বুক-মন পুড়ে যার খাক্ হয়, সেই-ই …..

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: শনি, ০১/০৩/২০০৮ - ১১:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লেখক এবং লেখালেখি নিয়ে রাসেল একটি পোস্ট দিয়েছেন এবং তার লেখার সূত্রে অনেকগুলো সরস এবং কঠিন মন্তব্য এসেছে। নিজের জীবনকে দিয়ে যেহেতু বিষয়টি নিদারুণ ভাবে উপলব্ধি করতে পারি, তাই ইচ্ছে হলো বিষয়টি নিয়ে নিজের কথাগুলো একটু ভাগাভাগি করে নেয়ার।

কেন লিখি? আজকাল দু’একজন এরকম প্রশ্ন করেন। উত্তরে মাণিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো বলা যেতো, পাখি কেন গায়? ফুল কেন ফোটে? নদী কেন বয়? কিন্তু এখন আর এসব কথা বলে লাভ নেই, হয়তো এসবের জেরায় কেউ উদ্ভট কিছু একটা বলে বসতে পারেন। যেমন কেউ ইচ্ছে করলেই বলতে পারেন, নদী বয় অসহায় লঞ্চযাত্রীদের শ’য়ে শ’য়ে ডুবিয়ে মারার জন্য!

তাই ওসব কথায় যাচ্ছি না। কিন্তু আমি নিজেও নিজেকে প্রশ্ন করেছি, কেন লিখি? না লিখে কি থাকা যায়? বাঁচা যায়? নিশ্চয়ই যায়, পৃথিবীর গরিষ্ঠ অংশ কিছুই না লিখে, এমনকি নিজের নামটা পর্যন্ত সই না করে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। তাহলে আমি কেন পারবো না? নিশ্চয়ই পারবো। অতএব, লেখালেখি বাদ। যেহেতু কলম ধরে লিখতে বসি না সেহেতু, কম্পিউটারের সামনে আর কখনও কোনও লেখা নিয়ে বসছি না। একেবারে শিলভাঙা পণ।

দিন যায়, আমি হাঁটি দীর্ঘ পথ, বিকেলের আলো ঢলো ঢলো করে ঢলে পড়ে কোথায় যেনো, যে দেশে বসবাস সেখানে কোন্‌দিকে পশ্চিম, কোন্ দিকে পূর্ব তার খবর আমি জানি না, জানতে হয়নি কখনও। টিউবের ভেতর মুখ গোমড়া করে বসে থাকি, অচেনা মানুষজনকে দেখে ইংরেজ কেতায় ঠোঁট দু’টোকে সামান্য বেঁকিয়ে হাসির ভংগি করি খানিক। তারপর হঠাৎ করেই নজরে আসে, টিউবের ভেতর অনেক বিজ্ঞাপনের পাশে অষ্টাদশ শতকের জনৈক চীনা কবির চারটি লাইন,

পৃথিবী এবং মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই
দু’য়ে দু’জনের সমান্তরাল
তবু এক লক্ষ্যে এরা হাঁটে
যার নাম শেষ হয়ে যাওয়া

অনুবাদটি হয়তো সঠিক হলো না, কাছাকাছি যেতে পারে। লন্ডনের মেয়র এই শহরবাসীকে কবিতাপ্রেমী করতে পোয়েমস অন দি আন্ডারগ্রাউন্ড বা শিল্প সচেতন করতে আর্ট অন দি আন্ডারগ্রাউন্ড প্রকল্প চালু করেছে, তারই আওতায় এসব পড়ে বা দেখে আমার টিউব ভ্রমণ চিন্তাহীন কাটে।

কিন্তু যখন টিউব থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরে হাঁটি, হিংসুটে সন্ধ্যা তখন মগজে এক ধরনের ক্লান্তি গুঁজে দিতে চায় কিন্তু মন মনে মনে নতুন কিছু সাজাতে থাকে অনবরত। ছোট্ট শিশুর মতো গুটি গুটি অনেক শব্দ, বাক্য বলে, আমিও আছি, আমি তোমার কাছে আসতে চাই, খুব কাছে, নেবে কি আমায়?

নিজেকে আমার তখন পাগল গাপল লাগে, বিড় বিড় করে কথা বললে মানুষ সত্যি সত্যি পাগল ধরে নেবে, হয়তো পাথর ছুঁড়ে মারবে না, কে জানে যদি পুলিশ কিংবা লোকাল অথরিটিকে ফোন করে, তারপর আমাকে সোজা নিয়ে যায় কোথাও? সাত-পাঁচ ভেবে চুপচাপ পথ ধরি, কিন্তু মনের ভেতরে শব্দের উথাল-পাথাল, কী দিয়ে ঠেকাই? মা কাঁকড়ার শরীরের ভেতর যেমন খুঁদে কাঁকড়ারা বড় হতে হতে মাকেই খেয়ে ফেলে, তার শরীর বিদীর্ণ করে আলো-বাতাসে মুখ রাখে তেমনই আমি কি একদিন! কে জানে?

ঘরে ফিরি, চায়ের জল চাপাই, টিভি ছেড়ে দেই, হাতের যন্ত্রের বোতাম টিপে টিপে সারা পৃথিবীর চ্যানেল ঘুরে-ফিরে আসি, তারপর পানি ভর্তি একটি বোতল থেকে ঘরের ভেতরের কিছু গাছগাছালির শরীরে জল দেই, ওরা বুঝতেও পারে না তখন যে আমার মনের ভেতর উল্কাপাত হচ্ছে অনবরত, পৃথিবী ক্ষয়ে-বয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, মুর্খের মতো মুখের দিকে ওরা তাকিয়ে থাকে, ওদের চোখে তখন সদ্য পাওয়া জল-সুখের কৃতজ্ঞতা।

কাপ ভর্তি করা ফুটন্ত জলে চীনের সবুজ চা ফেলে দিই, তারপর ঠোঁট লাগাতেই নাকে জুঁই-এর গন্ধ লাগার কথা, কিন্তু আমি পাই না, মনে হয়, আমার মন আমাকে বলছে, তাকে অবহেলার জন্য এই শাস্তি আমার প্রাপ্যই।
এরপর? এরপর আমার আর কিছুই করার থাকে না। কথাটা হয়তো একদমই সত্যি নয়, অনেক কিছুই করার থাকে, কিন্তু সেটা হয়তো অন্য কারোর জন্য, আমার নয়।
ঘর গোছানো যায়, রান্না করা যায়, নিজের যত্ন নেয়া যায় – মনের উল্কাপাত আমাকে বসিয়ে রাখে, ঠায়। মাথা থম থম করে, বুকের ভেতর শূন্যতার খোলশে কষ্টের উঁইপোকা বহুতল ঢিঁপি তৈরি করে বংশবৃদ্ধি শুরু করার আগেই আমি আমার ঊরুচ্চ (ল্যাপটপ) খুলে বসি; তারপর মন থেকে উল্কাগুলোকে বর্শাতে থাকি তা’তেই। কী জানি, যদি ভালো লাগে?

আমার না লেখার প্রতিজ্ঞা ভাসতে থাকে, সন্ধ্যায় পথের পাশে ফেলে আসা এক টুকরো সিগারেটের রাংতার ওপর টলটল করা জলের মতো; তাও আমারই মনের ভেতর।


মন্তব্য

অনিকেত এর ছবি

অসাধারন লাগল। আমি বোধহয় আগেও লিখেছি যে, আপনি অসম্ভব দরদ দিয়ে লেখেন। কিছু কিছু মানুষের লেখা হঠাৎ করে নিশ্বাস নিতে শুরু করে। তখন তারা অন্তর্জাল বা বইয়ের পাতার সীমানা পেরিয়ে চলে আসে মনের কাছাকাছি।

আপনি সেই ঈর্ষনীয় ক্ষমতাটি নিয়ে এসেছেন।

আপনার এই বিষয়টি ছাড়াও, আমি আপনার ভক্ত আরেক বিশেষ কারনে। আমাদের 'কুনাম ধন্য' শর্মিলা বসু'র ভন্ডামীর জবাবে আপনি যে তীক্ষন বিশ্লেষনী প্রবন্ধ লিখেছিলেন---- তা এক কথায় অসাধারন।

আর কিছু না হোক, আমার দেশের হতভাগ্য মেয়েদের আর কেউ যেন খেয়াল খুশির বশে অপমান না করতে পারে---এই দিক বিবেচনা করে, আপনার লিখে যাওয়া উচিত।

ভালো থাকবেন, আর ভাল লিখবেন।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

এরকমই।
না লিখলে আঙ্গুল কুটকুট করে। মাথা থিকা কূচিন্তা হারাইয়া যায়। সুচিন্তা একা একা শুকাইয়া মরে।
লেখার মধ্যে অন্তত তালিকায় থাকার শান্তিটুক থাকে.....



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

তালিকায় নয় রে ভাই শান্তি থাকে অন্য কোথাও অন্য কোন খানে।যেটা যে পায় সে শুধু জানে।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

গৌতম এর ছবি

ক্ষুধা লাগলে যেমন খাই, তলপেটে প্রেসার পড়লে যেমন টয়লেটে যাই, তেমনি হাত কুটকুট করলে কম্পিউটারের কি-বোর্ডগুলারে বাড়ি মারি। সারাদিন কি-বোর্ড টেপাটেপি করতে থাকলে দু'একটা শুদ্ধ শব্দ, বাক্য বেরিয়ে যায়। এটাকেই লেখা নাম দিয়ে চালিয়ে দিই। কেউ পড়ে মন্তব্য করলে আটখানা হয়ে ঘুমাতে যাই, না পড়লে কি-বোর্ডে আরো জোশ নিয়ে বাড়ি মারার সংকল্প নিয়ে ঘুমাতে চাই।

আপনার লেখার হালকা প্রতিক্রিয়া। কী করবো- জীবনটাই যে হালকা!
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

প্রদিন শরীরে যে ময়লাগুলো জমে স্নান করে সেগুলো ফেলে দেই সবাই
কিন্তু প্রতিদিন মনের ময়লাগুলো কি ফেলা হয়?

লেখালেখি একটা নিয়মিত স্নান
চিরস্থায়ী গার্ভেজ
মনের ময়লাগুলো ফেলে দিয়ে আবার ফ্রেশ হয়ে উঠার নিজস্ব উপায়

................

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

লেখালেখি কি আসলেই তাই? প্রাকৃতিক ক্রিয়াদির মতো?
কি জানি, আমি কিন্তু লেখালেখিকে ওই পর্যায়ে ফেলতে চাইনি।

আমার খুব আশ্চর্য লাগে, পৃথিবীর বেশিরভাগ লেখকই প্রচণ্ড অর্থ কষ্ট (এমনকি অন্ন-কষ্টও) সহ পারিবারিক, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। এসব কারণে তাদের লেখা আরও শক্তিশালী হয়েছে, একজন কষ্টভোগী মানুষ সেসব পড়ে নিজেদের সঙ্গে মিল পেয়ে আরও মোহিত হয়েছেন, তারা হয়েছেন কালজয়ী।

প্রশ্ন হলো, যদি তারা এই কষ্ট কিংবা কঠিন সময়কে গতানুগতিক জীবনের ভেলায় তুলে দিতেন তাহলে কি হতো? আমরা হয়তো এমন কোনও সৃষ্টি পেতাম না, কিন্তু লেখক হয়তো শান্তির, সুখের জীবনটা পেতেন, তাই না? তো এমন কি আহামরি সৃষ্টি-সুখ যে কারণে তারা জীবনের স্বর্ণসময়ের আর্থিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক ক্ষতিকেও অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন? তাহলে কি লেখক-এর জাত, কুল, এমনকি জেনেটিক পরিচয়ও, আলাদা? সমাজের দশজন মানুষের চেয়ে তিনি ভিন্ন এবং কৌণিক অবস্থানের বাসিন্দা? নাকি এর সঙ্গে খ্যাতির বিষয়টও কোথাও না কোথাও একটুখানি জড়িত?

মূলতঃ এসব প্রশ্ন মাথায় এসেছিল বলেই, লেখাটি লিখেছিলাম। অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আরও একটি পোস্ট দেওয়ার ইচ্ছে আছে, তবে সেটি হবে সম্পূর্ণ ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা এবং একটি কষ্টকর সময়ের বর্ণনা। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।

সবাই ভালো থাকুন। স্বাধীনতার জাইগোট সৃষ্টির এই মার্চে সবাইকে আগুন শুভেচ্ছা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।