কথাটা শেষ পর্যন্ত খাবার টেবিলেই পাড়লেন হাস্নুহেনা। রাতের খাবারে সবাই মোটামুটি টেবিলে, শুধু বড় মেয়ে ছাড়া, গেল বছর থেকেই সে আলাদা থাকে, তাই তাকে বাদ দিয়েই বলতে হলো। ভেবেছিলেন অবশ্য ডেকে আনবেন কিন্তু তারা মাল্টা না ক্যানারি আইল্যান্ড কোথায় যেনো গেছে। ওর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করে কোনও লাভ নেই। হাস্নুহেনা বেশ সহজ এবং স্বাভাবিক সুরেই বলেছেন কথাটি।
আমি দেশে ফিরে যেতে চাইছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ মাসের শেষেই যাবো।
স্বভাবসুলভ চপলতায় তার ছোট ছেলে অমিত, বললো, “দেশে ফিরিয়া যাইবে মানে? ইহা কি তোমার দেশ নহে?”
অমিতের বয়স চব্বিশ। এ বছরই ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে ফাইন্যান্স থেকে পাশ করে বেরিয়ে এখন বার্কলে কর্পোরেট-এ ইন্টার্নিশিপ করছে। এখনও তার বয়স বেড়েছে বলে মনে হয় না, মায়ের ন্যাওটা বেশ। কথাবার্তা তার চোস্ত ইংরেজিতে, বাংলা সে বোঝে সবটাই, কিন্তু বলতে পারে না এক ফোঁটাও। অনেক চেষ্টা করেছেন হাস্নুহেনা, কিন্তু কিছুই করার নেই।
নাহ্, এটা আমার দেশ নয়, এটা তোমার দেশ হয়তোবা, কারণ এখানেই তুমি জন্মেছো, আমিতো জন্মেছি বাংলাদেশে।
হে ঈশ্বর, তাহাতে কী হইলো? তুমিতো বিগত ২৫ বছর ধরিয়া এই দেশে বসবাস করিতেছো। তাই ইহা তোমারও দেশ।
হাস্নুহেনা তার অমিতের এই শিশুসুলভ কথার ঠিক উত্তর দিতে চাইছেন না। তিনি অপেক্ষা করছেন তার বড় ছেলে বিপ্র এবং স্বামী মাজহারের মন্তব্যের।এরা দু’জন এখনও কিছুই বলছে না। ভাবছে হাস্নুহেনা হয়তো মজা করছেন।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মাজহারই বললেন, “হঠাৎ দেশে ফিরে যেতে চাইছো কেন?” – মাজহারের কন্ঠ গম্ভীর, কারণ তিনি জানেন যে, হাস্নুহেনা মুখ দিয়ে যে কথা বের করেছে তা নিছক মজা করার জন্য বের করেননি। প্রায় পয়ত্রিশ বছর ধরে ঘর করছেন মহিলার সঙ্গে, বুঝতে অসুবিধে হয় না কোন্ কথাটা দুষ্টুমি আর কোন্টি নয়।
যেতে চাইছি অনেক কারণে, তবে মূল কারণ হলো জীবনের বাকি দিনগুলি আমি দেশেই কাটাতে চাই।
বাকি দিনগুলি মানে? তোমার বয়স কতো? মাত্র বায়ান্ন বছর। এরই মধ্যে বাকি দিনগুলির কথা আসে কী করে? পাগলামি আর কাকে বলে!
না আমি মোটেও পাগলামি করছিনে। আমি ঠিকই বলেছি। বাকি দিনগুলি আমি দেশে কাটাতে চাই।
এবার তাদের কথার মাঝখানে ঢুকে পড়লো মেজ ছেলে বিপ্র। যদিও এই দেশের বিদঘুটে উচ্চারণে নামটি এখন বি-প্রাহ্ গোছের কিছু একটা হয়েছে, বেশিরভাগের কাছেই অবশ্য সে শুধুমাত্র বিপ্। সে সরাসরি মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “বাকি দিন মানে কতোদিন তাহা তুমি জানো মনে হইতেছে”!
হাস্নুহেনার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র বড় মেয়ে অরণিই কেবল তার সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাকিরা সবাই তুখোর ইংরেজি চালিয়ে যায়। হাস্নুহেনা মেজ ছেলের মুখের দিকে তাকালেন কিছুটা, হাতটা তখনও ভাতের থালায়, বললেন, “নিশ্চিত করে জানি না, তবে একটা তারিখ আমি দিতে পারি।২০১২ সালের ২০ নভেম্বর, আমি মারা যাবো”।
এবার আবার মাজহারের অংশগ্রহণ, “বাহ্ এ যে দেখছি মৃত্যুর দিনক্ষণও জেনে বসে আছো, চমৎকার”। তার কথায় স্পষ্ট বিদ্রুপ।
হ্যাঁ জেনেছি, অমিত আমাকে একটা ওয়েব সাইটের ঠিকানা দিয়েছিল, নাম দ্য ডেথ ক্লক। এখানে গিয়ে জন্ম তারিখসহ আরও কিছু তথ্য দিলে মৃত্যুর দিন-ক্ষণ জানা যায়। আমি অবশ্য এই তারিখ দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেকথা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। আসলে এখানে আর আমার মন টিকছে না। মনে হচ্ছে, আমি এখানে বেমানান। আমাকে যেতে হবে, আমি ফিরতে চাই। যেখানে জন্মেছিলাম, যেখানে বড় হয়েছি, সেখানে যেতে চাই। থাকতে চাই, যতোদিন বেঁচে থাকি, ততোদিন।
হাস্নুহেনা একটানা বেশ কয়েকটি বাক্য বললেন, তারপর থামলেন। এবার সবাই তার দিকে হা করিয়ে তাকে আছে। তারপর প্লেটের ওপর কাঁটা-ছুরি বেশ একটু শব্দের সঙ্গে রেখে প্রথমেই উঠে দাঁড়ালো বিপ্র, তারপর মাজহাজর সাহেব তার স্বভাবমতো ধীর গতিতেই উঠলেন। আস্তে আস্তে বেসিনে গিয়ে হাত ধুলেন, থালা থেকে উচ্ছিষ্ট ফেললেন ময়লার ঝুড়িতে, তারপর থালা ঢোকালেন ডিশ ওয়াশারে। তারপর কেটলিতে জল ভরে সুইচ অন করলেন। যেমন প্রতিদিন করেন। তারপর খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা গিয়ে বসলেন টিভি সেটের সামনে। সেখানে আগেই পৌছে গিয়েছিল বিপ্র। এপাশ থেকে হাস্নুহেনা শুনতে পেলেন, আবহাওয়ার খবর দিচ্ছে কোনও নারী কন্ঠ, “ইউরোপের উপর দিয়া এই সপ্তাহান্তে বিপজ্জনক ঝড়ো হাওয়া বহিয়া যাইবে”।
খাবার টেবিলে তখন তিনি আর অমিত। হাস্নুহেনা অমিতের দিকে তাকান চোখ তুলে। তার মনে হয়, আহ্ অমিত যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হতো, তাহলেই ওকে বেশি মানাতো। ফর্সা নিটোল মুখ, ধনুকের মতো বাঁকা ভুরু, এতোদিন দু’টো ভুরু জোড়া দেওয়া ছিল নাকের শুরুতে কিন্তু বোঝা যায় অমিত সেই জোড়ার জায়গাটা থেকে সব লোম তুলে ফেলেছে। হাস্নুহেনা এ নিয়ে অবশ্য ছেলেকে কিছুই বলেননি, বলতেও চান না। তিনি অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন অমিতের এই ব্যাপারটা, ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করেননি। বড় হয়েছে, নিজের বোধ-বুদ্ধি হয়েছে, বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্সে ডিগ্রী নিয়েছে, কর্পোরেট ব্যাংকিং সেক্টরে ভবিষ্যতে বড় পদে চাকুরি করবে এটাই ইচ্ছে, সেদিকেই এগুচ্ছে, এমন ছেলেকে কেন সে নারীকে বাদ দিয়ে আরেকজন পুরুষকেই যৌনসঙ্গী হিসেবে বেশি পছন্দ করে সে প্রশ্ন করা বৃথা। অন্য কোনও বাঙালি মা হলে অবশ্য কেঁদে-কেটে একটা হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলতো, কিন্তু তিনি কিছুই করেননি। চুপচাপ থেকেছেন, ছেলেকে সময় দিয়েছেন, কিন্তু তাকে কোনও কিছুতেই বাঁধা দেননি। অবশ্য হাস্নুহেনা এখনও জানেন না যে, ব্যাপারটা মাজহার সাহেব কতোটা জানেন।জানুক বা না জানুক তাকে অমিতের এই ইচ্ছের হেরফের কতোটা হবে? কিছুই আসবে যাবে না।
হাস্নুহেনা আজীবন চেয়েছেন তাকে তার ইচ্ছের বিপরীতে যেনো কেউ চলতে বাধ্য না করে, তিনিও কাউকে তার ইচ্ছেয় বাঁধা দেবেন না। অথচ আজীবন তাকে তার প্রতিটি ইচ্ছেয় বাঁধা দেওয়া হয়েছে, তিনি অবশ্য মাত্র দু’একটি ক্ষেত্র ছাড়া শেষ পর্যন্ত তার প্রতিটি ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছেন। তার এই একরোখা জেদি চরিত্র সম্পর্কে ছেলেমেয়েরা এবং তাদের বাবা খুব ভালো করেই জানে।
অমিত শিশুর মতো আবারও মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “মাম উহা তো একটা হাস্যকর ওয়েবসাইট। উহাতে সবাই হাস্যরস করিতেই প্রবেশ করিয়া থাকে। উহাতে আমার মৃত্যু তারিখ কবে বাতলিয়েছে জানো? ২০২০ সালের ১৫ই অক্টোবর। ইহা কি অত্যন্ত হাস্যকর নহে? আমি কি তবে মাত্র ছত্রিশ বছর বাঁচিয়া থাকিবো? মাম, মধু আমার, তুমি ইহা বিশ্বাস করিও না, ইহারা ধোকা দিয়া লোক ঠকাইয়া মজা লুটিবার তরে এসব করিতেছে। মাম, তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দাও, তুমি এই সব পাগলামি ত্যাগ করিবে?”
তোদের সবার কাছে আমার ব্যাপারটা পাগলামি মনে হতে পারে, কিন্তু আমি জানি যে আমি ঠিকই বলছি। মৃত্যুর এই তারিখটা হাস্যকর হতে পারে, হতে পারে ওরা লোক ঠকানোর জন্য এসব করে কিন্তু আমাকে তো কেউ ঠকিয়েছে বলে আমি বলছি না, কিংবা আমি এও বলছিনে যে, আমি এই তারিখটিকেই আমার সত্যিকার মৃত্যুর তারিখ বলে আমি মেনে নিয়েছি এবং সে কারণেই দেশে ফিরে যেতে চাইছি। আমি বলতে চাইছি যে, এটা একটা তারিখ এবং হতে পারে যে আমি এর আগেও মারা গেছি, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, এই তারিখটিকে ধরেই আমি দেশে ফিরে যেতে চাই এবং এরপর থেকে দেশেই থাকতে চাই। আমি কি তোকে বোঝাতে পেরেছি?
পারিয়াছো মাম। কিন্তু আমার যে তোমাকে অনেক মনে পড়িবে? তুমি চলিয়া গেলে কে আমার জন্য রন্ধন করিবে? আমিতো এখনও পর্যন্ত এই বাড়িতে বসবাস করিতেছি কেবলমাত্র এই রাতের আহারটুকুর জন্য, নইলে কবে এন্ড্রুর সহিত উঠিয়া যাইতাম। তুমি দেখলে আশ্চর্য হইবে মাম, ক্যানারি ওয়ার্ফে এন্ড্রুর বারান্দা হইতে থেমস নদীকে কি সুন্দরীই না দেখায়। আমার কি ইচ্ছা জানো? আমি আর কিছুদিন পরেই একটি ছোট্ট প্রমোদতরী ক্রয় করিবো। তাহারপর আমাদের কর্মস্থলের নিকটেই থেমস নদী হইতে যে খাল প্রবেশ করিয়াছে, সেখানেই ভাসিয়া থাকিবো, খুব আনন্দ হইবে তাই না মাম?”
হাস্নুহেনা অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কি বলবেন ভেবে পান না।অমিতকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, ওর অন্য ভাইবোনেরাও নিজেদের কথাটাই কেবল বলতো। তবে একটি ব্যাপারে ওদেরকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। ওরা মিথ্যে স্তুতি দিয়ে কাউকে ভোলানোর চেষ্টা করে না। যেমন অমিত এখন একথা না বললেও পারতো যে, একমাত্র রাতের খাবারটার জন্যই সে এ বাড়িতে আছে, নইলে সে এণ্ড্রুর সঙ্গে গিয়ে উঠতো। এতোক্ষণ ওর বলা কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, এক বর্ণও মিথ্যে কিংবা বানিয়ে অথবা সত্য গোপন করতে শেখেনি ওরা। এটা একদিক দিয়ে খুব ভালো কিন্তু কঠিন সত্য যে কতোটা কাউকে আঘাত করতে পারে সেই সংবেদনশীলতাও ওদের ভেতর জন্মায়নি। অথচ তিনি প্রথম প্রথম চেয়েছিলেন এরকম কিছু ওদের ভেতর জন্মাক। অবশ্য হাস্নুহেনা তো জীবনে অনেক কিছুই চেয়েছিলেন। সেগুলো আর সব হলো কই? জীবনের শুরুতেই তো চাওয়ার আগুনে নিজেই প্রজাপতির মতো পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর তার গোটা জীবনটাইতো সেই নিজেরই পুড়ে যাওয়া ছাইদানি ছাড়া আর কিছু নয়। তবু ছেলেমেয়েরা ছিল, নিজের রক্তের সম্পদ, তাদের মুখ চেয়ে ছাইগাদার ওপর নরোম পলি বিছিয়ে ভালোবাসা কিংবা স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন। কিন্তু সেই পলির স্তরটুকুও খসে গেছে বলে বুঝতে পারেন।
একদিকে ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, অন্যদিকে মাজহার সাহেবও দূর থেকে দূরে গিয়েছেন। সেই অর্থে কোনও দিনই তিনি হাস্নুহেনার কাছের কেউ ছিলেন না। হাস্নুহেনার ঘোর অমতে বিয়ে, মেনে নেওয়া ছাড়া কোনওই গতি ছিল না। বিয়ের পর পরই বড় মেয়ে পেটে এলো, তার বয়স বছর ছয়েক হতে না হতেই এখানে। আসলে তিনি ভাবতেন যে, আর কিছু না হোক অন্ততঃ ছেলেমেয়েদের জন্য হলেও তাকে সংসার করতে হবে। করেছেনও। মানিয়ে নিয়েছেন অনেক কিছু। অশান্তির বিছানায় তাকে বহুদিন ছাদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, এর মধ্যে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা ছিল না। এ নিয়ে অবশ্য হাস্নুহেনার ভেতর সামান্য একটু বেদনাবোধ আছে, কারণ তার বিশ্বাস ছেলেমেয়েগুলো তাদের ভালোবাসাহীন সঙ্গমের ফসল। কিন্তু ওদেরকে সেসব বুঝতে দেননি। বড় হয়ে কে কি বুঝেছে তিনি জানেন না, মেয়েটা একবার অবশ্য প্রশ্ন করেছিলো, “মা, বাবাকে তুমি একদম ভালোবাসো না, তাই না?”
তিনিও মেয়ের কাছে মিথ্যে বলে অসততার পরিচয় দিতে চাননি। সরাসরি বলেছেন, না বাসি না। কিন্তু আমাদের সময়ে এরকমটাই প্রচলিত ছিল। আমি প্রচলণ ভাংতে পারিনি, সাহস হয়নি।
তার মানে তুমি আর কাউকে ভালোবাসতে মা?
হুঁ বাসতাম।
আমাকে বলা যাবে তিনি কে? – এটুকু বলেই অবশ্য অরণি বুঝতে পেরেছিল সে মায়ের অনেক লুকোনো এবং একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় জানতে চাইছে। ওর ভদ্রতাবোধ হয়তো বাঁধা দিয়ে থাকবে। ও ছোট্ট “দুঃখিত” শব্দটি উচ্চারণ করে মায়ের সামনে থেকে সরে গিয়েছিল, এরপর আর কখনওই এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি।
কিন্তু হাস্নুহেনা কেন একটি ওয়েব সাইট দেখে এরকম একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তা নিয়ে এই ক’দিন তিনি অনেক ভেবেছেন। নিজেকে জেরা করেছেন, প্রশ্নের পর প্রশ্ন দিয়ে আঘাত করেছেন। জানতে চেয়েছেন নিজেরই কাছে, কেন এসব করছি?
একটি মাত্র কারণ থাকলে সোজা উত্তর দেওয়া যেতো, কারণতো অনেকগুলি।
সবাই হাসবে তোমার এই পাগলামি দেখে।
হাসবে? হাসতেই পারে। তবে এসব আমার পাগলামি নয়। ওই তারিখটা একটা উপলক্ষ মাত্র। এখানে আমার আর ভালো লাগছে না, আমি ফিরে যেতে চাই।
কার কাছে ফিরে যাবে? কে আছে তোমার?
কেন মা বেঁচে আছেন। বাবার ভিটে আছে। আর দরকার হলে আমি নিজেই ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে নেবো। সেই সামর্থ তো আমার আছে, সেটা তুমি জানো, কি জানো না?
হ্যাঁ জানি। তুমি ভলান্টারি পেনশন নিয়ে নিয়েছো। স্কুলে পড়াতে, কিন্তু পড়াতে তোমার আর ভালো লাগছিলো না। এই অজুহাতে ছেড়ে দিলে। বেশ কিছু টাকা তুমি পেয়েছো তা জানি। তাছাড়া তোমার কিছু বন্ড টন্ড না কি যেনো কেনা ছিল?
হ্যাঁ, এসব মিলিয়ে ঝিলিয়ে আমার বেশ চলে যাবো। বাঁচবো তো আর মাত্র চার বছর।
আহ্ এসব কথার কোনও মূল্য আছে? কোন্ এক ওয়েব সাইট কী বলবো, তাই নিয়ে নাচছো। তোমার মতো বুদ্ধিমান মানুষের এরকম হাওয়ায় ভাসাটা শোভা পায় না।
আমি হাওয়ায় ভাসছি সেটা সত্যি। তবে সেটা এই কারণে নয়, অন্য কারণে। ফিরে যাওয়ার আনন্দে। আমি সত্যিই ফিরে যাবো।
ফিরে যাবে? ছেলেমেয়েরা? তোমার স্বামী?
এরা সবাই স্বাবলম্বী। এদের কারোর কাছেই আমার আর খুব বেশি প্রয়োজন নেই। যেটুকু আছে সেটুকু কিছুদিনের অনভ্যস্ততাতেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ আমি নিজে এদেশের অনেক কিছুকে চোখে হারাবো।
যেমন?
যেমন এদেশের লাইব্রেরীগুলো, লন্ডনের রাস্তায় একা একা হাঁটা, থিয়েটার, ভালো ভালো সিনেমা – এইসব আর কি। কিন্তু জীবনে তো অনেক কিছুই হারালাম, এসবও সেই তালিকায় যোগ হোক, আর তো মাত্র চারটে বছর! হা হা হা।
আবার?
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। আর বলবো না।
তোমার স্বামীর কি তোমাকে প্রয়োজন পড়বে না? মানে তোমাদের ভেতর শারীরিক ব্যাপার-ট্যাপার?
নাহ্ তার প্রয়োজন হবে না। ওসব অনেকদিন হয় নেই আমাদের মাঝে। আমার এসবে কতোটুকু আনন্দ ছিল তাতো জানোই। তারপরও আনন্দহীনতায় আনন্দ পেতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু শেষে ওর দিক থেকেই বন্ধ হলো ওসব। বার কয়েক নিজে চেষ্টা করেছিলাম, রেগে যায়। রেগে গিয়ে যাচ্ছে তাই বলে। বলে, দরকার হলে রাবারের লিঙ্গ কিনে নাও। বলোতো, বিষয়টা কি কেবল শারীরিক? আমিতো ওর দিকটাই ভেবেছিলাম বেশি। কিন্তু ফল হলো উল্টো, সে যাক। মাজহার অবশ্য আমার এই যাওয়াটার অন্যরকম ব্যাখ্যা করতে পারে।
সেটা কী রকম?
জানো তো, ও আমাকে বলে যে, বায়ান্ন বছর বয়েস নাকি আমার মোটেও মনে হয় না। চল্লিশ-টল্লিশ বড় জোর। বলোতো, এতে আমার দোষটা কোথায়? আমি নিজের যত্ন নিই, মেপে খাই, সময় পেলেই হাঁটতে বের হই, এতে যদি আমার শরীর ঠিক থাকে তাহলে আমি কি করবো বলো? ইচ্ছা করে তো আর আমি নিজের শরীর খারাপ করতে পারি না, তাই না? অসুখে পড়লে তো ভুগতে হবে আমাকেই, নাকি?
হুঁ, তাতো ঠিকই।
তাই বলছিলাম, মাজহার হয়তো এটাকেই একটা ইস্যু করবে। সে করুকগে, কাউকে তার মানসিকতা বদলে তো জোর করা চলে না, আমি কখনোই তা করিনি, আর করবোও না।
সেদিন খাবার টেবিল থেকে উঠে হাত ধুয়ে, থালা-বাসন গুছিয়ে, দাঁত ব্রাশ করে, হাতে খানিকটা লোশন নিয়ে যখন শোবার ঘরে এসেছিলেন হাস্নুহেনা তখন তার দিকে তাকিয়ে মাজহার সাহেব সত্যি সত্যিই বলেছিলেন, “আমি জানি তুমি কেন দেশে যেতো চাইছো। তোমার এখন অনেক পুরুষ দরকার। এখানে থাকলে সেটা সম্ভব নয়, আফটার অল ছেলেমেয়েরা রয়েছে, আমি আছি, তাই দেশে ফিরে যেতে চাইছো। আমি ঠিক বলেছি না?” তার কন্ঠে তখনও তাচ্ছিল্যের সুর।
এর উত্তর কী দেবেন হাস্নুহেনা? তিনি এসব নিয়ে ভেবেছেন অনেক কিন্তু তার পাল্টা কথাবার্তা তিনি ঠিক করেননি। তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করেছেন, এরকমটা তিনি আগেও করেছেন। এতে মাজহার সাহেব যথারীতি আরও রেগে গিয়েছেন এবং গর গর করতে করতে আরও অনেক নোংরা কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর ওদিকে হাস্নুহেনা মাজহার সাহেবের এসব কথা গায়ে না মেখে মনে মনে তালিকা করেছেন যাওয়ার সময় কি কি সঙ্গে নেবেন। অবশ্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বেশিকিছু নেবেন না, সামান্য কিছু জিনিসপত্রই নেবেন শুধু। সবইতো আজকাল ঢাকায় পাওয়া যায়। তাছাড়া তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যাওয়ার পথে তিনি কোলকাতা হয়ে যাবেন।কোলকাতা থেকে শান্তি নিকেতন যাবেন, বেড়াবেন, তারপর ফিরবেন ঢাকায়।
কোলকাতায় ঝুমুরকে ফোন করে একটা হোটেল ঠিক করে রাখতে হবে। ঝুমুর তার সঙ্গেই স্কুলে পড়াতেন, এখন কোলকাতায়ই ফিরে গেছে। বছরে দু’বার এখানে আসে।আবার ফিরে যায়। কিন্তু হাস্নহেনা আর ফিরবেন না। চার বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আর এই চার বছরে কতো কিই না তার করার আছে।
তারপর কোলকাতা থেকে যাবেন শান্তি নিকেতন। আহ্ কতো ইচ্ছে ছিল এখানে লেখাপড়া করার। একসময় ছায়ানট থেকে তার যাওয়ারও কথা ছিল। হলো না, বাসা থেকে যেতে দেওয়া হলো না। ওয়াহিদুল ভাই নিজে গিয়েছিলেন ওদের বাসায়, কিন্তু ছাড়লো কই ওকে বাসা থেকে? তখন বিয়ে দেওয়া নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেলো। হয়েও গেলো বিয়ে, সেখানেই ইতি গান, বাজনা, সমস্ত শখ আহ্লাদ।
শান্তি নিকেতনে না গিয়েও যেন সেখানকার সমস্ত মুখস্ত তার। শুনে শুনেই, কিংবা বিভিন্ন লেখকের বইয়ে পড়ে। একটা সাইকেল ভাড়া করবেন হাস্নুহেনা। শাড়ি পরে সাইকেল চালাতে একটু অসুবিধে হবে হয়তো, সে কিছুক্ষণ পরই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। একমাত্র শান্তি নিকেতনে গিয়ে সাইকেল চড়তে হবে বলেই না গোপনে তিনি সাইকেল চালানো শিখেছিলেন। কেউ জানতো না, পুরানা পল্টনে শিপ্রাদের বাড়িতে পড়তে গিয়ে শিপ্রার ভাই অমলের কাছেই শেখা হয়েছিল। ওদের পুরোনো দোতলা দালানের সামনে-পেছনে দু’দিকেই অঢেল জায়গা। ঢাকা শহরে অতো বড় বাড়ি তখনও ভাবা যায় না। কিন্তু শিপ্রাদের বাড়িটা অনেক পুরোনো, ওরাই পল্টনের আদি বাসিন্দা বলতে গেলে। শিপ্রার ঠাকুর্দা ছিলেন নামকরা উকিল, তিনিই বানিয়েছিলেন এই বাড়ি। হলুদ দালানে পিতলের পয়সায় জং ধরলে যে রং হয় সেই রঙের খড়খড়ি।
ভর দুপুরে শিপ্রাদের নিঝুম বাড়িতে অমল হাস্নুহেনাকে সাইকেল চালানো শেখাতে শেখাতেই একদিন ওর চুলের ভেতর নাক ডুবিয়ে বলেছিলেন, “আহ্ দারুন, সত্যিই হাস্নুহেনা, কিন্তু এখনতো দিন”, তারপরই হা হা শব্দে আকাশ কাঁপিয়ে হেসেছিলেন। এরকম আরও বহুবার হয়েছে, চুল থেকে বুকের ভেতরেও নাক ডুবিয়ে “আহ্ হাস্নুহেনা” বলে অমল হা হা করে হেসে উঠেছেন। এখনও হাস্নুহেনা সেই হাসির শব্দ শুনতে পান।
সাইকেল চালিয়ে সারা শান্তি নিকেতন ঘুরবেন। প্রতিটি পল্লী ঘুরে ঘুরে দেখবেন।আর কিছু বা কেউ একজনকে খুঁজবেন; সারাদিন, খোয়াইয়ের পারে, কিংবা কোনও কাঁঠাল আম বা আকাশমণিতলায়; তিনি জানেন না আবার জানেনও।
কিন্তু তারপর? তারপরটুকু আর হাস্নুহেনা জানেন না, জানতে চানও চান। জীবনে অনেক ‘তারপর’-কে তিনি জেনেছেন, কিন্তু কী হয়েছে সেসব জেনে, বুঝে, মেনে? কিছুই হয়নি।তাই আর কোনও ‘তারপর’কে হাস্নুহেনা জানতে চান না। অবশ্য সেই ‘তারপর’তো আর মাত্র বছরখানেক, ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত, তাই না? কিন্তু তারপর? হাস্নুহেনা হাসেন, হাসলে তাকে আজও খুব সুন্দর দ্যাখায়।
মন্তব্য
ওই ওয়েব সাইটে আমিও ঢুকেছিলাম। তাদের দেয়া তারিখ অনুযায়ী আমি এখন 'ভূতাবস্থায়' আছি ! হা হা হা !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
এদের হিসাবে আমিও মরে গেছি চলতি জুনের ছয় তারিখ
আর ৭২ সালে মৃত আমার দাদা মরবেন ২০৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে
মাসুদা ভাট্টির অনুরোধক্রমে গল্পটি অখন্ড আকারে প্রকাশিত হলো। বাড়তি দু'টি খন্ড প্রথম পাতা থেকে অনাবশ্যক বিবেচনায় সরিয়ে খসড়া হিসেবে সংরক্ষিত হলো।
হাঁটুপানির জলদস্যু
কিন্তু শিরোনামের পর্ব নির্দেশিত সংখ্যাটা মোছা হয় নি !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
অন্যরকম একটা গল্প
চমৎকার
ধন্যবাদ হিমু, একটি গল্পের তিনটি খণ্ডাংশ, পুরো গল্পটিকে আহত করতো। একটি শরীরে গল্পটি জীবন পেলো।
সবাইকে ধন্যবাদ, পাঠের জন্য।
চমৎকার লাগল।
আপনার লেখা মনে হয় কম দেখি।
অবশ্য পড়লেও সব সময় কমেন্ট দেয়া হয়নি।
সত্যি খুব ভাল লাগল।
ভাল লাগলো...।
-নিরিবিলি
প্রবাসীদের জীবন নিয়ে অনেকেই গল্প লেখেন । গতানুগতিক বলেই ঐ সব আমাকে টানেনা । সৈয়দ হক বহু আগে লিখেছিলেন- 'বালিকার চন্দ্রাভিযান' তার লণ্ডন থাকাকালীন সময়ের গল্প । আহা তেমন গল্প আর কেউ লিখলোনা ।
আপনার এই গল্পটা মনে থাকবে কারন এখানকার একটা অনুচ্চারিত সত্য ( অমিত ও তার বয়ফ্রেন্ড) সম্ভবতঃ আপনিই প্রথম গল্পে প্রকাশ করলেন ।
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
নতুন মন্তব্য করুন