(১)
বাংলাদেশ পুড়ছে প্রতিদিন, পুড়ছে তার ভেতরের আত্না-পরমাত্না। রুদ্রের সেই কবিতার মতোই ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের বাতাসে ভাসছে শুধু পোড়া লাশের গন্ধ। পোড়া মানুষের আর্তনাদে ভারী হচ্ছে বাতাস, ভারী হচ্ছে বুকের দীর্ঘশ্বাস। যে শিশুটি মায়ের সাথে খালার বাসা থেকে ফিরছে, যার জন্যে তার খেলার সাথী বোনটি অপেক্ষা করছে, যে বাবা সারাদিনে ক্লান্তি শেষে রাজ্য জয়ের হাসি নিয়ে ফিরছে নিজের নীড়ে, যে তরুণ-তরুণী তার বাড়ন্ত স্বপ্ন কে বুকে নিয়ে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখে আসছে, যে বোনটি আমার, দু-বেলা ঠিক মতো আহারের নিরাপত্তায় ছুটেছে অফিসে, যে শিক্ষক শিক্ষার আলোটুকু জ্বেলে দিতে গিয়েছে শিক্ষালয়ে তাদের সকল অপেক্ষা-চেষ্টা-স্বপ্ন কে ব্যর্থ করে একদল মানুষরুপী হায়না প্রতিদিন বাসে আগুন দিচ্ছে। আগুনে পুড়ছে প্রতিদিন মানুষের দেহ, পুড়ছে স্বপ্ন, পুড়ছে ভালোবাসা, পুড়ছে জীবনের সকল আশা।
আমরা আজ পর্যন্ত যারা খুব ভাগ্যবান, যাদের শরীরে আজ পর্যন্ত আগুনের উত্তাপ এখনো লাগেনি, তাদের ভেতরটা ঠিকি প্রতিদিন পুড়ছে। প্রতিটি দগ্ধ মুখ, প্রতিটি আর্তনাদ আমাদের সুস্থ থাকা কে-আমাদের বেঁচে থাকা কে প্রতিনিয়ত অপরাধী করে যাচ্ছে। বলছে, তোমরা স্বার্থপর, বলছে তোমরাও অমানুষ। না এই আত্নকথনের গল্প পুরোপুরি সত্যি নয়, আমরা সবাই অন্যের শরীরের আগুনে প্রতিদিন দগ্ধ হচ্ছি না, হইনা। আমাদের সবার বুকে একই দীর্ঘশ্বাস জমে না, আর্তনাদ সবার কানে পৌছায় না। যদি সত্যি জমতো সেই দীর্ঘশ্বাস, যদি আর্তনাদ পৌছাতো বিবেকের ঘরে তাহলে দিনের পর দিন পুড়তো না বাংলাদেশ। বেঁচে থাকার অপরাধ বোধে ভোগা মানুষের সংখ্যা এখনো কম, এখনো এরা সংখ্যালঘু। এখনো এখানে অমানুষের মিছিল, এখনো এখানে হায়নাদের ভীড়, এখনো এখানে সুযোগ সন্ধানী নরবানরের আধিক্য।
(২)
বাংলাদেশে যাদের জন্ম, বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলো-বাতাসে যারা বড় হয়েছে, তারা কমবেশি সবাই রাজনৈতিক সহিংসতা, রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সাথে পরিচিত। এগুলো কোনটাই নতুন নয়। প্রতি পাঁচ বছর পর-পর সেই সহিংসতার জাতীয় উৎসব হয়, উল্লাস হয়। কিন্তু ২০১৩র শেষ দিকে আর ২০১৫র শুরুতে যা ঘটছে তার সাথে বাঙালির আগে পরিচয় ছিলো না। গনতন্ত্র রক্ষার নামে যে আন্দোলন চলছে, যাকে অনেকেই সহিংসতা বলছে, বলছে সন্ত্রাস তাদের কে বলতে চাই এটি কোন সহিংসতা নয়, সন্ত্রাসও নয় এটি সহজ ভাষায় জঙ্গিবাদ। কেন জঙ্গিবাদ বলছি, তার ব্যাখা জেনে নেওয়ার আগে একটু ইতিহাসে ফিরে যাই।
৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন বাঙালি করেছে, আন্দোলনে লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমেছে। নিজের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে আসাদ-রা স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। ৯৬-তে তত্ত্বাবোধক সরকারের জন্যে আন্দোলন হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন হয়েছে ২০০১ সালে, হয়েছে ২০০৬ সালে। প্রতিটি আন্দোলনে মানুষ রাজপথে নেমেছে, যদি আরো সহজ করে বলি বড় দুটো দলের কর্মীরা রাজপথে মুখোমুখি হয়েছে, মারামারি করেছে। সেই মারামারিতে দুই দলের অসংখ্য কর্মী আহত হয়েছে, মারা গেছে। এমন মুখোমুখি মারামারিকে সহিংসতা বলা হয় কিংবা বলা যায় রাজপথে সন্ত্রাস। কিন্তু সেই আন্দোলনে কোথাও সাধারণ মানুষকে গণহারে পুড়িয়ে মারা হয়নি। রেল লাইন উপুড়ে মানুষ হত্যার পাশবিক পন্থা অবলম্বন করা হয়নি। অর্থাৎ কোথাও সাধারণ মানুষ আক্রমনের লক্ষ্য বস্তু হয়নি।
আচ্ছা আইএস-তালেবান-বোকাহারাম এরা কারা? ইউরোপ থেকে আমেরিকা, আমেরিকা থেকে এশিয়া-ওশেনিয়া সহ সারা পৃথিবীর যেখানে সভ্যতা গড়ে উঠেছে, যেখানে মানুষ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বিকাশিত হয়েছে, যেখানে শান্তি আর উন্নয়নের পথ ধরে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে তার সব মানচিত্রের মানুষজন জানে এদের কর্ম কি, এদের পরিচয়ই বা কি? হ্যাঁ এরাও আন্দোলনকারী, ওদের ভাষায় যা ইসলাম রক্ষায় আন্দোলন, ওরা ইসলাম রক্ষায় আন্দোলন করছে। আর সারাবিশ্বের মানুষের কাছে এরা জঙ্গি আর এদের কর্মের নাম জঙ্গিবাদ। এদের প্রধান কাজ ইহুদি-নাসারদের ষড়যন্ত্র বলে জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সারা বিশ্বে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা। নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলার নাম-ই জঙ্গিবাদ।
এবার আসুন বাংলাদেশে, বিএনপি-জামাত, যারা আজ আন্দোলনের নামে প্রতিদিন গাড়িতে আগুন দিয়ে নিরীহ মানুষ মারছে তাদের সাথে কি তালেবান-বোকাহারাম-আইএসের মিল খুঁজে পাচ্ছেন না? আপনি যদি বিবেকবান মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই পাচ্ছেন, তাহলে তালেবান-বোকাহারাম-আইএসের মতো একই প্রক্রিয়ায় নিরীহ মানুষ হত্যা করলে, কেন এদের জঙ্গি বলা যাবে না? নিরীহ মানুষ হত্যার নাম গনতন্ত্র রক্ষা নয়, সন্ত্রাস কিংবা সহিংসতা ও নয়, নিরীহ-নিরাপরাদ মানুষ মারার নাম জঙ্গিবাদ। আর যারা এই কাজ করে তারা দুর্বৃত্ত নয় এরা জঙ্গি। আপনি এটাকে আন্দোলন-সন্ত্রাস কিংবা সহিংসতা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সেটি প্রকারন্তে জঙ্গিবাদকে আড়াল করছেন, তাদের উৎসাহ দিচ্ছেন। আর এভাবে চলতে থাকলে সেইদিন বেশি দূরে নয় বাংলাদেশ, বাংলাস্থানে রূপান্তরিত হবে।
(৩)
প্রতিটি টেলিভিশনের পর্দায় দেখি দেশের জন্যে মায়া কান্না করে দেশের শান্তি ফিরিয়ে আনতে ব্যাকুল সুশীল-সাংবাদিক সহ নানান পদের বুদ্ধিজীবি। পত্রিকায়ও সেই সংখ্যা কম নয়। দেশের জন্যে তাদের নির্ঘুম দিন-রাত কাটছে দেখতে খারাপ লাগে না। অন্যদিকে দলকাণা বুদ্ধিজীবিদের দেখি এই জঙ্গিবাদ কে সহী করার জন্যে অতীতের ইতিহাস টেনে আনার অসম্ভব আন্তরিক প্রয়াস। একটা মানুষ মারার ঘটনাকে আরেকটা মানুষ মারার ঘটনা দিয়ে যারা বৈধতা দিতে চায় তাদের জন্ম নিয়ে সন্দেহ আপনি আমি করতেই পারি। এমন বেজন্মাদের সংখ্যাও মিড়িয়াতে নেহাত কম না। সুশীল থেকে নিরপেক্ষ মোটামুটি সবজায়গায় একটাই অভিন্ন সুর, অভিন্ন বাণী। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান, সংলাপ ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
আমি অতীতে যাবো না, দশম সংসদ নির্বাচনের পূর্বকার সংলাপ বিষয়ক বিস্তর পানি ঘোলা আলোচনায় ও না। আমি শুধু প্রশ্ন করবো তাদের যারা আলোচনা/সংলাপের কথা বলছেন, আচ্ছা আপনারা কি বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে কিংবা ফিরিয়ে আনতে জঙ্গি সংগঠন তালেবান-আইএস-বোকাহারামের সাথে আমেরিকা-ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-বেলজিয়াম-জার্মানী-ইটালী-ইসরাইল সহ বিশ্বের সকল ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোকে সংলাপে বসার আহ্বান করেছেন কোনদিন? কিংবা কেউ কি শুনেছেন সেইসব দেশের কোন বুদ্ধিজীবি বলেছে এইসব জঙ্গি সংগঠনের সাথে তাদের রাষ্ট্রকে আলোচনা করে দেশে দেশে শান্তি আর সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিতে? ওরাও বলেনি, আপনারাও বলেননি, বলতে পারবেন না। কারণ জঙ্গিদের সাথে কোন আলোচনা হয় না, জঙ্গিবাদ আর জঙ্গিদের নির্মূল করতে হয় একেবারে শিকড় থেকে। গোল গোল কথা বলে, আলোচনার নামে কথার সমুদ্র বসিয়ে দিয়ে বিশ্ব থেকে যেমন জঙ্গিবাদ স্ব-মূলে নির্মূল করা সম্ভব নয় তেমনি বাংলাদেশেও এই জঙ্গিদের সাথে গোল গোল কথা বলে এদেরকে শান্তির পথে আনা সম্ভব নয়।
তারপরও যদি আপনাদের কথা মেনে নিয়ে কোন দিন বড় দুই দল সংলাপে বসে, কি হবে? অসম্ভবের শেষ প্রান্তে গিয়ে ধরে নিলাম আওয়ামি লিগ, বিএনপির দাবি মেনে নিয়ে আবার তত্ত্বাবোধক সরকার দিয়ে নির্বাচন দিলো। আর বিএনপি-জামাত তাতে জয়লাভ করলো। বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসলে জঙ্গিবাদ প্রসার, হিন্দু নির্যাতন, দুর্নিতি-লুটপাট সহ নিজামী-সাঈদীরা জাতীয় বীর হবে কিনা সে আলোচনায় গেলাম না। সেই নির্বাচন সুষ্ঠ হয়নি বলে আবারো নির্বাচন দিতে হবে বলে যদি সরকার গঠনের পরদিন থেকে আওয়ামি লিগও ঠিক এমন আন্দোলন (জঙ্গিবাদ) করে, তখনও কি আপনারা বলবেন সংলাপে বসতে হবে? সংলাপ ছাড়া এটি সমাধান সম্ভব নয়? আপনি তখন মুখ কোথায় লুকাবেন জানি না, যখন দেখবেন আওয়ামিলিগও ঠিক এই পন্থায় রাষ্ট্রের বুকে গুলি ধরে-আগুনে সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে আন্দোলনের নামে সরকারকে সংলাপে বসাতে বাধ্য করছে! আপনি নিশ্চিত থাকুন এমনটাই হবে, একবার যখন জঙ্গিবাদের কাছে মাথা নত করবেন ফলাফলে জঙ্গিবাদের কাছে রাষ্ট্রের পরাজায় চক্রকারে ঘুরতেই থাকবে।
জঙ্গির সাথে সংলাপ কোন সমাধান নয়, জঙ্গিদের সাথে সংলাপে বসা মানে জঙ্গিবাদের কাছে মাথা নত করা। রাষ্ট্রকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দেওয়া। গোল গোল কথা বলে, আলোচনার নামে কথার সমুদ্র বসিয়ে দিয়ে বিশ্ব থেকে যেমন জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব নয় বলেই বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই সে পথে হাঁটেনি। তেমনি বাংলাদেশেও এই জঙ্গিদের সাথে গোল গোল কথা বলে এদেরকে শান্তির পথে আনা সম্ভব নয়, নির্মূল তো দূরের কথা। বরং সংলাপে বসা মানে তাদের বিজয়ে বীজ রোপন করে তাতে জল ঢেলে দেওয়া। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচ্চার হোন, জঙ্গিবাদকে, সহিংসতা-সন্ত্রাস কিংবা আন্দোলন বলে জামাই আদর করবেন না, করলে সেই আগুনে একদিন আপনি-আমি আর আমাদের প্রিয় মাতৃৃভূমি ও পুড়ে ছাই হয়ে যাবো, জন্ম হবে আরেকটি পাকিস্থানের।
মন্তব্য
কিছু বলার নেই, হুমায়ুন আজাদ লিখে গেছেনঃ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
জঙ্গিবাদ কে সহিংসতা-সন্ত্রাস কিংবা রাজনৈতিক সমস্যা বলে জামাই আদর করলে তার পরিণতি যে ভয়ংকর হবে সেটি সবাই বুঝতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত তলিয়ে গভীর অন্ধকারে।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
নতুন মন্তব্য করুন