গাবতলিতে বাস থেকে নামে হাঁসদার। একটা কালো শীর্ণ শরীর জলশূণ্য হয়ে পড়েছে। চোখ দুটো লাল কোটরাগত। কতকগুলো লালচে গোঁফের রেখা আর চিতে পড়া পাঞ্জাবির খোলা বোতামের মাঝ থেকে উঁচিয়ে থাকা বুকের হাড়। হাঁসদার, বরেন্দ্র অঞ্চলের কাঁকনহাটের এক বিশীর্ণ সাঁওতাল যুবক। গালভাঙা হতদরিদ্র এই মানুষের অবয়বে এক ধরনের পৌঢ়ত্বের ম্লান চিহ্ন আঁটা। কৈশোর না পেরুতেই অনাবৃষ্টি আর ক্ষরার হাঁমুখে লাল ধুলো ওড়া দরিদ্র জনপদে তার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়েছে। প্রপিতামহের তীরধনুক মাটির দেয়ালে টাঙানো। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক ধরনের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল সে। দাদিমার কাছে গল্প শুনেছিল তার পূর্বপুরুষের গহিন অরণ্যে পশু শিকারের কথা।
বন উজার হয়ে ধু ধু জলহীন যে জনপদ সেখানে সবুজ গাছপালা দিদিমার মুখের এক কিংবদন্তির গল্প হয়েই আছে। তারপরও তীর-ধনুক এক যোদ্ধার প্রতীক হয়ে ওঠে তাদের জীবনে। জোতদাররা হাঁসদারদের কতোবার উচ্ছেদ করতে চেয়েছে তাদের বাস্তুভিটা থেকে। পূর্বপুরুষের তীর-ধনুক নিয়ে তারা প্রতিরোধ গড়েছে। কয়েকজন আদিবাসী মানুষ রাত জেগে লাল মাটির উঁচু নিচু ঢিবির মধ্যে বাঘের মতো জ্বলজ্বলে চোখে পাহারা দিয়েছে আদিবাসী গ্রাম।
হাঁসদার কষ্টেসৃষ্টে এসএসসি পাস করেছে। বাপ বলেছিল, শহরে গিয়ে চাকরি খুঁজে নিতে। কিন্তু হাঁসদার তা পারেনি। স্বার্থপরের মতো কেবল নিজের জীবন নিয়ে ভাবেনি। গ্রামে ছোটখাটো একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। সাঁওতালি ভাষায় সেখানে শিক্ষা দেওয়া হয়। সাঁওতালি ভাষায় প্রথম যেদিন হাঁসদার তার নিজের লেখা শশাঙ্ক শাসনামলের সবুজ বরেন্দ্র জনপদের গল্প বলছিল- চোখ বন্ধ করে বলেছিল বৃষ্টির গল্প- ছোট ছোট বাচ্চারা আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলো যেন কানের পাশে শুনতে পাচ্ছিল ব্যাঙের ডাক। রাজশাহী থেকে, ঢাকা থেকে সাহেবসুবোরা একদিন এই আদিবাসী স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তাদের কথা শুনে হাঁসদারের মনে হলো একদম আপনার মানুষ।
সাঁওতাল কিশোর-কিশোরীরা সার বেঁধে হাতে হাত রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে গাইলো সাঁওতালি গান। ঢাকা থেকে আসা একজন লেখিকা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। 'কি সুন্দর তোমাদের নাচ'। এক সমাজকর্মী আপা ইংরেজিতে এক ফরেনার ভদ্রলোককে কি সব বোঝাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক ক্যামেরায় হাঁসদার ছবি তুললেন। সঙ্গে তার ছাত্রছাত্রীর। ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের মতো হলো। একজন সাদাচুল পন্ডিত বর্ণনা করলেন, নাচোল বিদ্রোহের কথা। হাঁসদার হতচকিত চোখে মুগ্ধতায় তার দিকে চেয়ে ছিল।
'আমগেরই কথা আমগের চাইত সুন্দর করি বললেক'। ছোট ছোট শিশুদের সামনে চিৎকার করে হাঁসদার বলে, 'আর আমগের দু:খ থাকবিক লা'। হাঁসদার যেন অনুভব করে কয়েকজন ঈশ্বর লাল বিস্তীর্ণ ধুলোমাখা হরিদ্র জনপদের পিচঢালা রাস্তায় পাজেরো চালিয়ে এই অনগ্রসর পল্লীতে ঢুকে পড়েছে। মানুষের মুক্তির জন্য তারা তীর্থযাত্রায় শ্যামিল। আমলা, বুদ্ধিজীবি, এনজিওকর্মী, দাতা-সংস্থার লোক কতগুলো তিন-ঠ্যাঙে টুল, ধুসর খেজুর পাটি আর দড়ির খাটিয়ায় বসে। ওপরে তিরিক্ষি সূর্য, বাতাসে জলীয়বাষ্প নেই- খরায় ফেটে চৌচির লাল মাটির লোহেল বুক।
হাঁসদার হন্তদন্ত হয়ে ছোটাছুটি করে। বউ রনকাকে তাড়া দেয়। কোত্থেকে একটা লালঝুটি, বিবর্ণ ধুলোমাখা পালক জলতৃষ্ণায় ধুঁকছে এমন মোরগ এনে জবাই করা হলো। লাল চালের ভাত ফুটছে। টিনের কতোগুলো প্লেট জোগাড়ে শশব্যস্ত বিজয় চন্দ্র। বউ মায়াবতী মাটির একটা কলস নিয়ে বের হয় পানি সংগ্রহের অভিযানে। সাঁওতাল পল্লীতে এমন উৎসব বহুদিন হয়নি। পূর্ণিমা রাতে ঢাক-ঢোল-কাঁসর বাজিয়ে জীবন উৎসব বন্ধ হয়ে গেছে দীর্ঘদিন। সেসব শুধু দাদিমার মুখে শোনা গল্প। হিংস্র শূকরকে শরবিদ্ধ করে আগুনে ঝলসানো কিংবা রং খেলার উৎসব- সারা রাত ঢোলকের শব্দে জেগে থাকতো গ্রাম। সালঙ্কারা সাঁওতাল বধূরা হাত ধরে ঝুমুর তালে নাচতো। হঠাৎ লুকিয়ে দেখতো স্বামী কিংবা প্রেমিক পুরুষকে।
**************
:- দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত
মন্তব্য
মনে তো হচ্ছে আরো কয়েক পর্ব লাগবে এর সমাপ্তি টানতে।
তাড়াহুড়ার দরকার কি?
চলুক...
-----------------------------------------------
গাধারে সাবান দিয়া গোসল দেয়ানোটা গাধাপ্রীতির উজ্জ্বল নমুনা হতে পারে; তবে ফলাফল পূর্বেই অনুমান করা সম্ভব, গাধার চামড়ার ক্ষতি আর সাবানের অপচয়।
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
পড়া শুরু করলাম ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
চমৎকার
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!
নতুন মন্তব্য করুন