'সত্য' হচ্ছে ফিনিক্স পাখীর মত

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি
লিখেছেন মাসকাওয়াথ আহসান (তারিখ: শুক্র, ২০/০৭/২০০৭ - ৪:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কখনো কখনো ক্ষমতা কাঠামোর দোর্দন্ড প্রতাপ আর উল্লম্ফন দেখে সাধারণ মানুষ অসহায় বোধ করে, নিয়তির কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা তাদের।
মনে আছে একবার গভীর রাতে আসাদ গেট থেকে আরিচাগামী এক কাঠবডি বাসের ছাদে উঠেছিলাম ইচ্ছা করেই। দেখতে চেয়েছিলাম ডালি-কোদাল হাতে ঘরমুখো যে ক্লান্ত মানুষেরা ওখানে বসে থাকে তারা কোন স্বাধীন দেশের নাগরিক। পতাকা, মানচিত্র, সংবিধান- এগুলোর কোন অর্থ আছে কীনা তাদের কাছে!

প্রায় তিন ঘন্টার বিরামহীন যাত্রায় লক্ষ্য করেছি ওইসব মানুষ হচ্ছে স্বপ্নের অভিযাত্রী। ঠ্যাঁকে আটকে রাখা ময়লা ৫০ টাকার নোট, ডালির মধ্যে প্লাস্টিকের খেলনা, গলায় বেঁধে রাখা লাল ডুরে শাড়ী- এই হচ্ছে বাংলাদেশ। নাকের সামনে ধক করে লাগা সাদা ভাতের গন্ধ, ক্ষিদেয় শুকনো পাউরুটি চিবানোর ফাঁকে- এই হচ্ছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল।
কোন দল ক্ষমতায়, কার ঠ্যামরে ব্রুট মেজরিটি, সিঙ্গাপুরে কার আলিশান ফ্ল্যাট, কার পোর্টিকোর নীচে দাঁড়ানো মার্সিডিজ, রুলস অব বিজনেসে কার স্বাক্ষরের মুরোদ কতো, কার টেলিফোনে নড়ে যায় ফাইলের গতিপথ- এইসব অর্থহীন মনে হয়েছিল কালো কালো মানুষের ভাঙ্গা গালের নীচে ঘরে ফেরা নির্মল হাসি দেখে। ওইতো বাংলাদেশ, এক টুকরো শুকনো পাউরুটি, হালাল রুজি দিয়ে কেনা প্লাস্টিকের খেলনা।

জানুয়ারী এগারোর পরে এপর্যন্ত চলমান ঘটনা প্রবাহ নিয়ে নানা রকম অভিমত থাকতেই পারে। এখন যা কিছু চলছে তা কি অন্তর্বতী শাসন নাকি জলপাই শাসন! এইসব প্রশ্নের ঘূর্ণাবর্তে কাটবে আরো কিছু সময়।
তবে একটা জিনিষ নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবে- এটা একটা প্রতীকী অবস্থা। সব গ্রেফতার যৌক্তিক না হলেও অধিকাংশ গ্রেফতারই সময়ের প্রয়োজনে। 'আইনের উর্ধ্বে কেউ নয়'- এই প্রায় অচল বাক্যবন্ধটি হঠাৎ সচল হয়ে ওঠার ঘটনাটা অভিনব। বাংলাদেশে কোন পরিবর্তনই অর্থহীন ছিল না। আর যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ, সেই রাবণ বধের মহাযজ্ঞে আমরা সাধারণ মানুষ এখন ফলাফলের অপেক্ষায়। আমরা ধৈর্য্য ধরতে পারি। গরীব মানুষকে ঈশ্বর যথেষ্ট ধৈর্য্য দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন।

মাননীয় ক্ষমতা কাঠমো,
এবার পরিবর্তন কিন্তু আনতেই হবে। সারাদিন মাটি কেটে এক শানকি গরম ভাতের স্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফিরছি। রাজা যায় রাজা আসে, আমার কী তাতে কিছু যায় আসে! অবশ্যই যায় আসে। আমার শ্রম এবং ঘামের রাজস্ব জমা হয় রাজকোষে। সরকারী প্রেসনোট কিংবা সুশীল সমাজের বিবৃতি কিছুই পড়তে পারিনা আমি। তবে আশায় আশায় থাকি, যুদ্ধের বছর যত গরীবের রক্ত, নব্বই সালে আমার জাতভাই নূর হোসেনের রক্ত- এইসব ফিনিক দিয়ে ওঠা রক্তের দাম দেবে আপনাদের সংবিধান।

"আমরা গরীব মানুষ একটা জিনিসরেই গুরুত্ব দেই। সেইডা হইতেছে সত্য কথা।
সদা সত্য কথা বলিবে। সত্য হইতেছে অচিন পক্ষীর মতন। ছাইগাদা থিকা ফাল দিয়া ওঠে, উইড়া যায়।
আরিচা আইসা গেছে।
অহন গিয়া লঞ্চে উঠুম।"

কাঠবডির ছাদ থেকে একে একে নেমে যায় বাংলাদেশের নাগরিকেরা। যারা এতদিন ভোট দিয়ে রাবণ নির্বাচিত করেছে। এখন কিন্তু তারা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, একটা ফিনিক্স পাখীর উড়ালের অপেক্ষায়।।

*********************

বিদ্র : লেখাটি হাজারদুয়ারীর জুন সংখ্যার সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত।
নিয়মুত পড়ুন হাজারদুয়ারী


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

আমরাও বুক ভরে আশা নিয়ে বসে আছি আমাদের ওদের আশাগুলো একদিন পাখির ডানা পাবে। আর পাবে উড়বার মতো মুক্ত আকাশ।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সুমন চৌধুরী এর ছবি

হ্যা।
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হাততালি
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- গল্প কবিতার পর সিরিয়াস (সমসাময়িক ভাবনার) লেখাতেও কথ্য ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিকতার ব্লেন্ডিং। ব্যক্তিগত কলামের ভাষা হবে নদীয়ার ভাষা, এটাকে তাহলে সাকসেসফুলীই রিপ্লেস করা গেলো!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।