কাঁকন বয়েস ত্রিশ, সমাজবিজ্ঞানের আজ অথবা আগামীর দার্শনিক। বিতার্কিক, লেখক, নাট্যনির্মাতা, মাইকে ওর গুণের কথা বলতে গেলে রিক্সা আরেফিন স্যারের গলি পেরিয়ে যাবে, মাহবুবউল্লাহ স্যারেরও জানা হবে না কে ছিলো এই কাঁকন।
কাঁকনের দাদাকে আমরা রাডক্লিফের ঈশারায় ৪৭ সালে বেনাপোলে পৌঁছে দিয়েছিলাম।ওর বাবা মালাঊন হয়েও কীভাবে বাঁচলেন এতগুলো বছর, যার পিসতুতো বোনদের ৭১এ পাড়াত যুদ্ধপরাধীদের ঈশারায়, পাক আর্মী ক্যান্টনমেন্টে তুলে নিয়ে যায়।ওর কাকার কপালে বোনকে বাঁচানোর বল্লমের চিহ্ন লেগে আছে।তার পরেও বেঁচে গেল এতোগুলো মালাউন, বলুন শফিক রেহমান বা এহসানুল হক মিলন, আমাদের সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী।আপনি হেলিকপ্টারে উড়ে উড়ে নকল থামালেন, মারহাবা বস, ঢাকা ইউনির সুদর্শন ছাত্র নেতা, আপনি চেনেন কে এই কাঁকন, সেরা ফলাফল করেও হিন্দু বলে অপরাজেয় বাংলার পাশে ক্লাস নিতে পা্রেনা, জগন্নাথে পড়ায়, তাতে অসুবিধা নেই, বুদ্ধদেব বসু পূর্ব বাংলার বলে কলকাতা তাকে রিপন কলেজে ফেলে রাখলো, আনন্দবাজারেও তো শফিক রেহমানের মত সংশয়বাদের দার্শনিকেরাই বসেন।
গত বিএনপি শাসনামলে হিন্দু কাঁকনের জন্য অপরাজেয় বাংলার পাশ দিয়ে কলাভবনে ক্লাস নিতে যাওয়ার সিঁড়িটা আটকে রেখেছিল বিএনপির উগ্র ইসলাম পন্থার রাজনৈতিক ব্যবসা এবং যুদ্ধাপরাধীদের সংগে যুগল জীবন।
তাই বলে কাঁকনের জীবন থেমে থাকেনি, জগন্নাথে পড়িয়েছে, ইভ টিজিং বন্ধ করিয়েছে, অপরাজেয় বাংলার চারপাশে বিতর্কের আর দর্শনের চিতা জালিয়েছে, মন্দির, জমি, বাড়ি, সম্মান সব কেড়ে নিলেও জিসিদেবেরা ফিরে ফিরে আসে, কাঁকনের কাকাত বোন দেবারতি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পাকিস্তান রিগেইনড সন্ত্রাসে ওর সন্তান সম্ভবা মা দেড়খানা জীবন নিয়ে কলকাতা পালিয়ে গিয়েছিলেন, কল্যাণপুরের নানু বাড়িতেই আসতে চেয়েছিল দেবী।নানুবাড়িতে থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়তে চেয়েছিল।কিন্ত তখন বাংলা ভাইদের জয়জয়াকার, একজন মেঘনা গুহ ঠাকুরতাকে হারিয়েছে অপরাজেয় বাংলা। দিল্লীর জহরলাল নেহেরুতে বাম নেত্রী ফার্স্টক্লাস পেয়েছিল, কাঁকন পেয়েছিল সেরা ফলাফল, শিক্ষকদের কাছে। রাজনীতির কাছে নিজভূমে পরবাসী হিন্দুপুত্র।
আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতিই কাল হলো, বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতি কাঁকনকে নেদারল্যান্ডসএ স্কলারশীপ নিতে বাধ্য করছে, কাকন শর্ত দিয়েছিলো সরাসরি পিএইচডি ঢাকা ইউনির মাস্টার্স যথেষ্ট হওয়া উচিত।এই সাহস আমাদের ক্যাডার বন্ধুদের ছিলনা।কিংবা ছিল আমরা বোঝাতে পারিনি তাদের, ক্যাডার বলে ভয়ে দূরে থেকেছি, ওদের বন্ধুতার ভাষা বা ব্যকরণ বুঝতে পারিনি, আমরা চট করেই, হিন্দু-মুসলমান, ছাত্র-ক্যাডার এরকম ট্যাগিং করি হরহামেশা।
সাংবাদিক দেবাশীষ বলছিলো এখন অসাম্প্রদায়িক সরকার, মেধার মূল্যায়ন হতে পারে। জানিনা নাহিদ ভাই শিক্ষানীতির সিসিফাসের বোঝা ঠেলতে গিয়ে ভুলে গেলেন কাঁকনকে যে শিক্ষানীতি নিয়ে আপনার সঙ্গে ঋজুতার সঙ্গে কথা বলেছিল, যে এখন ঢাবির রিক্রুটমেন্ট ল্যাবিরিন্থের চক্করে অভিমানী হয়ে টিউলিপ বাগানের দিকে হেঁটে যাচ্ছে, ওর বয়েই গ্যাছে হিন্দু মেধাবী ছাত্র বলে ছাত্রলীগ সমভিব্যহারে গণ ভবনের বসন্তের কোকিলদের মৌসুমী অহংকার দেখতে যাবে, দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে একজন ক্ষমতার পরজীবী দালাল ঘুষের প্রস্তাব দেবে, বা ভালো ছাত্র অতএব বোকা ভেবে অবজ্ঞার হাসি হাসবে।
তার চেয়ে যাযাবর ব্যাগপ্যাক। কিছু বই, কিছু সিডি, কিছু প্রেমপত্র, সংগুপ্ত বেদনা লুকোতে চশমা ঝাপসা হয়ে এলে, ঠাকুর দার বেনাপোলের ট্র্যাজেডির কথা মনে কর, তুমি তো রূপকথার দেশে যাচ্ছো, ওখানে তোমার নির্জন ডর্মে লালন কিংবা লেনন শুনতে শুনতে বাঘা ঠান্ডায় একটা সিগার খেতে গিয়ে ব্যালকনীর ঝুল টবে টিউলিপ ফোটাতে পার, দেখবে অপরাজেয় বাংলার পাশ থেকে সুমন দেবাশীষকে নিয়ে বিতর্ক করে ফেরার পথে যেরকম হাসনা হেনার গন্ধ পেতে সেরকম একটা সুবাস ওখানেও খানিকটা পাবে। আরেক পরবাসে।
মন্তব্য
ধর্ম নিয়ে আমাদের সেন্সিটিভিটিটা এখনও পীড়াদায়ক।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
ধর্ম, গায়ের রঙ, মুখমন্ডল, রাজনীতি এসবই সেনসিটিভ বিষয় করে রেখেছি আমরা, বাড়ি, জমি,মন্দির, মসজিদ, সিনাগগ, চার্চ, চাকরি, তেল, গ্যাস, খ্যাতি কিংবা ক্ষমতা লুন্ঠনের আত্মকেন্দ্রিকতায়। আমরা জিন্স-টিশার্ট, আলখাল্লা, গেরুয়া, হিজা্ব,চোলি বা বিকিনি কোন কস্টিউমেই একজন আধুনিক সুস্থ মানুষ একক বা সমষ্টি হতে পারলাম না।হয়ত আস্তিক বা নাস্তিক ট্যাগিং এর আদিম স্যাডিজমে নাক কুঁচকে ঈর্ষার কৃপণতায় পকেটে লুকাচ্ছি তারার আকাশ, কে জানে!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনি,নইলে কোন দিন নয়।
কাকন যখন অনার্সের ছাত্র, তখনই লণ্ডনে চলে যেতে চেয়েছিলো। আমি আর মনির ভাই প্রায় জোর করে রেখে দিয়েছিলাম। সেই রাতের কথা এখনো মনে আছে। বলেছিলাম "কাকন, তুই ঢাবির শিক্ষক হয়ে তারপর অন্য দেশে পিএইচডি করতে যাবি, এখন না। তুই হবি ঢাবির গর্ব"
কাকন যায়নি। অপেক্ষা করেছে।
কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এবং গোল্ড মেডেলিস্ট হওয়ার পরেও কাকনকে আটকে দেওয়া হলো শুধু ধর্মগত কারণে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছিলো, তখনও ঝুলেছিলো ঢাবির সিদ্ধান্ত। তখনও বলেছি, 'কাকন, আরেকটু অপেক্ষা কর'।
কিছুদিন আগে যখন জানালো "চলে যাবো কয়েক মাস পর..." এবার আর অপেক্ষা করতে বলতে পারলাম না। পারলাম না থামাতে। কোন মুখে বলবো?
যা কাকন... তুই নাহয় চলেই যা... জগন্নাথ হলে তোর বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে রাতের পর রাত আমরা যে দেশ উদ্ধারের স্বপ্ন দেখেছিলাম একদা... সেই দেশ তোর না... যা, চলেই যা তুই...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আসলে অভিজ্ঞতাগুলো যদি তাদের মুখ থেকে শোনা যেত তাহলে বোঝা যেত অবস্থা কি, কতটা খারাপ লাগে পরিস্থিতিগুলোতে।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
নতুন মন্তব্য করুন