আমি গাধা বলছি

মাসুদ সজীব এর ছবি
লিখেছেন মাসুদ সজীব (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৫/২০১৫ - ৯:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাঠক জীবনে লেখক কৃষণ চন্দরের কোন ধরণের লেখার সাথে পরিচয় ছিলো না এতকাল। ফলে কোন ধারণাও ছিলো না লেখকের সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম নিয়ে। গত বইমেলায় নানান স্টলে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে একটা আনকোরা লেখকের অদ্ভুদ সুন্দর নাম চোখে পড়লো। বইটির নাম দেখেই পছন্দ হলো, কি সুন্দর নাম ‘আমি গাধা বলছি’, তাই কিনে ফেললাম। নাম দেখেই এইটুকু বুঝেছি এটা স্যাটায়ার ধর্মী কোন লেখা হবে। কিন্তু সেই স্যাটায়ারের পরিধি যে এত ব্যাপক হবে সেটি বুঝতে পারিনি। কি নিয়ে ব্যাঙ্গ করা হয়নি উপন্যাসটিতে, কি নিয়ে উপহাস করা হয়নি? ধর্মীয় অন্ধতা, সামাজিক কুংস্কার, বইয়ের প্রতি মানুষের অনীহা, সরকারী কাজের নানান অসঙ্গতি, মানুষের হুজুগেকর্ম, লোভ, মোহ, ভন্ডামি, অসাধুতা, বিশ্বাস সহ শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত? যেখানেই অসঙ্গতি রয়েছে সেখানেই ব্যঙ্গ করা হয়েছে, উপহাস করা হয়েছে। ভুল বোধ, ভুল বিশ্বাস, ভুল দাম্ভিকতাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারিদিকে এত অসঙ্গতির জয়গান আর সেই অসঙ্গতিকে লেখকের লেখায় ব্যঙ্গময় উপস্থাপন, অন্তরের অন্তস্তলে নাড়া দেয়, হৃদয়ের সংবেদনশীলতা অর্থাৎ সুকুমার বৃত্তিগুলিকে জাগিয়ে তোলে। নানান বিষয়ের নানা অসঙ্গতিকে ইঙ্গিত করে এত বৈচিত্র‌্যময় এই লেখা, যে পড়তে গিয়ে শুধু বিস্ময়ের অতলে ডুবেছি আর ভেবেছি কি করে লেখক উনিশ শতকের মধ্যভাগে বসে ঠিক আমার দেশের আমার মানচিত্রের আমার সংস্কৃতির সব অসঙ্গতির চিত্র এঁকেছেন? কি করে?

মানুষের মনুষ্যত্ব, বিবেক জাগানোর জন্যে অভিনব পন্থায় রচিত এই উপন্যাসটি আমাকে নানান দিক থেকে মুগ্ধ করছে। গল্প বলার ধরণ, বিষয় বৈচিত্র্যতা, ঘটনার গভীরে প্রবেশ, উপলব্ধির মর্মমূলে আঘাত, রসালো উপস্থাপন, ভাষার অশেষ দক্ষতা সব মিলিয়ে স্যাটায়ার ধর্মী লেখার মাঝে এই লেখাটি আমার পড়া অন্যতম সেরা এ কথা বলতে পারি। গল্পের শুরুটা এমন....

ভদ্র মহোদয়গণ, গোড়াতেই বলে রাখি, আমাকে কোনো সাধু-ফকির মনে করবেন না। আমি না কোনো পীর দস্তগীর, না স্বামী ঘমঘমানন্দের চেলাচামুন্ডা, না দোয়া-তাবিজ দেনেওয়ালা সুফী গুরমুখ সিং মাঁঝিলা, না কোনো ডাক্তার, না হাকিম, না হিমালয়ের চূড়ায় আসীন কোন মহা পুরুষ, না কোন চিত্র তারকা, না রাজনৈতিক নেতা। আমি নেহাত গোবেচারা গাধা। ছোট বেলায় ভুলক্রমে খবরের কাগ পড়ার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলোম। এই রোগ শেষাবধি আমাকে এমন জেঁকে ধরেছিলো যে, ইট টানার কাজ রেখে আমি বেশির ভাগ সময় খবরের কাগজ পড়ায় নিমগ্ন থাকতাম। তখন আমার প্রভু ছিলো ধন্নু কুমার।

একটা গাধাকে আমরা যেভাবে চিনি কিংবা জানি, গল্পের গাধা সেই প্রচলিত গাধা নয়। যদিও এ গাধার চার পা আর একটি লেজ আছে তবু এ গাধা পড়ালেখা জানে, এমনকি কথা ও বলতে জানে! মানুষের মতোই সেই গাধার উত্থান-পতনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে লেখায়। ধন্নু মালিকের সাথে সে কাজ করতো সৈয়দ কেরামত আলী শাহর বাড়ী কাজে। তার কাজ ছিলো ইট টানা। কেরামত আলীর বইপ্রেম ছিলো অত্যাধিক, সে তার নতুন বাসায় একটা কামরা ও করেছিলো পাঠাগারের জন্যে। গাধাটির পড়ার অভ্যেস সেখান থেকেই হয়েছিলো। সময়টি ছিলো হিন্দু-মুলমানদের দাঙ্গাকালীন সময়। একদিন সকালে গাধাটি গিয়ে দেখে দাঙ্গাকারীরা হামলা করে কেরামত আলীর বাড়ি দখল করে নেয়, কেরামত আলী প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তানে। দখলকারীর কাছে বইয়ের কোন দাম নেই, তাই তাকে দিয়ে তারা বইগুলো লরিতে ভরে দূরে ফেলে দিলো। গাধা ভাবলো যে শহরে বই-পুস্তক এবং পন্ডিত লোকদের এহন অপমান সেখানে না থাকাই উত্তম। তখন সে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলো।

যাত্রা পথে তার সাথে দেখা হলো দাঙ্গাতে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা এক বুড়ো মুসলমানের, সে লোকটির দূরাবস্থা দেখে সহানুভূতি স্বরূপ তাকে পিঠে তুলে নিলো এবং দাঙ্গাকারীদের কাছ থেকে বাঁচানোর জন্যে দ্রুত পথ চলতে শুরু করলো। কিন্তু সহসা দাঙ্গাকারীরা গাধাটিকে ঘিরে ফেলে বলে, ’দেখেছো বদমাশ মুসলমান বেটা না জানি কোন গরিব হিন্দুর গাধা চুরি করে চলেছ ‘। মুসলমান বেচারা বাঁচার জন্যে অনেক অনুনয়-বিনয় করলো কিন্তু লাভ হলো না। তারপর দাঙ্গাকারীদের একজন গাধাটিকে নিজের বাড়ীর দিকে নিয়ে চললো। কিছুদূর না যেতে গাধাটি নতুন প্রভুসহ পড়লো মুসলমান দাঙ্গাকারীদের সামনে। ঠিক আগের মতোই ওদের একজন বললো দেখেছো ‘এই অবলা জীব গাধাটি নিশ্চয় কোন মুসলমানের’। ফলাফল হিন্দু প্রভুটিকেও প্রাণ দিতে হলো মুসলমান দাঙ্গাকারীর হাতে এবং গাধাটি আবারো পড়লো এক মুসলমান মৌলবীর হাতে।.... এইটুকু লেখার মাঝেই ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রতি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝা সক্ষম। জানা যায় মৌলবাদী সে যে ধর্মের হোক তার আচরণ ও কর্ম সর্বদা এক ও অভিন্ন। অন্ধ ধার্মিকরা কি পরিমান অন্ধতায় মেতে থাকে তার আরো কিছু চিত্র উঠে এসেছে এই কথোপকথনে....

পথিমধ্যে আমি মৌলবী সাবের কাছে অনেক আকুতি-মিনতি করলাম। বললাম-হুজুর, আমাকে ছেড়ে দিন।

-তা কি হয়? তুমি তো ‘মালে গনিমত’।

-না হুজুর, আমি মালে গনিমত নই। সৌভাগ্য বলতে হবে যে আমি এখনো বেঁচে আছি।

-তুমি একটা প্রশ্নের জবাব দাও, তুমি হিন্দু না মুসলমান, তারপর আমি একটা সিদ্ধান্ত নিবো।

-আমি না হিন্দু না মুসলমান, আমি তো ব্যাস এক গাধা, গাধাদের তো কোনো জাত-ধর্ম হয় না।

-আমার প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দাও।

-ঠিকিতো বলছি। এক মুসলমান বা হিন্দু গাধা হতে পারে কিন্তু কোন গাধা হিন্দু-মুসলমান হয়না

এইযে কথোপকথন এর সাথে কতকিছু মিলে যায় একাত্তরে পাকিস্তানিদের চরিত্রের। তারাও হিন্দুদের বাড়ি ঘর গনিমতের মাল বলে দখলকে জায়েজ করেছিলো। কে মুসলমান আর কে হিন্দু তা দেখে পাশবিকতার ধরণ নির্ধারণ করেছিলো। ধর্ম দিয়ে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ কত জঘন্য আর নির্মম হতে পারে সেটি একাত্তরে অামরা দেখেছি। এই গল্পে সংক্ষেপে হলেও সেই নির্মমতাকে তুলে ধরা হয়েছে।

এরপর সেই ধর্মান্ধ মানুষটির কাছ থেকে পালিয়ে যায় গাধাটি, পালিয়ে গিয়ে ঘাস খাওয়ার অপরাধে থানায় আটকা পড়ে। সেখান থেকে তাকে নিলামে দেওয়া হয়। সেই নিলামে তাকে কিনে নেয় এক ধোপা। রামু তার নাম, রামু মানুষ হিসেবে বেশ ভালোছিলো, তাই অভাবের কষ্ট থাকলেও রামুর সাথে গাধাটি ভালোই দিনযাপন করতে থাকে। কিন্তু একদিন নদীতে কাপড় কাচতে গিয়ে কুমিরের পেটে চলে যায় রামু। রামুর মৃত্যুর পর মানুষের সংকীর্ণতার যে চিত্র এঁকেছেন লেখক তা পাঠকের ভেতরের গভীর বোধকেও দারুনভাবে আহত করে। গাধাটি বলছে এভাবে....

বেশ কজন খদ্দেরই বাড়ি এসে সমবেদনা জানিয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাগাদাও শুরু করেছে তাদের হারানো কাপড়ের-হ্যাঁ রামু খুব ভালো ধোপা ছিলো; কিন্তু আমার সিফন শাড়িটার ভাগ্যে এ ছিল, আগে যদি জানতাম! এসব দেখে আমার দু:খ হলো, আমরা গাধারা পর্যন্ত সদ্য মৃতর স্ত্রীর সাথে এ ধারা ব্যবহার করি না। মানুষ সবই পারে-যেহেতু তারা আশরাফুল মাখলুকাত

এমন মর্মভেদী ব্যঙ্গ যাদের বিবেক-বুদ্ধি আর চেতনাকে স্পর্শ করবে না তারা খুব সম্ভব মানুষ নয়, মানুষের অবয়বে একটা দ্বি-পদী বিবেক-বোধহীন জন্তু।

অসহায় রামুর পরিবার কে বাঁচাতে নানান জায়গায় সাহায্য পেতে বেরিয়ে পড়ে গাধাটি। এখান থেকেই গল্পটি সত্যিকার রূপকের পথ ধরে। একজন মানুষ দুর্ঘটনায় মারা গেলে সরকারী সহায়তা পেতে হলে নানান জায়গায় কি পরিমান হয়রানি হতে হয় তাই উঠে এসেছে কৃষণ চন্দরের ‘আমি গাধা বলছি’র আত্নকথনে। নানান পদের, নানান ধরনের, নানান চিন্তা-চেতানায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে সাহায্য পাওয়ার জন্যে যেতে হয় গাধাটিকে। এদের মাঝে কিছু গা বাঁচানো বিশ্বাসী মানুষের কথোপকথন আমাকে বিস্মিত করেছে। ঠিক সেই সময়টাকে আজকের ২০১৫’ই মনে হয়েছে। কিভাবে? আসুন দেখি গাধা আর এক সরকারী কর্মকর্তার আলাপচারিতা।

-স্যার, আমি অধম রামু ধোপার নিজস্ব গাধা। তিনদিন হলো রামু ধোপা যমুনাতে কাপড় কাচতে গেলে কুমির তাকে খেয়ে ফেলে। এখন রামুর বৌ, বাল-বাচ্চা সব উপোস করছে।

-উপোস করছে তো আমি কি করবো? আমি কি এখানে কোনো এতিমখানা খুলে বসেছি?

-না হুজুর, আমি সে কথা বলছি না। ঘাটের ধোপাদের কাছ থেকে কর আদায় করা হয়। এত ট্যাক্স ও কর আপনারা উশুল করে থাকেন, অথচ এক গরিব ধোপার বিপন্ন স্ত্রী-পুত্রের কোন সংস্থান কি আপনাদের দিয়ে হবে না?

-কীভাবে হবে? ধোপাকে এক কুমির খেয়েছে; আমরাতো খাইনি। শুনো ধোপাদেরকে একটু সাবধানে চলতে হবে বৈ কি। তা না হলে রামুর মতো তাদের কেও বিপদে পড়তে হবে।

পাঠক মিল পাচ্ছেন কোনো? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, পহেলা বৈশাখে নারী লাঞ্চনার ঘটনায়ও ঠিক এমন করে একদল নরবানর বলেছিলো সাবধানে থাকতে হবে, ভিড়ের মধ্যে যেতে হবে কেন? সিপি গ্যাং নামের কওমী লীগ তো বলেই দিয়েছে পাঁচটার পরে ঘরের বাহিরে গেছে বলেই বিপদ পড়েছে, এই কথপোকথনের সরকারী কর্মচারীটির মতো তারাও বলেছে এ দায়ভার সরকারের নয়। নারীকে পর্দা করতে হবে, সাবধান হতে হবে।

এত কিছুর পরেও দমে যাওয়ার পাত্র গাধাটি নয়। তাই চেষ্টায় সে লেগে থাকে অবিরত। সেই চেষ্টাতে একদিন গাধাটির সাথে দেখা হয় নেতাজি নেহুরুর। তারপর থেকে গাধার জীবন বদলে যায়, গাধা হয়ে যায় মহা তারকা। আমরা এখন যেমন হুট করে হুজুগে ভাবে তারকা বানাই যাকে তাকে, ঠিক এই হুজুগেপণার চিত্রই এঁকেছেন কৃষণ চন্দর সেই কবে! তারপর গাধাকে দেওয়ার হয় নাগরিক সংবর্ধনা, সুন্দরী প্রতিযোগীতার মূল বিচারকের দায়িত্ব, কেউ তাকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর ভাবে, কেউবা স্বার্থের জন্যে এই গাধার সাথে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে উদ্ধত হয়! এগুলো সব আসলে মানুষের অধ:পতনকে উপহাস, লোভে পড়ে লাভের নেশায় মানুষ যে কত নীচে নামতে পারে সেটিই রঙ্গব্যঙ্গ ঢং এ তুলে এনেছেন লেখক। ’আমি গাধা বলছি’ আসলে মানুষ সৃষ্ট দোজখ সাদৃশ্য এই সমাজ ব্যবস্থাকে, কুসংস্কারকে, অনাচারকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।

তারকা হওয়ার পরে একে একে শিল্প-সাহিত্য-সংগীত সকল শ্রেণীর হর্তাকর্তাদের সাথে গাধাটির মতবিনিময় হয়, সবাই তাকে তাদের সৃষ্টি দেখাতে ব্যগ্র থাকে। আর শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের চলমান ধারা গাধাকে যে সত্যের মুখোমুখি করায় আজ এত বছর পরে আরেকটি মানচিত্রের দেশ বাংলাদেশে আমারাও আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের সেই একই ধারা দেখতে পাই। আমরা আজও সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করি, টেলিভিশনে সেটার দীর্ঘ প্রচার দেখি। সমাজের সব গুণী-জ্ঞানীদের সেই অনুষ্ঠানগুলো তে দেখি। প্রধান বিচারক হয়ে গাধাটি সুন্দরী প্রতিযোগিতা সম্পর্কে যা বলেছিলো তা কি অামাদের সভ্য সমাজের নব্য গাধারা অনুধাবন করে? গাধাটি বলেছিলো....

’বিভিন্ন অঞ্চলে সৌন্দর্যর মাপ কাঠি বিভিন্ন। বাংলাদেশে লম্বা চুল, হলিউড়ে ববকাট, ফ্রান্সে পাতলা নিতম্ব এবং ভারতে ভারী নিতম্ব সৌন্দর্যর মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। কাশ্মীরীরা গৌর বর্ণকে এবং টাংগানাইকাতে অমাবশ্যার মতো কালো ত্বকরকে সৌন্দর্যর মাপ কাঠিতে ফেলা হয়। কেউ পছন্দ করেন পাতলা ঠোঁট, কেউ পছন্দ করেন মোটা।আবার কেউ পছন্দ করেন লম্বা গ্রীবা, কেউ খাটো গলা, কেউ ডাগর চোখ, কেউ ছোট কুতকুতে চোখ। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সৌন্দর্য বিচারের মাপকাঠি কি হবে?

আমি মনে করি সৌন্দর্য বিচারের এই পদ্ধতি ভ্রান্ত। এক মেয়ের সৌন্দর্যকে তার মন এবং ক্রিয়াকর্ম থেকেই বিচার করতে হবে। তার সে ক্রিয়াকর্ম এবং চরিত্র হবে সর্বতোভাবে সংসার ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত। দেখতে হবে তার স্বামী ও সন্তান-সন্ততিদের সাথে তার সম্পর্ক। কারখানা এবং খেতে খামারে সে নিজের কী পরিচয় রাখছে। এক মেয়ের সৌন্দর্য খোলা অঙ্গনে বিচার করা যায় না। সৌন্দর্য মিশরের মমির মতো বিশেষ অস্তিত্ব নয়। তা হচ্ছে এক চলমান জীবনের বিবর্তিত রূপ।

আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি--সত্যিকার সৌন্দর্য, সত্যিকার কমনীয়তা বড় বড় ঢাক-ঢোল পিটিয়েদের বাজারের বিকানো পণ্য নয় যেখানে রান, গোড়ালি এবং বুকের স্ফীত মাপা হয়, কোমরের স্থুলতা মাপা হয়।

এমন সত্য কথনের ফলাফল কখনো শুভ হয় না, গল্পেও হয়নি। ফলে জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে হলো গাধাকে। ভাগক্রমে গাধাটি এসে পড়লো এবার সাহিত্যিকদের মাঝে। ভারতীয় সাহিত্য সভার সদস্যের সাহিত্য জ্ঞান, চর্চার নুমনা দেখে সে বিস্মিত হয়। সাহিত্য একাড়েমীর সদস্য আর তাদের কর্ম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় নিচের অংশটুকুতে।

সদস্য হতে হলে এই লেখাপড়ার চর্চাটুকু খারাপ। প্রকৃত পক্ষে আমাদের এখানে সদস্য হতে হলে খুবই কাঠখড় পোড়াতে হয়। প্রথম কথা হলো আমি পঞ্চাশ বছরের কম বয়েসী কোন সাহিত্য সেবীকে সদস্য পদ দান করিনা। কারণ, এর আগে লোকদের সঠিক দায়িত্ব জ্ঞান হয় না। আপনি আমাদের একাডেমির সদস্যদের মাঝে দেখবেন শুধু বুড়োদের সমাবেশ। কতদিন গত হয়েছে এরা কোন বই-পুস্তকে হাত দেননি! পড়ার প্রতি অনীহাই এদের আসল যোগ্যতা। সাহিত্য আলোচনার চাইতে অামাদের বৈঠকে রোগ-ব্যাধি আলোচনাটা আজকাল একটু বেশি হয়।কারো হৃদরোগ, কেউ চোখে কম দেখেন, কারো মাথা ঘুরানি আবার কারো ডায়বেটিস। বলুন, আপনার কোন রোগ আছে কিনা, তাহলে আপনার আবেদন আমরা বিবেচনা করে দেখতে পারি। সত্যিকার অর্থে আমরা চিন্তাশীল মনীষী সৃষ্টি করতে চাই। আমাদের এখানে এমন সব সদস্য আছেন যারা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে কোন কিছুই লেখেননি এবং পনের-বিশ বছর ধরে কোন বই পড়েননি। মানবতাবাদী, গণতন্ত্রবাদী, সমাজতন্ত্রবাদী ও প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের একাডেমির সদস্য হিসেবে দেখবেন না, কারণ আমরা তাদের পছন্দ করি না।

আমাদের প্রচলিত সাহিত্যের কর্ণধারদের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছেন? পেলে নিজগুণে পাবেন, পোষ্টদাতা কোন ভাবেই এই নীচু মানহানিকর তুলনার জন্যে দায়ী থাকবে না।

এরপর গাধাটির পরিচয় হয় সংগীত একাড়েমীর সেবক কর্তাদের সাথে। তাদের সাথে গাধার কথোপকথনটি পড়া যাক....

আমাদের ভারতীয় হিন্দি মিউজিক বিশ্বের প্রাচীনতম সংগীত কলা। বিগত সাড়ে তিন হাজার বছেরর মধ্যে এই সংগীতের একটি সুরও বিকৃত হয়নি। আমাদের সংগীতের রাগ আজ যে পর্যায়ে আছে তিনহাজার বছর পূর্বেও একই রকম ছিলো।

-আমি বললাম, কোনো পরিবর্তন না হওয়া, কারো কাছ থেকে কিছু না গ্রহণ করা বা না শেখা, নিজের গোঁড়ামি উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার মধ্যে গর্ব কোথায়? শিল্পকলায় যত বেশি পরিবর্তন ও নতুনত্ব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে ততই ভালো। আমি উচ্চাঙ্গ সংগীতের বিরোধীতা করছি না; কিন্তু আমি চাই আপনারা সংগীতকে আরো সমৃদ্ধ করুণ।বিদেশী অনুপ্রবেশের খারাপ দিকটা দেখলে শুধু চলবে না, এর সুন্দর দিকও দেখতে হবে। বিস্ময় লাগে অামাদের লোক সংগীত, ফিল্মের গান দেশের কোটি কোটি মানুষের মনের মাঝে এবং ভারতের বাইরে এশিয়া আফ্রিকা এবং ইউরোপে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে অথচ কি না আমাদের সংগীত একাডেমি সাপের মতো কুন্ডলী পাকিয়ে উচ্চাঙ্গ সংগীতকে পাহারা দিচ্ছে। আপনারা কি কখনো আপনাদের এই ভড়ং ত্যাগ করবেন না? এমনিতে তো উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রোপাগান্ডা করে বেড়ান যে, ভারতীয় জনগণের ধ্যান-ধারণা এবং রুচিকে উন্নত করতে হবে। কিন্তু যখন শো করেন, বড় বড় ওস্তাদদের নিয়ে আসেন আর একশো টাকা টিকেট নির্ধারণ করেন। আপনারা কি মনে করেন উঁচু দরের টিকেট রাখলেই লোকদের রুচিও উঁচুতে উঠে যাবে জনাব? আপনারা যদি হাজার হাজার লোকের সমাবেশে মহান উচ্চাঙ্গ শিল্পীদের অমৃত আলাপ না শোনাতে পারেন আর তা যদি শুধু উঁচু তলার কিছু লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চানম তাহলে আমি বলবো দেশে এ ধরনের সংগীত একাড়েমীর প্রয়োজন নেই এবং জনগনের ট্যাক্স থেকে তাদেরকে এক পাই পয়সাও দেয়া ঠিক হবে না।

এভাবে সত্য বলার ফল সেই সময়েও ভালো ছিলো না, আজও নেই। নির্মোহ সত্য বললে কপালে দু:খ ছাড়াও পিঠে বেত্রাঘাত পড়ে, আমাদের সময়ে অবশ্য রামদার কোপ পড়ে মস্তকে। এটাকে অবশ্য সমাজ-রাষ্ট তথা সভ্যতার উন্নতি’ই বলা যায়! যাইহোক গাধার কি পরিণতি হয়েছিলো সেটি জানতে হলে পড়তে হবে রচনাটি। পড়ে আপনিও না হয় রচনা করুণ আরেকটি ‘গাধার আত্নকথন’।

(লেখক পরিচিতি: কৃষণ চন্দর (১৯১৪-১৯৭৭) উর্দু ভাষার বিখ্যাত লেখক। হিন্দি এবং উর্দু উভয় ভাষাতে সাহিত্য সাধনা করলেও কৃষণ চন্দরের প্রধান পরিচিতি উর্দু সাহিত্যিক হিসাবে। সারাবিশ্বে উর্দু মাতৃভাষীর সংখ্যা প্রায় ছয় থেকে সাত কোটি। ইংরেজির সাথে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তাই অনেকের ধারণা উর্দু কেবল পাকিস্তানেই প্রচলিত। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, পাকিস্তানের মাত্র এক থেকে দেড়কোটি এবং ভারতে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কোটি মানুষের মাতৃভাষা উর্দু। উর্দু ভারতে একটি অন্যতম সরকারি ভাষা, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, দিল্লী এবং জম্মু ও কাশ্মীরে এটি সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। এছাড়া আফিগানিস্তানের শহরগুলিতে ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলির শহর এলাকায় এ ভাষার অল্প-বিস্তর প্রচলন রয়েছে। বাংলা ও ভারতীয় ভাষা ছাড়াও রুশ, জার্মান, ইংরেজি, চেক, হাঙ্গেরি, পোলিশ, চীন ও জাপানি ভাষায় তাঁর সাহিত্য অনূদিত হয়েছে। উর্দু ও হিন্দি ভাষায় তাঁর ৩০টি ছোটগল্প সংকলন এবং ২০টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।)


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ছোট থাকতে পড়েছি বইটা। মনেই ছিলোনা কি নিয়ে বইটা। হাসি আপনার লেখায় আবার মনে পড়ল। ধন্যবাদ।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

'গাদ্দার' পড়ে না থাকলে পড়ে ফেলেন

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাসুদ সজীব এর ছবি

আজিজে সেদিন খুঁজলাম গাদ্দার কিন্তু পেলাম না। ’ভগবানের সাথে কিছুক্ষন, নির্বাচিত গল্প আর ’যব খেতে জাগে’ তিনটা পেলাম। দেখি অনলাইন থেকে নিয়ে ফেলবো। হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

গাদ্দার আর রুটি কাপড়া আওর মোকাম, পারলে পড়ে ফেলেন, আরেকটা আছে ৫০ এর মন্বন্তরের ওপর লেখা, নাম ভুলে গেছি। গাদ্দার অতি অবশ্যই।

স্বয়ম

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নামটা 'রোটি কাপড়া মকান'। মন্বন্তর পঞ্চাশের দশকে নয়, চল্লিশের দশকের শুরুতে হয়েছিল। বইটার নাম বাংলায় 'অন্নদাতা' (আন্‌দাতা)। মুক্তধারাতে যেতে পারলে কৃষণ চন্দর তো বটেই মুন্সী প্রেমচাঁদ, সাদত হাসান মান্টো, খাজা আহমেদ আব্বাস, অমৃতা প্রীতমের অনেক বইয়ের উর্দ্দু থেকে সরাসরি বাংলায় অনুবাদ পাওয়া যাবার কথা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি কৃষণ চন্দরের 'জঞ্জাল বুড়ো' নামে একটা গল্প পড়েছিলাম "শ্রেষ্ঠ বিদেশী গল্প" নামে একটা গল্প সংকলনে এবং মুগ্ধ ছিলাম। এরপর-ই ঠিক করে রেখেছি এই লেখকের আরও লেখা পড়তে হবে। গল্পের মাঝে অনেকগুলো লাইন এত ভাল লেগেছিল.... তার মাঝে একটা -

"সে এখনও বোঝেনি দারিদ্র্য কী হতে পারে, মমতা কতটা ভীরু হতে পারে, জীবন কীভাবে বিগড়ে যেতে পারে, জীবনকে কীভাবে ময়লা দুর্গন্ধময় জঞ্জালের টবে জেলে দেয়া যেতে পারে।"

নাবিলা

অতিথি লেখক এর ছবি

বাবার সংগ্রহ থেকে কৃষণ চন্দরের ‘মিস নৈনিতাল’, ‘গাদ্দার’, ‘এক বেশ্যার চিঠি’সহ আরও বেশ কিছু বই সেই ছোটবেলাতেই কয়েকবার পড়া হয়ে গিয়েছিল। কৃষণজী’র লেখা খুব টানে। সাদত হোসেন মান্টোসহ ঐ সময়ের অন্য উর্দূ লেখকদের বই পড়ে ফেলতে পারেন। এই বইটা পড়া হয়নি, কিনতে হবে। বইমেলায় খুঁজলাম এবার কৃষণ চন্দরের বই, পেলাম না তো।

দেবদ্যুতি

মাসুদ সজীব এর ছবি

জীবনে আর আছে কি! সাদত হোসেন মান্টোর লেখাও পড়ে ফেলবো হাসি

আমিতো বইমেলাতেই পেলাম বইটি। তারপর গত সাপ্তাহে আজিজে গিয়ে আরও তিনটি নিলাম, গাদ্দারটা পেলাম না। মন খারাপ

মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সরাসরি মুক্তধারায় খোঁজ করেন। দুয়েক বছরের মাঝে পুনঃমুদ্রন হয়েছে। অবশ্যই পাওয়ার কথা। আর, মান্টো পেলে পড়ে ফেলেন। শুভ পঠন। হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাসুদ সজীব এর ছবি

এত এত বই পড়ার বাকী আছে যে সেইসব বই কিনে মুজতবা বাবুকে মিথ্যে প্রমাণ করে পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে যাবো দেখছি চিন্তিত

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

মাসুদ সজীব এর ছবি

গুরু মুজতবারে মিথ্যা প্রমাণ কইরা তো বই কিনতে কিনতে দেখি সত্যি সত্যি দেউলিয়া হইয়া যামু ওঁয়া ওঁয়া

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

‘মান্টো এবং কালো সালোয়ার’ নামে একটা বই আছে অনুদিত, মান্টোসহ বন্ধু লেখকদের একটা করে গল্প আছে, কৃষণ চন্দরেরও আছে। পড়তে পারেন হাসি

দেবদ্যুতি

মাসুদ সজীব এর ছবি

কেউ তার প্রিয় বইগুলো এই অধমরে উপহার হিসেবে দেয়না কেনু? ওঁয়া ওঁয়া

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

মাসুদ সজীব এর ছবি

হুম পড়ে তো ফেলবো, কেউ উপহার হিসেবে দিলে সময়ের আগেই পড়ে ফেলবো কথা দিলাম হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।