রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষিত, একটি ব্যক্তিগত বোধ

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: শনি, ৩০/০৮/২০০৮ - ৯:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলাদেশের রাজনীতি তার স্বরূপে ফিরছে বোধ হয়, এতোদিন একটা উপরি-স্থিরতা বজায় রাখার সমূহ চেষ্টা করা হয়েছিল। নাকি এই উপরি-স্থিরতা দিয়ে অতলে চলছিলো অনেক খেলা? বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন একটি রচনায় লিখেছিলাম, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপকর্মকে ঢাকা দেওয়ার জন্য এবং এসব অপকর্মের হোতাদের ভয়ংকর জনরোষ থেকে কিছুদিন দূরে সরিয়ে রেখে জনমানসে নতুন “দুর্নীতি-বিরোধী বীজ” পুঁতে দিয়ে, নতুন করে তাদের ফিরিয়ে আনার কৌশলটা মন্দ নয়। কারণ বিএনপি-জামায়াতের সামরিক ফ্রন্ট হিসেবে বাংলাদেশের সেনা বাহিনীর কাছ থেকে নতুনতর কিছু আশা করা যায় না। আমার সেই লেখায় অনেকেই গোসসা করেছিলেন এবং আওয়ামী লীগ-পন্থীদেরও কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন, মাসুদা, আপনি ভুল করছেন, এই সেনা বাহিনী আর আগের সেনা বাহিনী এক নয়। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে, পঁচাত্তরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত তারা করবে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে। যেহেতু বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই লেখালেখিতে স্ব-প্রণোদিত সেন্সরশিপ আরোপ করতে হয়েছে, তাই আর একথা লেখার সাহস পাইনি যে, সেনা বাহিনী কেন সেই স্বীকৃতি দেবে? তারা কোথাকার কোন্ “ভাউড়া” যে তাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি নিতে হবে?
দেখলাম, আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য হাত-পা বাড়িয়ে আছ।কিন্তু দ্যাখা গ্যালো তাদের নেত্রীকে গ্রেফতার করা হলো, দল ভাঙানোর চেষ্টা হলো এবং একের পর এক আওয়ামী লীগ বিরোধিতার নামে দেশ ও জাতির বিরোধীতা শুরু হলো। এসব নিয়ে কথা বলা বা লেখার জায়গা নেই, ঢাকার যে সব পত্রিকায় লিখতাম সেসব জায়গা থেকে সম্পাদক বলতে লাগলেন, একটু রয়ে-সয়ে। কী আর করা রইলাম সয়ে। এখন দেখছি সইতে সইতে সর্বংসহা হয়েও কাজ হচ্ছে না। জেল হত্যা মামলার রায় হলো, আত্মস্বীকৃত খুনীদের বেকসুর খালাশ দেওয়া হলো। এরপর আসবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, তাতেও একই রকম রায় হবে, কারণ রায়টা তো লেখা হচ্ছে সেনা সদর দফতরে। সেনা বাহিনী এই সুযোগ কি ছাড়বে? যা দিয়ে নিজেদের পাপ মোচন করা যায়? আদালতের মাধ্যমে একবার যদি হালাল করে নেওয়া যায় তাহলে সেনা বাহিনী কেন সেই পাপ আর বহন করবে বলুন?
এই কিছুদিন আগেও শেখ হাসিনা জামিনে মুক্তি লাভের পর বিএনপি-জামায়াত শিবির থেকে হৈ হৈ রৈ রৈ শোন গ্যালো, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছে, আর খালেদা জিয়া আপোসহীন হয়ে জেলের ভেতর বসে আছেন।শেখ হাসিনা মুক্তি লাভ করে মনে করেন তিনি জয়ী আর কারাগারে বসে খালেদা জিয়া তাই দুই মহাসচিব (এখনতো আর বিএনপি বলে আলাদা কিছুই নেই, জামায়াত নেতা মুজাহিদ আসলে খালেদা জিয়ার বৈতরণী পার হওয়ার কাণ্ডারী। জামায়াত এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল স্বাধীনতার পর থেকেই)কে নিয়ে বৈঠক করেন।এখন বোঝা যাচ্ছে আঁতাত কারে কয়! কতো প্রকার ও কি কি? রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিবৃত্তির শূন্যতা আবারও প্রমাণিত হলো। আর সাথে সাথে বোঝা গেলো, বাঙালি জাতি কতো বেকুব, লাঠি দেখিয়ে নিমের বড়িও এই জাতিকে গুড়ের দলা বলে গেলানো যায়, তারা সোনামুখ করে খেয়েও নেয়।
এটা সেই জাতি, কোটি কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ লুন্ঠনকারী তারেক জিয়ার জন্য এই জাতির সোনার ছেলেরা মাঠে নামে, ব্যবসায়ীকে পুড়িয়ে-পিটিয়ে হত্যা করে, তারেক জিয়ার মতো এক দামড়া বাথরুমে পড়ে যাওয়ার খবর শুনে। আবার নিহত ব্যক্তির স্ত্রীর কাছে দামড়ার মায়ের পাঠানো ফুল তার স্ত্রী বহন করে নিয়ে যাওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। হা ঈশ্বর, সইতে সইতেতো সেয়ানা হয়ে গেলাম!!!
এবার আমাদের অপেক্ষার পালা। একের পর এক নতুনত্ব যোগ হবে রাজনীতির খেলায়। আর সেখানে আমি নিশ্চিত আওয়ামী লীগ দর্শক, আর খেলোয়াড় বিএনপি-জামায়াত। আমার দেখতে ইচ্ছে করছে এবার নিরপেক্ষ সুশীলরা কি ভূমিকা গ্রহণ করেন সেটা। তবে এটাও বুঝতে পারছি যে, আবারও তারা আওয়ামী লীগের ঘাড়েই দোষ চাপাবেন। বলবেন, শেখ হাসিনাই দোষী।অবশ্যই শেখ হাসিনা দায়ী।সেনা বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে তার জন্য; সেনা বাহিনী বার বার ক্ষমতা দখল করেছে সে জন্য, ক্ষমতায় বসে দুর্নীতি দিয়ে দেশটাকে ডুবিয়েছে এবং রাজনীতিবিদদের ক্রনিক্যাল দুর্নীতিবাজ করে তোলার জন্য; আরও অনেক কিছুর জন্য। আসলে আমাদের একজন কেউ তো লাগবে যাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়, আর শেখ হাসিনা সে জন্য উপযুক্তও বটেন। ভাবছি, শেখ হাসিনার পর সেই জায়গাটি কে অলংকৃত করবেন?
এই সচলায়তনে আমাদের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন নিয়ে প্রথম প্রথম অনেক লেখা দেখতাম। আজকাল সেসব কথা তেমন একটা শোনা যায় না। এর কারণ কি আমাদের জাতীয়-ঝিমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? যেমন আমরা বর্তমান সরকারের নানা ফন্দি-ফিকির দেখতে দেখতে এখন ঝিমিয়ে পড়েছি।এখন আর কোনও জাহাঙ্গিরের মরদেহ আমাদের বিচলিত করে না।আমরা আশ্চর্য হই না জাতীয় নেতাদের জেলের ভেতর নৃশংস ভাবে হত্যাকারীদের রাষ্ট্রের নির্দেশে মুক্ত করে দিলে। আসলে সেনা বাহিনী বোধ করি আমাদের জাতীয় ভাবে ধ্বজ-ভঙ্গ করে দিয়েছে।আচ্ছা ঠিক আছে, জাতীয় ভাবে না হোক, রাজনৈতিক ভাবে তো বটেই।কী বলেন আপনারা?


মন্তব্য

আড্ডাবাজ এর ছবি
প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এগুলা সবি তো আমাদের রাজনীতির। শোনা যায় তারেকের কোটি টাকা নাকি জলিলের ব্যাংক দিয়েই চলে গেছে। অবিশ্বাস করি কিভাবে, এরা যে একে অপরের পরিপূরক তাতো বহুবারই প্রমাণ হয়ে গেছে। এতদিন এদেরকে মাইনাস করার যে মূলা ঝুলিয়ে সবাইকে আস্বস্ত করে রাখলো সে মূলা এখান শুকিয়ে গিয়েছে। নির্বাচনে আবারো সেই চোর-বাটপারেরাই নির্বাচিত হয়েছে। ফলে যে লাউ সেই কদু। আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে বক্তৃতার মঞ্চে, ব্লগের পাতায়, পত্রিকার কলামে -- রাজা উজির মেরে। বেশ দু:খ পাই যখন দেখি যারা আর্মির সমালোচনা করেন তারা রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলেননা। ১৯৯১ থেকে তো সবাইকেই দেখা হলো। সবাই যে একই মূদ্রার এপিঠ -ওপিঠ তা তো আর লুকানোর কোনো ব্যাপার না। আমাদের একটা সমস্যা হলো আমরা দেশের আগে কে আওয়ামী লীগ আর কে বিএনপি সেটা বিচার করি। একটাকে সমর্থন দিতে গিয়ে উটপাখির মত বালিতে চোখ গুজে রাখি।

তারেককে যখন ধরা হয় তখনই এই ব্লগে কে যেন আশংকা প্রকাশ করেছিলেন যে এরা একদিন ফুলের মালা গলায় দিয়ে বেরিয়ে আসবে। সেই আশংকাই ঠিক হতে যাচ্ছে।

আমাদের দেশ হল সেই কবিতার ছাগলের মত:

একদা ব্যঘ্রের কবলে পড়িয়াছিল এক পথহারা ছাগ
উদ্ধারে আনিল তাহারে এক সাধু মহাভাগ..
...
...
বৃক হতে উদ্ধারিয়া পুন বৃক সাজিলা আপনি।

সাধক শঙ্কু এর ছবি

আমার একটা অনুমান আছে।

আমার ধারণা আওয়ামী লীগ আর লগে আরো কিছু দল নির্বাচনে যাইবো, বিএনপি-জামাত যাইবো না। আওয়ামী লীগ নাচতে নাচতে সরকার গঠণ করবো। সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও থাকবো না। তারপর হয় :

১) জামাত-বিএনপির নেতৃত্বে একধরণের আন্দোলন টাইপ কইরা আওয়ামী লীগরে ফালাইয়া আবার ক্ষমতায় বইবো, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হিরু হিসাবে।

অথবা

২) নির্বাচন করতে দিলেই আপনারা খালি ক্যাচাল করেন...সো নো মোর নির্বাচন এইবার সরাসরি মাশাল্লাহ্ !

অথবা

৩) আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই পার্টিই রাজী হইবো কিন্তু প্রচারণার সময় পলিটিক্যাল রায়ট লাগাইয়া ( এই কাজে আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রত্যক্ষ সহায়তা করবো ) ১/১১ র নতুন ভার্সন আইবো।

এইরকম না হইলেই খুশী হই। কিন্তু হইবার সম্ভাবনা ব্যপক।


খোয়াব উড়ে
মিচকা ঘোড়ার কানপাখাতে
মাইট্যা খোলের
বুকের ভিতর শুকনা তাঁতে
ডিগবাজী খায়
খর-বিচালির আস্তাবলে
রাস্তা প্যাচায়
দমভরসার চিমনি জ্বলে


গড়ি দালানকোঠা ফেলে দিয়ে শ্মশাণে বৈঠকখানা

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমার মনে আছে, ১/১১ এর ঠিক পর পর হাওয়া যখন আওয়ামী লীগের আপাতঃ অনুকুলে সেই সময়ে গাফফার চৌধুরী তার এক লেখায় বাংলাদেশে সেনাবাহিনী সম্পর্কে উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন ।

তাঁর মতো অভিজ্ঞ মানুষের এই আশাবাদে আমার মতো সামান্যজন খুব আশাহত হয়েছিলো ।

'৭২ থেকেই যে সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়েছে, গত ৩৭ বছরের অনেকগুলো অভ্যুত্থান পালটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিকেশ করে দিয়ে পাক অফিসারদের বসানো হয়েছে( মার্শাল তোয়াব, জেনারেল এরশাদ হয়ে গোলাম আজমের পুত্রটি) , যে সেনাবাহিনী বারবার সংবিধানকে গিলে খেয়েছে সেই সেনাবাহিনী নিয়ে আশাবাদ!

আর শেখ হাসিনা-ভদ্রমহিলার বিশ্রী বদভ্যাস আগ বাড়িয়ে ঝোল নিজের পাতে টানার চেষ্টা করা এবং এটা করতে গিয়ে শেষপর্যন্ত লুসার হওয়া ।

'৭৫ এর পরের আওয়ামী লীগ এমন এক রাজনৈতিক দল যে তার নিজের নেতাকর্মী সমর্থক শুভাকাংখীদের বিশ্বাস কিংবা ভরসা করেনা । শেখহাসিনার নেতৃত্ব তার নেতাকর্মীদের উপর ভরসা না করে একবার সেনাবাহিনী আরেকবার মোল্লাবাহিনীর উপর ভর করে বৈতরনী পার হতে চায় ।

ফলতঃ ডুবে এবং ডুবায় ।
-------------------------------------
"শিয়রের কাছে কেনো এতো নীল জল? "

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ধ্রুব হাসান এর ছবি

এই বিষয়ে মন্তব্য করা যেমন অর্থহীন তেমন গলাবাজিও অর্থহীন। তবে একটা জিনিষ গোটা বিশ্ব রাজনীতি ও দেশীয় রাজনীতি থেকে জেনেছি, 'সব রসুনেরই মূল এক'।

আবির আনোয়ার [অতিথি] এর ছবি

ধ্রুব হাসান এর সাথে একমত। সব শেয়ালের এক ডাক।

অতিথি লেখক এর ছবি

দেখুন আমার সব সময়ই মনে হয় বি এন পি হচ্ছে বাংলাদেশের সামরিক বে-সামরিক আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিক ফ্রন্ট। ১/১১ তে ক্ষমতার মুখোশ পরিবর্তিত হয়েছে মাত্র,ক্ষমতা রয়ে গিয়েছে একই জায়গায়। জল ঘোলা করা হয়েছে বি এন পির পাঁচ বছরের দুষ্কর্মকে রাজনীতির ঘাড়ে চাপিয়ে লঘু করার জন্য।

এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে আমাদের নয়া-শিক্ষিত সুবিধাবাদী শ্রেনীর বিচারবোধহীনতার কারনে। তারা দিন দিন বারবণিতা আর সাধ্বী নারীর তুলনা বিচারের ক্ষমতাও হারাচ্ছে।

তবে আমি আশাবাদী, জনগণের বিজয় হবেই, কারণ আমাদের বেশিরভাগ মানুষ এখনও চাষা আর ঢাকার রাজপথ এখনও রিক্সাওয়ালাদের দখলে।

- অপ্রিয়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।