শান্ত চুপচাপ আরণ্যক সকাল এলো। একটি দিনের শুরু। দাওয়ায় বসে চাষের ক্ষেতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবাই। হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দে সচকিত হলো সকাল। পর্যাপ্ত ধূলোয় চারদিক অন্ধকার করে এলো মধ্যাহ্ন। একদল মানুষ এলো। চোখেমুখে ঔদ্ধত্য নিয়ে। নদীটি চুপচাপ দেখছিল স্থলদস্যুদের। কেমন করে বনের সুখেরা মরে গেল। ঐ রকম করে আর কোন সবুজ সকাল এলো না। ঘুঙুরের শব্দ ঘুমিয়ে গেলে মদ্যপ সকাল যেমন হয়। যেমন ঝিমুনি নিয়ে আসে। ক্রমাগত চাবুকের শব্দে ডাহুকেরা পালিয়ে গেল। ঝাড়বাতি দেখে জোনাকিরা অন্ধকারে নিঃশব্দ ডুব দিলো। পরদিন দুপুরে ওরা চাকায় বেড়ি পরাচ্ছিল। পথ হলো, ঘাট হলো, লাল সুড়কির দালান হলো। বৃক্ষরা ক্রমাগত মরে গেল। একদিন হতচকিত জনপদটি দেখলো জলদস্যুদের। আকাশ ছেঁয়ে গেলো বৃক্ষের শরীর পোড়ানো ধোঁয়ায়। আরন্যক উপত্যকায় সমতল পথ হলো। অথচ বেপথু হলো সমতল। অরণ্য মরে গেলে নরম পলিমাটিক বুক চিরে তৈরী হয় পাথর শহর। মাটির খুব গোপনে থেকে যায় আরণ্যক কষ্টের মৃদু লীনতাপ। খুব অগোচরে সূর্যের হলুদ ঠোঁট ছুঁয়ে নিয়ন বাতির আলোকযজ্ঞে বিষণ্ণতার শহর ঢাকা।
ব্যস্ত ঘড়ির কাটাটা পাগলের মতো ঘুরে চলেছে। হৃৎপিন্ড যখন ইঞ্জিনের হাপরের সঙ্গে ওঠানামা করে এলিয়টের আধুনিক মানুষ তখন অসহায়। ব্যস্ততা জীবনকে খেয়ে ফেলছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি একঘেয়ে কর্মচক্র জীবনের প্রয়োজনীয় বিকাশকে বিড়ম্বিত করছে। কম দৈর্ঘ্যের টাউন সার্ভিসের পাদানিতে ঝুলে, ভিতরে খানিক ঠাঁয় নিয়ে নুয়ে পড়ছে মানুষ। প্রাইভেট কারের পিছনের সিটে হেলান দিয়ে অর্ধঘুমে অর্ধজাগরণে কুঁকড়ে যাচ্ছে। কাজতো করতেই হবে। কাজই তো জীবনকে ঐশ্বর্য দেবে। কিন্তু কাজ যদি জীবনকে অর্থহীন ঘোড়দৌড়ে পরিণত করে তখন মানুষ টেনিসনের লোটাস ইটারদের মতো ন্যুব্জ দেহে আশ্রয় খুঁজবে। সকাল বেলা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে প্রস্ফুরকের মেকআপ সাঁটতে প্রিসিলার উজ্জ্বল চোখ কিংবা চাটাইয়ের ভাঁজে আটকে রাখা গোল আয়নাটা খুঁজে নিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ফুলমতির কাজল আঁকা- এসবই বিষণ্ণতার মুখমন্ডলে মোড়ক দেয়া। শহরের চোখে সিজোফ্রেনিক ঘুণ, পরিপাটি ড্রয়িংরুম বাবুই পাখির বাসা, অ্যাক্যুরিয়ামে হলুদ-সবুজ মৎসদল, ঝুলবারান্দায় অর্কিড- এসবই ভুল প্রচেষ্টা। ব্যালকনির চাঁদ এখন লাইক্যানথ্রোপিক রোগে ভুল আলোকবিন্দু। এই শহরে অসংখ্য মানুষ রাতের পর রাত জেগে থাকে। ওয়াইচার্লির নাটকের নট-নটীদের মতো অসম্ভব হাস্যকর একটি দিনের অভিনয় শেষে একসময় তাদের হাসি ফুরিয়ে যায়। এই শহরের ফাঁপা মানুষ এখন শুধু নিজেকে ভালোবাসতে ভালোবাসতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে যেন। জীবনের আঁটোসাঁটো রুটিন একসময় অঙ্ক খাতার শেষ পৃষ্ঠা থেকে খসে পড়েছে। মূক, বধির, অন্ধ, অক্ষম লোমওঠা নেকড়ের জীবনে ক্লান্ত সবাই- বিষণ্ণ; খুব বিষণ্ণ।
খুব ভোরবেলা যে কিশোরী মালকোশ রাগে সুর সাধছে তার আত্মার কাছে সুর কি পৌঁছায় কখনো, নাকি কেবল স্বরযন্ত্রের দেয়ালে ভুল প্রতিধ্বনিত হয়! সকালে উঠে ক্রিসেন্ট লেকের ধারে হাঁটতে যাচ্ছেন যিনি, তার শরীরে তো আত্মা নেই। একটি সবজি-শরীরের জন্য কি সব দুর্মর প্রচেষ্টা। শহরের পার্কগুলোতে বিষণ্ণ মানুষের দল ভিড় জমায়। কয়েকজন মানুষ অসম্ভব হো হো হাসিতে কখনো বা চটপটির আড্ডায় দুঃখ ভুলতে চেষ্টা করে। এ দুঃখ সে কখনোই ভুলতে পারে না। কারণ, এর কারণ সে জানে না। চায়নিজ রেস্টুরেন্টের অপর্যাপ্ত হলুদ আলোয় পৌঢ়ার চোখ মুহূর্তে তরুণী হয়ে যায়- ষাটের দশকের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কাঁটা চামচ হাতে লজ্জিত হয়- আমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে লজ্জিত হয় আধুনিকা ঘরনী। যার খাটুনি কমাতে অতিথিদের চায়নিজের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। বাসায় দাওয়াত করে খাওয়ানোর রেওয়াজ এ শহরে প্রায় উঠেই গেছে। বিল চুকিয়ে বিধ্বস্ত ভদ্রলোক যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছেন- গোল আয়নায় চোখের শেড ঠিক আছে কিনা তা দেখতে দেখতে ঘরনীর মৃদু অনুযোগ।
: ওদের বাসায় রেখে আসলেই হতো।
এইভাবেই ষাটের দশকের মানুষকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে সত্তর দশকের মানুষ, সত্তর দশকের মানুষকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে আশির দশকের মানুষ। এই লুকোচুরির পৌনঃপুনিক ধারায় এই শহর একদিন সমস্ত মানুষকে অবগুণ্ঠিত করবে। তারপর তারা পথে বেরুবে ছদ্মবেশে। জেনারেশন গ্যাপ কমাতে মানুষ ছদ্মবেশী হবে। মানুষ যত বেশি ছদ্মবেশী হবে তত বেশি বিষণ্ণ হবে। শহরের পেস্ট্রিশপগুলোতে, কাবাব হাউসগুলোতে বিভিন্ন প্রজন্মের উজ্ঝ্বল মানুষরা তাদের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আসে। অল্পশিক্ষিত ওয়েটার কিংবা ম্যানেজারকে বিড়ম্বিত করে তার মানিব্যাগের ঔদার্যে, বাহারি পোশাকের ঠমকে, পারফিউমের ঝাঁঝালো দুর্গন্ধে, চটকদার ইংরেজী কথোপকথনে সবশেষে শুকনো টিস্যু পেপারে ঠোঁটের কোণটা মুছে। একটি দৃশ্যের অভিনয় এখানেই শেষ। আসলে ওয়েটার বা ম্যানেজার এখানে অবজেক্ট। সাবজেক্ট তার পাশে দাঁড়ানো ছিল, অলিভ ব্লেজারের সোনালী বোতামে তার চোখ দেখা যাচ্ছিল। মিরান্দার নির্মল চোখ।
: এইট ওয়ান ওয়ান নাইন ওয়ান নাইন সেভেন।
একদিন মানিক মিয়া এভিনিউর চওড়া রাস্তায় খয়েরি বাইকের পিছে, কাঁচপুর সেতুর সঙ্কীর্ণ বুকে ফেরোজা গাড়িতে, মিড নাইট সানের কোণার টেবিলে তারপর ফার্দিনান্দের বাগান বাড়িতে লোলিতলোভনকান্তি সেই মিরান্দা আবিষ্কৃত হবে বারবার। লাভ এট ফার্স্ট সাইট । ওদের জীবনে বারবার আসে ভাল লাগার মহেন্দ্রক্ষণ। ওরা জীবনের এপিঠ-ওপিঠ সমস্ত রহস্য ছিঁড়ে খুঁড়ে এক সময় জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ওরা বিষণ্ণ হয়।
ঢাকার বর্তমান সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিবেশের সোৎসাহ এনথুসিয়্যাজমের মাঝেও একটা বিষণ্ণতা রয়েছে। এসব সংস্কৃতি চর্চায় আসল কাজটি বোধহয় একেবারেই হচ্ছে না। আত্মার ক্ষিধে মিটছে না। হয়তোবা খুব কম সৃষ্টিই হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছুচ্ছে। কণ্ঠশীলন বা নাট্যশীলনের মতো ব্যাপারগুলো ক্রমশ: ব্যবসায়িক চেহারা নিচ্ছে। 'গ্রুপ থিয়েটার করি' একজন ফ্যাশন সচেতন তরুণ বা তরুণীর প্রিয় উক্তি। অহরহ কণ্ঠকে শাণিত করে দুটো লাগসই কবিতার লাইন আউড়ে অনেকেই আবৃত্তিকারের একটি গর্বিত এক্সপ্রেশন দিয়ে বসে থাকেন টিএসসি চত্বরে। যেন শিল্পের শিল্প। একটা কিছু করতে হবে তাই করা। ভিতরের টানাপোড়েন নেই, শিল্পের জন্য কষ্ট নেই। যেন একটি নিয়ম। কিছু মহড়া, একমুঠো বাদাম, ঝকঝকে ডায়েরি, এককাপ চা, খোশগল্প, চোখাচোখি, চোখের তলায় ক্রাইসিসের কালি, বানোয়াট ব্যতিক্রমী বোহেমিয়ান আচার-আচরণ, সেন্স অব হিউমার- এর কপর্দকশূন্য তীর ছোড়াছুড়ি, খুব ভেতরে স্টার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, কেবল সুযোগ খোঁজা, সমস্ত কিছুর পরেও একটি ক্যারিয়ার সচেতনতা, তারও পরে সেই একজনকে খোঁজা ইত্যাদি বিষয়ের মাঝে আসল ব্যাপারটি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। একটি ভালো স্টেজশো হয়তো হচ্ছে। কিন্তু আসলে শিল্পী হচ্ছেন ক'জন। শিল্পীর বেশবাস নিয়ে, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, সর্বোপরি একজন পরিণত শিল্পীর মতো চলায় বলায় ঝোলায় পাঞ্জাবিতে শিল্পিত স্বপ্ন নিয়েও একজন তরুণ বা তরুণী যখন শিল্পী হতে পারে না তখন সে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। লিটল ম্যাগাজিনের আড্ডায় উজ্জ্বল কবিদল যখন বোদলেয়ার, কাফকা, কামু হয়ে সোয়েঙ্কা, নইপল, ব্রেখট, জাঁ পল সার্ত, জোয়েস ঘেটে একাকার করে তারপর কবিতা-গল্প ইত্যাদি বিনির্মাণে উৎসাহিত হয়। বিজ্ঞাপন খোঁজার মাঝে দুপুরে একটি বাটারবন এবং কলা খায়, সম্পাদনা পর্ষদে লাস্যময়ী কবিতাবিমুখ একজন তরুণীকে সংযুক্ত করে ফ্রাগমেন্টেড ভিসানের কবিতা লিখে হাত-পা ছুড়ে। ওপার বাঙলার কবিদের কিসসু হয় না ইত্যাদি বুলি আউড়ায়। এক সময় এপার বাঙলায় নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শুরু করে। অনেক কষ্ট করে একজন পৃষ্ঠপোষক জোগাড় করে একটি কবিতার বই ছাপায়। বইটি বিক্রি হয় না। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে একটি চাকরির চেষ্টা করে। কোন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য শাখার ডেস্কটি আলোকিত করার সুযোগ খোঁজে। হয়তো সুযোগ পায়ও, হয়তো পায় না। পড়াশোনা কম করে, বলে বেশি। সবাইকে বিরক্ত করে। টিএসসি'র বিরানী খেতে খেতে একসময় একঘেয়ে হয়ে পড়ে জীবন। কবিদেরও প্রতিষ্ঠান হয়। একান্ত ব্যক্তিগত পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা যায় ফেরিওয়ালাদের ঝাঁপিতে। কেউ কেউ কবিতা ফেরি করে। রাজকবি হয় কেউ কেউ। সুযোগ পেয়েও নিজের সৃষ্টির সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিষণ্ণ হয়, কেউ কেউ সুযোগ না পেয়ে বিষণ্ণ হয়। আকাঙ্ক্ষার দোর্দণ্ড প্রতাপে শহরের অকবি দল বিষণ্ণ হয় অথচ বেঁচে থাকে। কিন্তু এ শহর আবুল হাসানকে বাঁচিয়ে রাখে না। রুদ্রকে বেঁচে থাকতে দেয় না। এখানে রাজকবিরা ঝলমলে আড়ং-এর নকশাদার পাঞ্জাবি পরে কবিতা সন্ধ্যায় উচ্চকিত হয়- চিৎকার করে, প্রতিবাদ করে। অথচ মনে মনে সে আরও একটি লিফট খুঁজছে। একটি ইকনো কলম তার জন্য যথেষ্ট নয়। সে একটি চন্দন কাঠের কলম খোঁজে। কবি-অকবিরা পুনর্বাসিত হয়। তাদের অফসেট পেপারে ছাপা স্কেচসমৃদ্ধ অ-কাব্যগ্রন্থ পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায় সাদরে সমাদৃত হয়। 'ঢাকাই গোলাপ' কলকাতার সুনীল ভাইয়াদের আসরের মধ্যমণি হয়। পূর্ণেন্দু চাচ্চু মাঝে মধ্যে ঢাকায় এসে সে গোলাপের গন্ধ নিয়ে যায়। এই সব ভুল কবি, শাসক-শোষক-পরিতোষক, ভণ্ড সমালোচক, স্থূল সৌন্দর্য্যধারকদের ভিড়ে পরাজিত মেঘদল বিষণ্ণ হয়। বিষণ্ণ হয় শহর।
(চলবে!)
******* ******** *********
হাজারদুয়ারীর চলতি সংখ্যার সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত।
মন্তব্য
তারপর?...
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
নতুন লেখা চাই।
মাসকাওয়াথ ভাই, এই লেখা অনেক পুরনো,অনেক ভালো লাগার ।
নতুন গল্প দেন বস ।
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
নতুন মন্তব্য করুন