বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডঃ নানা প্রসঙ্গ

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি
লিখেছেন নুরুজ্জামান মানিক (তারিখ: রবি, ১৪/০৮/২০২২ - ৮:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাখি ডাকা ভোরে। বাংলাদেশের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে সেদিন পৈশাচিক উন্মত্ততায় হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনাক্রমে বঙ্গবন্ধুর দুই আত্মজা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাসভবনটিতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর পরিবারের যেসব সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তাদের মধ্যে রয়েছেন- ১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২) বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ৩) জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল ৪) মেজ ছেলে শেখ জামাল ৫) কনিষ্ঠপুত্র শিশু শেখ রাসেল ৬) বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসের ৭) বড় পুত্রবধূ সুলতানা কামাল খুকু ৮) মেজ পুত্রবধূ পারভীন জামাল রোজী ৯) গৃহকর্মী লক্ষ্মীর মা ১০) পোটকা ১১) কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা (নাম অজ্ঞাত) এবং ১২) বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল আহমেদ। এছাড়াও ওই রাতে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য আব্দুর রব সেরনিয়াবত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বাকশালের অন্যতম সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি এবং সন্তান সম্ভবা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, সেরনিয়াবতের ছোট মেয়ে বেবি সেরনিয়াবত, ছোট ছেলে আরিফ সেরনিয়াবত, নাতি শিশু সুকান্ত বাবু প্রমুখ।

পরিকল্পিতভাবে প্রায় একই সময়ে পৃথক তিনটি বাসভবনে একযোগে হামলা চালিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী খুনিরা ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ভোর ৫টার মধ্যেই তিন টার্গেট ঘেরাও করে ফেলে। আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর ফারুক যখন রক্ষীবাহিনীকে ঠেকাতে ব্যস্ত,ততক্ষণে সব টার্গেটে বিভিন্ন গ্রুপের অপারেশন শুরু হয়ে যায়। ১২টি ট্রাক ও কয়েকটি জিপ করে আক্রমণকারী ল্যান্সার ও আর্টিলারির প্রায় ৫০০ জন রাইফেলস ট্রুপস আশপাশ ঘিরে ফেলে। খুনিদের প্রধান টার্গেটই ছিল ৩২ নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি । খুনি মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা, মেজর পাশা, মেজর নূরের নেতৃত্বে আউটার ও ইনার দুটি বৃত্তে ঘেরাও করে ফেলে ওই বাড়ি । সেদিন হত্যাকান্ডের শুরু হয় শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে। প্রথম দফা আক্রমণের পর রাষ্ট্রপতির সহায়তায় সেনাবাহিনী এসেছে আশা করে শেখ কামাল সেনাদলকে ভেতরে ডাকার পরই খুনি হুদা তাকে গুলি করে । শেখ কামাল নিজের পরিচয় দিলে তাঁর উপর ব্রাশ ফায়ার করা হয় ।

বঙ্গবন্ধু যখন গোলাগুলির মধ্যে আক্রান্ত ছিলেন, তখন তিনি বাসা থেকে বিভিন্ন দিকে ফোন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করছিলেন,কিন্তু কেউ ফোন ধরছিল না। তিনি তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে ফোনে পেয়েছিলেন। তাকে বলেন,‘জামিল তুমি তাড়াতাড়ি আসো । আর্মির লোক আমার বাসা আক্রমণ করেছে । শফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো’। জামিল ফোন পেয়ে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে তাঁর প্রাইভেট লাল কার হাঁকিয়ে ছুটে যান, ৩২ নম্বর রোডে, কিন্তু সৈন্যদের গুলিতে বাসার কাছেই তিনি নিহত হন। সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে বঙ্গবন্ধু ফোনে বলেন, ‘শফিউল্লাহ,আমার বাসা তোমার ফোর্স অ্যাটাক করেছে। কামালকে হয়তো মেরেই ফেলেছে। তুমি তাড়াতাড়ি ফোর্স পাঠাও’। শফিউল্লাহ জবাবে বললেন ,’স্যার, ক্যান ইউ গেট আউট, আই আয়াম ডুয়িং সামথিং?’

মেজর মহিউদ্দিন তাঁর ল্যান্সারের ফোর্স নিয়ে গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দোতলার দিকে যায়। খুনি হুদা এবং নূর যখন সিড়ির চৌকির ওপরে, তখন আগেই দু’তলায় যাওয়া মেজর মহিউদ্দিন ও তাঁর ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে নিচের দিকে নামিয়ে আনছিল। খুনি মেজর নূর ইংরেজিতে কিছু বললে খুনি মেজর মহিউদ্দিন এবং তার ফোর্স একপাশে চলে যায় । এই সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, তোরা কি চাস ? সঙ্গে সঙ্গে খুনি নূর এবং হুদা স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে । সিড়ির ওপর লুটিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু, সেসময়ই তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন । শুধু জাতির জনক নন, সেদিন আসলে পুরো জাতিই লুটিয়ে পড়েছিল ।

ইতোমধ্যে হত্যা মিশনের গ্রুপ কমান্ডার মেজর ডালিম তার অপারেশন শেষ করে রেডিও সেন্টারে এসে ঘোষণা দিলেন, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারি শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। জননেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে এবং সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র’। এর মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় খুনি খন্দকার মোশতাকের ভাষণ । তাহেরউদ্দিন ঠাকুর নিজেই ঐ ভাষণ লিখে দেন । সকাল আনুমানিক ৮টার দিকে খুনি মোশতাকের কন্ঠে ভাষণটি রেকর্ড করে প্রচার করা হয়। সকাল ৯টার দিকে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, পুলিশ প্রধান নুরুল ইসলাম এবং রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান মেজর হাসান সেখানে এসে রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে খুনি মোশতাকের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন । পরে বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানেও তারা সকলেই যোগ দেন । রেডিও স্টেশনে সেসময় মেজর জেনারেল জিয়া ছাড়াও কর্নেল (অবঃ) তাহের এবং জেনারেল (অবঃ) ওসমানী উপস্থিত ছিলেন ।

দুপুর বেলা জুম্মার নামাজের আগেই খুনি মোশতাক বিরাট মিছিল সহকারে বঙ্গভবনে যান। সবাই বঙ্গভবনে একত্রে জুম্মার নামাজ আদায় করেন। এরপর তিন বাহিনী প্রধান, বিডিআর প্রধান এবং অন্যান্য সিভিল গণ্যমান্য ব্যক্তবর্গের সামনে খুনি মোশতাক শপথ গ্রহণ করেন । উপস্থিত সবাই ছুটে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। এরপর খুনি মোশতাক তার মন্ত্রীসভার সদস্যদের শপথ গ্রহণ করান। প্রায় সবাই পুরাতন মাল। পুরাতন আওয়ামী লীগ/বাকশালের মন্ত্রীসভার কয়েকজন বাদে সবাইকে নিয়েই নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করলেন খুনি মোশতাক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের লাশ তখনো তার বাসভবনের সিড়িতেই পড়ে রইল, তার কথা সবাই ভুলেই গেছে। বঙ্গভবনে চলছে আনন্দ উল্লাস, খানাপিনা!

ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ করায় খুন হন বঙ্গবন্ধুঃ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হিসেবে জনপ্রিয় ভাষ্যগুলো হচ্ছে, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, এক বিয়ের অনুষ্ঠানে মেজর ডালিমের হেনস্থা হওয়া, পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি চালু করা বাকশাল শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি। কিন্তু এর সবকটি ঘটনার আগেই আমরা দেখতে পাই খুনি চক্রের প্রধান মেজর ফারুক ঢাকার মার্কিন দুতাবাসে হাজির হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের অগোচরে ১৯৭২ সালেই ফারুক ঢাকার মার্কিন দুতাবাসে গিয়েছিলেন অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে আলোচনা করতে। এরপর বছর না ঘুরতেই ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই একইভাবে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য মার্কিন দুতাবাসে যান আরেকজন মেজর। তিনি ফারুকের ভায়রা ভাই মেজর রশীদ । দুজনই বঙ্গবন্ধু হত্যাকা হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। অধিকন্তু মেজর ফারুক আর তার মামা নুরুল কাদের খান ১৯৭৩ সালেই মেজর নাসিরকে তাদের অভ্যুত্থান পরিকল্পনার কথা জানান! সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র বেশ পুরনো। জনপ্রিয় ভাষ্যগুলো অবান্তর। তাহলে প্রশ্ন হলো কেন খুন হলেন বঙ্গবন্ধু ? মিজানুর রহমান খানের ‘মার্কিন দলিলে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যাকাণ্ড’ গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, পঁচাত্তরের খুনি চক্রের প্রধান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কর্নেল ফারুকের মতাদর্শগত ভণ্ডামি ও সন্ত্রাসী চিন্তাচেতনা সংক্রান্ত একটি চাঞ্চল্যকর নতুন দলিলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এতে সুনির্দিষ্টভাবে দাবি করা হয়েছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র না করে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার কারনেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছেন তিনি । ব্রিটেনের জাতীয় মহাফেজখানা থেকে উদ্ধার করা ওই গোপন নথিতে দেখা যায়, ফারুক ১৯৭৬ সালে লিখেছেন, একাত্তরের মূল চেতনা ছিল ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা । শেখ মুজিবকে মানুষ সে কারণেই নেতার আসনে বসিয়েছিলেন । কিন্তু যুদ্ধ শেষে তিনি মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন । তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন । আর সে কারণেই তিনি ‘আল্লাহর প্রেরিত বান্দা’ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেন । এর মূল দায় তার, তিনিই এ বিষয়ে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করবেন। (পৃ ১৩২)

খুনি ফারুক এখানে চরম মিথ্যাচার করেছেন। ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার কোনও চেতনা একাত্তরে ছিল না বরং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা বঙ্গবন্ধুর নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কোন গণতন্ত্রমনা ও শুভবোধ সম্পন্ন মানুষের আপত্তি থাকার কথা নয় ।

ভুট্টো ও পাকিস্তানের ভূমিকা:

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ভুট্টোর মনোভাব বা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কি ছিল তার এক বর্ণনা পাওয়া যায় তার কন্যা বেনজীর ভুট্টোর জবানীতে। মুনতাসির মামুন ও মহিউদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে এক সাক্ষাতকারে বেনজীর ভুট্টো বলেছেন, সেই রাতে আমরা রাওয়ালপিণ্ডিতে প্রধানমন্ত্রী ভবনে ছিলাম । বাবা আমার দরজায় নক করলেন , আমাকে তার ঘরে যেতে বললেন । বাবা বললেন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে । বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট তাদের লোকের হাতেই নিহত হয়েছেন। ঘটনাটা আমাদের কাছে খুবই মর্মান্তিক ও ভয়ঙ্কর মনে হলো । জানা গেল তার স্ত্রীকেও হত্যা করা হয়েছে । আস্তে আস্তে আমরা জানতে পারলাম তার শিশু সন্তানকেও খাটের নিচ থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে । আমরা খুবই শ্রদ্ধাভরে প্রবল আত্মবিশ্বাসি এক রাজনীতিক শেখ মুজিবকে স্মরণ করলাম’ । বেনজীরের এই বয়ানের সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ নেই তবে সেই রাত পোহাতেই জুলফিকার আলী ভুট্টো যেসব পদক্ষেপ নেন তা ছিল শোকগ্রস্ত হবার সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৬ আগস্ট ভুট্টোর পাকিস্তান সরকার খুনি মোশতাকের সরকারকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেয় । স্বীকৃতির সঙ্গে নজরানাও ছিল। বিবৃতিতে ভুট্টোর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়: As a first and spontaneous gesture to the fraternal people of Bangladesh, I have decided to immediately dispatch to Bangladesh as a gift from the people of Pakistan 50,000 tons of rice, 10 million yards of long cloth and five million yards of bleached mull. This is only a modest contribution of our people to our brothers in Bangladesh in their hour of need. We are prepared to make a greater contribution within our greater capacity for the well being of the people of Bangladesh with whom we have shared common nationhood and destiny. Let the world know that we stand together in weal and woe. We respectfully urge the state members of the Islamic conference to accord recognition to the new government of the Islamic Republic of Bangladesh and we appeal to all countries of the third world to do likewise. This appeal stems from our anguished awareness of how our country has dismembered by an international conspiracy culminating in aggression. I grieve that Sheikh Mujibur Rahman and members of his family have met a tragic end.

মার্কিন দলিল সূত্রে জানা যায়, পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ভুট্টো । তার উত্তেজনা এতটাই তীব্র হয়েছিল যে তিনি বাংলাদেশের নাম পালটে ইসলামি প্রজাতন্ত্র রাখেন এবং শিশু ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে বাঁচাতে মুসলিম বিশ্বের প্রতি আবেদন জানান। পাকিস্তানি জনগণ ও সৌদি আরবকে তিনি মোহবিষ্ট করেছিলেন এই ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কল্পিত বুলি দিয়ে । অবশ্য ভারতের চাপের কারণে খুনি চক্রের বা ভুট্টোর সাধের ইসলামি প্রজাতন্ত্র বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি । তবে, পাকিস্তানিকরণ শুরু হয়েছিল সফলভাবে যা চলে জিয়া-এরশাদের আমল পর্যন্ত । এখনো যার জের চলছে ।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড-সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা প্রসঙ্গ:

১৯৯৮ সালের ৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- মামলার রায়ের শেষদিকে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল লিখেন,‘প্রাসঙ্গিকভাবে ইহা উল্লেখ না করিয়া পারা যায় না যে, এই মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ বিশেষ করিয়া যাহারা ঢাকায় অবস্থান করিতেছিলেন, তাহারা তাহাদের দায়িত্ব পালন করেন নাই, এমনকি পালনের কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করেন নাই, যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও । ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন আদেশ পাওয়ার পরও তাহার নিরাপত্তার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। সাক্ষ্য প্রমাণে ইহা পরিষ্কার যে, মাত্র দুইটি রেজিমেন্টের খুবই অল্প সংখ্যক জুনিয়র সেনা অফিসার/সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেন এই কতিপয় সেনা সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ /নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে নাই তাহা বোধগম্য নয়। ইহা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে’।

খুনি কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষীদের সাক্ষ্যের লাইনে লাইনে ফুটে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক সেই ব্যর্থতার কথা। সেই ব্যর্থতার বিষয়গুলো বিচার বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, যাদের দেশের রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা ছিল তারা কেন ব্যর্থ হয়েছেন অথবা ব্যর্থ হওয়ার ভান করেছেন। আসুন পর্যায়ক্রমে জেনে নেয়া যাক সে সময় সিনিয়র আর্মী অফিসারদের ভূমিকা ও দায়ের ইতিহাস। প্রথমেই আমরা নজর দিব তৎকালীন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর ওপর। জানা যায়, ১৪ আগস্ট দুটি অনাকাংখিত ঘটনা ঘটে। এক দুপুরে বঙ্গবন্ধু যেখানে বক্তৃতা দেবেন সে জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। গুজব ছিল যে, ১৫ আগস্ট জাসদ ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে প্রতিবাদ মিছিল করবে। গুজব ছিল, রাষ্ট্রপতিকে হত্যার চেষ্টাও হতে পারে । অনুমান জাসদই এই কা- ঘটিয়েছিল। ওই সময় এ ধরনের ঘটনা মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট প্রশিক্ষিত পুলিশ ছিল না। একইদিন দুপুরে ফেনীতে ভারতীয় একটি হেলিকপ্টার বিধস্ত হয়। ফলে এসব ঘটনা মোকাবিলার দায়িত্ব বর্তায় সেনাবাহিনীর উপর । শফিউল্লাহ কুমিল্লা গ্যারিসনের কমান্ডারকে নির্দেশ দেন ভারতীয় পাইলটদের মৃতদেহ উদ্ধারে। আর কর্নেল জামিলকে দায়িত্ব দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা সমন্বয় করার। জামিলের সঙ্গে রউফও এ কাজে যোগ দেন। এ সমস্ত কিছু পর্যালোচনা ও সমন্বয়য় করতে করতে বেশ রাত হয়ে যায়। শফিউল্লাহ বেশ রাতে ঘুমাতে যান। পরদিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট ভোর সোয়া পাঁচ বা সাড়ে পাঁচটার দিকে তার ব্যাটম্যান হাবিলদার হায়দার আলী তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। দরজা খুলে তিনি দেখেন মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক লে. কর্নেল সালাহউদ্দিন ইউনিফর্ম পরে স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে। শফিউল্লাহ জানতে চান, এ রকম পোশাক পরে আসার হেতু কি ? সালাহউদ্দিন সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জানতে চান, তিনি কি আর্মড ও আর্টিলারি ইউনিটকে শহরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন? শফিউল্লাহ জানালেন, তিনি এ ধরনের কোনো নির্দেশ দেননি। সালাহউদ্দিন জানালেন, ওই দুটি ইউনিট শহরে মুভ করেছে এবং গণভবন,রেডিও স্টেশন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করেছে। শুধু তাই নয়, কয়েকটি ট্যাঙ্কও ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। ‘এ অবস্থায় আমার কি করার ছিল ?’ শফিউল্লাহ প্রশ্ন করেছেন নিজেকে। দুটি পন্থা ছিল। এক যা ঘটছে রাষ্ট্রপতিকে তা অবহিত করা এবং দুই ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার যিনি ফোর্সের কমান্ডার তাকে নির্দেশ দেয়া যারা এগুলো করছে তাদের প্রতিহত করার’। সালাহউদ্দিনকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, শাফায়াত জামিল কি ঘটনা জানেন ? সালাহউদ্দিন জবাব দিলেন, তা তিনি বলতে পারবেন না। কারণ খবর পেয়েই তিনি তার বাড়িতে ছুটে এসেছেন। তিনি সালাহউদ্দিনকে নির্দেশ দিলেন দ্রুত গিয়ে শাফায়াতকে যেন ১, ২ ও ৪ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টকে তাদের প্রতিহত করতে বলে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করার জন্য ঢাকায় ওই তিনটি রেজিমেন্টকে মোতায়েন করা হয়েছিল। এ নির্দেশ দিয়ে তিনি দ্রুত লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করলেন । রেড টেলিফোন এনগেজড । তখন সাধারণ টেলিফোনে ফোন করলেন । সেটিও এনগেজড । সময় বাঁচাবার জন্য স্ত্রীকে লাল টেলিফোনে রিং করে যেতে বললেন । তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন অন্য টেলিফোনে শাফায়াতকে ধরার । তার টেলিফোনও এনগেজড । তখন তার বাড়ির এক্সচেঞ্জকে বললেন, যেভাবেই হোক শাফায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করার। অন্য টেলিফোনে তিনি অন্যান্য অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে লাগলেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি যোগাযোগ করতে পারলেন কর্নেল জামিলের সঙ্গে । জামিল জানালেন, রাষ্ট্রপতি তাকে টেলিফোন করে বলেছেন জলদি তার বাসায় যেতে। কারণ তিনি বিপদ আশঙ্কা করছেন। শফিউল্লাহ জানালেন, সালাহউদ্দিনের কাছ থেকে তিনি ঘটনা জেনেছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন, পারছেন না । জামিল যেহেতু যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতির বাসায় তিনি যেন রাষ্ট্রপতিকে জানান শাফায়াতকে মুভ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে । সুতরাং সম্ভব হলে রাষ্ট্রপতিকে যেন বাসা থেকে নিরাপদ কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় । জামিল জানালেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসায় পোঁছে সে চেষ্টা করবেন। কর্নেল জামিলের সঙ্গে কথা শেষ করে তিনি শাফায়াতকে ধরার চেষ্টা করলেন। তাকে পেলেন । শফিউল্লাহ লিখেছেন তার গলার স্বর অদ্ভুত বা ঘুম ঘুম লাগছিল, হয়তোবা চিন্তা থেকে। কোনো সময় নষ্ট না করে তিনি জানতে চাইলেন, ঘটনা যা ঘটছে শাফায়াত কি তা জানেন ? শাফায়াত জানালেন, তিনি জানেন না। শফিউল্লাহ তাকে আবারো সেই নির্দেশ দিলেন এবং মনে হলো শাফায়াত তা বুঝেছেন। শাফায়াত পরে বলেছেন, তিনি কোনো নির্দেশ পাননি । লিখেছেন শফিউল্লাহ, ‘তবে এটুকু স্বীকার করেছেন ওই দিন সকালে তিনি আমার ফোন পেয়েছিলেন । আমি তাকে সে নির্দেশ না দিলে অত সকালে কি কারণে ফোন করেছিলাম ? তাকে কি নির্দেশ দেয়ার জন্য ফোন করিনি?’ ঢাকা ব্রিগেডকে এই নির্দেশ দেয়ার পর বিমানবাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার ও নৌপ্রধান এম এইচ খানকে ফোন করে ঘটনা জানান। তারাও কিছু জানেন না । তারপর জিয়াকে ফোন করেন , শফিউল্লাহ লিখেছেন, ‘জিয়ার গলার স্বর শুনে মনে হলো সেও প্রথমবার খবর শুনেছে। জিয়া শুধু বললেন, ‘ইজ ইট সো!’ এরপর খালেদ মোশাররফকে ফোন করলেন । তিনিও মনে হলো, খবরটি শফিউল্লাহর কাছ থেকেই জানলেন । এরপর রউফের বাসায়, সেখানে কেউ ফোন ধরলেন না । শফিউল্লাহ যখন এদের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন তার স্ত্রী প্রাণপণে লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে ধরার চেষ্টা করছেন । এবার শফিউল্লাহ চেষ্টা করতে লাগলেন । খুব সম্ভব ছয়টা বাজার কয়েক মিনিট আগে তিনি লাইন পেলেন। বঙ্গবন্ধুই ফোন ধরেছেন । শফিউল্লাহর গলা শুনে উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘শফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি এটাক করছে-কামালরে বোধহয় মাইরা ফেলছে-তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও’ । শফিউল্লাহ লিখেছেন, ‘আমি শুধু বলতে পারলাম, ‘আমি কিছু করার চেষ্টা করছি, আপনি কি বাসা থেকে বেরুতে পারবেন?’ রাষ্ট্রপতি কোনো জবাব দিলেন না । আমি হ্যালো হ্যালো বলতে লাগলাম । মনে হলো, তার সামনে কেউ আছে যে জন্য তিনি জবাব দিতে পারছেন না । আমার আরো মনে হলো, তিনি ফোনটি টেবিলে নামিয়ে রেখেছেন কারণ এর ৩০ কি ৪০ সেকেন্ড পর টেলিফোনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ পেলাম। এরপর প্রায় এক মিনিটের মধ্যে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হইয়ে গেল’ । শফিউল্লাহ ভেবেছেন কেন বঙ্গবন্ধু তাকে সরাসরি ফোন করলেন না। তিনি অন্যদের সঙ্গে নিশ্চয় যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন । কারণ তার টেলিফোন সব সময় ব্যস্ত ছিল । বা তিনি চেষ্টা করছিলেন কিন্তু শফিউল্লাহর ফোন ব্যস্ত ছিল । বা এমনো হতে পারে, তার বাসায় সৈন্যসামন্ত দেখে তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন শফিউল্লাহর ওপর। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলার পর শফিউল্লাহ নিশ্চিত হতে চাইলেন শাফায়াত সম্পর্কে। শাফায়াত কি সৈন্য পাঠিয়েছে ? তার টেলিফোন ব্যস্ত । অপারেটরকে বললেন, তিনি অন্য লাইনে কথা বলতে থাকলে তা কেটে যেন তার লাইন দেয়া হয় । কিন্তু তার টেলিফোন এনগেজড। শফিউল্লাহর মনে হলো, হয় সেটের টেলিফোন ঠিক করে রাখা হয়নি অথবা বিদ্রোহী সৈন্যরা তাকে নিশ্চল করে ফেলেছে । ‘কিন্তু পরে দেখা গেল, আমার দুটি ধারণাই ভুল’। লিখেছেন শফিউল্লাহ , ‘তার পরবর্তী কার্যকলাপে প্রমাণ করেছে তিনি ঠিক পথে চলেননি। তিনি সৈন্য চলাচলের নির্দেশ না দিয়ে চুপ করে ছিলেন। তিনি আমার নির্দেশ শোনেননি’। পরে শফিউল্লাহ জেনেছেন, বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক, কর্নেল জামিল এবং আরো কয়েকজনকে ফোন করেছিলেন। শফিউল্লাহ আফসোস করে লিখেছেন, তার সঙ্গে খানিকটা আগে যোগাযোগ করলে হয়তো তিনি খানিকটা সময় পেতেন কিছু করার । কারণ তিনি যখন খবর পেয়েছেন তখন হত্যাকারীরা ৩২ নম্বরের পথে । সৈন্য দেখেই বঙ্গবন্ধু তার ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন। কিন্তু তার ফোন পাওয়ার পর হয়তো তিনি বুঝেছিলেন শফিউল্লাহ এর সঙ্গে জড়িত নয় । লিখেছেন তিনি, ‘আগে পরে আমাদের সবাইকে মরতে হবে । আমার এইটেই সান্ত্বনা যে, বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে অন্তত এটুকু জেনে গেলেন যে, শফিউল্লাহ তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেনি’ ।

দেখা যাচ্ছে শফিউল্লাহ তার ব্যর্থতার দায়ভার শাফায়াত জামিলের উপর চাপিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন শাফায়াতকে নির্দেশ দেয়ার যা শাফায়াত পালন করেনি যদিও শাফায়াত বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন । এখানে শফিউল্লাহর যে বড় ভুল তা হলো তিনি যখন দেখলেন যে কোনও কারণেই হোক শাফায়াত জামিল তার সৈন্য মুভ করছে না, তখন তিনি মাত্র পাঁচশ গজ দূরে অবস্থিত শাফায়াতের হেড কোয়ার্টারে একে ওকে না পাঠিয়ে নিজেই ছুটে গিয়ে শাফায়াতের সৈন্য মুভ করাবার ব্যবস্থা নিতে পারতেন। এখানে তিনি চরম মুহুর্তে টেলিফোন ও কথাবার্তায় অযথা সময় নষ্ট করেছেন। কিন্তু একটি সৈন্যও ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুভ করাতে পারলেন না । এখানে সেনাপ্রধান দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছেন । অবশ্য অন্যদের মতো তাকে বিশ্বাসঘাতক, কুচক্রি বা ষড়যন্ত্রী বলা যায় না। কারণ খুনি ফারুক-রশীদের সাথে অনেকের পূর্ব যোগাযোগের তথ্য থাকলেও শফিউল্লাহর সাথে ছিল না । ক্যুর ব্যাপারে তিনি আগাম কিছু জানতেন না। তিনি দুটো ভুল করেছেন এক. অহেতুক এখানে সেখানে কল করে সময়ের অপচয় আর দুই. খুনি ডালিম-রশীদের চাপে পড়ে অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক খুনি মোশতাকের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা ।

এবার নজর দেয়া যাক, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়ার কর্মকান্ডের ওপর। ১৫ আগস্ট সকালে খুনি রশীদের কাছে বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার খবর পেয়ে শাফায়াত জামিল ছুটে যান জিয়ার বাসায় । শাফায়াত লিখেছেন, ‘কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কাধাক্কির পর দরজা খুললেন ডেপুটি চিফ স্বয়ং। অল্প আগে ঘুম থেকে ওঠা চেহারা । সিøপিং ড্রেসের পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে। একদিকের গালে শেভিং ক্রিম লাগানো, আরেক দিক পরিষ্কার । এত সকালে আমাকে দেখে বিস্ময় আর প্রশ্ন মেশানো দৃষ্টি তার চোখে। ভয়ংকর খবরটা দিলাম তাকে। রশীদের আগমন আর চিফের সঙ্গে আমার কথোপকথনের কথাও জানালাম । মনে হলো জিয়া একটু হতচকিত হয়ে গেলেন । তবে বিচলিত হলেন না তিনি । নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, President is dead, so what? Vice President is there. You should uphold the sanctity of the constitution. Get your troops ready immediately.’ বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা শুনে এই ছিল জিয়ার প্রতিক্রিয়া ! বস্তুত জিয়া শফিউল্লাহ বা শাফায়াতের সাথে অবাক হবার ভান করেছেন। ক্যুর আগাম সংবাদ তার কাছে ছিল । খুনি ফারুক-রশীদের ভাষ্য অনুসারে তারা আগেই জিয়াকে তাদের ক্যুর পরিকল্পনার কথা জানান । ২০ মার্চ, ১৯৭৫ জিয়ার সাথে সরকার পরিবর্তন নিয়ে পরামর্শ করতে গেলে জিয়া খুনি ফারুককে বলে দেন ‘সিনিয়র হিসেবে এ ধরনের কিছুর মধ্যে তিনি জড়াতে চাননা, জুনিয়ররা কিছু করতে চাইলে নিজেদের করা উচিত’ । প্রশ্ন হলো জুনিয়রদের কাছে সরকারের উৎখাতে ক্যুর পরিকল্পনা কথা শুনে তিনি তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করেছিলেন ? এই চেপে যাওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু সেনা আইনে গর্হিত অপরাধ । নাকি তিনি নিজেও ষড়যন্ত্রীদের একজন । যথাযথ তদন্তের মাধ্যমেই সত্য উন্মোচিত হবে একদিন । বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি যে জিয়া সেটা বলাবাহুল্য। ক্যুর ৯দিনের মাথায় তিনি সেনাপ্রধান হন আর ৭ নভেম্বর জাসদের কর্নেল তাহেরের কথিত বিপ্লবে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে যান ।

এবার আসা যাক চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদের বেলায় । ৭৫ এর মার্চে মহড়ার জন্য ৬টি ট্যাঙ্ক নিয়ে চিটাগাং এ যাবার আগে ফারুক একটা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলো, তা জানিয়েছিল মেজর নাসিরকে। মেজর নাসির জানিয়েছিলেন সিজিএস ব্রিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে। খালেদ এটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর বদলে ধামাচাপা দিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে খালেদ মোশাররফ তখন সিজিএস, এর পরবর্তী আর্মি চীফ হবার ক্যান্ডিডেট হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। তিনি তার অধীনস্ত একজন কর্মকর্তার এমন চরম শাস্তিযোগ্য বিদ্রোহী আচরণকে রিপোর্ট করা তো দূরের কথা, নিজেও কোন ব্যবস্থা নেন নি, কিংবা তাকে শান্ত করতে কোন ব্যবস্থা নেন নি, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তার প্রমাণ। সেদিন ফারুককে বিধি মোতাবেক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসলে কি ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ড ঘটার সুযোগ ৫০ ভাগ কমে যেত না? সুতরাং ১৫ আগষ্টের ঘটনা সম্বন্ধে খালেদ মোশাররফ আগে থেকেই জানতেন, হয়তো জানতেন না কবে ঘটানো হবে। উপরন্তু ১৫ আগস্ট দুপুরে ফারুকের জন্য চীফ শফিউল্লাহর নির্দেশ ছাড়াই ট্যাংকের গোলাবারুদ সরবারহের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ফারুকের সাথে খালেদের সংশ্লিষ্টতা কিংবা ফারুকের কাজের প্রতি খালেদের সমর্থন দিবালোকের মত স্পষ্ট হয় । এ প্রসঙ্গে শফিউল্লাহ লিখেছেন, When Brig. Khaled was informed that the rebel troops of the tank regiment did not have main gun ammunition in their tanks, that was the time he should have acted and hold them . He instead of taking any action to hold them , issued ammunition to them without even consulting me. Thereby Brig. Khaled earned their goodwill. Am I wrong to hold this view? These troops were still rebel soldiers and how could CGS issue ammunition to the rebel troops? Therefore, would I be wrong to say that Brig. Khaled also wanted to be on their side.

খালেদের সংশ্লিষ্টতার আরেকটি প্রমান পাওয়া যায় ১৫ আগস্ট সকালে তার কর্মতৎপরতায়। শাফায়াত জামিলের ৪৬ ব্রিগ্রেড গিয়ে এর নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেন খালেদ, কিন্তু একজন সৈন্যও ফারুক-রশিদের বিরুদ্ধে নড়েনি। তখন ফারুক-রশিদের বিরুদ্ধে ৪৬ ব্রিগ্রেডই ছিলো একমাত্র ভরসা! খালেদের এই পদক্ষেপ ৪৬ ব্রিগ্রেডকে ফারুক-রশিদের ইউনিটের বিরুদ্ধে ব্যবহারের যে কোন চেষ্টা নসাৎ করে ক্যু-পরবর্তী পরিস্থিতি তাদের অনুকুলে রাখার সুপরিকল্পিত কৌশল বলে সহজেই ধরে নেয়া যায়। যদিও সেনাপ্রধানের নির্দেশে ফোর্স মুভ করানোর জন্য খালেদ ৪৬ ব্রিগ্রেডে গিয়ে নাকি আটকে গিয়েছিলেন, তাকে নাকি ওরা (শাফায়াত) যেতেও দিচ্ছে না কিংবা কিছু করতেও দিচ্ছে না ! ১৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য রক্ষীবাহিনীকে নিস্ক্রিয় করে ফেলাও গুরুত্বপূর্ণ এটি ধাপ ছিলো, ফারুক যার ৫০ ভাগ কাজ এগিয়ে নেয় ভোরেই গোলাবিহীন ট্যাংকের ভয় দেখিয়ে, আর বাকীটা করেন খালেদ মোশাররফ রক্ষী বাহিনীর দুজন লিডার আনোয়ার উল আলম ও সারোয়ার হোসেনকে একটা বাক্য দিয়ে, I know you are patriots, but we had to do it because we do not want this country to be a kingdom ! এমনকি রক্ষী বাহিনীকে মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার জন্য জোরাজুরিও করেন খালেদ মোশাররফ ।

কর্নেল শাফায়েত জামিলের ব্যাপারে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ হিসেবে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়। প্রথমতঃ ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ফোন করেন শাফায়াত জামিলকে তার ৪৬ ব্রিগ্রেড নিয়ে বিদ্রোহীদের প্রতিহত করার জন্য। যদিও জামিলের মতে শফিউল্লাহ বিড়বিড় করেছেন, স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। শফিউল্লাহ পরবর্তীতে জামিলকে ফোন করে পাননি, কারণ জামিল নাকি টেলিফোনের রিসিভার উঠিয়ে রেখেছিলেন! দ্বিতীয়তঃ ১৫ আগস্ট ভোর রাতে শাফায়াত জামিলের বাসস্থান এর পেছনের রাস্তা দিয়েই ঘড় ঘড় শব্দ তুলে ফারুকের ট্যাংক বহর শহরের দিকে যেতে থাকে। এত শব্দেও শাফায়াত জামিলের নিদ্রাভংগ হয়নি, কিংবা প্রশ্ন জাগেনি। যদিও শাফায়াত জামিল বলতেই পারেন, ১ম বেংগল ল্যান্সার ও টু ফিল্ড আর্টিলারী একত্রে মহড়া করবে এটা তিনি জানতেন। তাই এ নিয়ে প্রশ্ন জাগেনি। তারপরও ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাপ্রধানের ফোন পাবার পরও শাফায়াত জামিলের নিস্ক্রয়তা ফারুক-রশিদের পরিকল্পনা সঠিক ভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করেছে এই নিয়ে সন্দেহ নেই। খালেদ সেনাপ্রধানের কাছে অভিযোগও করেছিলেন, ৪৬ ব্রিগেডের কেউ তাকে যেতে দিচ্ছে না, কিছু করতেও দিচ্ছে না । আর কর্নেল হামিদের স্মৃতিকথায় জানা যায়,ফারুক যে কিছু একটা করবে এটা নিয়ে সেনানিবাসে আগে থেকেই কানাঘুষা ছিলো। জামিলের নিস্ক্রিয়তার পেছনে এমন পূর্বধারনার কোন প্রভাব ছিলো কি? কর্নেল হামিদ তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন ১৫ আগস্ট সারাদিন জামিল খোশমেজাজে ছিলেন এবং কর্নেল হামিদকে বলেন, “দেখলেন স্যার, ফ্রিডম ফাইটার্স হ্যাভ ডান ইট বিফোর, এন্ড দে হ্যাভ ডান ইট এগেইন!” উল্লেখ্য, শাফায়াতের অধীনে ছিল প্রায় ৪ হাজার সৈন্য । তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেই যে, সেনাপ্রধান তাকে কোনো নির্দেশ দেননি তবুও প্রশ্ন জাগে রাষ্ট্রপতির ভবন আক্রান্ত হয়েছে এই খবর পাবার পর ইন্ডিপেনডেন্ট ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াতের কি বিপদগ্রস্ত রাষ্ট্রপতির সাহায্যার্থে তৎক্ষণাৎ সৈন্য মুভ করা উচিত ছিল না ? সেনাপ্রধান কি তাকে একশনে যেতে নিষেধ করেছিলেন ?

সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে বিদায়ী ডিএফআই (বর্তমানে ডিজিএফআই) প্রধান ব্রিগ্রেডিয়ার আব্দুর রউফের ভুমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ কয়েকটি কারণে। এক, ১৫ আগস্ট রাতে ফারুক-রশিদের সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের খবর পেয়েও তড়িৎ কোন ব্যবস্থা না নিয়ে নিজের প্রাণ বাচাতে কিংবা দায়িত্ব এড়াতে পরিবারসহ বাসার পেছনে লুকিয়ে ছিলেন, এবং ভোর ৬.৩০ টায় লুংগী পরিহিত অবস্থায় সেনাভবনে হাজির হন। তিনি মাঝরাতেই তৎক্ষনাৎ আর্মি চীফ শফিউল্লাহকে জানালে হয়তো কিছু হতে পারতো । দুই, নতুন গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমেদ নিয়োগ পেলেও অসন্তষ্ট রউফ দায়িত্ব হস্তান্তরে গড়িমসি করছিলেন, শেষে ১৫ আগস্ট দায়িত্ব হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয় । তিন, এত বড় একটা ঘটনার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির কোন খবরই কি ডিএফআই পায়নি? নাকি পেয়েও চুপ করে ছিলো ? যেখানে ফারুকের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো, সেখানে তার কর্মকান্ড সম্বন্ধে খোজ রাখা তো ডিএফআই এর দায়িত্ব ছিলো। বস্তুতঃ উপরোক্ত ঘটনাগুলো বিচার করলে ১৫ আগস্টের ঘটনায় ব্রিগ্রেডিয়ার রউফের সংশ্লিষ্টতার যথেষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৫ আগস্টের ঘটনায় আরেকজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার ক্লু না পাওয়া গেলেও, ক্যু পরবর্তী তার কর্মকান্ড যথেষ্ট বিস্ময় জাগানিয়া। তিনি হলেন তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। প্রেসিডেন্টের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছাত্র জীবনে কলকাতার বেকার হোস্টেলে থাকার সময় থেকেই খুব ভালো ছিলো। খলিল পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে হতে চেয়েছিলেন সেনাপ্রধান, জেনারেল ওসমানীর সুপারিশ ছিলো, হতে পারেননি, বদলে পেয়েছিলেন বিডিআর এর প্রধানের দায়িত্ব। ওসমানীর সাথে ছিলো ভালো সম্পর্ক। সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অফিসারদের প্রতি তার বিরাগ ছিলো, সেটা লুকাননি তার বইয়ে । ১৯৭৫ এর আগস্টে শফিউল্লাহ ২য় মেয়াদের জন্য সেনাপ্রধান হওয়ায় তার সেনাপ্রধান হবার আশা আর ছিলো না। তাহলে কি ১৫ আগস্ট তার মৃতপ্রায় ক্যারিয়ারে নতুন সুযোগ এনে দিয়েছিলো? এবং তা হয়েও ছিলো। পাকিস্তান ফেরত এই কর্মকর্তাকে ফারুক-রশিদ কেউ যে আস্থায় আনার প্রয়োজন করেনি সেটা ধারনা করা যায়, তবে এই ব্যক্তি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকাল থেকেই মোশতাক আর ওসমানীর সাথে মিলে তার ক্যারিশমা দেখিয়েছেন ৫ নভেম্বর পর্যন্ত। এবার আর আর্মি চীফ না, বরং মোশতাক তিন বাহিনী প্রধানদের উপরে তাকে বসিয়েছিলেন চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ হিসেবে । কোন চুক্তিতে বা ভরসায়? খলিল তো শেখ মুজিবর রহমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন! ১৫ আগস্ট সকালে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা পিলখানায় রক্ষিত নিজেদের অস্ত্র আনতে গেলে খলিল সাহেব তাতে বাঁধা দেন, তবে এটা হয়তো সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য করে থাকতে পারেন।

ভারতে থাকার কারণে কর্নেল মঞ্জুর ও এরশাদের সংশ্লিষ্টতার কোন মোটিভ বা ক্লু পাওয়া যায় না। তবে দুজনেই ১৫ আগস্টের পর ভারত থেকে দেশে ফিরেছিলেন, আবার ধমক খেয়ে ফিরেও গিয়েছিলেন। তবে ফারুক-রশিদের সাথে এরশাদের সমাঝোতা থাকার সম্ভাবনা প্রবল, কারন ৭৫ এর ১৮ আগস্ট দেশে ফিরে এরশাদ নিষেধ স্বত্ত্বেও গনভবনে গিয়ে ফারুক-রশিদের সাথে দেখা করেন । জিয়ার আমলে ফারুক-রশিদসহ বাকীদের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে চাকুরী দেয়ার সুপারিশেও এরশাদ ছিলেন, আবার তার শাসনামলেই ফারুক-রশিদ বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করার সুযোগ পায়।

১৫ আগস্টের ঘটনায় আর কোন সিনিয়র অফিসারদের সংশ্লিষ্টতার ক্লু না পাওয়া গেলেও দুজন সিনিয়র সেনা অফিসার স্পষ্ট ভাবেই এই ঘটনার বিরুদ্ধে ছিলেন, দুজনের কেউই মুক্তিযোদ্ধা নন বরং পাকিস্তান ফেরত। একজন তৎকালীন কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমেদ, যিনি ছিলেন প্রেসিডেন্টের বিদায়ী মিলিটারী সেক্রেটারী, সেই সকালে প্রেসিডেন্টের ডাকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হন । আরেকজন ব্রিগ্রেডিয়ার কাজী গোলাম দস্তগীর, ১৫ আগস্ট সকালে ডালিমের ঘোষনা রেডিওর চিটাগাং স্টেশনে এ প্রচার বন্ধ করার আদেশ দিয়েছিলেন। তবে তাদের এই আচরণ রাজনৈতিক বিশ্বাসপ্রসুত ছিলো না, বরং সম্পূর্নই পেশাগত দায়িত্বশীলতার অংশ, যারা রাজনীতিতে জড়িত হবার চেয়ে নিজের পেশাগত দায়িত্বকে বেশী গুরুত্ব দিতেন।

এটা আজও রহস্য, আগে থেকেই সেনানিবাসে চাউর হওয়া সম্ভাব্য ক্যু’র শিখন্ডী কর্নেল ফারুককে কেন গোয়েন্দা পর্যবেক্ষনের আওতায় আনা হয়নি, নাকি তাকে উলটো প্রটেকশন দেয়া হচ্ছিলো। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর জন্য গোয়েন্দা ব্যর্থতা দায়ী। এমনকি ক্যান্টনমেন্টে সেনা গোয়েন্দা সংস্থাও সামান্য তৎপর থাকলে শুরুতেই এই অভিযান নস্যাত করে দেয়া যেতো ।

এই আলোচনার ইতি টানছি সশস্ত্রবাহিনী নিয়ে মেজর জেনারেল খলিলের মন্তব্য দিয়েঃ ‘একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর স্টেনগান সজ্জিত হয়ে বিনা বাধায় সেনাসদর দপ্তরে প্রবেশ করে এবং সেনাপ্রধানকে ভয় দেখিয়ে হোক, বন্দী করে হোক, যা যা করতে চায়, তা সবই বিনা বাধায় করাতে পারে এবং বাকি দুই বাহিনীর প্রধানেরাও ওই এক মেজরের দ্বারা বন্দী হয়ে প্রায় ছয় মাইল দূরে বেতার ভবনে যান এবং তাদের যা আদেশ করা হয় তাই পালন করেন, সে বাহিনী বা বাহিনীত্রয়কে ‘প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও স্বীয় দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিতকারী সশস্ত্র বাহিনী তো নয়ই , কোনও বাহিনীই বলা ঠিক হবে না । এই বাহিনীর একমাত্র উপযুক্ত নাম শৃঙ্খলাবিহীন জনতা’ । সেদিন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থা তাই ছিল’ ।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রসঙ্গ:

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি দীর্ঘদিন। আর এই দীর্ঘ বছরগুলিতে জিয়ার সামরিক ও বিএনপির সরকার, এরশাদের সামরিক ও জাতীয় পার্টির সরকার এবং বেগম খালেদা জিয়ার আমলের বিএনপি সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে দেয়নি; বরং এ সরকারগুলি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বহুভাবে সহযোগিতা করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খুনি মোশতাক বঙ্গবন্ধু হ হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রিসিপশনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় ২৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ খুলে দেয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ ২৪ জন আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ চার আসামি মৃত্যুবরণ করায় ২০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার জজ আদালতে বিচার শুরু হয়। একই আদালত ১৯৯৭ সালের ৭ এপ্রিল ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫০ কার্যদিবস শুনানির পর ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের দণ্ডাদেশ দেন। ওই রায়ের পর এর বিরুদ্ধে কারাবন্দি চার আসামি মেজর হুদা, লে. কর্নেল ফারুক, লে. কর্নেল শাহরিয়ার ও লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন (আর্টিলারি) হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০০০ সালের ২৮ জুন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা কয়েক দফায় বিব্রত হওয়ার পর ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২মাস ৩দিন শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ মামলায় বিভক্ত রায় প্রদান করেন। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের আদালতে মামলার শুনানি শুরু হয় । ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির ফাঁসি বহাল রেখে ৩ জনকে খালাস দেন। ওই বছরই কারাবন্দি চার আসামি আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের করেন। ২০০৭ সালের ১৩ মার্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামি মহিউদ্দিন ল্যান্সারকে মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্রে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৮ জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় । ২০০৭ সালের ৭ আগস্ট বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জল ইসলাম, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন এবং বিচারপতি মোঃ হাসান আমিনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার লিভ টু আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ শুরু করেন। ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর মামলার নিষ্পত্তিতে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়। ১৯ নভেম্বর ২০০৯ বৃহস্পতিবার । ঘড়ির কাঁটার তখন বেলা ১১টা ৪৬ মিনিট । বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা শুরু করলেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম । পাঁচ আসামির আপিল খারিজ, ফাঁসির আদেশ বহাল-এই রায়ের মাধ্যমে শেষ হলো ১৩ বছর ধরে চলা বিচার প্রক্রিয়া । মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে কারাবন্দি ৫ আসামি হলেন-খুনি ফারুক, খুনি শাহরিয়ার, খুনি মহিউদ্দিন (আর্টিলারি),খুনি হুদা ও খুনি মহিউদ্দিন (ল্যান্সার)। পলাতক ৬ আসামি হলেন খুনি রশীদ, খুনি ডালিম,খুনি রাশেদ চৌধুরী, খুনি নূর, খুনি মাজেদ (২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়)এবং খুনি মোসলেমউদ্দিন । বাকি একজন খুনি আজিজ পাশা মারা গেছেন। ২৭ জানুয়ারি ২০১০। সুপ্রিমকোর্টের চার বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ধৃত আসামিদের রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেয় । ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতিও তাদের প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন। এরপর ২৭ জানুয়ারি রাত ১২টার পর পাঁচ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর করা হয়। অবশিষ্ট খুনিরা ধরাছোয়ার বাইরে থাকায় মামলার রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে বটে ; তবে ধৃত আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করার ভেতর দিয়ে বহু প্রত্যাশিত একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটে ।

তথ্য সহায়িকাঃ

১) বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় বাঙালির কলঙ্কমোচন, নূহ উল আলম লেনিন;

২) তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম এ হামিদ পিএসসি;

৩) গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী, মেজর নাসির উদ্দিন ;

৪) বাংলাদেশঃ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড,আ্যান্থনী মাসকারেনহাস;

৫) এক জেনারেলের নীরব স্বাক্ষ্য স্বাধীনতার প্রথম দশকঃ মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অবঃ) বীরবিক্রম ;

৬) রক্ষীবাহিনীর অজানা অধ্যায়ঃ কর্নেল সরোয়ার হোসেন মোল্লা (অবঃ);

৭) রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যাঃ আনোয়ার উল আলম;

৮) কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫- মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান;

৯. সৈনিকের জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পচাত্তরঃ হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম;

১০) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বরঃ কর্নেল শাফায়াত জামিল (অবঃ);

১১) নভেম্বর ১৯৭৫, নজরুল সৈয়দ;

১২) ১৫ আগস্ট আ্যা ন্যাশনাল ট্রাজেডি, মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ;

১৩) পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি;

১৪) বাংলাদেশঃ রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১, ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন (অব);

১৫) মার্কিন দলিলে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যাকাণ্ড, মিজানুর রহমান খান;

১৬) ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড কে এম সফিউল্লাহ ও শাফায়াত জামিল বিতর্ক,মতিউর রহমান ;

১৭) ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দুই রাষ্ট্রপতি হত্যা, মুনতাসীর মামুন ;

১৮) বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সামরিক গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল, জাহিদ নেওয়াজ খান;

১৯) বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কি চেয়েছিল ভুট্টোর পাকিস্তান ? রাহাত মিনহাজ ;

২০)যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি, লেঃকর্নেল (অব) শরিফুল হক (ডালিম)

২১) স্বাধীনতা যুদ্ধের অপর নায়কেরা, নুরুজ্জামান মানিক,২০০৯;

২২)রক্তাক্ত পঁচাত্তর: ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ! অমি রহমান পিয়াল,বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,২৮ জানু ২০১২;

২৩)১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ক্যু : সামরিক বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের দায় কতটুকু? শরীফ আর রাফি,দৈনিক আমার হবিগঞ্জ, আগস্ট ৮, ২০২১

ছবি: 
01/06/2007 - 1:46পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

Rahman Faruk এর ছবি

খুবই তথ্য বহুল লেখা।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

আমার লেখাটি পড়ার জন্য এবং কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ জানাই ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।