আঙুল-কাটা ইচ্ছে-কথা (১)

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: শনি, ১৫/০৩/২০০৮ - ২:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রোগের বয়স এবার বেশ অনেকদিন, এক দানা ভাত মুখে না তোলার মতো, একটি শব্দও লিখিনি, মনে হয় দীর্ঘ দিন; এখানে দীর্ঘ শব্দটি পড়বার কালে অবশ্যই দী-উচ্চারণের দৈর্ঘ্যকে অনেক দূর টেনে নিতে হবে, নিতেই হবে, নইলে ঠিক বোঝা যাবে না এই না-লেখা রোগের কাল।
বিছানায় যুবুথুবু হয়ে শুয়ে থাকলে না হয় কথা ছিল, হাতের আঙুল কখনওই অমল ছিল না, ফরাসি কায়দায় নখরঞ্জনও করিনি কোনও কালে, আজকাল যেনো আঙুলগুলো আরও কদাকার লাগে, যখন দাবা-ঘরের নক্সা আঁকা এক টুকরো কাঠের ওপর পেঁয়াজ অথবা চর্বিস্ব মুরগির পা রেখে ধারালো চাকু দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করি, ইচ্ছে করে আঙুলগুলো ঠেলে দেই, যদি ফরাসি সেই কবির মতো কাটা আঙুল থেকে ফিনকি দিয়ে বেরুনো রক্তে দেয়ালে কবিতার কোনও আদল আঁকা হয় - বেশি নাটুকে মনে হচ্ছে? হতেই পারে, তবে ইচ্ছের সততা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না।

শেষ গল্প লিখেছি মাস খানেক আগে, তারপর ফেলে রেখেছি, অথচ আমি আমার লেখা ফেলে রাখতে পারি না, আমি নিজের লেখা একবার শেষ করে তা আর পড়ি না, পড়ি না কারণ, যদি কোথাও বদলাতে হয়, কিংবা বদলে ফেলে তাহলে যে মুহূর্তে লেখাটি লিখেছি সেই মুহূর্তের আমির সঙ্গে লেখা সংশোধন কিংবা সংযোজন মুহূর্তের আমির সঙ্গে তুমুল লেগে যাবে। অথচ আজকাল আমার গল্প পড়ে থাকে, অনাথ পথশিশুর মতো গল্পেরা আমার হয়ে গেছে - তারা ঠোঙা কুড়োয় নিজেদেরই ভাগাড়ে, সারাদিন কুড়োনোর পরেও দেখা যায় সাঁঝের কালে ওদের পিঠে ঝোলানো থলেটা শূন্য।

দেশের কাগজগুলোয় লিখতাম ছাই-পাশ, যাকে গালভরে উপসম্পাদকীয় কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষণও বলেন কেউ কেউ। আজকাল তাও লিখতে পারি না, পারি না বলতে, লিখতে বসে নিজের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করতে হয় নইলে সম্পাদক মহাশয় ছাপতে পারেন না। যদিও অনুমতি চান কিন্তু লেখাটি প্রকাশের পরে দেখা যায় এমন এমন যায়গায় কাঁচির পোচ্ পড়েছে যে, সেটা স্কন্ধকাটা কি¤ভ’ত হয়ে পাঠকের দরবারে সঙ-এর মতো গিয়ে দাঁড়ায়। অথচ, আমার সোনামুখ পাঠক, তাই পড়েই আমাকে নিজগুণে অসংখ্য আকাশ-চিঠি পাঠান, তাতে ভালো লাগা, না-লাগার কথা থাকে, থাকে নতুনতর বিশ্লেষণ, অথবা আমার পাঠক কিন্তু আমাকে অপছন্দকারীদের অশ্রাব্য, অকথ্য কটুবাক্য।

খুব আশ্চর্য হয়ে দেখি, আজকাল সংবাদপত্রে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ধরণ-ধারণও পাল্টে গেছে অনেক। কেউ সাহস করে দু’চার কথা লিখতে গিয়েও কেমন লাজরাঙা হয়ে ওঠেন, ফরিদপুরে এই অবস্থাকেই মনে হয় বলে থাকে “কবার মনে পারি, মুখ থুইয়াছি বাড়ি”। নইলে অনাচার-অত্যাচার, অন্যায্য ও অসততার নজির তো চারদিকে কম নেই, কিন্তু কোথায় সেসব নিয়ে কথা, সমালোচনা, নিদেন রিপোর্টিং। সবাই শুধু সারভাইবিং-এর রাস্তা ধরে হাঁটলেই কি টানেলের শেষে আলো পাবেন বলে এগুচ্ছেন বলে মনে হয়। দেশ ও জাতির স্বনিয়োজিত বিবেকদ্বয়ও আজকাল আর “মন্তব্য প্রতিবেদন” লিখেন না যে, আমরা জানতে পারবো পরের সপ্তাহগুলিতে কী হতে যাচ্ছে, বা অস্ত্রধারীদের গরম হাওয়া কোন্ দিক থেকে এগিয়ে আসছে। অবশ্য এই সেদিন, বিবেকের একজন লিখেছেন, সিকিউরিটি কাউন্সিল নিয়ে, এতে বোঝা যায় খুব দ্রুতই এ নিয়ে গোগনে অথবা সেমি-প্রকাশ্যে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এবার বোধকরি তাকে সুশীলদের পক্ষ থেকে সংযুক্তি দেওয়া হয়নি এই চক্রে Ñ খেদটা তাই আগেই প্রকাশ করে রাখলেন তিনি।
ওদিকে “বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি” একদিকে বর্তমান শাসকক’লকে মগডালে তুলে দেয়ার পর যেই না এরা শুঁয়োপোকা হয়ে কচি সবুজ পাতা সবে খেতে শুরু করেছে ওমনি আটলান্টিকের ওপার থেকে সামান্য বিষ মাখিয়ে তীর ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, যার নাম “মিসাইল মানবাধিকার”Ñ সঙ্গে সঙ্গে শুঁয়োপোকাদের চিড়বিড় করে উঠতে দেখা গেলো। এহেন পরিস্থিতিকে সিলেটি উপভাষার প্রবাদে বলা হয়, “কার হুগদা খাও গো বান্দি, ঠাকুর চেনো না”, যার দয়ার বরকতে গাছে চড়ার সুযোগ হলো তাকে তুষ্ট না করলে দেবতাতো নারাজ হবেনই। একটি বিষয় কেউ খেয়াল করেছেন কি না জানি না, আমাদের সেন-বাবু ভারত থেকে ঘোড়ায় চড়ে যেই না দেশে ফিরলেন ওমনি তার মুখ থেকে আমরা আর কোনও বাণী পাচ্ছি না। এখন আর তার নিজ এলাকাতেও গরুদান অনুষ্ঠান হচ্ছে না Ñ এর কারণ কেউ জেনে থাকলে বা আন্দাজ করতে পারলে দয়া করে জানাবেন। মনে হয়, ঘোড়ার সঙ্গে অঙ্কুশের হুঁলও পশ্চাতদেশে জুটে থাকবে, তার ব্যাথাতেই কাতর কি না কে বলবে!

ইস্ শুরু হলো আমার প্যাঁচালি, খুব ছোট বেলায় যখন জ্বরের ঘোরে বেশ ক’দিন ভুল বকাবকির পর হঠাৎ এক বিকেলে জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর মনে হতো, পৃথিবীটাকেই খেয়ে ফেলবো, জঠরে তখন ক্ষিদের ঠাকুর জঁপতপ করতেন উচ্চস্বরে। এই লিখতে না পারা রোগও আমার এখন সেই জ্বরো রোগির মতো করে ফেলেছে মনে হয়, লিখতে বসেই আঙুলে হাজার কথারা ছুটে-ফুটে আসছে। এদের এখানেই লাগাম দেওয়া ভালো, নইলে সেই জ্বরগ্রস্ত জিহ্বার মতো হবে, মুখে তুলতেই ওয়াক্ . . . । মা বলতেন, ছোট বেলায় আমার যে কোনও রোগের পূর্ব লক্ষণ নাকি এই ওয়াক্-অবস্থা। ইস্ যদি ফেরা যেতো সেখানে!


মন্তব্য

অমিত আহমেদ এর ছবি

এই তো রোগ কেটে গেলো... এবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসবার পালা... স্বাগতম।

রাকিব হাসনাত সুমন এর ছবি

ওই মিসাইল মানবাধিকারের মালিকরাই তো মনে হয় সব গন্ডগোলের হোতা।

কনফুসিয়াস এর ছবি

বাহ!

-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।