এখানে রঙধনুর কবর

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৩/০৭/২০০৮ - ৯:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বহু প্রপিতামহ আগের একজন পিতামহ, যার ছিল সবুজ এক খণ্ড জমি, সেখানে পাখি আসতো, দূর দূর দূরের দেশ হতে। তাদের কারো রঙ সূর্যের মতো, কারো বা চাঁদ, কারও পান্না-সবুজ, কেউ বা প্রবাল, মোটকথা সবুজের ভেতর তাদের ঔজ্জ্বল্য আরও প্রজ্জ্বল হতো।তিনি শুয়ে থাকতেন, জমিতে শিথেন দিয়ে। তার শরীর থেকে পাখিরা খুটে খেতো সময়ের উকুন। আরামে তার চোখ বুজে আসতো, মনে হতো তিনি বুঝি মৃতের মতোন। তার পাশদিয়ে শবযাত্রা গেলেও তিনি তাদেরই মতো বিছিয়ে রাখতেন নিজেকে।যতোদিন না জন্ম হলো আমার পিতার।যিনি সেই সবুজের শিথেন থেকে তাকে শববাহী শকটে তুলে দিলেন। আমার সেই বহু প্রপিতামহ আগের একজন, মানুষ ছিলেন শুনেছি।

দুই.
জানালা দিয়ে দ্যাখা যায় বিলবোর্ডটি, সেখানে একখানি মুখ, একটি নারী মুখ। চোখের নীচে এক জনমের কালি, মেয়েটি কি এককালে কাজল পরতো? সূর্যের গ্রহণ লাগার মতো পুরো মুখটা জুড়েই লেপ্টে আছে অশুভ বেদনাগণ। মেয়েটির পুরুষ্টু ঠোঁট, উপছানো হ্রদের মতো বুক, নাভি, স্বর্ণাভ রোম পর্যন্ত আলোর সঙ্গে স্পষ্ট হয়। পথচারী পুরুষটি থেমে যায় মুহূর্ত, বোঝা যায় তার ভেতরে পৌরুষ চুলবুল করে, তারপর দু’পায়ের মাঝে ঝুলে থাকা বংশবিস্তারের থলেটাকে অকারণে একটু চুলকে আবার হাঁটতে শুরু করে সে, এসব সবই ঘটে যেনো অজ্ঞাতেই। ততোক্ষণে অবশ্য আলো নিবে যায়।

জানালা দিয়ে বিলবোর্ডের নারীমুখটিকে সেই আঁধারে আমার জীবন্ত মনে হয়, আলো যে এতোটা জীবনহারি তা বিলবোর্ডটি না দেখলে অজানাই থেকে যেতো।

তিন.
জ্ঞানবৃক্ষটি পুড়ে ছাই হলো এইতো কিছুদিন আগে, শূন্যোদ্যান ধ্বসে পড়লো, হায় মেসোপটেমিয়া; তোমার সব শাখা প্রশাখা যেখানে ঝুলে থাকতো বোধিস্ব, এখন শুধুই ছাইয়ের শহর,যদিও তার আকাশে এখন রোমান মোজাইক, মোজাইক থেকে রক্ত ধুয়ে নেয়া সহজ; পেটের ভেতর তোমার সিন্দবাদ বড় হয়েছিল,শাহরজাদি অথবা মর্জিনা, কোথায় ওরা সব? সরাইখানার তীব্র আলার নীচে ফিনফিনে নাকাবে চোখ ঢেকে যৌনাঙ্গের খানিকটা ওপর অনাবৃত করে সেই জমকালো নাচ, সব শূন্যে মিলিয়ে গ্যালো বুঝি? তাহলে বলো, শূন্য আবিষ্কারে ভুল ছিল, বিরাট ভুল। আহা দজলা ফোরাত মরুরাতের তারা, সব ছাই, কেঁদো না, কাঁদে না, সভ্যতা চুরি যায়;
কোনও এক মোহাম্মদ কিংবা তার প্রচারিত ধর্ম তখনও লোভ দ্যাখায় থোকা থোকা আঙুর অথবা সত্তর নগ্নিকার।

চার.
তার জ্ঞান প্রয়োজন নেই, তার ধর্ম আছে; তার প্রয়োজন নেই মানবিকতার; যদিও সে চায় সবচেয়ে ভালো খাবার, পোশাক এমনকি শ্রেষ্ঠত্বও; অন্যের ওপর কর্তৃত্ব তার চাই-ই চাই, সমাজকে সে হাতের মুঠোয় চায়, নিয়মের জোয়াল তুলে ধর্মের ঘানিতে সে জুতে দিতে চায় পৃথিবীকে; একালতো বটেই, আরও একটা কল্পিত কালেও তার শান্তি চাই, চাই অবাধ যৌনতা, প্রতিদিন নতুন শয়নসঙ্গী, যদিও একালে সে তার নারীর মুখ ঢেকে অন্য নারীকে দৃষ্টি এবং শক্তি দিয়ে ধর্ষণ করতে ছাড়ে না; সে জানে মানুষকে দুর্বল করার কৌশল, যদিও সেসব পুরোনো, বহু ব্যবহারে ছিবড়ে, তবুও সেসবই তার অমোঘ অস্ত্র, ব্যবহারে সেসব তার ক্লান্তি নেই, সে এই নিয়েই প্রস্তুত যুদ্ধযাত্রায়; কারণ সে জানে, জিতলে গাজী, মরলে শহীদ, হয় গনিমতের নারী, নয় হুরী- ধর্ম তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় অবাধ সঙ্গমের।

পৃথিবী দখল তার প্রয়োজন, জীবনও প্রয়োজন ভোগের জন্য, অথচ সে দাবি করে তার কিছুই প্রয়োজন নেই, কারণ ধর্ম আছে; যদিও ধর্ম মানেই ভোগদখল আর আরও ভোগের প্রতিশ্রুতি।

পাঁচ.
আমি মনুকে ক্ষমা করেছি
আমি ইব্রাহিমকে ক্ষমা করেছি
আমি মুসাকে ক্ষমা করেছি
আমি যীশুকে ক্ষমা করেছি
আমি ক্ষমা করেছি মুহম্মদকেও

মানুষ থাকতে চেয়েছিল মানুষ, ওরা ধর্মের আফিম খাইয়ে মানুষকে মনুষ্যতর করেছে।ওরা স্বর্গের স্কেচ দেখিয়ে মানুষকে করেছে সারমেয়, তারা ছুটছে সেই কাল্পনিক পথে; তারপরও ওদের ক্ষমা করেছি, কারণ ওরাও মানুষই ছিল, আমার মতো, তোমার মতো; ভুল এবং মানুষ, দু’জনে হরিহর।

ছয়.
আজ রাতের কথা আমি বলতে পারবো না, নিঃশ্বাসের মতো স্মৃতিরা বেরিয়ে যাচ্ছে ভেতর থেকে, কোনও স্বপ্ন হয়তো থাকতে পারে, জানি না; আগুন জমে বরফ হয়ে গিয়েছে, কয়লার রঙ সাদা, হা হা হা; লম্বা চুল টেনে ধরে ভায়োলিনের ছড়া কেউ টানছে এদিক ওদিক, ইথিওপিয়া থেকে বেনামি এক চিঠিতে জেনেছি, আজ রাতেই সেখানে ভোজ হবে, তবে মানুষের নয়, গৃদ্ধকূটের; আজ রাতের কথা আমি বলতে পারবো না, আমিও সেখানে যেতে পারি পারস্য ঈত্ত্বরে নেয়ে; পঁচা মাংসের গন্ধ আমি ঠিক সইতে পারি না।

সাত.
আমার পা নেই, তাও আমি কত্থকের বোলে পদ্ম ফোটাতে, পাহাড়ের গ্রীবা ঘেঁষে থাকা রঙধনু ছুঁতে হামাগুড়ি দিই।
আমার জিহ্বা কাটা, অথচ আমি হাজার রাতের গল্প নিয়ে বসে আছি।
বর্ণ পরিচয় নেই আমার, শুধু লিখতে বসেছি মহাকাব্য।
আমি কথা বলতে পারি না, তবে মিহি সুরে ঘুম এনে দিতেও পারি।
শুধু একথোকা রাতের খুব প্রয়োজন।

আট.
ভালোবাসা একদিন ছিল ঘুঘু পাখির মতো, অলস দুপুরকে আরও নিঃসঙ্গ করে দিতো। সে দীর্ঘ গ্রীবার রাজহাঁসও ছিল কিছুকাল, জলে তার প্রতিবিম্ব তাকে হিংসে করতো। একসময় আবাবিল হলো ভালোবাসা, ফুরুত-ফারুত, এদিক-সেদিক; তারপর পাহাড়ি ঈগল এসে এক ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো তাকে- এখন শুধু ভরা গ্রীস্মে শূন্য পাথারে তাকালে তাকে দ্যাখা যায়; লোকে তাকে ভুল করে কী সব ডাকে।


মন্তব্য

কনফুসিয়াস এর ছবি

নেশারু টাইপ লেখা। যিনি লিখেছেন, আর যিনি পড়ছেন, দুজনের জন্যেই। হাসি
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মুজিব মেহদী এর ছবি

অনেক ভালো লাগল লেখাটা, ছয় খণ্ড ধরেই।
কবিতাই এটা, কিন্তু পলায়নপর নয়-- সভ্যতার উত্থান ও পতন, লিঙ্গের জেগে ওঠা ও ঘুমিয়ে পড়াসহ সবকিছু ছুঁয়ে যেন।

................................................................
আমার সমস্ত কৃতকর্মের জন্য দায়ী আমি বটে
তবে সহযোগিতায় ছিল মেঘ : আলতাফ হোসেন

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

তীরন্দাজ এর ছবি

আমার পা নেই, তাও আমি কত্থকের বোলে পদ্ম ফোটাতে, পাহাড়ের গ্রীবা ঘেঁষে থাকা রঙধনু ছুঁতে হামাগুড়ি দিই।
আমার জিহ্বা কাটা, অথচ আমি হাজার রাতের গল্প নিয়ে বসে আছি।
বর্ণ পরিচয় নেই আমার, শুধু লিখতে বসেছি মহাকাব্য।
আমি কথা বলতে পারি না, তবে মিহি সুরে ঘুম এনে দিতেও পারি।
শুধু একথোকা রাতের খুব প্রয়োজন।

অসাধারণ!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।