প্রত্যহ জীবনের ব্যবহারী নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলার অভ্যেস আমার ছোটবেলা থেকেই ছিলো, আজও আছে। ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে যখন উঠলাম, পরীক্ষায় ভালো করার জন্যে বাবা একটা লাল রঙ্গের জ্যাকেট কিনে দিয়েছিলেন। সেই জ্যাকেট আমার ছেলেবেলার সেই সময়টা কে হুমায়ুন আজাদের কবিতার মতো লাল করে তুলেছিলো। কতদিন আমি সেই লাল জ্যাকেট বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। অথচ মাস দুয়েক যাওয়ার আগেই নদীর ওপারে পানের বরজে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে তাকে হারিয়ে ফেললাম মনের ভুলে! সেই শুরু, এরপর কত কি হারালাম, সময়ের সাথে পা্ল্লা দিয়ে হারানোর তালিকা শুধু লম্বা করতে থাকলাম। হারানোর সেই ধারাবাহিকতায় কৈশোর পেরোনোর আগেই একদিন বাবাকে ও হারিয়ে ফেললাম!
স্থির আমি ছিলাম না কিছুতেই, এমনকি স্থির ছিলো না আমার বেড়ে উঠার সময়টা। স্কুল পরীক্ষা পাশ দেওয়ার আগেই এক ডজন স্কুলের আঙ্গিনায় নিয়ে গেছি নিজেকে। শহরের জীবন অচেনা ছিলো আমার, থেকেছি প্রত্যান্ত গ্রামে, রাজশাহীর তানোর-বাঘমারা-দুর্গাপুর, চাঁদপুরের হাইমচর, সিলেটের হবিগঞ্জ-নবিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। আমার বেড়ে উঠা তাই প্রসারিত সুবজের মাঝে, দু-কূল ছেপে যাওয়ার নদীতে সাঁতার কেটে, উত্থাল-পাতাল বৃষ্টি আর কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়াতে। রাজশাহীর তানোরে প্রায় ভেঙ্গে পড়া টিনের ঘরের স্কুলে আমি আমার প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম তার চেয়ে ও ভেঙ্গে পড়া হরিদাস নামক একজন মুগ্ধ জাদুকরের কাছে। যিনি আমায় বলেছিলেন একটু মনোযোগ দিলে তুই অনেক দূর যাবি পাগলা..! আমার বেশিদূর যাওয়া হয়নি, তার আগেই এক কালবৈশাখে সেই স্কুল উড়ে গিয়ে পড়েছিলো পাশের ধানক্ষেতে। আর সেই সবুজ ধানক্ষেতেই প্রিয় হরিদাস স্যার আমার ভবিষ্যতকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন চিরতরে।
রাজশাহী কিংবা সিলেট থেকে বছরে একবার আসতাম নিজের জেলায়, নিজের গ্রামে। এসেই জলে লম্ফ, রোদে দৌড় আর গোল্লাছুট। বছরের শেষের সময় সেটা। সাত সকালেই শীত আর কুয়াশার দীর্ঘ প্রাচীর ভেঙ্গে দাদার সাথে চলে যেতাম খেজুর গাছ থেকে রস নামাতে। সেই খেজুরের রসের গন্ধে ভরে উঠতো প্রতিটি সকাল-দুপুর আর রাত। সূর্য ঘরের চৌকাঠে পৌছাবার আগেই প্রতিদিন মুড়ির মোয়া নিয়ে চলে আসতো জীবনের প্রথম দেখা বাঁশিওয়ালা মধ্যবয়স্ক লোকটা। যার বাঁশি শুনে মোয়া ব্যবসায়ী হবো বলে মনস্থির করে ফেলেছিলাম ছেলেবেলায়। তার অদ্ভুত সেই বাশির সুর আজো আমি ঘুমের ভেতর শুনতে পাই, সুমনে গানের ভেতর দিয়ে মানুষটিকে আজো দেখতে পাই স্মৃতির ঝাপসা হয়ে যাওয়া আয়নায়। শীতের নানান পিঠা-রস-নারিকেল-পায়েস আর কুয়াশার আদরে সেই একটি মাস স্বপ্নের মতো কিংবা স্বপ্নের চেয়েও রঙিন হয়ে উঠতো আমার। অথচ একযুগ পার হতেই সবগুলো সকাল হয়ে উঠেছে এখন রঙহীন, বর্ণহীন আর গন্ধহীন।
নানান জায়গায় থাকার কারনে ছোটবেলার কোন বন্ধুত্ব দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি। যাদের সাথে প্রথম স্কুলে গিয়েছি, যাদের সাথে খেলে বড় হয়েছি, যাযাবর জীবনের জন্যে তাদের কারো খোঁজ আজ আমার জানা নেই। সেই যুগে ছিলো না ফোন-ফেসবুক, তাই টুকে রাখা হয়নি কিছুই। তাদের খুঁজে পাওয়া হয়তো হবে না একজীবনে, না হোক। তারা নাইবা জানুক আমার শৈশব মানেই বাবু-মিন্টু-সুজন-সেতু, আামার কৈশোর মানেই জাহাঙ্গীর-শিমুল-রাসেল-সোহাগ-শাহীন সহ তাদের মতো আরো কত প্রিয় নাম।
মন্তব্য
ছেলেবেলার লাল জ্যাকেট কিংবা রং পেন্সিল হারিয়ে গেলেও হয়ত ঠিক তেমনটা না হলেও পাওয়ার উপায় থাকে।
কিন্তু বাবা নামের বিশাল আকাশ, মা নামের ভূবনডাঙার মাঠ, আর খোলা জানালার মত বন্ধু হারিয়ে ফেলার আফসোস বুঝি প্রায় সবাইকেই কোনো না কোনো সময়ে বইতে হয়। এসব হারানোর আফসোস সাত পৃথিবী এক করলেও যাবার নয়! মন খারাপিয়া পোস্ট কেমন!
মন্তব্যকে বাহবা দেবার জন্য একটা মন্তব্য করতে হল।
সুন্দর করে বলেছেন মন খারপ করার মত কথাগুলো, আয়নাদি
মন্তব্যে পাঁচতারা আয়নাদি
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
দিলেনতো খেঁজুরের রসের কথা মনে করায়ে। ছোটবেলাগুলা কী ভীষণ রঙ্গিন ছিল সবারি!
আমিতো সবকিছু-ই মিস করি। বন্ধু নেই, আড্ডাবাজি নেই, হৈ হুল্লড় নেই, সকাল-বিকাল একই নিয়মে বাক্সবন্দি জীবন।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
আহা! শৈশব!
মাহমুদুল হকের ভাষায় বলি
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
বাবার বদলির চাকরির সুবাদে বারবার বন্ধু হারিয়েছি। নতুন বন্ধু পেয়ে পুরনোদের ভুলে গেছি। তবু কত নাম মাথায় গেঁথে আছে! মন খারাপ করা লেখা। বুকের ভেতর চাপ ধরে যায়। দুই একজন পুরনো বন্ধু খুঁজে পান, প্রত্যাশা রইল।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
গত দুই বছরে সবচেয়ে বড় বন্ধু আসলে সচল। যেখানে সব বলতে পারি, সব শেয়ার করতে পারি আর ঠিক আমার মতোই বিশ্বাস আর বোধের অসংখ্য জ্ঞানী মানুষের নিত্য নতুন চিন্তা-চেতনার কথা পড়ে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হতে পারি, অনুপ্রাণিত হতে পারি। একজীবনে আর আর কি চাই বলেন?
পড়ার এবং মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
শৈশব মিডিয়ার সৃষ্টি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এখন চারিদিকে দুর্বৃত্তদের জয়জয়কার। বলুন শৈশব ও দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে হারিয়ে গেছে।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
চমতকার!ছোটবেলার গল্প সবারই মোটামুটি একই টেম্পলেটের
-গগন শিরীষ
হুম সব একি, একি রকমের
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
আমার জীবনের গল্পও তোমার মতোইগো, শুধু কয়েক যুগ আগের। আর কৈশোরে বাবা হারানোটা বাদে। তবে পঞ্চাশ বছরের পুরনো বন্ধু এখনও দু-একজন আছে। ভাল থেক। আনন্দে থেক।
আপনার জীবনের পথ চলাও আনন্দময় হোক, স্মৃতিরা বেঁচে থাকুক অকৃত্রিম ভালোবাসায়।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
ভাই আগে জানলে আপনার লেখা পড়তাম না। লেখা পড়ে প্রায় ভুলতে বসা অনেক ড্রেইন ফ্রেন্ড (যাদের সাথে একই ড্রেনে প্রশ্বাব করেছি), ব্রেইনফ্রেন্ড (ভাল ব্রেইন থাকার কারণে যাদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে), গেইন ফ্রেন্ড (কিছু পাবার আশায় যাদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল) আর মেইন ফ্রেন্ড (যারা আসল/মূল বন্ধু) দের স্মৃতিচারণ করে মনটা হু হু করে অবাধ্যের মত কেঁদে উঠলো।
- পামাআলে
সবগুলা ফ্রেন্ডরে লইয়া একখান লেখা পুষ্টান, আমরাও এতরকম ফ্রেন্ডের সাথে পরিচিত হই।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
ভাল লেগেছে।
লোকে আমাকে বলে হারান-দা। আবার, বাবার বদলির চাকরীর সুবাদে আমারও শৈশব, কৈশোর ঘুরে ঘুরে কেটে গেছে। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আয়নায় নিজেকে দেখছি।
ক্যানভাসে ছবি আঁকা চলতে থাকুক।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্যে
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
রাজশাহীতে ছিলেন দেখছি!! আহা! বিশেষ করে এখন প্রবাসে এসে বেশী বেশী করে মনে পড়ে ফেলে আসা শহরটির কথা!
____________________________
রাজশাহী বুকের ভেতর জেগে থাকা স্বর্ণালী এক ভোরের নাম। ভালোথাকুন, পরবাস সুখময় হয়ে উঠকু
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
ভাল লাগল। লেখা চলুক
সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত একই স্কুলে গেছি, তাও বহু বন্ধু হারিয়েছি।
তাদের ফেসবুক আইডি জানি, ফোন নম্বর জানি, বাড়ির ঠিকানাও জানি, কেবল জানি না তাদের মনের ঠিকানা। এত বদলে যাওয়া মানুষগুলির প্রতিদিনের স্ট্যাটাস আপডেট আর প্রোফাইল পিকচার দেখতে দেখতে কেবল মনে মনে খুঁজে বেড়াই সেই ছোট্টবেলার মুখগুলি, মনগুলি, প্রাণগুলি। মিলে না, একদম ই মেলে না। এইসব হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরি।
গানটা আপনার জন্য। ভাল থাকবেন।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
ধন্যবাদ
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
নতুন মন্তব্য করুন