শ্যারনের বিয়ে - একটা অন্যরকম দিন

মাশীদ এর ছবি
লিখেছেন মাশীদ (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/০৫/২০০৬ - ৭:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


সুপ্তি, সুবর্ণা আর আমি। বুয়েটে পড়ার সময় আমরা তিন বন্ধু ছিলাম inseparable. ক্লাসে সব সময় একসাথে বসতাম, ক্লাসের বাইরেও একসাথে ঘুরাঘুরি করতাম। কখনো একজন বা দুইজন কোথাও গেলে 'অন্যজন/অন্য দুইটা কই' এ প্রশ্ন শোনা ছিল অবধারিত। অনেকে ডাকত Three Stooges বলে।

আমাদের তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে আগে বিয়ে করলাম আমি। সে সময় সুবর্ণা প্রায় টানা 15 দিন আমার বাসায় থেকে পুরোপুরি বাড়ির মেয়ে হয়ে গিয়েছিল। সুপ্তিও কম যায়নি। ঘন্টার পর ঘন্টা পারলারে সাজগোজের বিরক্তিকর সময়গুলোতে আমাকে সঙ্গ দেয়ার দায়িত্ব ছিল ওর। আহা! কত মজাই না করেছি তিনজনে মিলে! ভেবেছিলাম, যাক, ওদের বিয়েতেও না জানি কত্ত মজা হবে।

কিন্তু জীবনে আমি যা ভাবি, হয় তার উল্টো। বিয়ের এক মাসের মাথায় চলে আসলাম সিঙ্গাপুরে । তারো প্রায় আরেক মাস পরে পট করে সুপ্তির বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের সাজের সময় আমার ওর সাথে থাকা হল না। বুঝলাম, This is just the beginning.

একে একে অনেকগুলো প্রিয় বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেল। গ্রুপ মেইলে ছবি দেখে দেখে দিন কাটে।

কিন্তু জীবনে না ভাবা অনেক কিছুও ঘটে যায় বুঝি ! সিঙ্গাপুরে আসার পরে নতুন পাওয়া বন্ধুদের একজন হল মালয়েশিয়ান চাইনীজ শ্যারন। প্রথমদিকে অতটা খাতির না হলেও একটা common ব্যাপার আমাদের কাছে নিয়ে এলো - বিয়ে। আমি মাত্র বিয়ে করে এসেছি, সারাদিনই হোমসিক লাগে, আর শ্যারনও মাত্র engagement করে এসেছে, বিয়ের প্ল্ল্যান-প্রোগ্রাম চলছে, ওরও সারাদিন হোমসিক লাগে, যদিও ও যাকে ফেলে এসেছে সে অনেক কাছে থাকে, মালয়েশিয়ায়, আর আমারটা তখনো ঢাকায়।

এর মধ্যে অপু (ব্ল্লগে অরূপ নামেই বেশি পরিচিত) একদিন Kuala Lumpur চলে আসল চাকরির সুবাদে। এত্তবড় একটা শহরে খুব অদ্ভুতভাবে ও এসে উঠল শ্যারনের বয়ফ্রেন্ড লুইসের বাড়ির পাশেই। আমার আর শ্যারনের কমন ব্যাপার আরো বাড়ল। প্রথমবার তাই শ্যারনের হাত ধরেই KL যাওয়া। সেবার লুইসের গাড়িতে করে ওরা দু'জন মিলে আমাদের ঘুরিয়েছিল Petronas Towers, ওদের স্মৃতিবিজরিত University of Malaya, Mid Valley সহ KL এর নানা অলিগলি। ঐ আমার প্রথম KL ভ্রমণ (এরপরে গত দেড় বছরে আরো প্রায় 23 বার গেছি অবশ্য)।

শ্যারন এখানে Ph.D করছে। কাজের ব্যাপারে তো বটেই, এছাড়াও সব ব্যাপারেই সে হাইলি অরগানাইজড। গত এক বছর ধরে বিয়ে নিয়ে টুকটুক করে নানা প্ল্ল্যান করছে। ওর বিয়ের যেকোন প্ল্ল্যান আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনি। সুপ্তির বিয়ে মিস করার দুঃখ কিছুটা যেন কমে যায়।

এখানে সময় খুব দ্রুত কেটে যায়। বছর পেরিয়ে হুট করেই দেখি একদিন মে মাস এসে গেছে। 21 তারিখ শ্যারনের বিয়ে। ওর বিয়ের দুটো অনুষ্ঠান হবে - একটা চাইনীজ অনুষ্ঠান আর আরেকটা খ্রিস্টান Church Wedding। প্রথমটা ওর হোমটাউন নেগেরি সেম্বিলানের বাহাউ অঞ্চলে, পরেরটা লুইসের হোমটাউন সারাওয়াকে। আমরা ল্যাবের বন্ধুরা বাহাউ এর অনুষ্ঠানে যাবার দাওয়াত পেলাম। আগে কোন চাইনীজ বিয়ে দেখিনি। তাই ওর সাথে সাথে আমাদের উৎসাহও কম না।

গত 21 তারিখ সকালবেলা তাই আমি, সাদিক, সাজিদ, আমাদের কলকাতার বন্ধু ইন্দ্রনীল আর মালয়েশিয়ার বন্ধুWoon বিপুল উৎসাহে বাসে করে রওনা দিলাম বাহাউ এর উদ্দেশ্যে। বাহাউ মালয়েশিয়ার একটা small town. যাবার পথটা অনেক সরু, চারদিকে কিছুটা পাহাড় ঘেরা, কিছুটা পাম গাছের বাগানে ঘেরা আর কিছুটা যেন ছোট ছোট গ্রামে ঘেরা। হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায় ছোট ছোট বাড়ি, আশেপাশে হয়ত বাচ্চারা খেলছে বা বড়রা বসে আড্ডা দিচ্ছে। খুব রিল্যাক্সড একটা ভাব, যেন কোন ব্যস্ততা নেই কোথাও। KL যাবার পথে ঠিক এতটা প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া যায় না। আর সিঙ্গাপুরের মত কৃত্রিম শহরে তো এমন দৃশ্য অকল্পনীয়। আমরা 4 বাঙালী যেন হুট করে ফিরে গেলাম নিজেদের দেশে। আমার মনে হল আমরা যেন অনেকদিন পরে ঢাকা থেকে রাজশাহী বা চট্টগ্রাম যাচ্ছি কারো বিয়ে খেতে।

বাহাউ পৌঁছালাম বেলা 3:30 টার দিকে। লুইস আমাদের স্টেশন থেকে তুলে বিয়ের ভেন্যু Era Hotel এ নামিয়ে দিল। অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়, আমাদের হাতে তাই কিছুটা ফ্রি সময়। আমরা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য। কিন্তু বাহাউ নিতান্তই ছোট জায়গা। আশেপাশে তেমন কিছু নেই। তাই পাশের একটা মলে আর পার্কে ঘুরে সময় কাটালাম। সবাই মিলে কিছু মজার ছবি তোলা হল।

অনুষ্ঠান শুরু হল 7 টার দিকে। সোনালী গাউনে শ্যারনকে রাজকন্যার মত দেখাচ্ছিল। একটার পর একটা চাইনীজ ডিশ আসতে থাকল। তার প্রায় সবগুলোই আমরা বেশ আগ্রহ নিয়ে খেলাম। সাথে চলল একের পর এক পারফমেন্স। শ্যারনের পুরো পরিবার দেখা গেল চমৎকার গান করে। বাবা-মা, ভাইবোন ছাড়াও আরো অনেকেই গান গাইল। সব মিলে একটা অসাধারণ পরিবেশ। মাঝে মধ্যে Woon আমাদের বুঝিয়ে দিল কোনটা কিভাবে খেতে হয়, কোন গানের কি মানে।

ফিরব রাত 1:40 এর ট্রেনে। আমরা ল্যাবের ক'জন ছাড়াও শ্যারন আর লুইসের আরো কিছু বন্ধুও সিঙ্গাপুর ফিরবে। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরে আমাদের সবাইকে নামিয়ে দিতে বর-কনে নিজেই রওনা দিল ট্রেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ওদের আতিথেয়তায় ততক্ষণে আমরা অভিভূত।

অনেকদিন পর একটা ভীষণ অন্যরকম দিন কাটল। দেশে ফেলে আসা পুরোনো বন্ধুদের বিয়ে মিস করার দুঃখ কিছুটা কাটল নতুন পাওয়া এ বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে। বিয়ের কিছু নিয়ম হয়ত একটু অন্যরকম, গানগুলোর ভাষা হয়ত আলাদা কিন্তু কি আশ্চর্য! একবারের জন্যও মনে হলনা আমরা বিদেশী বা আমরা ভিন্ন। বন্ধুত্ব বোধ হয় আসলেই পারে সব difference ছাড়িয়ে যেতে।

মূল চার্চের বিয়ে জুন মাসের 1 তারিখে। শ্যারন আর লুইস নবদম্পতিকে অনেক অনেক ভালবাসা।

(ট্রেনে করে ফিরে আসার যাত্রাটা একটু বিটকেলে ছিল। ভিতরে অসম্ভব ঠান্ডা ছিল আর সাজিদ ছাড়া আমরা কেউই সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সারারাত একফোঁটাও কেউ ঘুমাতে পারিনি। শীত তাড়াতে একেকজন একেক অদ্ভুত পন্থা নিল। সাদিককে দেখা গেল ট্রেনের পদর্ার আড়ালে, Woon কে দেখা গেল ওর বড় চামড়ার ব্যাগটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে আর বাথরুম থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে এসে সারা গায়ে জড়িয়ে ফেলা ইন্দ্রনীলকে বলতে শোনা গেল,'টিসু্য পেপার কিন্তু খুব ভাল insulator'! )

[বেশিরভাগ ছবি সাদিকের তোলা। কিছু আমার তোলা আর কিছু সেল্ফ টাইমারে।]


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।