এবার গণতন্ত্রের চাকা ঘুরতে পারে

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি
লিখেছেন মাসকাওয়াথ আহসান (তারিখ: শুক্র, ১২/০৯/২০০৮ - ৮:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন পথে? এই অন্তহীন প্রশ্নের দোলাচলে সময় কাটছে জনমানুষের। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভয়াবহ দূষণ যে এক-এগারো সন্নিহিত তত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতায় আসীন করেছে, তার দুর্নীতি বিরোধী অভিযান, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার উদ্যোগ দেশবাসীর মনে বেশ আশার সঞ্চার করেছিল।
দুর্নীতিবাজ ফ্রাঙ্কেস্টাইনদের গ্রেফতার, বিচার প্রক্রিয়া 'কেউ-ই আইনের ঊর্ধ্বে নয় ' এই চিরন্তন বাক্য বন্ধটিকে সচল করে তুলেছিল। অবশ্য দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনমানুষের দেশপ্রেম, গণতন্ত্রের প্রত্যাশা এসব বিমূর্ত অথচ জরুরী উপাদানগুলোকে অনেকটাই ফিকে করে রেখেছে।
এক-এগারো সরকারের জনসমর্থনের পারদ ওঠানামা করেছে বাজারদর ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।

মাইনাস টু, মাইনাস পরিবারতন্ত্র- এসব হিসাব নিকাশ রাজনৈতিক বিকাশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, বাংলাদেশ মুশাররফ মডেল গণতন্ত্রের দিকে এগুচ্ছে কিনা সেই আশংকা সচেতন জনগোষ্ঠীকে বেদনাহত করেছে পুরো সময় জুড়ে। অবশ্য পাকিস্তানে মুশাররফের পতন সেই প্রশ্নের একটা উত্তর খুঁজে দিয়েছে আপনা আপনি।

সন্দেহভাজন কিংবা অভিযুক্ত রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার, বিচার প্রক্রিয়া অতঃপর গণজামিন বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার পাটীগণিত কিংবা 'যেই লাউ সেই কদু' জাতীয় লোকজ রসিকতার ক্ষেত্র তৈরী করেছে কিনা তা নিয়েও চায়ের স্টলে ঝড় উঠেছে। উপায়হীন জনমানুষ সাক্ষী গোপালের মত অর্ধেক বুঝে অর্ধেক না বুঝে নিয়তির কাছে নিজেদের সঁপে দিয়ে বসে আছে। উপায় সম্পন্ন মানুষেরা বাংলাদেশ 'রুয়ান্ডা হয়ে গেছে' জাতীয় কনক্লুশনে পৌঁছে নিয়তি বদলাতে পশ্চিমে কিংবা মধ্য গোলার্ধে দেশান্তরী হবার প্রবণতাও সচল রেখেছে।

এক-এগারোর পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিবর্জিত একটি উচ্চাভিলাষী নব-রাজনীতিবিদ গোষ্ঠী গলি থেকে রাজপথ ঘুরে সংসদের সবুজ চেয়ারে বসার দিবাস্বপ্নে ব্যাকুল হয়েছে।

মেয়র নির্বাচনে গণতন্ত্রের গুণগত উত্তরণের খুব বেশি নজির না দেখে দুর্নীতিগর্বী সিজনড রাজনীতিবিদরা গোঁফে তা দিচ্ছে আবারো ক্ষমতায় গিয়ে এক হাত দেখে নেবার কুসংকল্পসহ। তাহলে কী দাঁড়ালো? থোব বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়!

এর উত্তর সম্ভব না।
এক. এক-এগারোর পরিবর্তন ছিল দেশকে সীমাহীন নৈরাজ্য থেকে আপাত ভাবে রক্ষা করে সুষম গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবার আগ্রহ থেকে।

দুই. এক-এগারো সন্নিহিত নব্যরাজনীতিকরা এক সেট নতুন খেলোয়াড় সংসদে খেলবে এই ইউটোপিয়ায় মগ্ন হলেও দুর্নীতি বিরোধী অভিযান ছিল সম্ভবতঃ নজীর স্থাপন এবং সমঝে চলার প্রতীকী দৃষ্টান্তের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা আর সার্বভৌম দুর্নীতি দমন কমিশন ও ট্রুথ কমিশনের ভবিষ্যত যাত্রার পথ প্রশস্ত করার লক্ষ্যে।

তিন. মেয়র ইলেকশনে কোন রকম ভোট কারচুপি বা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর সুযোগ না থাকায় অন্ততঃ সভ্য নির্বাচনের কর্মশালা বলা যায় এই প্রক্রিয়াকে। সার্বভৌম নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশা পথ হাঁটতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।

চার. গ্রেফতারকৃত রাজনীতিবিদদের গণজামিন সম্ভবত রাজনীতির চাকাকে সচল করতে। জাঢ্য জরদগব রাজনীতি ব্যবসায়ীরা বাইরে বেরিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেও, বাংলাদেশের জনমানুষের নেতৃত্বের স্বপ্নের সমান্তরাল দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া বিশেষ কারাগারে বসে তাদের ভুল ভ্রান্তির স্মৃতি রোমন্থন করেছেন, তাদের প্রতিনিয়ত দিকভ্রান্ত করে এমন বসন্তের কোকিলদের চিনে নিয়েছেন প্রতিদিন-প্রতিরাত-প্রতিমুহূর্তে।

পাঁচ. এক-এগারো সরকার সামরিক সমর্থনে অনির্দিষ্টকালের জন্য থেকে যাবে ক্ষমতায়- এই হাইপোথিসিসও আপাততঃ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। নয়াস্বপ্নে উদ্দীপিত পাকিস্তান মডেলের ভুঁইফোড় কিংস পার্টিগুলোর সম্ভবতঃ সাইনবোর্ড গুটানোর সময় এসে গেছে।

এখন সম্ভবতঃ শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া ক্ষমতামুখী দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির পরিবর্তে ভবিষ্যতমুখী সমন্বয়ী রাজনীতিকতা চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠবেন। পরষ্পর বিদ্বেষ পোষণ না করে নব্বুই এর গণঅভ্যুথানকে ঘিরে যে ধরনের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন। দেশবাসীর আকাঙ্খা দেশের প্রধান দুই নেতা পাশাপাশি বসে এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেবেন যাতে আর কোনও এক-এগারো পরিস্থিতি তৈরী না হয়।

নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, কালোটাকা, পেশী শক্তির পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা রাজনীতিবিদদের চরিত্রকে যেন প্রশ্নবিদ্ধ না করে সেই চেষ্টা তারা দুজনে মিলে যদি অব্যাহত রাখেন তাহলে বাংলাদেশ আর পেছনে হাঁটবে না, 'ব্যর্থ রাস্ট্রে'র কলঙ্ক বৈশ্বিক পরিসর থেকে মুছে যাবে, বাংলাদেশের ধৈর্য্যশীল স্বপ্নগ্রস্ত মানুষ আরও একবার ভরসা রাখতে চায় এই দুই দেশপ্রেমিক নেত্রীর ওপর।

আশা করি তাঁরা দুজন এই আস্থার প্রতি সম্মান দেখাবেন।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

দেখা যাক শেষমেষ যে লাউ সেই কদুই হয় কিনা।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

হিমু এর ছবি

তারপর ঘুম ভেঙে উঠে দেখি সেই ছেঁড়া কাঁথাটি দিয়েই লজ্জা ঢেকে রেখেছি।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অতিথি লেখক এর ছবি

এনবিআর এর এত কড়াকড়ির যুগেও আশার উপর ট্যাক্স নাই বুঝলাম তাই বলে এত আশা করে পরে ছ্যাকা খাইয়েন না ।
নিবিড়

নজমুল আলবাব এর ছবি

আগের মতই সব হবে, আমরা শুধুই দর্শক মাত্র।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, কালোটাকা, পেশী শক্তির পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা রাজনীতিবিদদের চরিত্রকে যেন প্রশ্নবিদ্ধ না করে সেই চেষ্টা তারা দুজনে মিলে যদি অব্যাহত রাখেন তাহলে বাংলাদেশ আর পেছনে হাঁটবে না...

নেতানেত্রীগণ মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তান-সন্ত্রাসীগুলাও মুক্তি পাচ্ছে। কেউ কেউ পাশের দেশ থেকে স্বদেশেও প্রত্যাবর্তন করছে। লক্ষণে কি মনে হয় বাংলাদেশ আর পেছনে হাঁটবে না?
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

সুমন চৌধুরী এর ছবি

এক. এক-এগারোর পরিবর্তন ছিল দেশকে সীমাহীন নৈরাজ্য থেকে আপাত ভাবে রক্ষা করে সুষম গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবার আগ্রহ থেকে।

দেখা যাক।
এরকম হলেই ভালো। তবে চুন পোড়া জ্বিভে রুচির খোঁয়াব দেখা কঠিণ।



অজ্ঞাতবাস

হাসান মোরশেদ এর ছবি

মাসকাওয়াথ ভাই, আমি নিশ্চিত এই লেখাটা আপনার নিজস্ব ভাবনার সাথে মেলেনা ।
লেখাটাকে মনে হলো প্রথম আলোর সম্পাদকীয় । সবকিছু ভালো, সবকিছুতে আশার বানী শোনানো ।

গনতন্ত্রের চাকা যে ঘুরছেনা তাতো নয়, এমনকি এরশাদ ও তার স্বৈরশাসনের যুগে নির্বাচন পাতিয়ে মাঝেমধ্যেই গনতন্ত্রের চাকা ঘুরানোর মহরত আয়োজন করতো ।
চাকা ঘুরা যেমন জরুরী তেমনি জরুরী বোধহয় গন্তব্যটুকু নিশ্চিত করা?
চাকা ঘুরতে ঘুরতে গনতন্ত্র কোথায় যাচ্ছে?
-------------------------------------
"শিয়রের কাছে কেনো এতো নীল জল? "

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

Shadhoo [অতিথি] এর ছবি

স্বভাব যায় না মলে ।

পলাশ দত্ত এর ছবি

জামিনে যেসব নেতারা মুক্তি পেলেন তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে হবে না মানুষকে?! তারা তাদের অপমানের প্রতিশোধ নেবেন না সাধারণ মানুষের ওপর? তারা কি আর রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন না?

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

বিপ্লব রহমান এর ছবি

মাসকাওয়াত ভাই সম্ভবত তার লেখায় এই পয়েন্টটি যোগ করতে ভুলে গেছেন:

...ছয়: এক-এগারোর অনিবার্যতা হচ্ছে সফল সংসদ নির্বাচনের পর একটি দুর্বল সরকারের গণতন্ত্রের শুভ্র অশ্ব ডিম্ব প্রসব করা এবং বন্দুক দিয়ে ধান চাষ করে দেশে উন্নয়নের মচ্ছব বইয়ে দেওয়া।...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।