কেমন আছে বাংলার নারীরা? কিশোরী থেকে যারা তারুণ্যে এসেছে, তারুণ্য থেকে যারা পূর্ণ যৌবনা হয়েছে, হয়েছে কারও প্রেয়সী, হয়েছে কারও স্ত্রী তারপর একদিন হয়েছে মা। কেমন আছে সব কন্যা-জননী-জায়া-রা? কেমন আছে তারা নিভৃত গ্রামে কেমন’ই বা আছে শহরের চারদেয়ালের বদ্ধ ঘরে? স্ব-সম্মানে আছে তো কর্মজীবি নারীরা, নিজের অধিকারটুকু নিয়ে ভালো আছে তো গৃহিণী-রা?
(১)
কিশোরী থেকেই ধরা যাক। সে যখন স্কুলে যায় গ্রামের মেঠো পথ থেকে শুরু করে শহরের ব্যস্ত পথ ধরে তখন কত শত রাক্ষুসে চোখ তাকে গিলে ফেলতে চায়? কত? আমি জানি, আপনি ও জানেন এই সংখ্যা শত-শত, হাজারে-হাজার। শুধু চোখের সন্ত্রাসেই কি সীমাবদ্ধ থাকে এই যৌন হয়রানি? না, এতটা সভ্য এখনো হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশ! নারী যৌন হয়রানির প্রথম ধাপ চোখের সন্ত্রাসে বেশিদিন আটকে থাকে না সূর্য সন্তানেরা। রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে কিংবা আর্থিক খুঁটির জোরে এরাই অল্পদিনে চলে যায় দ্বিতীয় ধাপে। যেখানে চোখের সহায়ক হিসেবে মুখও চলে, যাকে ভদ্রলোকী ভাষায় আদর করে ইভটিজিং আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই ভদ্রভাষার ডাকা এই করুচিপূর্ণ ইভটিজিং এ স্বীকার হয়ে সেই কিশোরীর রঙিন পৃথিবী দিনে দিনে ধূসর হয়ে ওঠে। মাঝে মধ্যে খবরের কাগজে আমরা দেখি বোকা-সোকা দু-চারজন আবার আত্নহত্যাও করে বসে! এদের আসলে অভিযোজন ক্ষমতা কম, আরে বাপু নারী মানেই তো ভোগের মাংস পিন্ড, তাকে দেখলে তো দু-চারটে দুষ্ট ছেলে ঢিল ছুঁড়বেই। মাওলানা সাহেবের ওয়াজ-মাহফিল থেকে শুরু করে গ্রামে-শহরে প্রতিটি লোকালয়েই তো এই কথন আজ সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ‘গাছে বরই থাকলে তাতে ঢিল পড়বেই’। অর্থাৎ নারী হলো বরই, তাকে দেখলে ঢিল ছুঁড়াতে দোষের কিছু নেই! ঢিল ছুঁড়া যেখানে অপরাধ নয় সেখানে তাই মুখের সন্ত্রাস কোনভাবেই বড় কোন অপরাধ হতে পারে না।
পারিবারিক, সামাজিক আশ্রয়ে পালিত এমন যৌন হয়রানির বৈধতা নরপশুদের আরও সাহসী করে তুলে। তখন চোখ আর মুখের সন্ত্রাস বেশি দিন তাদের তৃপ্ত রাখতে পারে না, ফলে একদিন চোখ-মুখের সন্ত্রাসের সাথে হাত ও চলে আসে নতুন অস্ত্র হিসেবে। ভিড়ের মাঝে, অন্ধকারে কিংবা অালোতে সুযোগ পেলেই এরা নারীর দেহে হাত চালায় নির্বিঘ্নে। বাংলায় এমন কোন কিশোরী খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাকে এই তিনটি সন্ত্রাসের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠতে হয়নি। কিশোরী থেকে তরুণী, তরুণী থেকে কর্মজীবি নারী, কর্মজীবি নারী থেকে স্ত্রী-মা যে রূপায়ণটাই ঘটুক না কেন এই তিন ধরণের সন্ত্রাস থেকে মুক্তি ঘটেনি বাঙালি নারীর।
তারুণ্যে এসে যখন সে ফুটে কারো চোখে পৃথিবীর বিশুদ্ধতম ফুল হিসেবে, চারিদিকে যখন স্বপ্নময় স্বাধীন জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, তখন-ই তাকে লড়তে হয় সবচেয়ে বড় বাধা-বিপত্তিগুলোর সাথে। এতদিন লড়াই চলে বাহিরের পৃথিবীর সাথে, এবার শুরু হয় চারদেয়ালে, লড়াইটা চলে এবার কাছের মানুষদের সাথে। খালাতো ভাই, চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, কখনো কখনো নানান সম্পর্কের চাচা-মামা, কখনোবা গৃহশিক্ষক, সুযোগ পেলে সম্পর্কের হিসেব চুকে দিয়ে সবাই হাত বাড়ায় তার পানে। লজ্জায়, ঘৃনায়, পরাজয়ে সেই কিশোরী/তরুণী মিশে যেতে থাকে মাটির সাথে। মিশে যাওয়ার আগে কার কাছে বিচার দিবে? কে তাকে বিশ্বাস করবে? বিশ্বাসের মানুষগুলোই তো সর্বপ্রথম বিশ্বাসভঙ্গের খেলায় মেতেছে!
তারপরও কেউ কেউ কাছের মানুষের কাছেই অভিযোগ করে যৌন হয়রানির। ফলাফল নির্যাতনকারীর কিছু না হলেও এই ঘটনার জন্যে অভিযোগকারী দোষী সাবস্ত হয় সবার আগে। আত্নীয় মানুষ, লোকে জানলে ছি: ছি: করবে, তার চেয়ে চেপে যাওয়া ভালো বলে ধামাচাপা দেওয়া হয় আর নিজের কাপড়-চোপড় ঠিক রেখে চলার হুলিয়া দেওয়া হয় সেই পরিবার থেকেই। নিজের অভিজ্ঞতার ছোট্ট একটা ঘটনা উল্লেখ করি, বছর দশেক আগে আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতো একটা পরিবার। সেই পরিবারে দুটো মেয়ে ছিলো। একজন ক্লাস টেনে আরেকজন খুব সম্ভব সেভেনে পড়তো। যখন থেকে তারা আমাদের ভাড়াটিয়া হয়েছে তখন থেকে দেখেছি আমাদের সামনের বাসার ছাদে বখাটের আড্ডাখানা, বাসার সামনে এখানে সেখানে দলাপাকিয়ে আছে নব্য শুয়োরেরা। তাদের কে ডাক দিতে গিয়ে পাড়ায় অনেক বড় একটা ঝামেলা হয়েছিলো আমার সাথে, এলাকার সব বড় নেতারা যোগ দিয়েছিলো সেই বখাটেদের বাঁচাতে। আমার সাথে যারা ওই শুয়োরগুলো কে ডাক দিয়েছিলো তাদের কে উল্টো প্রহার করেছে রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা। যাইহোক সে ইতিহাসে না যাই, সেই গন্ডগোলের এক মাসের মাঝে মেয়েটার পরিবার বাসা ছেড়ে চলে গেছে, তারও মাস দুয়েকের মাঝে শুনেছি মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। গন্ডগোলের দিন সন্ধ্যায় মেয়ের বাবা-মা-চাচা সবাইকে দেখেছি মেয়ের ও দোষ আছে বলে বুলি উড়াতে। বিনা বাতাসে গাছের পাতা লড়ে না বলে অনেক বুড়ো শয়তানকে দেখেছি সমতা রক্ষা করতে।আমি জানি প্রতিটি শহরে, প্রতিটি মফস্বলের চিত্র এমন। বখাটেরা শিস দিবে, মন্দ কথা ছুড়ে দিবে আর অকাজের বুড়োরা (নারী-রা এক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে) বলে বেড়াবে ‘বিনা বাতাসে গাছের পাতা নড়ে না’ আর দুকূল রাখা নারীলিপ্সুক সুশীলরা বলে যাবে ’না, দোষ দু-পক্ষেরই আছে’। এমন যখন অবস্থা তখন সে কাকে বলবে তার নির্যাতনের কথা? কেউ কি আছে?
(২)
তারপরও পথের সব বাধা আর জঞ্জাল সরিয়ে পড়ালেখা শেষ করে যখন কোন নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখন সে কেমন থাকে? না, সেখানেও ভালো নেই। কামনার চিন্তাহীন, লালসার দৃষ্টি ছাড়া ক’জনা তাকে শুধু সহকর্মী হিসেবে দেখে? ভেতরের পশুটাকে স্যুট-কোট পরালেও সময়ে-অসময়ে সেটি বেরিয়ে পড়ে। এমন অসংখ্য পশু আমার সহকর্মী হয়েছে। বাড়তি খাতির, বাড়তি সুযোগ দিয়ে পোষ মানাতে চায় তাকে। নারী মানে এদের কাছে একথালা মাংস পিন্ড ছাড়া আর কিছু নয়। এদের ভাবনা জগত এমন, যে একটা শাড়ী দিলে, একদিন চায়নিজ খাওয়ালেই বিছানায় পাওয়া হয়ে যাবে! বিছনাটাই শেষ কথা এদের! শত চেষ্টাতে ও যদি সফল না হয় তখন সেই নারীকে নিয়ে কুৎসা রটাবে। দেহ লুটেরা প্রেমিকরা অভাব কে চাঁদের দেশে পাঠিয়ে দিবে, সুখের একটা সংসার দিবে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবে জীবন এমন অসংখ্য মিথ্যে আশ্বাসের বুলি উড়িয়ে প্রেমের ফাঁদ পাতে, আর যখন লক্ষ্যে পৌছাতে পারে তখন থেকেই বদলে যেতে থাকে।
এভাবে আপনি সামাজিক কাঠামোর যে স্তরেই নারীকে দেখেন সবখানেই এই একি চিত্র, একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলছে। কোন প্রতিকার নেই, কোন ব্যতিক্রম নেই। আচ্ছা যৌন হয়রানির বাহিরে কেমন আছে নারীরা?
দু:খিত এখানেও আপনাকে আশার বাণী শুনাতে পারছি না, এখানেও ভালো নেই তাঁরা। পুরুষ আর ধর্মগ্রন্থ মিলে তাদের বানিয়ে রেখেছে হাতের খেলনা, যাকে যেমন খুশি তেমন পরিচালনা করা যাবে। তাদের নিজস্ব কোন মতামত থাকবে না, থাকবে না ব্যাক্তি স্বাধীনতা। ধর্মগ্রন্থগুলোই নারীদের উপর আরোপ করেছে শত শত বিধি নিষেধ। তার শরীর কে দেখিয়েছে পাপের আখড়া রূপে। তাই চারদেয়ালে বন্দি থেকে সেটিকে সম্পূর্ণ ঢেকে রাখতে হবে দিনে রাতে, যাতে পুরুষের রাক্ষুসে চোখ না পড়ে। এসব দেখেই বেগম রোকেয়া একদিন বলেছিলেন ’ধর্মগ্রন্থগুলো সব পুরুষদের রচনা’। আরও বলেছিলেন, ‘ধর্ম’ই আমাদের দাসত্ব বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ‘ধর্মে’র দোহাই দিয়া পুরুষ রমণীর উপর প্রভূত্ব করিতেছেন’। ভাগ্যিস রোকেয়া এ যুগে জন্ম গ্রহন করে নাই, করিলে মোল্লাদের শানিত চুরিতে ক্ষতবিক্ষত তাহার লাশখানিও পড়ে থাকতো শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে, আর রোকেয়ার রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার আগেই ধার্মিক বাঙালি থেকে শুরু করে অস্প্রদায়িক কওমি লীগ সবাই বলে উঠতো ‘না, এগুলো নিয়ে কথা বলার মতো সময় এখনো আসেনি’।
রোকেয়া যুগ থকে শুরু করে সব যুগেই নারীদের দমন করা হয়েছে, আজও হচ্ছে। আজও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সমস্ত বিধানই পুরুষকেন্দ্রিক এবং নারীবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী। এখন এই আধুনিক যুগে পরিবারে নারীর অবস্থান কতটা মজবুত? তার মতামত কতটা শক্তিশালী? উত্তর হলো সেখানেও করুণ দশা, পরিবারে নারীর কাজ রান্না-বান্না করো, স্বামীর সেবা-যত্ন করো, ঘর পরিষ্কার রাখো, বছরে বছরে বাচ্চা দাও (বাচ্চা না হলে কিংবা মেয়ে হলেও সব দোষ নারীর, এই অপবাদ তো আছেই) আর তাদের খাইয়ে দাইয়ে মানুষ। পরিবারের কোন বড় সিদ্ধান্তে তার মতামত আগেও নিতো না আজও নেওয়া হয় না, এমনকি নামের অর্ধাঙ্গীকে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেনা কর্তা পুরুষটি। আমি আমার নিজের পরিবারে দেখেছি, চারপাশের সবগুলো পরিবারে দেখেছি এমন স্বৈরাচারি মনোভাব। বাংলার প্রতিটি পরিবারের পুরুষ নিজেকে অনেকটা ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে রেখেছে। এসব দেখেই হুমায়ুন আজাদ আমাদের মা কবিতায় বলেছিলেন
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মতো দাঁড়াতো বাবার সামনে
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয় নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড়ো ছিলো, কিন্তু ছিল আমাদের সমান,
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেণীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়ল বিলের প্রচণ্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া স’রে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
(৩)
শত বছর আগেও নারীদের শিক্ষার্জন, কর্মক্ষেত্র নিষিদ্ধ ছিলো, আজও আছে। যেমন আরব বর্বর রাষ্ট্রগুলোতে শিক্ষা সহ কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহন নিষিদ্ধ এখনো। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে এসেছে মানুষ দাবি করে, কিন্তু কতটা আধুনিক হয়েছে মানুষ তথা পরুষ? মধ্যযুগে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহন করিলে তাকে মাটিতে জীবন্ত পুতে ফেলা হতো! বিপত্নীক পুরুষের বিয়ে করার বৈধতা ছিলো অথচ বিধবা নারীদের বিয়ে নিষিদ্ধ ছিলো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরদের হাত ধরে বিধবা বিবাহ আইন পাস হলেও এই আধুনিক যুগে মেয়ে সন্তান জন্ম দিলে সেই মা আজও নিগৃহীত হয়! অাজও বিয়েতে নারীর মতের কোন গুরুত্ব নেই বেশিভাগ পরিবারে। গরু-ছাগলের হাটের মতো তাকেও পুরুষদের হাটে তোলা হয়, তারপর দামদর ঠিক করে সোপে দেওয়া হয় তার চেয়ে দ্বিগুন বয়সী এক পুরুষের কাছে। চেনা নেই-জানা নেই এমন একটা পুরুষের সাথে শরীর দিয়ে সূচিত সম্পর্কে নারীরা পুরুষটি কে কতটা নিজ থেকে আপন করে নেয় আর কতটা লোক দেখানো আপন করে নেয় এটা নিয়ে আমার সংশয় আছে। শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত প্রায় সব বাঙালি পুরুষের বিয়েতে একটা ঐতিহ্য আছে। সেটি হলো ‘ কম বয়সী মেয়ে’ বিয়ে করা। আপনি আপনার পরিচিত যাকেই জিজ্ঞেস করবেন সেই বলবে ’ভাই, আমার কেসটা আলাদা’।
নারীর প্রতি পুরুষের বিদ্বেষ, অসম ভাবনা এখনো কমেনি, শুধু তার রূপটা হয়তো কিছুটা বদলেছে। বিদ্বেষ, নির্যাতন পাশ কাটিয়ে যদি দেখি পরিবারে, সমাজে নারীর স্বাধীনতা কতটুকু, অধিকার কতটুকু? এখানেও হতাশার কালো মেঘ জমে আছে। আধুনিক বাংলাদেশের নগর জীবনেও একজন কিশোরী কিংবা তরুণী কোন বিষয়ে পড়ালেখা করবে, কোথায় পড়বে সব কিছু ঠিক করে দিবে পরিবার! এমনকি তার পোশাক কেমন হবে, বন্ধু-বান্ধব কেমন হবে, সবকিছুর উপর আসতে থাকে নানান বিধি-নিষেধ আর একমুখী নিয়মকানুন। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব ঘরেই নারীদের জন্যে বৈষম্যের এই প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে পুরুষ। এতসব প্রাচীর বিদীর্ণ করে যারা সফলতার সহিত উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে অপেক্ষা করে কর্মক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে, সেখানেও তাদের জন্যে তুলে রাখা হয়েছে আরো দীর্ঘতম প্রাচীর। আমার চাকরির অভিজ্ঞতায় যতটুকু দেখেছি, ঔষুধ প্রতিষ্ঠানের ল্যাবগুলোতে মেয়েদের না নেওয়ার একটা রীতি মোটামুটি প্রসিদ্ধ করে নিয়েছে বড় বড় হর্তাকর্তা-রা। আমার নিজের বিভাগে যদি একশোটা সিভি পড়ে যার মাঝে ত্রিশ-চল্লিশটা নারী থাকলে ডাকা হয় হয়তো দু-চারজন কে! আর তাদের নেওয়া হয় কদাচিত কিংবা শক্ত কারো রেফারেন্সে। দেশ সেরা এমন একটা ঔষুধ প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন আমার বিভাগের প্রধান কে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন মেয়েদের নেওয়া হবে না যোগ্যতা থাকলে? আমেরিকা থেকে পিএইচডি নেওয়া সেই আদম আমায় বলেছিলো ‘মেয়েদের ক্যালিবার কম, সমস্যা থাকে বেশি! আমি সেই সর্বোচ্চ শিক্ষিত মুর্খের কথা শুনে ‘থ’ হয়ে গিয়েছিলাম! একজন পিএইচডি ধারী মানুষ যদি নারীর প্রতি এমন ধারণা পোষন করে তাহলে অর্ধ-শিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর-রা আর কি ধারণা পোষন করবে আর নারীর সাথে কেমন-ই বা আচরণ করবে। আমাদের সেই ল্যাবে ২৩-২৪ জন ছেলে আর দুজন মেয়ে ছিলো সর্বসাকুল্যে। আজ আমি নত মস্তকে বলতে পারি সেই দুটি মেয়ে যত কাজ করতো তার সিকিভাগ কাজও কোন ছেলে সেখানে করতো না। এই সত্য সবাই জানতো, সবাই মানতো তারপরও সেখানকার দৃশ্যপট বদলায়নি। হ্যাঁ মেয়েদের নেওয়া হয় ফুলদানিতে রাখা ফুলের মতো সাজিয়ে শোভা বৃদ্ধি করতে হেড অফিসে, কখনো এডমিনে কিংবা মার্কেটিং বিভাগে।
তারপর ও এই দেশে নারীরা পড়ালেখায় যে এতটা এগিয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নিয়েছে এটা আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকে। তাদের অফুরন্ত ইচ্ছেশক্তি, অসীম সাহস, স্রোতের বিপক্ষে লড়াই করার অপারেজয় মানসিকতা কে আমি কুরনিশ করি। নারীদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুন, অাসুন নিজের নামের সাথে পুরুষ বাচক শব্দটা ত্যাগ করে আমরাও তাদের সহযাত্রী হই, মানুষ হয়ে উঠি, অন্যকেও মানুষ হিসেবে দেখি। মানুষের অধিকারের জন্যে, মুক্তির জন্যে কাজ করি। নারী-পুরুষ বলে ভেদাভেদের দীর্ঘ প্রাচীর ভেঙ্গে দেই। মানুষের জয় হোক।
মন্তব্য
(১) নম্বর পয়েন্ট প্রসঙ্গে রেডিটে দেখা একটা কথার অনুবাদ বলি,
" মেয়েরা মনে করে না যে সব পুরুষই অমন লম্পট, কুত্তসিত মানসিকতার
তবু অমন বিকৃত যৌনলালসায় ভোগে এবং সুযোগ পেলে চরিতার্থ করে তাদের সংখ্যা খুব কম নয়,
অমন পিশাচের সংখ্যা এতটাই বেশি দুনিয়ার প্রতিটা মেয়েকেই কোন না কোন সময়ে কোন না কোন ভাবে তার স্বীকার হতে হয়েছে,
সংখ্যাটা এতটাই বেশি যে এই বিকৃত লালসার চর্চা ব্যক্তিবিশেষের চারিত্রিক সমস্যা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না,
সংখ্যাটা যখন এতটাই বেশি হয়, এটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়"
এই কচি মেয়ে খোঁজা, সুযোগ মত লালসা মেটানো এগুলি নিয়ে আমরা একটি ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ। এখানে অযথাই আমরা পবিত্র/ শুদ্ধ নারী খুঁজে বেড়াই যেখানে নিজেরাই ইচ্ছেমত তাদের জীবনে কদর্যতা ছড়াতে ব্যস্ত থাকি।
আমার আশ্চর্য লাগে এত পঙ্কিলতা মোকাবেলা করে এসেও বাংলার মেয়েরা এখনো বাংলার পুরুষদেরকে ভালবাসে, ভালবাসার সুযোগ দেয়, বিশ্বাস করে। নাকি জোর করে ধরে বেধে দেয়ার বৈবাহিক সম্পর্কে কেবল অভিনয় করে যায়?
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
ভাল প্রশ্ন।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
প্রথমটাই সত্য মনে হয় আমার। আমার মনে হয় বাঙালি মেয়েদের বিশ্বাস প্রবণতা, কোমলতা, চিন্তার শুদ্ধতা পুরুষের চেয়ে কয়েক লক্ষগুণ বেশি। এগুলো মিলিয়ে যে উদারতার জন্ম হয় সেই উদারতা থেকেই নারীরা আজও বাঙালি পুরুষদের ভালোবাসে।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
তবু তারা ভাল থাকে। না থাকলেও বলবে, ভাল আছি, তুই কেমন আছিসরে বাবা নতুবা তুমি ভাল আছো তো?
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
বাঙালি নারীদের জীবন সংগ্রাম এত বহুমুখী যে খুব গভীর থেকে চিন্তা করলে বিস্মিত হতে হয়। যে পরিবারে জন্ম হয় সেখান থেকে বিদায় নিয়ে একেবারে অচেনা-অজানা পরিবারে স্থায়ী হতে হয়। সেই পরিবারের সবগুলো মানুষকে খুশি রাখা, আপন করে নেওয়া কম আত্নত্যাগের গল্প নয়। এই আত্নত্যাগের মাঝে সে আসলে সত্যিকার অর্থে কতটা ভালোথাকে আর শুধুমাত্র সৌজন্যতাসূচক বলার জন্যে ভালোথাকে সেটা অজানা থেকে যায় সবার। তবু বেঁচে থাকার তাগিতে ভালোথাকার অবিরত সংগ্রাম সে করে যায়। একি সময়ে, একি ছাদের তলে থেকেও দুজন মানুষের (স্বামী-স্ত্রী) ভালোথাকার সংগ্রামের পথ কত ভিন্ন!
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
"আজ আমি নত মস্তকে বলতে পারি সেই দুটি মেয়ে যত কাজ করতো তার সিকিভাগ কাজও কোন ছেলে সেখানে করতো না। এই সত্য সবাই জানতো, সবাই মানতো তারপরও সেখানকার দৃশ্যপট বদলায়নি" - বদলাবে, অর্থনৈতিক 'নিয়ন্ত্রণ' পুরুষের হাত থেকে যত বেশী করে মেয়েদের হাতে যাবে, তত বদলাবে। পুরুষ সমষ্টিগতভাবে সে বদলকে স্বাগত জানাবে না। প্রচুর চেষ্টা করবে বাধা দেবার, নানা কিসিমের অত্যাচার চালাবে, কিন্তু সে বদল আটকানোর ক্ষমতা তার থাকবে না।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পরিবর্তন আসবেই, মানুষের মুখোশ পড়ে থাকা পশুরা একদিন হারাবে আস্তাকূঁড়ে। মানুষের জয় হবেই এ বিশ্বাস আছে।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
শুধু ধর্মগ্রন্থগুলিই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসের প্রাচীন সব গাঁথাগুলি পুরুষেরাই নিজ হাতে লিখেছে এবং সংরক্ষিত করেছে। সেখানেও যা হবার হয়েছে। মহাকাব্য কিংবা কোনো আদিকাব্যের পাতা জুড়ে রয়েছে নারীর জন্যেই হয়েছে সমস্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ কিংবা অশান্তি। সুতরাং নারীই হলো সমস্ত অশান্তির মূল। এই নিয়ে পরবর্তীতে সময়ে-সময়ে ধর্মের ধারক-বাহক গুরু-পান্ডা-পুরুহিত-মোল্লারা তাদের ঐশী বাণীই দিয়ে গেছেন এবং বলে গেছেন নারীই হলো সমস্ত বিষের উৎস। এটাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিরায় শিরায় প্রবাহিত
ডাকঘর | ছবিঘর
নারীর প্রতি ধর্মের বিদ্বেষ কতটুকু সেটা আদম-হাওয়ার স্বর্গ থেকে পতনের কাহিনি টা জানা থাকলেই বুঝা যায়। একটা ধর্মের যেখানে শুরু হয়েছে ‘নারীকে’ এমন ছোট করার মাধ্যমে সেখানে নারীর প্রতি সমঅধিকার দিয়েছে এরচেয়ে বড় জোকস আর কি হতে পারে?
পাপ, অনাচার, অশান্তি, যুদ্ধ, ধ্বংস সবকিছুর জন্যে ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে মহাকাব্য-আদিকাব্য সবাই ’নারীকে’ কী নির্লজ্জ ভাবে দায়ী করে গেছে। হুমায়ুন আজাদের করা একটি উক্তি কে আমার পুরুষ তথা কোন গ্রন্থকে আধুনিক নাকি অনাধুনিক বিচার করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গ্রহনযোগ্য মনে হয়েছে, তিনি বলেছিলেন
পুরুষের জায়গায় ধর্ম গ্রন্থ/মহাকাব্য/আদিকাব্যকে বসিয়ে দিলে তাকেও সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
পড়লাম। কিছু বলার ক্ষমতা উবে গেছে হঠাৎ। তবে আপনার লেখা এবং শিশির কণার মন্তব্য পড়ে
নিজের মনেও বিস্ময় এবং প্রশ্ন জাগলো। যদি সুযোগ পাই পরে এসে কিছু বলে যাবো হয়ত। লেখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ সজীব।
আসার আগ পর্যন্ত সচলের লেখাগুলোতে চোখ বুলাই আর একা একা খাই।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
লেখা ভাল লাগলো।
শিরোনাম লাগলো না। নারীদের শুধু নারী হিসেবে দেখলেই ভাল লাগে। কন্যা জায়া জননী হিসেবে না।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ধন্যবাদ।
জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সবার নিদিষ্ট কিছু পরিচয় থাকে, কেউ সন্তান, কেউ পিতা-মাতা, কেউ স্বামী-স্ত্রী। এই চক্রের মধ্য দিয়ে সবাই কে যেতে হয়। বয়সের সাথে সাথে নারী-পুরুষেরও নিদিষ্ট কিছু পরিচয় থাকে। সামগ্রিক ভাবে কোন মানুষকে খুঁজতে হলে, তার জীবনচিত্র আকঁতে হলে সবগুলো পর্যায় নিয়ে আলোচনা করতে হয়। সেই জীবনবৃত্তান্ত আকঁতে গিয়েই এই শিরোনামের ব্যবহার।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
নতুন মন্তব্য করুন