৪ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল ৯ টায় মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল রাও আমাদের ক্যাম্পে এসে নির্দেশ দিলেন সন্ধ্যা ৭টায় পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতা আক্রমণ করতে হবে। তার নির্দেশ শুনে আমার কোম্পানির যোদ্ধারা কিছুটা ভড়কে গেল । কারণ, কিছুদিন আগে উক্ত ঘাটি আক্রমণ করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর একজন কোম্পানি কমান্ডার সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে ।
যা হোক, দেশকে শত্রু মুক্ত করতেই হবে যে কোন মূল্যে, পিছপা হলে চলবে না । আমি সকলকে একত্র হতে আদেশ দিয়ে ব্রিফিং দিলাম । সবাই 'জয় বাংলা' বলে অপারেশনে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করল । সন্ধ্যায় কর্নেল রাও এসে আমাদের প্রস্তুতি দেখে খুশি হলেন ।
শুরু হল আমাদের যাত্রা । ঘুটঘুটে অন্ধকার ,সামনে ছোট নদী পার হয়ে পানিহাতার দিকে নিরবে চললাম । আনুমানিক রাত ১১টায় পাকবাহিনীর ক্যাম্পের অতি নিকটে পৌঁছলাম । আধার রাতে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না । কিন্তু ক্যাম্পটি দেখা যাচ্ছে হারিকেন এর প্রজ্বলিত আলোয় ।
বেশ কিছুক্ষণ কাদাযুক্ত ধানক্ষেতে চুপটি মেরে থাকার পর আদেশ দিলাম ফায়ারিং এর । মিত্রবাহিনী সেল মারা শুরু করল । আর আমরা এলো এম জি, এস এলো আর ও রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম । প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলল । পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে সাজোঁয়া গাড়ি করে পালিয়ে গেল ।
ভোর ৪টায় পানিহাতা ক্যাম্পে রেড করলাম। বিজয় নিশান উড়ানো হল ময়মনসিংহ জেলার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতায় । শত্রু মুক্ত ঘাটিতে শুরু হল আনন্দ উল্লাস।
সকালে বাঙ্কারের ভিতরে দেখলাম সম্পূর্ণ নগ্ন মা -বোনাদের । তাদের দেহে শক্তিবল কিছুই নেই , রক্তশূন্য ফ্যাকাসে ,একেকজন যেন জিন্দা লাশ । প্রশ্ন জাগে মনে "পাকিস্তানি সেনারা কি মুসলমান ", "তারা কি মানুষ নাকি নরপশু " । ১৭/১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করলাম । আমাদের সাথে যে গামছা ছিল তা' দিয়ে তাদের লজ্জা ঢাকার ব্যবস্থা হল । আশপাশের লোকজন এলে বীরাঙ্গনাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য তাদের হেফাজতে দিয়ে ক্যাম্পে চলে এলাম । সঙ্গে ছিল দুই সহযোদ্ধার লাশ
মূল স্মৃতিচারণঃ মরহুম মোঃ রহমতুল্লাহ (আমার বাবা),কোম্পানি কমান্ডার, ১১ নং সেক্টর ,১৯৭১।
অনুলিখনঃ নুরুজ্জামান মানিক
মন্তব্য
বীর যোদ্ধার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা!
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
অজস্র ধন্যবাদ ।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
গা শিউরে ওঠা ঘটনা। আরো লিখুন। সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসীম অসীম শ্রদ্ধা।
আরো কিভাবে লিখবো ভাই আমার প্রাণাধিক প্রিয় বাবা তো ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সালেই মারা গেছেন । আমি তো জানতাম না তিনি এতো তাড়াতাড়ি চিরতরে চলে যাবেন । জানতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা রেকর্ড করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতাম । আমার বাবা শেরপুরের কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু দেশের কয়জন তাকে চিনে ?
হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না
হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না
বড়ো বড়ো লোকেদের ভীড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে
তোমাদের কথা কেউ কবে না
তবু এই বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা
তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না
না, না, না শোধ হবে না [ খান আতা]
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
নতুন মন্তব্য করুন