গ্রামে যখন পোস্টিং ছিল টাটকা শাকসবজি পাওয়া যেতো। শেষ প্রমোশন নিয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছিল মাবুদ সাহেবকে। ঢাকায় এসে মনে পড়তো গাইবান্ধার টাটকা শাকসবজির কথা। বড়ো বড়ো পেঁপে পাওয়া যেতো কতো অল্প দামে। ঢাকায় এসে কতোদিন পেঁপে খাওয়া হয়নি! গ্রামে জামাকাপড় ময়লা হতো কম। দুটো সাফারি স্যুটে চার বছর স্বচ্ছন্দে কেটে যেতো। বিকাল বেলায় হাঁটতে বেরিয়ে মফস্বল শহরের গানের স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে গানের রেওয়াজ শুনতে ভালো লাগতো। ভালো লাগতো মাটির ভাঁড়ে করে একটু রসমঞ্জরী নিয়ে ফিরতে। গরম গরম রসমঞ্জরী। একটা কাঠের ভাঙাচোরা দোকান। অথচ সেই দোকানে উপচে পড়া ভিড়। ঘাগোয়া ইউনিয়ন ভিজিটে গিয়ে প্রীতিলতা পাঠাগারের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিতেন। গ্রামের ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট চেষ্টার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কারের আনন্দ। সবুজ রঙের জিপ গাড়ি থেকে নেমে মহোদয়ের মুখোশ খুলে গণমানুষের ধুলোয় মিশে যাওয়ার অদ্ভুত রোমান্টিকতা এক। বন্যায় ভেসে যাওয়া বাঁশের কারিগর পরিবারগুলোর আবার বেঁচে ওঠার সংগ্রামে পাশে দাঁড়ানোর সুখ। ব্রক্ষ্মপুত্র নদের চরে জেগে ওঠা চরের সিকোস্তিপয়স্তির ঠগি হিসাব-নিকাশের বাইরে ভূমিহীন কৃষকদের একটি গ্রাম রচনার স্বপ্নের সাথী হওয়া।
মফস্বলের গণমানুষের ভিড় থেকে ঢাকার জীবন। আকাশ-পাতাল। প্রথম প্রথম দম বন্ধ হয়ে আসতো মাবুদ সাহেবের। সকাল বেলা শিফটের মাইক্রোবাসের জন্য চাতক পাখির মতো সেজেগুজে বারান্দায় পায়চারী করা। তারপর জ্যামে বসে মাইক্রোবাসের সিটে সিটিয়ে এক পাশে কলিগদের ট্র্যাশ শোনা। শেয়ার বাজারের ওঠানামা- চাকরির জ্যেষ্ঠতা- চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ- লুক্রেটিভ পোস্টিং- সিভিল সার্ভিসের স্বর্ণযুগের আকাশকুশুম স্মৃতিচারণ। অফিসে বসে একঘেয়ে সারপত্র, পরিপত্র লেখা- ফাইলের পতাকা বাড়তে থাকে ক, খ, গ, ঘ...। ওপর থেকে নিচে- নিচ থেকে ওপরে নোটের ওঠানামা খেয়াল করতে গিয়ে মাথা ঘুরে যেতো। হঠাৎ হঠাৎ ফাইল হাওয়া হয়ে যাওয়া- দু'চারটে টাউট লোকের ঘন ঘন আসা- উদ্দেশ্যপ্রণোদিত স্যার স্যার শুনে বিরক্তিতে মন বিষিয়ে উঠতো। দাঁত বের করে বলতো, 'স্যার ফাইলের নিচে চারটে চাকা লাগাতে এসেছি, যাতে জোরে চলে'। 'স্যার মোহাম্মদপুরে একটা অ্যাবানড্যান্ড প্রপার্টি আছে'।
রাবিশ। গা ঘিন ঘিন করে মাবুদ সাহেবের। বিকালে রমনা পার্কে হাঁটতে গেলেও তারা পিছু নিতো। লোকগুলো ইমপসিবল হয়ে উঠলো। তারপর বেশ কয়েকটা পোস্টিং চেঞ্জ। শিফটের গাড়ি চেঞ্জ। শুধু বদলায় না প্রতিদিনের গল্পের প্রসঙ্গগুলো। আবার অনেকেই মাবুদ সাহেবকে নিয়ে ঠাট্টামস্করা করতো। অপরাধীর ভঙ্গিতে মাবুদ সাহেব শ্বাস রোধ করে বসে থাকতেন গাড়ির এক কোণায়।
শুধু ভালো লাগতো মাঝে মধ্যে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চেম্বারে ডেকে ডায়াবেটিক বিস্কুট আর দুধ-চিনি ছাড়া কফি খাইয়ে বলতো, উই নিড মোর পিপল লাইক ইউ।
কোনো অসুবিধা হলে বলবেন।
বড়ো মেয়েকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করতে গিয়ে মনে পড়ে অতীত স্মৃতি। আইউব শাহীর বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলনের স্মৃতি। কার্জন হল, শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক হলের মাঝে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে। শুধু তার চুলগুলো সাদা, প্রেসার হাই- বুক ধরফড় করে। মনে পড়ে মিছিলের কতোগুলো ঝাপসা মুখ। চারপাশে হেঁটে যাওয়া তরুণদের মতোই। কমপিটেটিভ পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে চলে গেলেও আন্দোনলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতো। মাসে মাসে চাঁদা পাঠাতেন ঠিকঠাক। চাকরিরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে চলে যাওয়া। টুকরো টুকরো স্মৃতির কোলাহল। কতো স্বপ্ন এই দেশকে নিয়ে। মফস্বলের প্রতিটি পোস্টিংকে তিনি এনজয় করেছেন। মানুষের জন্য কিছু করতে পারার সুখ। বদলির সময় শতশত মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত কান্নার জল। যেখানেই গেছেন, মায়ায় জড়িয়ে গেছেন। কোন একটি উচ্চবিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সাংস্কৃতিক সংগঠনে স্টিলের আলমারি- বইপুস্তক, বয়ঃশিক্ষা- রক্তদান কর্মসূচি, আই ক্যাম্প, ষোলই ডিসেম্বরে আন্তঃস্কুল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। পাবনা জেলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রের রচনা প্রতিযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা প্রত্যয়ী শব্দাবলী তিনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। লাঞ্চ ব্রেকে হটপট খুলে ভাত-মাছ-লালশাক, কাগজিলেবু চিপে খেতে খেতে তিনি ঘুরে আসেন স্মৃতির লম্বা বারান্দা। অনেক দেশে শুনে নিউমার্কেট কাঁচা বাজার থেকে কাগজিলেবু কিনে এনেছেন। তারপর চা খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ রেখে পে-স্কেলের খসড়া নিয়ে দারুণ উত্তেজনা হয়। ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসাব কষে ফেলেন। বেইলি রোড থেকে একটা সুন্দর শাড়ি কিনতে হবে, অনেক দিনের শখ। দারুণ উত্তেজনা হয়।
জ্যেষ্ঠতার তালিকায় একের পর এক কতোজনই সুপারসিড করলো। একবারও বলতে রুচি হয়নি আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ তো একেবারে নিজস্ব অহঙ্কার।
অনেকেই সদুপদেশ দিলো, মাবুদ সাহেব চেষ্টা করুন। আপনার এক্সটেনশন হয়েই যাবে।
প্রশ্নই ওঠে না। মাবুদ সাহেব একখানা কুরআন শরীফ, ছাতা, স্যুটপিস, দেয়ালঘড়ি, স্ত্রীর জন্য বেইলি রোডের শাড়ি আর মানপত্র নিয়ে বাসায় ফিরলেন। তার কানে বাজতে থাকলো সহকর্মীদের বক্তৃতার বিশেষণগুলো।
তারপর এক একটা দিন মসৃন ভোর থেকে শুরু করে রাতের শয্যায়। এলপিআরটা ভালোই কাটলো। কিন্তু পেনশনের টাকা তুলতে গিয়ে শরীর ভেঙে পড়লো। মনে মনে শুধু বলতেন, 'শক্তি দাও খোদা- আমাকে টাকাগুলো তুলতে হবে'।
মাঝে মধ্যে শতায়ু অঙ্গনে সফল বন্ধুদের প্রমোশন, এক্সটেনশন, বিদেশ ভ্রমন, আন্তর্জাতিক সংস্থায় লিয়েন, কনসালটেন্সির গল্প শুনে প্রাণ ভরে যেতো। এতোটুকু ঈর্ষা হয়নি কখনো। মেয়ের বিয়ের জন্য তখন অল্প কিছু টাকা স্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন- স্ত্রী ম্লান হেসে বলেছিল, এই টাকায় আজকাল কিছু হয় না।
মেয়ের বিয়েটা হয়েই গেলো। তারপর প্রায়ই তিনি স্ত্রীকে বলতেন, চলো গ্রামে চলে যাই। ব্রক্ষ্মপুত্রের নতুন চরে গড়ে ওঠা নতুন কোন স্বপ্নের গ্রামে। এমন অনেক গ্রামই তো নিজের হাতে গড়া। কোথাও না কোথাও নিশ্চই আশ্রয় মিলবে। গুলিস্তানে গাইবান্ধার কাদের মুনশীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে। 'ছার হামরা আপনাক মাথাত করি আখবো'।
মেয়ে- জামাই ঢাকায় থাকে। স্ত্রী রাজী হয় নি। বলো কি তুমি, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে!
উইকএন্ডে মেয়ে- জামাই বেড়াতে এলে মাবুদ সাহেব ব্যস্তসমস্ত হয়ে বাজারে দৌড়ান। এক এক করে বাজারের ফর্দের সবকিছু কেনেন। শরীরে ঘাম হতে থাকে। চোখটা একটু লাল। মাছের বাজারে ঢুকে চারপাশের শব্দ অবচেতনের সারি সারি কোলাহলের মতো মনে হয়। একটা রুই মাছ দেখে খুব পছন্দ হয়ে যায়। মন লেগে যায়। মাছের আঁশগুলোর রং বড় বাহারি। গাইবান্ধায় এমন রুই মাছ পাওয়া যেতো। মনের মধ্যে ঝাপসা ঝাপসা স্মৃতির ভিড়। হরেন জেলে বাসায় এসে বেচে যেতো। 'স্যার খুশি হয়ে যা দেন'।
মাবুদ সাহেব মাছের আঁশের রং দেখে দামের বাইরেও বখশিশ দিয়ে হরেনকে বিদায় করতেন। হঠাৎ মাছের বাজারে মাঝে চিৎ হয়ে পড়ে যান মাবুদ সাহেব।
কতোক্ষণ এইভাবে পড়ে থাকে একটি অপরিচিত লাশ। মাবুদ সাহেবের পছন্দের রুই মাছের ওপর থেকে মাছিগুলো এসে তার খোলা চোখে বসে। উই নিড মোর পিপল লাইক ইউ!
মন্তব্য
ভাইয়া গল্পটা পড়ে খুবই ভালো লেগেছে। এইরকম মানুষ কিন্তু অনেক ছিলো কিন্তু সবাই খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছেন। যদি এঁদের কথাগুলি ধরে রাখা যেতো তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আজকে এতো কনফিউশন তৈরি হতোনা। এঁদের যদি সময়মতো সামনে এগিয়ে দেওয়া হতো তাহলে দেশেরও আজকে অনেক ভালো অবস্থা হতো। আপনার গল্প পড়তে অনেক ভালো লেগেছে একই সাথে অনেক মন খারাপ হয়ে গেছে। আপনার বর্ণনা খুবই সুন্দর।
অনেকদিন পর লিখলেন।
হাঁটুপানির জলদস্যু
মাছবাজারে প্রাণত্যাগ।
যাক মৃত্যু নিয়ে রসিকতার বিষয়টাও ধরা পড়ে।
ভালো লাগলো।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
হুমম।
মুগ্ধ।
মধ্যবিত্ত চাকুরে বাবার মাস-বেতনে চালানো সংসারে অনেক দঙ্গল ভাই-বোনের মাঝে কষ্টে বড় হয়ে ওঠার স্মৃতির পুরো ছবির মাঝে বাবার চেহারাটাই সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ভেসে উঠলো।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
নতুন মন্তব্য করুন