ভোরে ঘুম ভেঙে যায়, প্রতিদিনই, তারপর যতোক্ষণ ঘড়িতে দেওয়া এ্যালার্ম না বেজে ওঠে ততোক্ষণ বিছানায়, আধো ঘুম, আধো তন্দ্রায়। দিন শুরুর হিসেব-নিকেশ পেঁচিয়ে ধরে আমাকে। জীবনতর নিয়মাবলীর ভুল ভুলাইয়ায় হাঁটার প্রস্তুতি নিতে নিতে কেটে যায় ততোক্ষণ, যতোক্ষণ না দরোজা খুলে বাইরে পা রাখি।
কিন্তু আজ ভোর-এ, যথার্থই ভোর, আমি দরোজা খুলতেই সামনের রাস্তাটি, যাকে গভীর রাতে আমার কাছে মনে হয় নদীর মতো, কূল ভাসানো, উপছানো আলোর নদী, মাঝে মাঝে লালালো’র নৌকোগুলো ভেসে যায় তীব্র বেগে, সেই প্রিয় রাস্তা-নদী, যাকে দিনের বেলায় আমি ঘৃণাভরে ছুঁড়ে ফেলি মন থেকে, সেখানে, একেবারে আমার বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। আমার বাড়িকে মাঝখানে রেখে দু’পাশে মিনিট খানেক দূরত্বের রাস্তায় গাড়ির চলাচল বন্ধ, পুলিশের গাড়িতে ছয়লাপ, সাদা-কালো পোশাকের পুলিশ গোমড়া মুখে ঘুরছে। প্রথমেই আমি হোঁচট খেয়ে দাঁড়াই, কারণ, আমার দরোজার সামনেই এক দঙ্গল প্রতিবেশি জটলা করছে।
আমি রাস্তায় পা রাখার আগেই পাশের বাড়ির বিস্বামী ভ্যালেরি দৌঁড়ে আসেন, প্রতিদিনকার মতো সঙ্গে তার ইয়র্কশায়ার টেরিয়র কুকুরটি নেই, অথচ তাকে ছাড়া ভ্যালেরিকে কল্পনাই করতে পারি না। ব্রিটিশ ভদ্রতার কোনো ধার না ধেরে সরাসরি, “জানো কী ঘটেছে?”
- নাতো, কী ঘটেছে?
- ওহ্ ভগবান, কী ঘটেছে, তা বর্ণনার মতো নয়।
- আহা বলোই না কী হলো এই ভোরে?
ভ্যালেরির চেহারা তখন আমাদের গাঁয়ের ময়না দাদির মতো হয়ে যায় নিমিশে, তারপর গলা নামিয়ে ঠিক ময়না দাদির মতো মুখভঙ্গী করে আমার কানের কাছে মুখ এনে যা বলে তা খানিকটা এরকম,
আজ ভোরে যখন আমি আমার ‘টেডি’-কে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছি, তুমিতো জানোই টেডি তার প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য পপলার পার্কটিকেই পছন্দ করে। আমিও সেদিকেই হাঁটছিলাম ওকে নিয়ে। কিন্তু জানো, হঠাৎ টেডি থেমে গেলো, যেনো ও কিছু একটা টের পেয়েছে। আমিও দাঁড়িয়ে রইলাম, কারণ আমার চোখের সামনে দেখতে পেলাম আমাদের পাশের চারতলা বিল্ডিং-এর তিনতলা থেকে মুহূর্তের মধ্যে একটি শরীর, একটি নারী শরীর, আমার মনে হলো এশিয়ান পোশাকের, এসে আছড়ে পড়লো ওই বাঁধানো চত্বরে। ভাবতে পারো? ভাবতে পারো?
আমি তখনও কিছুই ভাবতে পারছি না। আমার চোখের সামনে, দিনের বেলা শুকনো রাস্তা-নদীর ওপারে ছোট্ট পার্কমতো জায়গায়, একটি লাল রঙের হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে, যে হেলিকপ্টারটিকে প্রায়ই দেখি, হোয়াইটচ্যাপেল রয়েল লন্ডন হাসপাতালের বিশাল ভবনের মাথায় নির্মিত হেলিপ্যাড থেকে উঠছে অথবা নামছে; জানি, এই লাল রঙের উড়ন্ত ফড়িং-এর দেহের ভেতর আছে নিদারুণ অসুস্থ কোনও রোগি, যার জীবন সংকটাপন্ন, এই হেলিকপ্টারের গায়ে লেখা এ্যাম্বুলেন্স, উল্টো করে যা লেখা থাকে গাড়ির শরীরে, আমার জোখের সামনেই ফড়িং-এর মতো সেটি উড়ে গেলো। তার দিকে দেখিয়ে, ভ্যাল আবার শুরু করলো, “ওই দ্যাখো, নিয়ে যাচ্ছে, ওই যে যাচ্ছে. . . .
জানো, আমিই ফোন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমিতো জানো, আমার মোবাইল ফোন নিয়ে আমি সকালে বেরোই না, আমার টেডি মোবাইল-এর রিং পছন্দ করে না। তবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে একজন ফোন করে পুলিশ এবং এ্যাম্বুলেন্সকে জানালো, জানো, ভদ্রলোক, খুব সুন্দর করে ওদেরকে বোঝাচ্ছিলেন, আমি কখনওই পারতাম না, আমার পক্ষে সম্ভব নয়, মোবাইল সঙ্গে থাকলেও আমি ওই সময় কথা বলতে পারতাম না। আমার টেডিও যেনো ডাকতে ভুলে গিয়েছিল, অন্যদিন হলে আমার টেডি এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতো না, ও ছুটোছুটি শুরু করে দিতো, ওর পেটের ভেতর দাপাদাপির জন্য ওকে পার্কে নিয়ে যেতেই হতো আমাকে, কিন্তু জানো, আজ ও আমারই মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
ভ্যালের মুখ থেকে শেষতম বাক্যটি যখন শুনি, তখন ওর মুখ আমার কানের খুবই কাছে, “জানো, আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনে, আমারই চোখের সামনে, একটি লোক, মেয়েটিকে তিনতলার বারান্দা থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিলো, মেয়েটি ধপাস করে পড়লো, আর লোকটির মুখে তখনও হাসি ছিল, সত্যি বলছি, আমি লোকটির চেহারায় হাসি দেখেছি, তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, সত্যি, খুবই সত্যি”।
ভ্যালের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি, ভ্যাল আরও কি কি যেনো বলে যায়, ততোক্ষণ আমার অন্য প্রতিবেশিরাও আমার দরোজার একেবারে সামনে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, আমাকে গল্পটি আদ্যপান্ত শুনতেই হবে। আর গাড়িহীন রাস্তাটি, দরোজার ঠিক সামনেই বাস-স্ট্যান্ডে আরও জটলা, সকালে স্কুলগামী শিশুদের প্রশ্নবোধক চোখ আর সেই সঙ্গে স্কুলে পৌঁছে দিতে আসা অভিভাবকদের সরাসরি প্রশ্ন আর উত্তর মিলে গোটা ভোর যেনো প্রশ্নময়; পুলিশের টাঙিয়ে দেওয়া সাদা-লাল ফিতে এসব প্রশ্নকে আরও উস্কে দিচ্ছে।
যখন, হাঁটতে শুরু করেছি নিজের গন্তব্যে, তখনই একজন পুলিশ এগিয়ে এলেন, জানতে চাইলেন, আজ ভোরে আমার চোখে কিছু পড়েছে কি? অনিয়মিত কিছু দেখেছি কি? কোনও ঝগড়া কিংবা চিৎকার শুনেছি কি? একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন, আমি প্রতিটি প্রশ্নের শেষে দু’দিকে মাথা নাড়ি, নেতিবাচক এই উত্তরে পুলিশ সদস্য তার নোটবুকে লিখে নেন, তারপর নাম জিজ্ঞেস করেন, নাম বলি, তারপর হাঁটতে থাকি, দিনের তখন সবে শুরু, বিশাল কর্মময়তার পাথর আমার কাঁধের ওপর জোয়ালের মতো, আমি হেঁটে যাই, পেছনে তাকাই না।
সারাদিন কেটে গেলো, ফিরে এলাম, তখন সন্ধ্যে, তখনও পুলিশের গাড়ি, সাদা-লাল ফিতে; আমার মনেও আবার সেই সকালের প্রশ্নাদি. . . এখন গভীর রাত, আরেকটি দিনেরও শুরু, আমি প্রশ্ন নিয়েই আছি, অথচ উত্তর খোঁজার কোনও তাগিদ আমি অনুভব করছি না, এক ফোঁটাও না।
মানুষ বদলায়, দিনের চাকা ঘোরে. . . . . ।।
মন্তব্য
লেখাটি সন্দেহাতীতভাবে চমত্কার।
একই সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সচলায়তনকে বিষণ্ণায়তনে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় আপনার অবদান জনতা চিরকাল স্মরণে রাখবে
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
- প্রায় একই রকম ঘটনার প্রায় আপনার মতোই অবস্থা হয়েছিলো আমার প্রায় বছরখানেক আগে। সেটা নিয়ে লিখেওছিলাম, কিন্তু এখানে আর প্রায় নয়। আমার লেখার স্টাইলটা ছিলো আগামাথাহীন, লাগামছাড়া কথাবার্তা, আপনার মতো করে এতো সুন্দর উপভোগ্য, খুব যত্ন করে বলা কোনো বিষাদ গল্পের মতো নয়।
বড় কম লিখেন আপনি কর্মময়তার জোঁয়ালের ভারে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
হায় মানুষ,বদলে যাওয়া মানুষের অনাগত দিনের চাকা কি কেবল সামনের দিকেই ঘোরে?
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
মন খারাপ করা লেখা।
লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?
মন ভালো নেই।মন ভালো নেই।লেখাটা পড়ে মন আরো খারাপ হয়ে গেল।
eru
-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।
নিস্পৃহতারও দরকার আছে বোধহয়। জীবনটাই তো একটা বড় অভিনয়।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
নতুন মন্তব্য করুন