনে ফেলে দেয়ার বিরুদ্ধে ।

আমার যখন ভেড়ার পাল ছিল, আমি সুখী ছিলাম, আমার চারপাশের সবাইকেও আমি সুখী রাখতাম। মানুষ আমাকে আসতে দেখলে খুশী হতো, স্বাগতম জানাতো—সে ভাবে। কিন্তু এখন আমি চরম অসুখী এবং নিঃসঙ্গ। আমার বাকী জীবন কাটবে তিক্ততা আর মানুষকে অবিশ্বাসের মাঝে কারণ একজন আমাকে নিদারুন ভাবে প্রতারিত করেছে। আমি তাদের ঘৃণা করব যারা নিজেদের গুপ্তধনের সন্ধান পাবে, কারণ আমি কখনই আমার নিজেরটা খুঁজে পাবনা। আমি আমার সামান্য সহায়-সম্বলকে আঁকড়ে ধরেই জীবন কাটিয়ে দেব, কারণ পৃথিবী বিজয়ের পক্ষে আমি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।

সে তার থলে খুলে দেখছিল ভেতরে আর কিছু আছে কিনা, হয়তো সকালের আধ-খাওয়া রুটির অংশবিশেষ পড়ে থাকতে পারে কোথাও। কিন্তু সে খুঁজে পেল কেবল মাত্র সেই মোটা বই, ভারী আলখাল্লা আর বৃদ্ধ রাজার দেয়া পাথর দুইটি।

কোন এক অজানা কারণে পাথর দু”টির দিকে তাকিয়ে তার কাছে একটু ভালো বোধ হতে লাগলো। ছয়টি ভেড়ার বিনিময়ে সে এই দামী পাথর দু”টিকে পেয়েছে যেগুলো বসানো ছিল স্বর্ণের তৈরী এক বর্মের উপরে। হয়তো এই পাথর দু’টিকে বিক্রি করে তার বাড়ি ফেরার জাহাজ ভাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু এবারে আমি আর বোকামী করবনা, থলে থেকে বের করে পাথর দু’টোকে পকেটে ঢোকাতে গিয়ে ছেলেটি ভাবে। এটি একটি বন্দর নগরী এবং যে একমাত্র সত্যি কথাটি তার নতুন বন্ধুটি বলেছিল সেটি হলো—বন্দর নগরী চোর-ছ্যাচড়ে ভর্তি।

এখন সে বুঝতে পারল কেন সেই পানশালাটির মালিক এত ক্ষেপে গিয়েছিল, সে চাচ্ছিল চোরটির হাত হতে তাকে রক্ষা করতে।

“আমি আসলে আর সবার মতোই—আমি পৃথিবীকে দেখি আমার নিজের ইচ্ছা-আকাংখার দৃষ্টি দিয়ে, বাস্তবতার চোখ দিয়ে না” ।

সে পাথর দু’টোর উপরে হাত বুলাতে শুরু করে, সেগুলোর তাপমাত্রা আর মসৃনতা অনুভব করে। এগুলোই তার সম্পদ। ওগুলো নাড়াচাড়া করতেই তার কাছে ভালো লাগছিল। সেই বৃদ্ধ রাজার কথা মনে পড়ল।

‘তুমি যখন কোন কিছু অকৃত্রিম ভাবে কামনা কর, সমস্ত বিশ্বচরাচর তোমার সাহায্যে এগিয়ে আসে’—তিনি বলেছিলেন।

ছেলেটি বৃদ্ধ রাজার কথার সত্যতা অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলো। এই মুহূর্তে সে বসে আছে এক নির্জন বাজারে, নিঃসঙ্গ, কপর্দকহীন, এবং রাতে পাহারা দেয়ার জন্য কোন ভেড়াও নেই তার সাথে। কিন্তু এই পাথরগুলো প্রমাণ করে যে তার সাথে কোন এক রাজার দেখা হয়েছিল –যে কিনা তার অতীত সম্পর্কে সব কিছু জানতেন।

‘ এদের নাম উরিম এবং থুমিম, এবং তারা দৈব ইশারা বুঝতে তোমাকে সাহায্য করবে’।
ছেলেটি পাথর দু”টিকে আবার থলেতে পুরে একটা প রীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। বৃদ্ধ বলেছিলেন খুব পরিস্কার করে প্রশ্ন করতে হবে, তবে তার আগে ছেলেটিকে জানতে হবে সে আসলে কী চায়। সে জানতে চাইলে বৃদ্ধ রাজার আশীর্বাদ এখনও তার সাথে আছে কিনা।

উত্তর আসল—‘হ্যা’ ।

‘আমি কি আমার গুপ্তধন খুঁজে পাব?’—সে প্রশ্ন করল।

সে থলেতে হাত ঢুকিয়ে একটি পাথর খুঁজে নিতে চেষ্টা করল, কিন্তু থলের ফুটো গলে দু’টো পাথরই মাটিতে পড়ে গেল। থলেতে যে একটা ফুটো রয়েছে ছেলেটির সেটা জানাও ছিলনা। সে উরিম এবং থুমিমকে মাটি থেকে তুলে আবার থলেতে ঢুকিয়ে রাখবে বলে নিচু হলো। কিন্তু ওদের মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে আরেকটা কথা তার মনে পড়ল।

‘দৈব ইশারা খুঁজে পেতে শেখ এবং তাদের অনুসরণ কর’ –বৃদ্ধ রাজা বলেছিলেন।

দৈব ইশারা। ছেলেটির মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল। সে তাদের তুলে নিয়ে আবার থলেতে ঢোকালো। ফুটো বন্ধ করার কথা তার বিবেচনায়ও আসল না—পাথরগুলো পড়ে গিয়ে হারিয়ে যাবার হলে অনেক আগেই যেত। সে বুঝতে পারল যে এমন কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলো জানতে চাওয়া ঠিক না, যেমন উচিৎ নয় নিয়তি হতে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা।

‘আমি কথা দিয়েছিলাম সব সিদ্ধান্ত নিজেই গ্রহণ করব,’—সে নিজেকে বলে।

কিন্তু পাথরগুলো তাকে বলেছে যে বৃদ্ধ রাজা এখনও তার সাথে আছেন, এটা তাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলল। নির্জন বাজারের দিকে আবার তাকিয়ে এবারে তার আগের চেয়ে কম হতাশ লাগলো। এটা খুব অদ্ভুত কোন জায়গা না, এটা কেবল নতুন একটা দেশ।

আর এটাই তো এতকাল ধরে সে চেয়ে এসেছে, নতুন নতুন দেশ দেখতে।

পিরামিডে যদি তার কোনদিনই যাওয়া না হয়, তবুও এর মধ্যেই সে এতটা রাস্তা ভ্রমণ করেছে যা তার চেনাজানা আর কোন রাখাল কখনও করেনি। তাদের ধারণাতেও নেই যে মাত্র দুই ঘন্টার রাস্তা দূরেই সব কিছু কতটা বিচিত্র আর ভিন্ন ধরনের। যদিও তার বর্তমান আশ্রয়স্থল পরিত্যক্ত এক বাজার, কিন্তু দিনের বেলায় এর সরগরম আর প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর রূপটিও সে দেখেছে, যেটা সে কখনই ভুলে যেতে পারবেনা। তার সেই তরবারীটির কথা মনে পড়ল। মনে পড়ায় তার কষ্ট আবার জেগে উঠলেও এটা সত্যি যে এমন অসাধারণ একটা তলোয়ার এর আগে সে কোথাও দেখেনি। এসব ভাবনা যখন তাকে আবার উদ্বুদ্ধ করে তুলছিল তখন সে বুঝতে পারল নিজের ভাগ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তার নিজেকেই নিতে হবে—সে কি তস্করের হাতে সর্বস্ব খোয়ানো এক দুর্ভাগা হতদরিদ্র মানুষ, না ভাগ্যান্বেষণে ঘর ছাড়া এক দুঃসাহসী অভিযাত্রী ।

‘ আমি এক অভিযাত্রী, গুপ্তধনের সন্ধানে,’—সে নিজেকে আশ্বস্ত করে।


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দারুণ অনুবাদ। খুব সাবলীল। পরের পর্ব তাড়াতাড়ি ছাড়লে ভালো হতো। নইলে এমন একটা একটা পর্ব পড়লে খেই হারিয়ে ফেলি মন খারাপ

এর চেয়ে সুরাজাতীয় পানীয় তার বেশি পছন্দ।
সন্ন্যাসী'দার কথা মনে করিয়ে দিলেন। তাঁর 'সুরাপানের সুরা' সিরিজটা দুর্দান্ত ছিল।

আপনার অনুবাদ মরুভূমির উটের চেয়েও দ্রুতগতিতে দৌড়াক হাসি

মামুন হক এর ছবি

ধন্যবাদ শামা পোকা। মাঝে মাঝে একটু কষ্ট করে বানান টানান শুধরে দিও হাসি

এনকিদু এর ছবি

ভিন্ন ধর্মীদের আচরণ

যদ্দূর মনে পড়ে বইতে শব্দটা ছিল infidel, যদ্দূর জানতাম শব্দটায় খানিকটা এবং অবজ্ঞা ঘৃনা জড়িয়ে থাকে । এই শব্দটার বাংলা "ভিন্ন ধর্মী" বললে ভেতরের ঘৃনার ভাবটা ঢাকা পড়ে যায় । "বিধর্মী" অথবা "ধর্মহীন" ব্যবহারের প্রস্তাব করছি ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মামুন হক এর ছবি

বিধর্মীদের ভিন্নধর্মী বললে আমিতো ভুল কিছু দেখিনা। অবজ্ঞা বা ঘৃণামূলক শব্দ এড়িয়ে অনুবাদের চেষ্টা করেছি, শব্দের পরিবর্তনটা কী বেশি চোখে লাগছে?

s-s এর ছবি

পড়ছি, অনুবাদে কিছু আড়ষ্টতা এখনও আছে বলেই বোধ হ'লো। তারপরও ভালো লাগছে , পড়ছি.. ... ... ... ...

মামুন হক এর ছবি

অনুবাদে আড়ষ্টতা আসলেই আছে। আর আসলে নানা হাবিজাবিতে ব্যস্ত থাকার মাঝে এই কাজে হাত দিয়েছি, বলতে গেলে একটানে লেখা। পড়ে মূল্যবান মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আড়ষ্টতা কাটাতে চেষ্টা থাকবে, কোন টোটকা জানা থাকলে জানাবেন হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক মামা...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মামুন হক এর ছবি

চলবে মামুজান হাসি

সাইফ তাহসিন এর ছবি

চলুক তাড়াতাড়ি এইটা শেষ করেন, ভুইলা গেছি, আগে কি পরছিলাম।

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

মামুন হক এর ছবি

আচ্ছা, চেষ্টা করতেছি। অনেক ধন্যবাদ সাইফ।

মূলত পাঠক এর ছবি

এবারেরটা এক্ষুণি পড়তে পারলাম না সময়াভাবে, কিন্তু পরে পড়ে নিশ্চয়ই জানাবো কেমন লাগলো। আপনি লিখতে থাকুন।

মামুন হক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ পাঠকদা। তোমার উৎসাহেই কিন্তু শুরু করেছিলাম হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

ভালো লাগছে, অপেক্ষায় থাকছি পরের অংশের।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মামুন হক এর ছবি

ধন্যবাদ তুলিরেখা। ভালো থাকবেন হাসি

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

সুন্দর! (যথারীতি) চলুক
পাউলো মামায় পুরাই আধ্যাত্নিক! ইয়ে, মানে...

___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।