ক্লাস টেনের শুরুটাই হল খুব চমৎকারভাবে। একটা পিকনিক দিয়ে। এমন না যে অন্য ক্লাসে পিকনিক হয়নি। তবে এবারের পিকনিকটা যেন একটু ভিন্ন ছিল । স্কুলের শেষ ক্লাস বলে আমাদের ক্লাসের ছেলে-মেয়ে সবার মধ্যে হঠাৎ করে বন্ধুত্ব বেড়ে গেল। এর আগ পর্যন্ত শুধু ক্লাসমেটই ছিলাম, কিন্তু বন্ধু ছিলাম না সবাই। এটা নাইন থেকেই বোধ হয় শুরু হয়েছিল। যা হয় আর কি! আর একসাথে দেখা হবে না, ক্লাস করা হবে না, একই সাবজেক্ট আর টিচারদের নিয়ে ফাজলামী হবে না - এই বোধ হুট করেই সবাইকে এক করে দেয় মনে হয়। শুধু অপুর সাথেই কেন যেন মাঝখানের ক্লাসগুলোয় যোগাযোগ ছিল না তেমন। দেখা হত প্রতিদিনই, কিন্তু এই ছেলে তার স্বভাবসূলভ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকত। আমি প্রায়ই নানা অজুহাতে ডাক দিয়ে হয় খুব অপ্রয়োজনীয় কোন প্রশ্ন করতাম অথবা তুচ্ছ কারণেই ঝাড়ি দিতাম। কিন্তু সেটাই বা আর কত করা যায়! আমাদের প্রিয় ফোনের আলাপ থেমে গেল কেন যেন। এ কারণে যে সে সময় খুব মন খারাপ ছিল - তা নয়। আগেই বলেছি, ওর প্রতি ভালবাসার জন্য যতটা নয় তার থেকে ওর প্রতি কৌতুহলেই ওকে বিরক্ত করে মজা পেতাম।
যা হোক, 1994 সালের সেই পিকনিকে হঠাৎ করেই ভীষণ মজা হল। ক্লাসের আঁতেল ছেলেগুলো করল সবচেয়ে মজার সব কাজ। অপু দুর্দান্ত সব গেম এর আয়োজন করল। তার একটা ছিল আর্চারীর মত। দূরে ওর আঁকা গোলাম আযমের ছবি, সেটায় সবাই তীর ছুঁড়বে। পিলো পাসিং টাইপ কি যেন একটা গেম ছিল যেটার পুরস্কারগুলো ছিল দেখার মত। অপু খুবই সুন্দর করে সেগুলো সাজিয়েছিল। 1ম পুরস্কার লেখা বিরাট বড় একটা বাড়ির শেপ করা বাক্স দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করল, 'বল তো এটা কি?' আমি তো অবাক! পরে খেলা শেষে দেখা গেল ওটায় ছিল একটা বিরাট সাইজের লাউ! ঐ পিকনিকে আমরা ছেলেদের সাথে ক্রিকেটও খেলেছিলাম মনে আছে। তাও শাড়ি পরে।
পিকনিক শেষেও বেশ কিছুদিন এর রেশ রয়ে গেল। সবার মধ্যেই বেশ একটা বন্ধু- বন্ধু ভাব। ক্লাসের স্বঘোষিত A Team বা আঁতেল টিমের সদস্যরা সবচেয়ে আশ্চর্য সব কাজ করা শুরু করল। A Team এর সদস্য ছিল অপু, জারির (SSC-10th, HSC-4th), জাবের আর সাইফ। সাথে আমার বন্ধু সনি মিলে ঐ পিকনিকের সবার তোলা সব ছবি একসাথে করে একটা অ্যালবাম বানালো। মজার ব্যাপার হচ্ছে - ওরা প্রত্যেকটা ছবির দুর্দান্ত সব ক্যাপশান দিল। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায় টাইপ। একটার কথা মনে আছে। সনি ছিল খুবই শুকনা - প্যাকাটি টাইপ। আমরা ওকে ডাকতাম 'বাঁশ'। আমি একবারই বোলিং করেছিলাম সেদিন, সনি ছিল ব্যাটে - সেটার একটা ছবিতে জারির, আমাদের অতি সিরিয়াস 1st boy ক্যাপশান দিল এরকম - সনি বলছে,'আল্লাহ! মান-ইজ্জত রাইখো!' আর আমি বলছি, 'খাড়া, চারডা বাঁশ একলগে ফেলতাছি'। এ ব্যাপারগুলো আমাদের কাছে খুব ইন্টারেস্টিং ছিল কারণ সেবারই প্রথম হঠাৎ করে ক্লাসের সব সিরিয়াস ছেলেগুলোর হিউমার প্রকাশ পেতে থাকল। আমরা যারা অল-টাইম ফাজিল easy-going type, তারা সবাই ওদের অন্য চোখে দেখা শুরু করলাম। সাথে অপুকেও।
আবার শুরু হল বন্ধুত্ব। এই ক্লাস টেনের কথা মনে করতে গিয়ে শুধু অপুর কথা বললেই ঠিক হবে না। তখন ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে সনি, জাবের আর জারিরের সাথেও আমার তুমুল বন্ধুত্ব হল। সবার সাথেই নানা বিষয়ে নানা সময় গল্প হত। আজকালকার পিচ্চিরা কি গল্প করে জানিনা, কিন্তু আমাদের গল্প এ-ওকে পঁচানো, স্যারদের নিয়ে ফাজলামী, গল্পের বই আর অবশ্যই গানের মধ্যেই ঘোরাফেরা হত। জারিরের সাথে কথা হলে ধর্ম-ইতিহাস-ভাষাতত্ত্ব আরো অনেক বিষয়ে ওর ভাবনার কথা জানতাম। অপুর সাথে কি নিয়ে গল্প হত মনে পড়ছে না। একটা জিনিস মনে পড়ে, সেটা হচ্ছে টুকটাক বিষয়ে ঝগড়া। পট করেই লেগে যেত। আবার ঠিক।
অপুর গলার স্বর তখন থেকেই খুব ভারি ছিল। আমার ধারণা, আমি ওর প্রেমে পড়ার আগে ওর গলার স্বরের প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু তখন সেটা বুঝিনি। বরং ওর ফোন আসলে ঝামেলায় পড়তে হত মাঝে মাঝে। অন্য কেউ ধরলেই বলত, 'অ্যাই, তোমাকে একটা লোক ফোন করেছে।'
আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল আমাদের সবার মধ্যে - কার্ড দেয়া। যেকোন অনুষ্ঠান - হোক না সে জন্মদিন, ঈদ, নববর্ষ - আমরা সবাই সবাইকে কার্ড দেবই। অনেক সময় সেটা পোস্ট করা হত। জন্মদিনের গিফট কুরিয়ারও শুরু হল।
সেই সব কার্ডে অপু খুব সুন্দর করে মেসেজ লিখত। আমার বড়বোন সেই মেসেজ দেখেই আমার আগেই অনেক কিছুর গন্ধ পেত।
দুই ধাপে এরকম আমাদের দুইটা বিরতিকে অপু নাম দিল '3 Yr Theory'। স্কুল ছাড়ার আগে আগে আমাদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। মনে আছে, লাস্ট দিন অপুর জ্বর ছিল বলে সকালে না এসে টিফিনের সময় এসেছিল। আমরা দু'জন ভেবেছিলাম আবার বোধ হয় 3 বছর চলে যাবে বন্ধুত্বের ভাটায়।
কিন্তু স্কুল ছাড়ার পরে আর সেরকম হল না।
[ক্লাস টেনের শেষ সপ্তাহে অপুর তোলা আমার ভেংচি কাটার খুব ফানি একটা ছবি আছে। আহা! কবেকার কথা!]
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন