মায়া

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি
লিখেছেন মানিক চন্দ্র দাস [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/০৬/২০১১ - ১০:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

টেবিলের উপর বোতল। সাদা বোতল, বোতলের ছিপি আটকানো, জল আছে অর্ধেক। সে হিসেবে চিন্তা করলে অর্ধেকটা খালি। বোতলটা এখন যদি উল্টে যায় তাহলে কি হবে? ধরা যাক বোতলটা টেবিলের উপরেই উল্টে যাবে। ছিপির উপর বোতলটা দাঁড়িয়ে থাকবে। জল নেমে আসবে ছিপির দিকে। তলার দিকটা হয়ে যাবে ফাঁকা। আর কি ভাবে উলটানো যায়? গোটা বোতলটা যদি ভেতরের দিকে উলটে যাওয়া শুরু করে, তাহলে কি হবে? জল চলে আসবে বাইরের দিকে। ছিপির রঙ্গীন দিকটা চলে যাবে ভেতরে আর ভেতরের অ্যালুমিনিয়ামের দিকটা চলে আসবে বাইরে। জলটাকে যদি তখন ধরে রাখার ব্যাবস্থা করা যেতো তাহলে সে তখন থাকতো বোতলের চারিদিকে এবং অবশ্যই অর্ধেকটা জুড়ে। অদ্ভুত একটা দৃশ্য হবার কথা। মনের চোখে জমির সাহেব পুরো দৃশ্যটা দেখা শুরু করলেন।

টেবিলের উপর বোতল। সাদা বোতল, বোতলের ছিপি আটকানো, জল আছে অর্ধেক। সে হিসেবে চিন্তা করলে অর্ধেকটা খালি। বোতলটা এখন যদি উল্টে যায় তাহলে কি হবে? ধরা যাক বোতলটা টেবিলের উপরেই উল্টে যাবে। ছিপির উপর বোতলটা দাঁড়িয়ে থাকবে। জল নেমে আসবে ছিপির দিকে। তলার দিকটা হয়ে যাবে ফাঁকা। আর কি ভাবে উলটানো যায়? গোটা বোতলটা যদি ভেতরের দিকে উলটে যাওয়া শুরু করে, তাহলে কি হবে? জল চলে আসবে বাইরের দিকে। ছিপির রঙ্গীন দিকটা চলে যাবে ভেতরে আর ভেতরের অ্যালুমিনিয়ামের দিকটা চলে আসবে বাইরে। জলটাকে যদি তখন ধরে রাখার ব্যাবস্থা করা যেতো তাহলে সে তখন থাকতো বোতলের চারিদিকে এবং অবশ্যই অর্ধেকটা জুড়ে। অদ্ভুত একটা দৃশ্য হবার কথা। মনের চোখে জমির সাহেব পুরো দৃশ্যটা দেখা শুরু করলেন।

একটা মশা কানের সামনে পিন...ন পিন...ন করে যাচ্ছে। শব্দটা বিরক্তিকর, বোতল থেকে জমির সাহেবের মনোযোগ সরে গেলো। মশাকে বিরক্তিকর এই শব্দ করতে হচ্ছে পাখা নাড়িয়ে। মশা সেকেন্ডে কতবার পাখা নাড়ে? কে জানে ! পাখা নাড়া, কি জটিল প্রক্রিয়া ! মশাটা কি অবলীলায় সেই জটিল কাজটি করে যাচ্ছে ! নতুন প্রাণ এই পৃথিবীতে আনার কি প্রানপন প্রচেষ্টা মশাটার। নিজের প্রানের মায়া উপেক্ষা করে সে এসেছে লাল বর্নের অমৃত সুধা খেতে। মশাটা থাকতো কোথায়, কোত্থেকে এসেছে এই মশা? নাগরিক জীবনের সমস্ত জৈবিক পঙ্কিলতা নির্মল বর্নহীন জলকে যেখানে গিয়ে করেছে কৃষ্ণ কালো, সেখানেই নিশ্চয়ই এর আবাস। জৈবিক পঙ্কিলতা নতুন প্রান আনছে এই পৃথিবীতে। পঙ্কিলতাও তাহলে খারাপ কিছু নয়। নতুন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা এরও আছে।

আবারো বোতলের দিকে মনোযোগ দিলেন জমির সাহেব। বোতল উলটে যাচ্ছে। প্রথমে উলটে গেলো ছিপি। লাল-সোনালী ছিপি এখন হয়ে গেছে অ্যালুমিনিয়ামের মতো রুপালী। ছিপির একেবারে উপরের দিকে পাতলা নরম রাবারের মতো অংশ। রাবার গলে বোতলের তলা হচ্ছে। তলার পুরোটায় ছড়িয়ে গেলো রাবার। তারপর ছিপি। ছিপি এখন আর ছিপির মতো আকৃতিতে নেই। সে হয়ে গেছে চ্যাপটা। ছিপি এখন বোতলের তলা। কাঁচ গলে ভেতরের দিকে সরে যাচ্ছে। প্রথমে বোতলের গলা গলে গেলো, হয়ে যাচ্ছে বোতলের তলার দিকের চওড়া অংশ। এরপরের বিষয়টা খুব স্বাভাবিক ভাবেই চলে গেলো। ঝামেলা হলো বোতলের ছিপি নিয়ে। ছিপিটা এখন কাঁচের। এই বোতল এখন আর খোলা যাবেনা। নাকি খোলা যাবে? জল কোন এক অজ্ঞাত উপায়ে বোতলের চারপাশ জুড়ে ছড়িয়ে গেলো। এখন একে জলের তৈরি বোতলে থাকা কাঁচ বলা যায়। তাইতো হবার কথা।

রাত একটা বেজে গেছে। জমির উদ্দিন এইসব চিন্তা করছেন তার লেখার টেবিলে বসে। লেখার টেবিলে তিনি দিনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেন। তার দিন কাটে নানা বয়সী ছাত্রদের জন্যে নোট তৈরী করে। নানা রকম কোচিং সেন্টারের সাথে তার চুক্তি আছে। সবাইকে তিনি নোট সাপ্লাই দেন। তাতে জমির সাহেবের নাম থাকেনা। কোচিং এর শিক্ষকদের নাম থাকে। তাই সব নোট আলাদা হতে হয়। বছরের শুরুর দিকটায় তার খুব ব্যস্ততা থাকে। তখন নানা প্রকাশনীকে নোট সাপ্লাই দিতে হয়, বছরের মাঝামাঝি বলে সেই রকম ব্যস্ততা নেই। এখন খালি কোচিং সেন্টারে সাপ্লাই দিলেই চলে।

জমির সাহেবের লেখার ঘর আর শোবার ঘর আলাদা। আলাদা একটা ড্রইং রুম আছে। তাতে রাজ্যের সব বই গাদা করে রাখা। কেউ আসেনা তাই ড্রইং রুমে কিছু বসানোর কথা জমির সাহেবের মাথায় আসেনি।

শুধু নোট সাপ্লাই দিয়ে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট তিনি কিনে ফেলেছেন। একাই থাকেন। নোট তৈরির ফাঁকে নিজের জীবনের পান্ডুলিপিটাতে আর কোন চরিত্র যোগ করতে পারেননি। একসময় সত্যিকারের সাহিত্য, নানা রকম চরিত্র তৈরি করতে জমির সাহেব খুব পছন্দ করতেন। মনের আনন্দে লিখে যেতেন পাতার পর পাতা। সেসব আনন্দময় লেখা এই পৃথিবীর আলোছায়া দেখতে পারেনি। সব সম্পাদক, প্রকাশক রদ্দিমাল বলে লেখাগুলোকে সোজা ঢেলে দিয়েছেন ডাষ্টবিনে। তাই জমির সাহেব এখন আর সাহিত্যে নেই। তিনি এখন মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দেবার ক্ষমতা সম্পন্ন রোবটদের জন্যে লেখেন। রোবট...জমির সাহেব এখন সেই অর্থে রোবট তৈরী করেন। এজন্যে তার অপরাধবোধ আছে।

বেশ কদিন ধরেই তার সব কিছু ছেড়ে কোথাও চলে যেতে করছে। কিন্তু তার কোথাও যাবার যায়গা নেই। তাই আর শেষ পর্যন্ত কোথাও যাওয়া হয়নি। এই তিন রুমের ফ্ল্যাটটাতেই তিনি আছেন। খাবার আসে খুব সস্তা ধরনের একটা হোটেল থেকে। পরে জমির সাহেব সেইসব খাবার গরম করে খেয়ে নেন। তার শরীর যথেষ্ট ভালো। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম হয়না। সেজন্যে ডাক্তার দেখিয়েছেন। ডাক্তার কড়া মাত্রার ঘুমের ঔষধ দিয়েছেন। সেই জিনিষ খেয়ে মড়ার মতো ঘুমান জমির সাহেব কিন্তু ঘুমের পর শরীরে যে চমৎকার একটা ঝরঝরে ভাব থাকে সেটা এখন তিনি পাচ্ছেন না। কেমন যেন সব কিছু অবসাদ্গ্রস্থ মনে হয়।

জমির সাহেবের ধারনা ঘুমের ঔষধ থেকেই এই সমস্যা তার হচ্ছে। ঘুমের ঔষধ ছাড়ি ছাড়ি করেও ছাড়া হচ্ছেনা। লেখার টেবিল থেকে উঠে জমির সাহেব ঘুমের ঔষধের প্যাকেটটা হাতে নিলেন। একসাথে বেশ কিছু ট্যাবলেট কেনা হয়েছে, বেশ কিছু মানে পুরো এক বক্স, শ খানেক ট্যাবলেট, দোকানদার দিতে চায়নি,একসাথে কড়া মাত্রার ঘুমের বড়ি বেশী বিক্রি করার নাকি নিয়ম নেই। একটু জোরাজুরি করতেই দোকানদার অবশ্য দিয়ে দিয়েছে। জমির সাহেব কোন কাজেই খুব একটা জোরাজুরি করেন না। স্রেফ বারবার একই ঔষধ আনার জন্যে দোকানে যেতে হবে ভেবেই একসাথে বেশী করে ঔষধ নিয়ে নেয়া। ঔষধের প্যাকেট খুললেন জমির সাহেব। প্যাকেটের ভেতর ছোট্ট মত একটা কাগজে ঔষধের সব কিছু বলা হয়েছে। তিনি সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। প্যাকেটটা আবার জায়গা মতো রেখে দিয়ে বসলেন লেখার টেবিলে।

রাত দুটো বাজে, এখন একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিলেই হয়। মড়ার মতো ঘুম হবে। তবে রাতটা জেগে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। সকালের সূর্য্যদয়টা দেখা যাবে। সাথে কিছু লেখালেখি।

আজ নোট লিখতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। অন্য কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। একটা কবিতা কিংবা একটা ছোট্ট গল্প। কতদিন আনন্দময় এই কাজটি করা হয়না। হাতে কলম নিয়ে জমির সাহেব বসে রইলেন। সামনে দুধ সাদা কাগজ। অফসেট পেপার। কোথাও কোন কালোর ছোঁয়া নেই। একদম সাদা। মা একসময় ঠিক এইরকম সাদা শাড়ী পরতেন। মা চলে গেছেন অনেকদিন হলো। জমির সাহেব নিজের মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলেন। মনে পড়ছেনা। এক জীবনের খুব প্রিয় মানুষ, যাঁর শরীরের নির্যাস নিয়ে জমির সাহেব একসময় বড় হয়েছেন, সেই মানুষটির চেহারা তার মনের চোখে ধরা পড়ছেনা।

এক জীবনের খুব প্রিয় মানুষ...মানুষের জীবন কয়টা? একটাইতো। তাও কেন তার মনে হচ্ছে ‘এক জীবনের’ ? জীবনের সময় গুলো ভাগ করে কি জীবনকে অনেকগুলো জীবন বলা যায়? জীবনময় জীবন? মায়ের কথা মনে হতেই জমির সাহেবের চোখে জল এলো। কান্নাটা কেমন যেন গলার কাছে এসে পাকিয়ে গেলো। ফুঁপিয়ে উঠলেন জমির সাহেব।

“মা...মা...মাগো, তোমার চেহারাটা আমার মনে নাই। কি পাপ... কি পাপ... মাগো আমারে ক্ষমা করো গো মা। আমারে ক্ষমা করো।”
অনেকক্ষন কাদলেন জমির সাহেব। চোখের জল মোছার কোন চেষ্টা তিনি করেননি। অনেকদিন পর বুকটা কেমন হালকা হালকা লাগছে।

“মাগো, যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। আল্লাহ তোমার বেহেস্ত নসীব করুক।” কথাটা বলেই দুধ সাদা কাগজে জমির সাহেব বড় বড় করে কালো কালিতে একটা শব্দ লিখলেন,‘মা’। আর কিছু না।

লিখেই জমির সাহেব হাতের কলম রেখে চেয়ারে হেলান দিলেন। খুব মনোযোগ দিয়ে তার লেখার রুমটার দিকে চোখ বোলানো শুরু করলেন। লেখার টেবিলটা শ্বেত পাথরের। খুব বিলাস বলতে তার এই টেবিলটাই আছে। ঠিক শ্বেত পাথরও বলা যাচ্ছেনা। টেবিলের একটা অংশে খয়েরী রঙের একটা সরু ধারা কোনাকুনি বয়ে গেছে। শ্বেতশুভ্র একটা টুকরোতে খয়েরীর অনাকাঙ্খিত অনুপ্রবেশ। কোন প্রয়োজন ছিলোনা, তাও আছে। জীবনে অনেক কিছুরই প্রয়োজন নেই, তাও অনেক কিছুরই অনুপ্রবেশ ঘটে। চাইলেও তাকে ঠেকানো যায়না। তিনি নিজেও কি পেরেছেন? জীবনটাকে তিনি লেখক হিসেবে এই শ্বেতপাথরের টেবিলের মতোই করতে চেয়েছিলেন। মাঝখানে উটকো কিছু লোক খয়েরী দাগের মতো জীবনটাকে ভাগ করে দিয়ে গেছে। এপারে সাহিত্য পিয়াসু মন, জীবন আর ওপারে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ছাত্রদের নোট লেখার মত অকিঞ্চিৎকর এক জীবন।

জমির সাহেবের মনে হলো তার জীবনটা এই শ্বেতপাথরের টেবিলের মতোই। শুধু ফরমায়েশী লেখার এক যন্ত্র মাত্র, আর কিছু নয়। টেবিলের পায়া কালো কাঠের। কি কাঠ জানা নেই। জীবন এরকম কিছু কালো, ভুলে যাওয়া ভালো ঘটনার উপর দাঁড়িয়ে আছে। টেবিল থাকলে যেমন তার পায়াও থাকে, জীবনের পায়া, ভিত্তি সেসব ঘটনা। জীবন যেহেতু আছে তাই ঐ ঘটনা গুলোকেও ভুলে যাওয়া যায়না।

ভুল ঘটনার মাঝে আছে এই যেমন কলেজে শেফালির সাথে দেখা...এরপর দুরুদুরু বুকে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা...তারপর ঢাকায় চলে আসা...সব ছেড়েছুড়ে। ভুল সময়ে ভুল বিষয় নিয়ে লেখালেখি। আরো কত কি !

টেবিল ছেড়ে সামনের দেয়ালের দিকে তাকালেন জমির সাহেব। একপাশে একটা ক্যালেন্ডার লাগানো। ক্যালেন্ডারে টবে লাগানো চমৎকার একটা গাছের ছবি। গাছের পাতাগুলো ছোট ছোট কিন্তু ওর ডালপালা গুলো বেশ পোক্ত, মোটাসোটা। এইটুকু একটা গাছ, তার নাকি অনেক বয়েস। কেতাবি ভাষায় একে বলা হয় বনসাই। জমির সাহেব বুঝতেই পারেন না, এই ছোট্ট টবে দীর্ঘদিন একটা গাছকে এরকম বাটু রেখে ঠিক কিভাবে কাজটা করা হয়। সব শেষে গাছটাকে সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে, দীর্ঘ কোন মহীরুহ লিলিপুট হয়ে গেছে। ছোট্ট সব প্রানকেই সুন্দর লাগে। মানুষের সন্তান কিংবা অন্য কোন প্রানী যেমন কুকুর, বিড়াল। ঠিক একই কারনে কি এই দীর্ঘ মহীরুহের লিলিপুট সংস্করন ভালো লাগছে? আমাদের আসলে কেন ভালো লাগে? এর উত্তর অবশ্য জমির সাহেবের জানা নেই। অনেক কঠিন প্রশ্ন কিন্তু সব মানুষের মাথাতেই একবারের জন্যে হলেও এই প্রশ্নটা আসে। কেউ কি উত্তর পায়, নাকি সবাই এই প্রশ্নের উত্তর জানেনা। জ্ঞানী মানুষেরা নিশ্চয়ই জানেন।

ক্যালেন্ডার ছেড়ে এবার পাশের দেয়ালে তাকালেন জমির সাহেব।

দেয়ালের একপাশে একটা বিশাল ছবি। ক্যামেরায় তোলা ছবি, মোল্লার হাট থেকে কেনা। টাকাটাও লেগেছিলো বেশ। তাতে কিছু যায় আসেনা। ছবিটা জমির সাহেবের কাছে অন্য পৃথিবীর ছবি মনে হয়। বিশাল ক্যানভাসে নিচে জল। নদী। উপরে আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে। কালো কালো মেঘ। কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে একটুকরো আলো আসছে নীচে। জলের উপর একটা সাধারন ছই বিহীন নৌকা। নৌকায় নীল রঙের শাড়ী পরে এক কিশোরী বসে আছে। কিশোরীর মুখে ঠিক হাসিও নেই আবার কোন বেদনাও নেই। চেহারায় তার মাঝামাঝি একটা আবেগের রুপরেখা। মেঘ ভেদ করে আসা আলো কিশোরীর চেহারায় হালকা ছোঁয়া দিয়ে নেমে গেছে জলে। একফালি আলো ছবির মেজাজ বদলে দিয়েছে। একে এখন আর ঠিক বিষাদের ছবিও বলা যাচ্ছেনা আবার ঠিক আনন্দের ছবিও বলা যাচ্ছেনা।

জমির সাহেবের প্রায়ই মনে হয় ছবির কিশোরীর চেহারার সাথে শেফালির চেহারার কোথায় যেন একটা মিল আছে। কিশোরী বলেই এই মিল কিনা তা তিনি জানেন না। জানার কোন ইচ্ছাও নেই। জমির সাহেবের কাছে শেফালি এখনো কলেজের সেই কিশো্রীই রয়ে গেছে। স্মৃতিতে শেফালির বয়স বাড়েনি।

শেফালি এখন কেমন হয়েছে দেখতে? খুব ভারিক্কি চেহারার সুখী কোন গৃহিনী নাকি জীবন যুদ্ধে পর্যদুস্ত লিকলিকে শরীরের কেউ? কোনটা হলে তার ভালো লাগবে? জমির সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। এভাবে কখনো ভাবা হয়নি। লিকলিকে কেউ না হলেই বোধহয় ভালো, সুখী ভারিক্কী চালের গৃহিনীই শেফালীর এই বয়সের সাথে মানাবে। আচ্ছা যদি জমির সাহেবের সাথেই বিয়েটা হয়ে যেতো, তাহলে কি হতো? দম্পত্তি জীবনটা কি সুখের হতো? সুখ কি? নিজ পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে হলেই যে সুখ উপচে পড়বে পরিবারে, এমনটা কি হয়? না, হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। সুখ যে কি জিনিষ তা মানুষ বোধহয় জানেনা। সবাই শুধু সুখের ভান করে যায়। হা হা হা। প্রাণ খুলে হাসি বেরিয়ে এলো জমির সাহেবের।

হাসির শব্দে জমির সাহেবের পোষা বিড়াল টুকটুকির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। নারী বিড়াল। কিছুদিন পরপর সে অপার আনন্দ নিয়ে গর্ভ ধারন করে। বাচ্চা প্রসব করে। সেই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে দারুন একটা হুটোপুটি শুরু হয়। বাচ্চারা হাঁটতে শেখার পর তো কোন কথাই নেই। জমির সাহেব নিজেও তখন বাচ্চাদের নিয়ে খুব ব্যাস্ত থাকেন। টুকটুকির জন্য এলাহি কারবার। তখন তিনি বাজার থেকে ছোট মাছ নিয়ে আসেন ,সাথে মুরগীর মাংস। নিজের জন্যে জমির সাহেব রান্না করেন না কিন্তু টুকটুকির বাচ্চা হলে ফ্ল্যাটে রান্না হয়। জমির সাহেব নিজে হাতে সেসব রান্না করেন এবং সেটা শুধুই টুকটুকির জন্যে। বাচ্চাদের জন্যে ভ্যাক্সিন এর ব্যাবস্থা করা হয়। সেই কাজটি ভ্যাটেরিনারি ডক্টর নিজে এসে করে দিয়ে যান।টুকটুকি কয়েকদিন হলো বাচ্চা দিয়েছে। বাচ্চাদের চোখ মাত্র ফুটেছে। বাচ্চাদের টুকটুকি রেখেছে জমির সাহেবের কিছু বই এর খোড়লের ভেতর, বাইরে থেকে অবশ্য দেখা যায়। টুকটুকি তার ম্যাটার্নিটি হাউজ হিসেবে জমির সাহেবের লেখার ঘরই বেছে নিয়েছে। ড্রইংরুমে বাচ্চা রাখলে বা প্রসব করলে খুব একটা সমস্যা হবার কথা না, তাও কেন লেখার ঘরেই কাজটা করতে হবে সেটা বোধহয় কেবল টুকটুকিই জানে। বাচ্চারা এখন বেশ হুটোপুটি করে। জমির সাহবের হাসির শব্দে টুকটুকির ঘুম ভেঙ্গেছে, সাথে বাচ্চারাও কচি কন্ঠে মিঁউ মিঁউ শুরু করেছে। অখন্ড নীরবতা খানখান। লেখার ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন জমির সাহেব। খাবার তৈরী করে টুকটুকিকে দিতে হবে। কাজ শেষ করে লেখার ঘরে এসে জমির সাহেব আবিস্কার করলেন টুকটুকি ঘুম, বাচ্চারাও চুপচাপ। আলাদা বাটিতে খাবার রেখে টুকটুকির একটু দূরে বাটিটা রেখে দিলেন। যখন ঘুম ভাংবে তখন টুকটুকি খেয়ে নেবে।

চারপাশ আবার চুপচাপ। পুরোপুরি নিঃসঙ্গতা এখন ফ্ল্যাট জুড়ে। তার এই ত্রিভূবনে আপন বলতে কেউ নেই।হঠাৎ জমির সাহেবের মনে হলো এই অর্থহীন জীবন টিকিয়ে রাখারই বা কি দরকার? একটু বিষ পেলে ভালো হতো। কিন্তু সেই মৃত্যু খুবই বেদনাদায়ক হবার কথা। জমির উদ্দিন সাহেব এখন শান্তিময় মৃত্যুর উপায় খুঁজছেন। হঠাৎ তার মনে হলো তার কাছে বেশ কিছু ঘুমের ট্যাবলেট আছে। খুব স্বাভাবিক ভাবে সব ঘুমের ঔষধ তিনি পানি দিয়ে গিলে ফেললেন। খাওয়ার পর অনেকদিন পর জমির সাহেবের শান্তি শান্তি একটা ভাব হলো। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই তার চোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। কষ্ট হচ্ছে ঘুমকে আটকে রাখতে। কিই বা দরকার এই অকিঞ্চিৎকর একটা জীবন যাপন করে,কোন অর্থ নেই।

জীবনের শেষ নোটটি লিখলেন জমির সাহেব।
“আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়।
লেখকঃ জমির উদ্দিন।”

হঠাৎ জমির সাহেবের মনে হলো খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করা বাকী রয়ে গেছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। কাজটা তাকে করতেই হবে। কি সেই কাজ?? জহির সাহেব প্রায় ঘুমিয়ে পরেছেন। এই সময় তার পোষা বিড়াল টুকটুকি তার বুকের উপর উঠে আঁচড়ানো শুরু করলো। জমির সাহেবের মনে হলো বিষয়টা তিনি ধরতে পেরেছেন। তাকে বাঁচতে হবে টুকটুকির জন্যে, বাচ্চাদের জন্য। তিনি মারা গেলে এই বেচারারা না খেতে পেয়ে মারা পড়বে। তা কিছুতেই হতে দেয়া যায়না। জমির সাহেব বহু কষ্টে হাসপাতালের ফোন ডায়াল করলেন। বললেন,‘আমি মারা যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান। আমার বাসার ঠিকানা হচ্ছে…’
এর পরেই জমির সাহেবের হাত থেকে ফোনের রিসিভার খসে পড়ে গেলো।


মন্তব্য

শ্রীকৃষ্ণ এর ছবি

গুরু গুরু

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ফখরুল হাসান শান্ত এর ছবি

মানিকদা উপরের প্যারাটা দুইবার এসেছে। একটু মডারেশন করে দিয়েন।
বোতলের ভেতর অনেকক্ষণ ঘুরপাক খেয়েছি। পরে মাথা আউলে যাবে তাই চিন্তাটা বাদ দিয়েছি। আর হতাশ লক্ষ্যহীন জীবনের চিত্র এনে সেটার দারুন মোড় ঘুরিয়েছেন। আশা করছি অ্যাম্বুলেন্স শিগগিরি এসে পড়বে।

ফখরুল হাসান শান্ত এর ছবি

মানিকদা প্রথম প্যারাটা মনে হচ্ছে ২বার এসেছে। বোতলের ব্যাপারটা চিন্তা করে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে তা বাদ দিয়েছি। হতাশ একটা মানুষের লক্ষহীন জীবনে দারুন মোড় এনেছেন। আশা করছি অ্যাম্বুলেন্স শিগগিরি পৌছে যাবে।

নাজমুল ইমু এর ছবি

মন্তব্য কি এখানেই লিখব? না মেইল করব ? ইয়ে, মানে...

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

যেমনে আপনের ভালো লাগে ভাই, সেমনেই মন্তব্য করেন। ভালো আছেন?

joyonti এর ছবি

গুরু গুরু

আয়নামতি1 এর ছবি

ঠিক! প্রথম প্যারাটা দু'বার এসে যাওয়ায় বোতলের ভেতরই খানিকটা সময় ঘুরপাক খেতে হয়েছে। 'বেশ কিছুদিন ধরেই তার সবকিছু ছেড়ে কোথাও যেতে '--- ' করছে'(৮নং প্যারা) এটি একটু দেখবেন প্লিজ! গল্পে কিছু কথা বার বার না আনলে গল্প মেদহীন হতো বলে মনে করি। গল্পের পরিণতি অনুমান যোগ্য হলেও আপনার লেখনীর কারণে চমকটা ঠিকঠাক মতই পেয়েছি! শুভকামনা থাকলো।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

প্রিয় আয়নামতি,
গল্প পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো। ঠিক কি কারনে প্রথম প্যারা দুবার এসেছে আমার জানা নেই। কম্পিউটারের জিনিষপত্র আমি ঠিকঠাক বুঝিনা । ভুল আছে আমি স্বীকার করছি। আশা করছি ক্ষমা করেছেন। ভালো থাকবেন।
-------------মানিক

 তাপস শর্মা  এর ছবি
মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ধন্যবাদ তাপস দা।
আমার গল্প নামের ছাইপাশ যে কারো ভালো লাগতে পারে তা আমার জানা ছিলো না।
ভালো থাকবেন দাদা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।