ধরা যাক প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রাজনীতি, যুদ্ধের নেতৃত্ব, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র কিংবা একাত্তর পরবর্তী চারটি বছর যে রক্তাত্ত ইতিহাসের মাঝ দিয়ে বেড়ে উঠেছিলো বাংলাদেশ, তার কিছুই জানে না। জানে না বঙ্গবন্ধু হত্যা তথা বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিতে কে বা কারা কাজ করেছিলো প্রকাশ্য দিবালোকে আর একান্ত সঙ্গোপনে। জানে না একাত্তরের রণাঙ্গনের দেবদূত হয়ে ওঠা আদর্শের প্রবাদ পুরুষ একজন খালেদ মোশারফের নাম আর কীর্তি, জানে না নির্ভীক যোদ্ধা মেজর হায়দারের নাম, জানে না চার জাতীয় নেতার মৃত্যু রহস্য। কিংবা জানে যা কিছু তার কোনটাই তেমন স্পষ্ট নয়। সাতই নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহী বিপ্লব দিবস কে জানে রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধামত ব্যাখানুসারে, জানে না অপরিণত একজন ক্রাচের কর্ণেলের ভুল সময়ে বেড়ে উঠা শোষনহীন সাম্য সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন আর নিজেকে বিসর্জন দেওয়ার গল্পটাকে। জানা নেই ঠান্ডা মাথায় অসংখ্য খুন আর সুযোগের সদ্বব্যবহার করে ইতিহাস কে বিকৃত করে একজন জিয়া কেমন করে বনে গেছেন কিংবদন্তি নেতা রূপে। আর জানেন না একজন খন্দকার মোশতাকের নাম, জানে না বলেই আজও মীরজাফরকে বেঈমানের মুকুটহীন সম্রাট করে রেখেছে, অথচ এই বঙ্গে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকটির নাম অবশ্যই খন্দকার মোশতাক। এই বিশ্বাসঘাতক পাকিমনা কূটবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষটিই বাংলাদেশ কে পেছনে দিকে ঠেলে দেওয়ার সব দুয়ার খুলে দিয়েছে একাত্তর থেকে পচাত্তরের প্রতিটি ক্ষনে। তার দেখানো পথেই হেঁটে গেছে ৭৫র সব কুশীলবরা।
হ্যাঁ বলছিলাম একাত্তর থেকে পঁচাত্তর কে জানার কথা। যেই সময়টা অর্জনে সবচেয়ে আলোকিত আর ষড়যন্ত্রের সফলতায় বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারে ঢাকা হতাশার সময়। কিভাবে জানবেন এত এত অর্জন, রক্তাত্ত সেনা অভ্যুত্থান, এত ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার পালাবদলের কথা। কিভাবে জানবেন সেই ষড়যন্ত্রে জাল ছিন্ন করে স্বাধীনতার সূর্যটাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা সেই অসীম সাহসী বাঙলার শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ-মুজিবুর রহমান আর তাজউদ্দিনদের কথা? এখানে-সেখানে ছড়ানো ছিটানো হয়তো আছে একাত্তর থেকে পঁচাত্তরের অর্জন আর রক্তাত্ত ষড়যন্ত্রের ইতিকথা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসের সবটুকু নিজের মাঝে আয়ত্ত করা তাই চারটে খানি কথা নয়। কিন্তু সেই সব ইতিহাসের অনেকটুকু যদি এক মলাটে বন্দি হয়ে যায় তাহলে কেমন হয়? হ্যাঁ ঠিক সেই কাজটি করেছেন সুহান রিজওয়ান নামের একজন নতুন লেখক, যিনি ইতিহাসের ভাস্মর থেকে শুরু করে মুছে যাওয়া সবগুলো চরিত্রকে এক ফ্রেমে তুলে এনেছে পরম মমতায়। না, তিনি ইতিহাস লেখেন নি, লিখেছেন ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস। আর এই উপন্যাসটিই আপনার ভিতর বাংলাদেশ কে জানার আগ্রহ বুঁনে দিবে, আপনাকে জানিয়ে দিবে একাত্তর থেকে পচাত্তরের সকল অর্জন, ব্যর্থতা, চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রর কথা। সেই আলো-আধাঁরে ঢাকা সময়টি কে ইতিহাস বিকৃতকারীরা আড়াল করে রেখেছিলো যুগের পরে যুগ ধরে, সেই লুকিয়ে রাখা অস্পষ্ট সময়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে সুহান রিজওয়ানের লেখনীতে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম যারা চোখে দেখেননি, মুক্তিযুদ্ধে এবং তার পরবর্তী ইতিহাস যাদের জানা নেই বিন্দুমাত্র, তাদের জন্যে একাত্তর থেকে পঁচাত্তর কে জানার সূচনা পর্ব হিসেবে এটি অসাধারণ এক দলিল হবে নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। কারণ এই উপন্যাসে উঠে এসেছে সেই সময়ের ঐতিহাসিক সমস্ত ঘটনা, চরিত্র আর পালাবদলের দোলায় ভাসতে থাকা বাংলাদেশের ভাগ্য রেখা।
একটি উপন্যাস পাঠককে কিভাবে আকৃষ্ট করতে পারে? খুব সম্ভব সহজ গল্প বলার দক্ষতা, মোহনীয় মুগ্ধতা ছড়ানো আবেগের পংক্তিমালা, গল্প বলার পট, চরিত্রের দৃঢ়তা কিংবা গল্পের গভীরতা। সুহানের এই লেখায় তার সব বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। ত্রিশলক্ষ প্রাণের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া একটা দেশের জন্মকালীন কথা, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাকিস্থান মনাদের নানান ষড়যন্ত্র আর সকল প্রতিকূলতা ঠেলে এগিয়ে যাওয়া সময়ের আখ্যান ’সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ ‘। সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ একাত্তরের নি:সঙ্গ সেনাপতি তাজউদ্দিনের অসম লড়াইয়ের গল্প, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতার গল্প, পরাজিত দীর্ঘশ্বাসের গল্প, বুক ভরা বেদনার গল্প, খালেদ-হায়দার,বাতেন, আলাউদ্দিন, তারেকের মতো অসংখ্য ভুলে যাওয়া মানুষের ত্যাগ আর দেশপ্রেমের গল্প। তার সাথে সাথে ইতিহাসের নিকৃষ্ট চরিত্রগুলোর অন্যতম খন্দকার মোস্তাক আর রশিদ-জিয়াদের ষড়যন্ত্রের সকল ইতিবৃত্ত।
উপন্যাসটি দুটি খন্ডে বিভক্ত, পূর্ব খন্ড দিয়ে শুরু আর উত্তর খন্ড দিয়ে পরিসমাপ্তি। উপন্যাসটির অভিনব দিকটি হলো প্রতিটি খন্ডে অসংখ্য ছোট ছোট শিরোনাম করে অসংখ্য অধ্যায়ে বিভক্তি। ফলে প্রতিটি অধ্যায়ে অসংখ্য গল্প জুড়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। নানান ছবি, নানান গল্প, চেনা-অচেনায়, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকে মেলাতে মেলাতে প্রতিটি শিরোনামের গল্প এগিয়ে চলে আর সুতোয় সুতোয় অপ্রত্যাশিত ভাবে কখনো প্রত্যাশিত পথেই যোগসূত্র তৈরি করে। এমন অসংখ্য যোগসূত্রের শিরোনামে নামকরণ মুগ্ধ করেছে আমায়। কখনো নামকরণে, কখনোবা গল্পের গভীরতায় প্রতিটি অধ্যায় পাঠককে এক ধরনের শূণ্যতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিবে, কখনো বা দীর্ঘশ্বাসের স্রোতে ভাসিয়ে যাবে।
ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের দেশে রাজনীতি বিমুখ বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাজউদ্দিন নামের মানুষটি এখন প্রায় অপরিচিত-অচেনা এক নাম। কালো চাদরে ঢেকে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি কে নতুন করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন সুহান রিজওয়ান। সেই নক্ষত্রের নাম তাজউদ্দিন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে তাঁর নির্দেশে ষড়যন্ত্রের সমস্ত বেড়াজাল ছিন্ন করে যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্বাধীনতার পরে দেশভার তুলে দিয়েছেন বাঙলার অবিসাংবাদিত নেতার হাতে তুলে দিয়েছিলেন যিনি তার নাম তাজউদ্দিন আহমদ। যাকে ক্ষমতার মোহ কোনদিন আকৃষ্ট করেনি, হিংসা আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে কখনো প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠেননি যিনি, স্বাধীন দেশে অর্থমন্ত্রি হয়ে যিনি মাথা নীচু করা ভিক্ষা নীতি গ্রহণ করেননি। সারাটি জীবন নিজের নীতি আর আদর্শে অটল থেকেছেন, থেকে গেছেন অভিমানী নীরব পাথর হয়ে। দল থেকে বহিস্কৃত হয়েও যিনি শেখ মুজিবের বিষদগার করেননি কোনদিন, কোনক্ষনে। বরং বারে বারে বঙ্গবন্ধুর বিপদে কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়েছেন নি:সঙ্কোচে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সেই অগাধ ভালোবাসা আর বিশ্বাসের দাম দিয়েছেন যিনি নিজের জীবন দিয়ে। সেই অদ্ভুত আলোকিত নক্ষত্র তাজউদ্দিনের কথাই বলেছেন লেখক তার সমগ্র উপন্যাসে। তাজউদ্দীন সেই মানুষ যিনি রাজপথের আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা প্রণয়নে কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধুর আপন সত্তা হয়ে, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতে, চিন্তায়, আদর্শে আর পরামর্শে। যিনি মুক্তিযুদ্ধাদের সম্মানার্থে পরিবারের নিকটে থেকেও বাস করেননি একি ছাদের তলে, বলেছেন ’আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা বন-বাদড়ে রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে কিংবা ভিজে যুদ্ধ করে বেড়াবে আর আমি পরিবার নিয়ে আয়েশে থাকবো, এ কেমন করে হয়’ ? তাজউদ্দিন সেই অর্থমন্ত্রি হয়ে যিনি সাইকেল নিয়ে বাজারে যেতে পারতেন, সাধারণ মানুষের সাথে অবলীলায় মিশতে পারতেন। যিনি নীরবে, হাসিমুখে নেতার কথা মতো তাঁর মন্ত্রিত্বের চেয়ার এক কথায় ছেড়ে দিয়ে আসতে পারেন, ছেড়ে দেওয়ার পর যিনি অভিযোগের তীরে বিদ্ধ করেন না নিজের দল কিংবা দলনেতা কে। যিনি বাংলাদেশের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে, তাইতো দলের পদে না থেকেও আত্নিক সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন মুজিব পরিবারের সাথে। দল থেকে বহিস্কৃত হওয়ার পরও দলের প্রধানের প্রতি যার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা এতটুকু কমেনি যার। এমন মানুষের গল্প পড়তে পড়তে পাঠক অবাক হয়ে ভাববে একটা মানুষ কেমন করে এত ভালোবাসতে পারে আরেকটা মানুষকে(বঙ্গবন্ধু) আর কেমন করেই বা এত আস্থায় অবিচল থাকতে পারে। তাজউদ্দির সেই মানুষ। অসম্ভব পরিশ্রমী, বিনয়ী, সাদামাটা জীবন-যাপন কারী আর বড্ড বেশি অভিমানী, মৃদুভাষী মানুষটির রাজনৈতিক জীবন আর চরিত্র গভীর মমতায় একেঁছেন লেখক সুহান।
প্রথম খন্ডটি শুরু হয় উত্তাল মার্চ থেকে আর শেষ হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে। অনেক অনেক চরিত্র, অনেক অনেক ঘটনার সমাহার ঘটতে থাকে পূর্ব খন্ডে। আসতে থাকে খন্দকার মোশতাক, ইন্দিরা গান্ধী, রাও ফরমান আলী, নিয়াজি, রুমী, জাহানারা ইমাম, আলতাফ মাহমুদ, খালেদ মোশারফ, মেজর হায়দার, ক্রিকেটার রকিবুল হাসান, আমীরুল ইসলাম, ছাত্রনেতা আব্দুল বাতেন, আলাউদ্দিন, মাওলানা ভাসানী, নিউজ উইকের লরেন জেনকিন্স, নুরুল আলম, শেখ মনি, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আহমদ ছফা সহ আরো অসংখ্য ঐতিহাসিক চরিত্র। ওঠে আসে যুদ্ধকালীন সময়ে প্রবাসী সরকার প্রধান তাজউদ্দিনের সাথে মুজিব বাহিনীর প্রধান শেখ মনির দ্বন্দ, মাকড়সার মতো ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো গুটিবাজ মোশতাকের সাথে চিরকালীন দ্বন্দ তো ছিলো ৪৪০ পৃষ্ঠার প্রতি অক্ষরে অক্ষরে। মোশতাক জানতেন বাংলাদেশকে আবার পাকিস্থান করতে হলে তাজউদ্দিনকে সরিয়ে দিতে হবে বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকে। নানান দলের, নানান স্রোতের মানুষদের সাথে মিশে গিয়ে সেই কাজে সফল হয়েছিলো আর রচিত করেছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো দিনটির।
দ্বিতীয় খন্ড শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রর্ত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। শুরু হয় সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা দেশের বেড়ে উঠার গল্প। চারিদিকে দারিদ্রতার ছোবল, অনিয়মের বেড়াজাল আর সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুযোগ সন্ধানীদের নানান ষড়যন্ত্রের মাঝে দেশকে গড়ে নেওয়ার কাজে বঙ্গবন্ধুর সাথে যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি নিবেদিত প্রাণ হয়েছিলেন তার নাম তাজউদ্দিন আহমদ। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তাজউদ্দিন আহমদের চরিত্রায়নই থাকে উত্তর খন্ডের অষ্টপৃষ্ঠে। সততায়, নিষ্ঠায়, ন্যায়পরায়ণতায়, একাগ্রতায়, আনুগত্যে, আদর্শে, ধৈর্য আর সংযমে অবিচল থেকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকে তাজউদ্দিন নামের ছোটখাট আকৃতির মানুষটি। অন্যদিকে দেশকে বদলে দেওয়ার স্বপ্নে ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে ধূসর থেকে ধূসর হতে থাকেন স্বাধীনতা তথা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানটি। তাঁর সাথে ধূসর হতে থাকে বাংলাদেশের ভবিষ্যত। সরলমনা মানুষটি চেয়েছিলো টেকনাফের নীল জল থেকে শুরু করে তেতুলিয়ার স্নিগ্ধ আকাশের সর্বত্র দিন বদলের জয়গান লিখে যেতে। স্বপ্ন দেখেছেন সুখী-সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশের। নিজের উপর প্রগাঢ় আস্থা ছিলো বলেই শত সমালোচনা সহেও বাকশাল গঠন করেছিলেন ক্ষনিকের বিপর্যয় ঠেকাবার পন্থা রূপে। যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন জীবনভর, শুধু সেই স্বপ্নেই বিভোর থাকাতেই জানতে পারেননি বাঙালির কুটিলপনা, চিনতে পারেন নি তাকে ঘিরে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের, যারা দাবার ঘরে তাঁকে কত সহজে বন্দি করে ফেলেছিলো।
শেখ মুজিব ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকেন ষড়যন্ত্রকারীদের চোরাবালিতে। সেই চোরাবালিতে আটকে গিয়ে দূরত্ব বাড়তে থাকে শেখ মুজিব আর তাজউদ্দিনে। এমন টানাপোড়েন-দ্বন্দ আর অভিমানের গল্পই ছিলো উত্তরখন্ড জুড়ে। সেই ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত বলি হয়ে ১৫ই আগষ্টের রাতে স্বপরিবারে নিহিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মানে একজন মানুষ কে হত্যা ছিলো না, ছিলো একটি চেতনা কে হত্যা করা, একটি দেশকে হত্যা করা। একাত্তরে যে দেশ জন্মেছিলো পাকিস্থান নামক এক নষ্ট ভূ-খন্ড থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারাতে। প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ, সেনাশাসিত, নাক উচুঁ সমাজতান্ত্রিক দেশের অতল থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জেগে ওঠেছিলো অসম্প্রদায়িক চেতনা আর গনতন্ত্রের প্রতি অনুগত নতুন একটি দেশ। যারা প্রথমেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে রাষ্ট্রের গায়ে ধর্মের পোশাক। জলপাই রঙের অর্ধমূর্খদের আরাম আয়াশে রাখার জন্যে নয়, শোষনহীন সাম্যের ভিত্তিতে দারিদ্রমুক্ত একটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যেখানে ক্ষমতা থাকবেনা ক্যান্টনমেন্টের চারদেয়াল আর কামানের মাঝে, ক্ষমতার উৎস হবে সাধারণ জনগন। শেখ মুজিব কে হত্যা মানে তাই সমস্ত প্রগতিশীলতা কে হত্যার চেষ্টা, জলপাই রঙের অর্ধমূর্খদের ক্ষমতায়ন করা, ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে দেওয়া, রাজাকারদের পূর্ণবাসনের চেষ্টা করা। সেই চেষ্টার সবচেয়ে সক্রিয় নাম পাকিস্থান, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য আর দেশী-বিদেশী নানান প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবি আর অভিজাত শ্রেণীর জলপাই সদস্য। যারা কোনদিন মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিতে পারেনি, মেনে নিতে পারেনি টঙ্গিপাড়ার এক সাধারণ কিশোরের মহানায়ক হওয়াকে। তাদের ঘুমের ভেতর দু:স্বপ্ন হয়ে এসেছে বারবার সেই মহানায়কের তর্জনী, যে তর্জনীতে স্বাধীনতা এসেছিলো, পাকিস্থান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো। একাত্তর থেকে পচাত্তরের প্রতিটি ক্ষনে এই সমস্ত গোষ্ঠি ষড়যন্ত্রের জাল বুঁনে গেছে। আর তার সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছিলো ১৫ই আগষ্টের রাতে। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা কোন ব্যাক্তি বিশেষের ব্যাক্তিগত ক্ষোভ বা লোভ লালসা থেকে নয়। যারা খুনের কাজটি করেছিলো তারা কেউই চায়নি রাষ্ট্র ক্ষমতা। আর যদি ব্যাক্তি ক্ষোভ থেকেই হয়ে থাকতো তাহলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২৪ ঘন্টার মাঝেই ’পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ হয়ে যেত না ’ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ , জয় বাংলা স্লোগান প্রতিস্থাপিত হতো না পাকিস্থান জিন্দাবাদের অনুরূপ বাংলাদেশ জিন্দাবাদে। যে আরব দেশগুলোর কাছে বারবার গিয়েও সাহায্য আর স্বীকৃতি মেলেনি সে রাষ্ট্রগুলো কেন, কি কারণে বঙ্গবন্ধু কে হত্যার সাথে সাথে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়? এমন প্রশ্ন আর উত্তরগুলোর মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা কোনভাবেই কোন ব্যাক্তি বিশেষের ক্ষোভ কিংবা লোভ থেকে সৃষ্ট নয়। জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক নানান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই শেখ মুজিব তথা বাংলাদেশকে পেছনের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। অথচ আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যার শোচনীয় সব ব্যাখা দেওয়া হয়েছে যুগে যুগে। আহমদ ছফা থেকে শুরু করে ফরহাদ মাযারহার-রা দিয়ে ইতিহাস বিমুখ জাতিকে দিয়ে গেছেন মিথ্যে দিয়ে বোনা অপইতিহাস।
সুহান রিজওয়ানের এই উপন্যাসও সেই হত্যাকান্ডে ষড়যন্ত্রকারীদের সকল মুখোশ আর উদ্দেশ্য সরাসরি খুলে দিতে পারেনি, বরং হত্যাকান্ডটি কে অনেকটাই রশিদ-ফারুকের ব্যাক্তি ক্ষোভের কেন্দ্রিভূত করেছে। যদিও উপন্যাসের এখানে-সেখানে ষড়যন্ত্রের অনেকগুলো ঘটনার কথা প্রচ্ছন্নভাবে উল্লেখ করেছেন। মোশতাকের সাথে আমেরিকান এক লবির গোপন দেখার বর্ণনা, মধ্যপ্রাচের গাদ্দাফি কিংবা আরবের বাদশাহ ফয়সালের সাথে রাষ্ট্রের নামকরণ (ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ নামকরণ) নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীতা, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করে দেওয়া প্রভৃতি। লেখক আরেকটু সচেতন হলে সবগুলো ঘটনাকে একত্রিভূত করলেই স্পষ্ট হয়ে উঠতো খুনীদের দীর্ঘ দিনের উদ্দেশ্য। এই অস্পষ্টতাই উপন্যাসটির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা মনে হয়েছে ব্যাক্তি আমার কাছে।
এই বিচ্যুতিটুকু বাদ দিলে ’সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ ইতিহাস ভিত্তিক নির্মোহ উপন্যাসের তালিকায় সবচেয়ে উজ্জ্বল নামের একটি হয়ে থাকবে বাংলা সাহিত্যে। বাক্য গঠনে, শব্দ চয়নে, কাহিনী বিন্যাসে, উপমা অলংকরণের দক্ষতায় লেখাটি সকল পাঠকের কাছেই সুপাঠ্য হবে আশা করি। আর আশা করি ইতিহাসকে জানার যে বীজ রোপিত হবে ‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণে’ তা একদিন পূর্ণ বৃক্ষে পরিণত হবে সকল পাঠকের মাঝে।
মন্তব্য
শিরোনামে-
আছে আর ট্যাগে সাক্ষী ছিলো
। একটু খেয়াল করবেন প্লিজ।
বইটি গতকাল হাতে পেয়েছি, পড়া শুরু করলাম। শেষ হলে আপনার লেখায় আবার ফিরে আসবো। ভাল থাকুন।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
বড় ভুলের জন্যে দু:খিত, ঠিক করে দিলাম। ধন্যবাদ
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
বইটা এখন ও হাতে পেলামনা। পড়তে হবে।
পড়ে ফেলুন, অন্যকে ও পড়তে উৎসাহী করুন। এমন বই সবাই পড়া উচিত
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
যা যা কইতে আইছিলাম ঠিক তাই তাই সাদিয়াপায় কইয়া ফালাইছে। (আইনের মানুষ না হইলে কপিরাইট আইনে মামলা ঠুকতাম।) যাই হোক, লেখকের আশু দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ঠিক করে দিয়েছি, লেখা পাবলিশের আগে আরো যত্নবান হতে হবে
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
বইটা খানিক পড়ে রেখে দিয়েছি-নিরবচ্ছিন্ন কিছুটা সময় নিয়ে পড়ব বলে। রিভিউ ভালো লাগল। আর টাইপো আছে বেশকিছু, ঠিক করে নেবেন না হয় তবে সাদিয়া’পু আর সাক্ষী দা’র সাথে এট্টু আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি-দ্বিতীয় প্যারার শেষের দিকে ‘রেজওয়ান’ টা ‘রিজওয়ান’ করে দেবেন দয়া করে
দেবদ্যুতি
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
বানানগত প্রমাদ আরও দু’একটি থেকে গেছে মনে হয়। তবে সেগুলো উল্লেখ করছি না কারণ ধরে নিচ্ছি ওগুলোও উল্লেখিত দু’টি শুদ্ধ করার সময় ঠিক করে দেয়া হবে। বইটির ব্যাপারে আগেও গোটা তিনেক পোস্ট পড়েছি। সেগুলো পড়ার কারণেই আপনার এ পোস্টটি দেখার সাথে সাথেই পড়ে ফেলতে বাধ্য হলাম। বইটি এখনও আমি পড়িনি বা যোগাড়ও করতে পারিনি। তবে আমাদের গ্রামের ‘বইয়ের ডাক’ নামের বই পড়ার আন্দোলনের ‘বই সেবক‘ বৃন্দকে বইটি আন্দোলনের পুস্তক সংগ্রহশালার জন্য ক্রয় করতে বলেছিলাম বেশ আগেই। এখন দেখছি আরও কয়েক কপি কেনার অনুরোধ জানাতে হবে। মহান নেতা তাজ উদ্দিনের দুর্লভ আদর্শের দিক গুলো যে বইটিতে সুন্দরভাবে ফোটিয়ে তোলা হয়েছে, সে বিষয়টি আপনার পোস্ট মারফৎ জানার পর খুব ভাল লাগছে এই ভেবে যে তাজউদ্দিনের জেলার এক গন্ডগ্রামের ক্ষুদে পাঠক গণ নিজ জেলার মহান মানুষটির বিষয় যখন পড়বে তখন গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠবে নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই তাদের অন্তত কেউ কেউ সেসব আদর্শ গুলো অনুস্মরণ করতে চেষ্টা করবে, অন্যদেরকেও অনুকরণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। শক্তিশালী লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
- পামাআলে
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
১৯৭৫ এর হত্যাকান্ডের অস্পষ্টতাটুকু ছাড়া 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' একটি চমৎকার পাঠযোগ্য গ্রন্থ।
লেখকের জন্য শুভকামনা।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
হাসান মোরশেদ ভাইয়ের মন্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ একমত।
লেখা ভাল লেগেছে।
আচ্ছা বানানটি কি পচাত্তর না পঁচাত্তর??
বই পাবলিসের আগেই এই বই নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। একেক জনকে একেক রকম ভাবে প্রভাবিত করেছে এই বইটা।তবে বইয়ের লেখক যে অসাধ্য সাধন করেছেন এবং এই নির্মোহ একটা উপন্যাস(তথ্যভান্ডারও বলা যায়) উপহার দিতে পেরেছেন তাতে করে কি ভাষা প্রয়োগ করলে তাকে পুরস্কৃত করা যায় বুঝতে পারছি না।
মাসুদ সজীবের রিভিউও দারুন হয়েছে।এই তথ্য বহুল বইটার সব কথাকে সারমর্ম আকারে এই রিভিউর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তার জন্যও ধন্যযোগ রইলো!
-------------
রাধাকান্ত
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
নতুন মন্তব্য করুন