আহমদ ছফার শ্রাবণে মৃত্যু নিয়ে বিচিত্র ভাবনা

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি
লিখেছেন নুরুজ্জামান মানিক (তারিখ: শনি, ২৭/০৭/২০২৪ - ৮:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আহমদ ছফা এই ধূলির ধরা থেকে বিদায় নেন শ্রাবণের ১৩ তারিখে বঙ্গতয় ১৪০৮ সালে । তখনই মনে এই প্রশ্ন উঁকি দেয় মরিবার জন্য ছফা ভাই কেন শ্রাবণকেই বেছে নিলেন? শ্রাবণ মানেই তো মেঘের ক্রন্দন যাকে আমরা মিষ্টি করে বৃষ্টি বলি । সেই বৃষ্টির দিনে আনন্দ করে ভেজা যায় কিংবা বাদুর ঝোলার মত বাসে চড়ে অফিস ঘরে কামলাগিরীও করা যায় কিন্তু মরা কি ঠিক ?

“বৃষ্টিতে তো সবই ভিজে যায়
ওই দেখুন আজিমপুর গোরের লাশগুলিও ভিজে যাচ্ছে”

কে বলল এই কথা ?
গলাটা চেনা ঠেকে ।
চিনতে পেরেছি–
এতো স্বয়ং আহমদ ছফারই গলা
হুমায়ুন কবির আর ফরহাদ মজহারকে বলছেন তার বিপ্লবী তত্ত্ব ।

কিন্তু তিনি তো কালের নিয়মে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ।তার নিজেরই বয়ানঃ

“অনাদি অনন্তকাল নয় পরমায়ু
প্রাণের সন্তাপ নেবে জল আর বায়ু।
এই প্রাণ অন্ধকারে কোনও একদিন
সময় সিন্ধুর বুকে হয়ে যাবে লীন।
হাওয়াতে খোদাই করা অমর অক্ষরে
আমার করুণ মুখ যুগ যুগ ধরে
সময় সাগর বুকে বিদ্রোহী পদ্মের মতো ছড়িয়ে সুঘ্রাণ
গেয়ে যাবে মুক্তি প্রেম আনন্দের গান।”

মিরপুরে কবরস্থ করার সময় ছফা ভাইয়ের লাশও কি ভিজে গিয়েছিল ?
ভিজবেই তো–
“বৃষ্টিতে তো সবই ভিজে যায় “
কিংবা বিপ্লব প্রত্যেকেরই মুক্তি আনে
তবে কি তিনি তার বিপ্লবী তত্ত্ব প্রমাণের জন্যই শ্রাবণ কে বেছে নিলেন ?

২। “বৃষ্টি আসলে সবকিছুই ভিজে যায়" এই বুলি ছফা ভাই প্রচার করেন তার লেখাজোখার শুরুর কাল মানে ষাটের দশকে কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের সতর্কতা দরকার
যেন তাকে আমরা ষাটের প্রোডাক্ট মনে না করি । যা বলছিলাম “সূর্য তুমি সাথী” দিয়ে উপন্যাসের পথে যাত্রা শুরু ছফার কিন্তু সবাই একমত হবেন ছফা আহমদ ছফা হয়ে উঠেছেন “ওঙ্কার ” এ এসে । “কার রক্ত বেশী লাল- আসাদের না আমার বৌয়ের “-সেই প্রশ্নের মীমাংসার চেষ্টা আছে “অলাতচক্র” বা “একজন আলি কেনানের উত্থান পতনে ” । যাক সে আলোচনা যেহেতু বর্তমান রচনার লক্ষ্য নয় তাই এখানেই বিরতি ।

৩। বোধিসত্ত্ব আলোকিতেশ্বর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন -

“যতক্ষণ জগতের একটি মাত্র প্রাণী বদ্ধ থাকিবে ততক্ষণ আমি নির্বাণ লইব না” । আমাদের কালের চিন্তক সলিমুল্লাহ খানের ভ্রম “বোধিসত্ত্ব আলোকিতেশ্বর কি এই জন্মে চাটগা বঙ্গে আহমদ ছফা নামে নির্বাণ লইলেন ?”

কিন্তু শুধু নির্বাণই কি যথেষ্ট ?
বাসনার জয় পরাজয়ই কি শেষ কথা ?
যদি করুণার যোগ না হয় তবে নির্বাণ আর নাস্তিতে প্রভেদ কোথায় ?

“ওঙ্কারে” ছফা যদি সিদ্ধ
“বাঙ্গালী মুসলমানের মন”এসে মননে পক্ব
“বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস” এ বিদ্ব্যত সমাজের যথা চিত্রক
তবে “পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ” এ তিনি বুদ্ধ ।

মহামতি বুদ্ধের ন্যায় ছফা তাই তার পুরাণের সমাপ্তিতে মুখ খোলেনঃ

“সকলে আমার মধ্যে আছে , আমি সকলের মধ্যে রয়েছি । …..আমার পাখি পুত্রটি আমাকে যা শিখিয়েছে কোনও বৃহৎ গ্রন্থ , কোনও তত্ত্বকথা কোনও গুরুবানী আমাকে সে শিক্ষা দিতে পারেনি । একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারে । “

কিন্তু আমার প্রশ্নঃ
ছফা ভাই এই বুদ্ধত্ব লাভের পরও
কি করে আমাদের মুক্ত না করেই নিজে
ফানার পথ লইলেন
তাও এই ভরা শ্রাবণে !

আমরা অন্যকে মুক্ত করে মুক্তি আনতে পারি কিনা সেই পরীক্ষা নেয়ার জন্যই
কি তিনি আমাদের এতিম করে গেলেন ?

আবার তার তত্ত্ব নিয়েও তো ঝামেলা।
অন্যের মুক্তির আগে –
নিজের মুক্তি কি নিশ্চিত করা দরকার নয় ?
যে নিজে মুক্ত নয় সে অন্যের মুক্তি আনবে কি ভাবে ?
নিজের দাসত্ব থেকে মুক্ত না হয়ে অন্যের মুক্তি কি সম্ভব ?

দোহাইঃ

১। ফরহাদ মজহার, যুগান্তর ৩ আগস্ট ২০০১
২। “নির্বাণ” হর প্রাসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ ,৩য় খণ্ড , কলকাতা ১৯৮৪
৩। ভূমিকার পরিবর্তে , সলিমুল্লাহ খান , আহমদ ছফা উপন্যাস সমগ্র , মওলা ব্রাদার্স , ফেব্রুয়ারি ২০০৪
৪। আহমদ ছফা , পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ , সন্দেশ , ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬
৫।আহমদ ছফার কবিতা ,শ্রী প্রকাশ , ফাল্গুন ১৪০৩

ছবি: 
31/05/2007 - 2:46অপরাহ্ন

মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।