আমি পুরোনো হয়ে গেছি, না আমার মানসিকতা পড়ে আছে আসছে শীতে ব্যবহারের জন্য ট্রাঙ্ক থেকে সদ্য নামানো পুরনো কাঁথার গন্ধ মেশানো ভাঁজের ভেতর?
প্রশ্নটি মনে হচ্ছে বেশ অনেকদিন ধরে। যতোখানি পেছনে গেলে বাঙালি মুসলমানের লেজের নিশানা পাওয়া যায়, সেখান থেকে সময় হিসেব কষে একটি উপন্যাস লেখার পাঁয়তারা করছি বেশ অনেকদিন হয়। জীবনটাকেই গোছাতে পারছি না, তাই উপন্যাসের রসদও জোগাড়ে বেরুনো হচ্ছে না। কিন্তু মনের পাতায় নোট নিচ্ছি অনবরত। আর এসব সময়েই এই প্রশ্নটা আসছে মাথায়, খুব বেশি করে, শিলের ওপর মশলার মতো প্রশ্নটা, কষ্টের নোড়াটা আমাকে বার বার ঘঁষে দিয়ে যাচ্ছে অনবরত।
আজকাল স্কাইয়ের কল্যাণে বাংলাদেশের বেসরকারী চ্যানেলগুলির কয়েকটা দ্যাখা হয়, বিশেষ করে খবরটাতেই আগ্রহী থাকি, কিন্তু হাতে রিমোট থাকলে ঘুরে ফিরে বার কয়েক যাওয়া হয় এসব চ্যানেলে। কোথাও তখন নাটক হচ্ছে, কোথাও বা গান, কোথাও বা টক শো। সবতাতেই নাকি “আধুনিকতা” চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। আমার টিভি-বন্ধুদের অনেকেই তাদের গর্বিত গ্রীবা দুলিয়ে কথাটি আমাকে বলেছেন। তাদের ধারণা, আমি তো দেশে থাকি না, তাই বুঝতে পারি না, মানুষ কতোটা বদলেছে, কতোটা আধুনিক হয়েছে! বিশেষ করে, আমার লেখায় আমি যখন উল্লেখ করি যে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনজগতে একটি পরিবর্তন ঘটেছে অবশ্যই, কিন্তু তাকে কোনও ভাবেই আধুনিক বলা যাবে কিনা তা নিয়ে আমার প্রবল আপত্তি রয়েছে। কিঞ্চিত আর্থিক স্বচ্ছলতা মানুষকে খাওয়া-পরার ক্ষেত্রে হয়তো একটু বিলাসি করতে পারে কিন্তু তাতে মনোজগতের খোরাকির কি কোনও যোগাযোগ আছে? বিশেষ করে, আমি গ্রামের কথা বলতে চেয়েছি অনেকবার। দু’একটি উদাহরণ পেশ করছি।
আমার নিজের গ্রামের কথাই ধরি, আমার সঙ্গেই যারা বড় হয়েছে, তাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা মদনদেবের কৃপায় গণ্ডাখানেকও ছাড়িয়েছে ক্ষেত্র বিশেষে। তবে আমাদের একটু আগের জেনারেশনের যারা, তাদের ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে মেয়েদের অনেকেকই দেখলাম, গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছে, জিজ্ঞেস করলে শুনেছি, গার্মেন্টস-এ কাজ ধরেছে। এ এক বিস্ময় বটে, অন্তত আমি এবং আমার গ্রামের ক্ষেত্রে, কারণ আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার মা আমাকে যখন পাঠিয়ে দিলেন লেখাপড়ার জন্য একেবারে গ্রাম, শহর এমনকি দেশ ছেড়ে বাইরে, তখন আমার মা’কে তুমুল বদনামের ভাগি হতে হয়েছে। বিশেষ করে, আমার পারিবারিক গণ্ডিতে আমার মা বেচারিতো রীতিমতো “মাছের মা” হিসেবে অনেককাল পরিচিত ছিলেন। তখন গ্রামের সুস্থ-সবল যুবা শ্রেনী ছাড়া, গ্রামের বাইরে যাওয়ার সাহস কেউ দেখিয়েছে বলে জানি না, তাও তারা বর্ষাকালে একসঙ্গে চার-পাঁচটি কুড়ি-হাতি নৌকো আর মাস খানেকের চাল-ডাল, একটি মাটির তোলা-উনুন, দু’টি লুঙ্গি, একটি গামছা আর বড় জোর পঞ্চাশটি টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে “দোয়া হইরেন, দক্ষিনি যাবার লাগছি, ফিরা নাও আসফার পারি”। এই দক্ষিণে যাওয়া মানে হচ্ছে “বাদায়” ধান কাটতে যাওয়া, এই বাদা হচ্ছে সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকা এবং খুলনার বিখ্যাত বিল ডাকাতিয়ায় ধান কাটতে যাওয়া। মাস খানেক সেখানে কাটিয়ে একদিন নৌকোর খোলের ভেতর ধান ভরে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসা, একেকজনের চেহারা তখন চেনা দায় – সে অন্য গল্প, এদের নিয়ে আমার বেশ কিছু ছোট গল্প আছে।
যাহোক, এতো গেলো পুরুষের কথা, নারীর ক্ষেত্রে গ্রামের বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, একমাত্র বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আলাদা কথা। কিন্তু এই পনের-কুড়ি বছরে একটি অবিবাহিতা নারী ওই গণ্ডগ্রাম (আমাদের গ্রামের ক্ষেত্রে দয়া করে শব্দটির আক্ষরিক অথটিই ধরে নেবেন) ছেড়ে, ঢাকার সাভারে এসে গার্মেন্টস-এ কাজ করছে, একে যদি আধুনিকতা হিসেবে ধরে নিয়ে বগল বাজাতে চাই, তাহলে তাই-ই সই। কিন্তু এই আধুনিকতার মূল্য তাকে দিতে হচ্ছে নানা ভাবে, সেকথাও অন্য কোনও সময় বলবো। মোটকথা এসব কথা নিয়ে যখনই লিখেছি, তখনই আমারই বন্ধুবান্ধব গর্জে উঠেছেন, তারা বলেছেন, তুমি তো বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলি দ্যাখো না, খবরের কাগজের পাতায় ঠিক আধুনিকতটাকে ধরা যায় না, টিভি পর্দায় না দেখলে বোঝা যাবে না, বাংলাদেশ কতোটা আধুনিক আর অগ্রসর হয়েছে। বন্ধুদের কথামতো, অনেক আশা নিয়ে আধুনিকতা দেখবো বলে, স্কাই সংযোগ নিয়েছি। এখন আমি প্রতিদিন রিমোট হাতে টিভির সামনে বসে আধুনিক বাংলাদেশ খুঁজি, কিন্তু কোথাও তার দেখা পাই না। এ কি আমার দেখার ভুল? নাকি আমি আমার দেখার চোখ দু’টো ফেলে এসেছি, বিদেশে প্রবেশের আগে আমার দেশজ-আত্মার শবদেহের পাশে?
আমি দেখতে পাই, উদ্যাম নাচ, জীবনমুখী গানের নতুনতর সংযোজন আধুনিক কবিতার মতো দুর্বোধ্য গান, পাঞ্জাবীওয়ালার সঙ্গে তথাকথিত আধুনিকার রগরগে শরীর দোলানি (ভাগ্যিস শেফালি ঘোষ দেহ রেখেছেন, নইলে কষ্ট পেতেন খুব), সংলাপ-কাহিনী-অভিনয় এবং পরিচালনার আধুনিকতার উৎকৃষ্ট নির্দশন বাংলা নাটক দেখে আমার নিজেকে আরো পুরনো আর নিঃস্ব মনে হতে থাকে। সিভিল শাসন এবং গণতন্ত্রকে নোংরায় ফেলে সেনাশাসন এবং অরাজনৈতিক-গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উত্তরপাড়ীয় প্রচেষ্টার কৌশলটি এখন দৃশ্যমান গণমাধ্যমে ফারুকি-বংশ (ঘরানা বলতে পারতাম, কিন্তু তাতে শব্দটির অপমান হতো)’র দ্বারা চমৎকার ভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আমার অনাধুনিকতার আর বাংলাদেশের আধুনিক হওয়ার তালিকা আরো দীর্ঘ করা যেতো, কিন্তু সময়ক্ষেপনে কী বা লাভ? তাতে আপনাদের দাঁতে নোখ কাটার প্রবণতাই বাড়ানো হবে শুধু।
আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি, পুরোনো লেপ কাঁথার ন্যাপথলিন-গন্ধ থেকে বের করে এনে সৌদি-কম্বল (যা আদতে চায়নীজ মেড)দিয়ে ঢেকে আধুনিক করতে, কিন্তু এটা কি যাহাতাহা কাজ!
মন যে আমার চায় রংগের ঘোড়া দাবড়াইতে . . পাগল মনরে. . .
মন্তব্য
কিছু মনে করবেন না। আপনি কি কি জিনিস পছন্দ করেন না তা তো বুঝলাম। (লিস্টে মেয়েদের গার্মেন্টসে কাজ করা থেকে শুরু করে পাঞ্জাবীওয়ালা পর্যন্ত দেখতে পেলুম।) কিন্তু তার পরিবর্তে কি পেলে ভালো হত, বা ভালোতর হতো, সেটাতে একটু আলোকপাত করবেন?
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
সহমত, আমারো খুব জানার খায়েশ আপনার না বলা কথাগুলো...।
আদিত্য
সহমত
বোধ হচ্ছে যা বলতে চেয়েছি ঠিক বোঝানো যায়নি। নইলে, গার্মেন্টস-এ কাজ করাকে আমি কখন অপছন্দ করলাম? আমি বলতে চেয়েছি, এই কাজ করাটাই আধুনিকতার সূচক হিসেবে মেনে নিতে আমি নারাজ। বরং যে গ্রামের ছেলেরা পর্যন্ত বাইরে বেরুতে চাইতো না, আজ তারা ক্ষেতি-বাড়ি করার অক্ষম (কৃষির দূরবস্থার কথা সবারই জানা) চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে গ্রামের মেয়েগুলো ঝাঁক ধরে বেরিয়ে পড়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে, এদের মধ্যে কেউ কেউ যে নানা অনাচারের শিকার হচ্ছে, তার দায়টুকু কি এই তথাকথিত আধুনিকতা বহন করবে? না করেছে কোনও কালে?
বৃত্তি হিসেবে একজন বেবুশ্যেকেও আমি সম্মান করতে প্রস্তুত, যদি সে যেচে জিনাত কিংবা তদ্বীয় আধুনিক নারীর কাতারে নিজেকে ঠেলে না নিয়ে আসে।
আর পাঞ্জাবী্ওয়ালা? তাকে তো পছন্দ করেছি শেফালি ঘোষের চাটগাঁইয়া বাচন এবং মিঠেলা সুরের সঙ্গেই, কিন্তু সেই পাঞ্জাবীওয়ালাকে যখন আধুনিক করতে গিয়ে যন্ত্রের ভেতর আটা দিয়ে সেমাই বানানোর কষ্টসাধ্য বাচালতায় ঠেসে, খানিকটা শরীরের বিশ্রী নর্তন-কুর্দনের ভিয়েন দিয়ে উপস্থাপন করা হয়, তখন বেচারি শেফালি ঘোষ আর আমার "অনাধুনিক" মন দু'জনকেই সমানভাবে আহত করে।
এসবের পরিবর্তে আমি কি চাই, সে সম্পর্কে তো আমি শেষ কথা এখনও বলিনি। যে কারণে শিরনামায় শব্দের সঙ্গে সংখ্যার একটা মিশেল নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন আপনারা।
আমি প্রথমে বুঝতে চেয়েছি আমার আহত বোধ কিংবা না-বুঝ মনকে; জানতে চেয়েছি আমার অবস্থানে দাঁড়িয়ে সময়টাকে; ধরতে চেয়েছি এর মগ্নতাকে, যা আমারই চৈতন্যে অনবরত শীষ দিয়ে চলেছে - এর বেশি এখন্ও কিছু চাইনি, তবে হ্যাঁ, সামনে যে চাইবো না, তা কিন্তু বলিনি।
গারমেন্টে কাজ করাকে কি আপনি আধুনিকতার লক্ষণ বলে দেখছেন না? আমি তো মনে করি আধুনিকতা একটা সূচক দিয়ে মাপা যায় না আর এই গারমেন্টস এর মেয়েরা নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের আধুনিকতার প্রথম দশটা সূচকের মধ্যে একটা ...
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আপনার বক্তব্যগুলো বোধহয় আমি ধরতে পেরেছি
এবং সেজন্যই বলছি
আপনার মন খারার করার কোনো কারণই নেই
বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি সাম্প্রতিক হয়েছে
কিন্তু আধুনিক হয়নি এক বিন্দুও
সাম্প্রতিকতা এক্সটার্নাল
আর আধুনিকতা ইন্টারনাল
টিভি পত্রিকা আর আমাদের বেশিরভাগের চোখ শুধু এক্সটার্নালটাই দেখতে ও দেখাতে পারে
ইন্টারন্যাল যে দেখার বিষয় তাও জানে না অনেকে
“বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি সাম্প্রতিক হয়েছে
কিন্তু আধুনিক হয়নি এক বিন্দুও
সাম্প্রতিকতা এক্সটার্নাল
আর আধুনিকতা ইন্টারনাল
টিভি পত্রিকা আর আমাদের বেশিরভাগের চোখ শুধু এক্সটার্নালটাই দেখতে ও দেখাতে পারে
ইন্টারন্যাল যে দেখার বিষয় তাও জানে না অনেকে” –
ধন্যবাদ মাহবুব লীলেন, আপনাকে।
আমার ভালো লাগছে, মাহবুব লীলেনের এই মন্তব্য, কারণ এতো দীর্ঘ লেথায়ও আমি যে কথাটা বলতে চেয়েও পারিনি, সেটি তিনি অনায়াসে বলে দিয়েছেন বলে।
হিন্দি সিমেনা বা সিরিয়ালের অপভ্রংশ যখন একটি শক্তিশালী সংস্কৃতির সঙ্গে পায়ে পায়ে ফেরে এবং তথাকথিত সংস্কৃতির ধারকরা যখন মূলধারার চেয়ে এই অপভ্রংশকেই কৌশলে কিংবা বলতে গেলে খানিকটা অদল-বদল করে শহুরে মধ্যবিত্তকে দিয়ে গিলিয়ে এবং তার বদহজমের দুর্গন্ধে জাতীয় সংস্কৃতির প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলেন, তখনও আমরা কেবল তার বাহ্যিচ চাকচিক্যে মোহমুগ্ধ হয়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছি। দিবা-নিশিতে পাওয়া মানুষ আমরা, খাচ্ছি-দাচ্ছি, বংশ বাড়াচ্ছি, কিন্তু এই নব্য বংশধরদের আত্মিক-খরচাদির জন্য কিছু রেখে যাওয়ার কথা ভাববার আর সময় কোথায়? এতো গেলো সংস্কৃতির অচৈতন্য, কিন্তু সামাজিক অচেতনাকে নিয়ে লিখতে গেলে তো মহাভারত লেখা যাবে। গার্মেন্টস-এর নারী শ্রমিকের কথা এ কারণেই তোলা হয়েছে। শ্রমক্ষেত্রের পর্যাপ্ততা কিংবা সহজলভ্যতা সমাজকে খানিকটা এগিয়ে নেয় সেটা যেমন সত্য তেমনই শ্রমক্ষেত্রের অস্বচ্ছতা, বৈষম্য এবং নিষ্পেশন যে দাস-মনোভাবের জন্ম দেয়, তা মৌনিক আধুনিকতার পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে, ব্যক্তি-সমাজ এবং রাষ্ট্রের ত্রয়ী-চক্রের সামনে।
ভালো থাকুন লীলেন।
নতুন মন্তব্য করুন