ভি এস নাইপল – নোবেল বিজয়ী আত্মম্ভরী মর্ষকামী

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: মঙ্গল, ২৩/০৯/২০০৮ - ১:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্যার ভিদিয়া প্রসাদ নাইপল, যিনি ভি এস নাইপল হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত, বাঙালি পাঠকের সঙ্গে তার পরিচয় শুধুমাত্র সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হিসেবে নয়, বরং উপমহাদেশ বিশেষ করে ভারতবর্ষ সম্পর্কে তার সরস-বিরস রচনার কারণেও।কলোনিয়াল যুগের লেখকদের মধ্যে যিনি এখনও সাবেক কলোনীসমূহকে মূলতঃ নীচু স্তুরের সমাজব্যবস্থার আবহে রেখেই বিচার করেন তিনি নাইপল। নিজের লেখক সত্ত্বা নিয়ে এই নোবেল বিজয়ী লেখকের অসীম গর্বই শুধু নয়, তিনি কলমের এক খোঁচায় উড়িয়ে দিয়েছেন অতীতের অনেক লেখকের লেখনীকে। এমনকি ব্যক্তিগত ভাবেও অনেক নোবেল বিজয়ী কিংবা জনমানস-বিজয়ী লেখকে আক্রমণ করেছেন অত্যন্ত কদর্য ভাবে। ই এম ফস্টারের মতো লেখককে তিনি আক্রমণ করেছেন এভাবে, “ভারত সম্পর্কিত ই এম ফস্টারের জ্ঞান-গম্মি তো বাগানের তরুণ মালিদের কাছ থেকে আহরিত। ফস্টার এইসব বালক মালিদেরকে নিজের ঘরে ডেকে এনে বিছানায় টেনে নিতেন এবং তারপর সঙ্গমান্তে ভারত সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতেন”। অথচ সম্প্রতি প্রকাশিত ভি এস নাইপলের জীবনী “দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ হোয়াট ইট ইজ – দ্য অথোরাইজড বায়োগ্রাফি অব ভি এস নাইপল”-এর লেখক প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ বলেছেন, “ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য ভিএস নাইপল অধীর অপেক্ষায় ছিলেন, আর এই গোটা সময়টা তিনি অত্যন্ত বন্য প্রেমাক্রান্ত ছিলেন একজন আর্জেন্টিনিয়ান মহিলার সঙ্গে, শুধু তাই-ই নয়, তিনি একজন গ্রেট প্রস্টিট্যুট ম্যান এবং স্ত্রীর মৃত্যুর মাত্র সপ্তাহ খানেকের মাথায় যিনি একজন পাকিস্তানী নারীকে বিয়ে করেন, যাকে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন স্ত্রীকে মৃত্যুসয্যায় রেখেই”। এই নাইপলই আবার তার নতুন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে পুরাতন স্ত্রীর কবরে ফুল দিতে দিতে জীবনী-লেখকের সামনে উচ্চারণ করেন, “কেউ কেউ হয়তো একথাও বলবেন যে, আমি তাকে (স্ত্রী প্যাটরিসিয়াকে) হত্যা করেছি”- বলতে বলতে ছোট্ট সুন্দর শান্ত কবরস্থানের পাশে দাঁড় করানো গাড়ির ওপর নিজেকে ঠেস দিয়ে দাঁড় করান এবং নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না শেষ পর্যন্ত।

ভি এস নাইপলের জীবনীগ্রন্থে আমরা যে নাইপলের সঙ্গে পরিচিত হই, তার সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত, তার লেখনীর মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে ইনি সেই নাইপল, যার পূর্বপুরুষ বিশেষ করে যার বাবাকে ভারত থেকে ত্রিনিদাদে নিয়ে আসা হয়েছিল আঁখ-চাষী হিসেবে কাজ করানোর জন্য; যার বাবা শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গিয়েছিল, এই দেশত্যাগ এবং প্রচণ্ড পরিশ্রমের যন্ত্রণা সইতে না পেরে। যার কথা আমরা জানতে পারি ভি এস নাইপলের “এ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস”-এ। যে দারিদ্র ও কষ্টে নাইপল তার শিশুকাল অতিক্রম করেছেন তা তাকে অধ্যবসায়ী করেছিল সন্দেহ নেই এবং এর ফলেই ১৯৫০ সালে অক্সফোর্ডে পড়তে আসেন বৃত্তি নিয়ে। পঞ্চাশের দশকের অক্সফোর্ড, খুব সহজ বা স্বাভাবিক কোনও জায়গা নয়, কলোনিয়াল যুগের বৃত্তবাণদের মেইজ বা গোলকধাঁধা হিসেবেই আমরা সেই অক্সফোর্ডকে চিনি। যে পারিবারিক বা সামাজিক অবস্থা থেকে নাইপলের আসা, সেখান থেকে এসে এই এ্যারিস্ট্রক্রেসির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়াটা খুব সহজ ছিল না মোটেও। তারপরও নাইপল নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন বোঝা যায়, নইলে সেই সমাজের গলি-ঘুপচিতে ঢোকার পথ করে নেোয়াতে তিনি সফলই হয়েছিলেন বলতে হবে।
তবে অক্সফোর্ড থেকে লেখাপড়া শেষ করে যখন লন্ডন আসেন তখন থেকেই আমরা নাইপলকে চিনতে শুরু করি। কারণ অক্সফোর্ডে তার জীবন নির্বাহ হতো বৃত্তির অর্থে কিন্তু লন্ডনে তাকে জীবন যাপনের ভারটি তুলে নিতে হয় নিজেরই হাতে। বেঁটে, কালো, শ্বাসকষ্টে ভোগা এই ভারতীয়কে কেউই তখন কোনও চাকুরি দিতে আগ্রহী হয়নি। একের পর এক ২৬টি চাকুরিতে আবেদন করেও নাইপল কোনও চাকুরি পাননি।শুধুমাত্র আলু সেদ্ধ খেয়ে থাকাটাও তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। এই কষ্টে একমাত্র আশ্রয় ছিল প্যাট্রিসিয়া। যার সঙ্গে অক্সফোর্ডে থাকাকালীনই নাইপলের পরিচয় হয়েছিল এবং সেই সময় প্যাট্রিসিয়া বা প্যাট একটি স্কুলে পড়ানোর চাকুরি করতেন।

প্যাট্রিক ফেঞ্চ-এর লেখা নাইপলের জীবনীতে আমরা নাইপলকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখতে পাবো এই প্যাট্রিসিয়া বা প্যাট-এর দৃষ্টিতে, যা তার জীবিতকালে তিনি কোথাও বলেননি, অথচ তার ডায়েরীর পাতা ভর্তিকরে তিনি লিখে রেখে গিয়েছেন।আরও একটু বাড়িয়ে বলতে গেলে বলতে হবে যে, নাইপলের এই জীবনী আসলে প্যাট-ট্রাজেডি বা প্যাট্রিসিয়ার করুণ জীবনীও।অক্সফোর্ডে যখন নাইপলের সঙ্গে প্যাট-এর পরিচয় হয়, তখন তাদের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া চিঠিগুলি ছিল সংবেদনশীল, প্রেমময় এবং আশাব্যঞ্জক। নিজের পরিবারের সঙ্গে অত্যন্ত কঠোর দান্দ্বিক সংঘাতান্তে প্যাট নাইপলকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের কিছুকাল পরেই সম্পর্কটি কেমন যেনো ভুল আর ভ্রান্তির যোগফল বলে মনে হয়। অত্যন্ত খুঁতখুতেঁ স্বভাবের নাইপল, যে নিজেকে নিজের কাছেই সম্পূর্ণ প্রকাশে অক্ষম, তার সঙ্গে নিজের জীবনকে জুড়ে প্যাট কি ভুল করেছেন কি না এই প্রশ্ন প্রথম থেকেই তার মনে হতো। নাইপলের কাছে বিয়ের আংটি চেয়েও পাননি প্যাট, শেষ পর্যন্ত নিজেই একটি আংটি কিনে নেন। এর চেয়েও বড় কথা হলো, প্যাট কখনওই নাইপলকে শারীরিক ভাবে আকর্ষণ করেননি। নাইপল একথা জোর দিয়েই বলেছেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভালোবাসার মাঝে যৌন আকর্ষণহীনতা কোনওই প্রভাব ফ্যালে না। বিষয়টি নিয়ে প্যাট আলোচনা করতে চাইলেও নাইপল কখনোই তাতে আগ্রহী হননি। যে কারণে নাইপল তার শারীরিয় ক্ষুৎ-পিপাসা মেটাতে বেশ্যাগমনকে বেছে নেন আর প্যাট আশা করতে থাকেন একদিন, কোনও একদিন নাইপল তার প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করবেন। যদিও সেদিন কোনও দিনই আসেনি।

বরং ১৯৭২ সালে নাইপলের পরিচয় হয় এক এ্যাংলো-আর্জেন্টিনিয়ান নারীর সঙ্গে, যার নাম মার্গারিট মারে। প্রথম দেখাতেই ভালোবাসা হয়নি তাদের মধ্যে, যদিও প্রথম দেখাতেই নাইপল তাকে শারীরিক ভাবে চেয়েছেন। দু’জনের সম্পর্কটি ছিল শারীরিক ফাঁস, মূলতঃ নাইপল মার্গারিটকে চেয়েছেন একজন যৌন-দাসী হিসেবে আর মার্গারিটও নাইপলকে একজন সেক্স-মাস্টার হিসেবে পেয়ে খুশী হয়েছেন। এই যৌনতা ছিল উদ্যাম, কখনও কখনও ভয়ংকর। নাইপল স্বীকার করেছেন যে, তিনি আসলে কোনও নারীকে সাধারণ ভাবে ভোগ করতে চাননি কোনওদিন। তিনি নারীকে চেয়েছেন যথেচ্ছা ভোগ করতে, একজন যৌন-দাসী হিসেবে, যাকে যখন যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে ভোগ করতে। নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিছানায় নিয়ে কষ্ট দেয়ার মাঝে নাইপল পেতেন চরম আনন্দ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোনও শিক্ষিত নারী নাইপলকে যৌনভাবে আকর্ষণ করে না, তার কাছে নারীর অশিক্ষা এবং অনাধুনিকতা যৌনতা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। সেদিক দিয়ে মার্গারিট সত্যিকার অর্থেই একজন অশিক্ষিত এবং যার ইংরেজি শব্দের ভান্ডার মাত্র পঞ্চাশটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। নাইপলের কাছে মার্গারিট ছিলেন তাই শুধুমাত্র একটি যৌনবস্তু, বিছানায় নিয়ে আগাপাশতলা ভোগ করার যন্ত্র-বিশেষ। কারণ যখন মার্গারিট তার কাছ থেকে দূরে থেকেছে তখন নাইপল মার্গারিটের লেখা কোনও চিঠি খুলে দেখতে পর্যন্ত আগ্রহী হননি, পড়ে দেখাতো দূরের কথা। কিন্তু তারপরও দীর্ঘ ২০ বছর ধরে নাইপল এবং মার্গারিট তাদের শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং মার্গারিট অকপটে স্বীকার করেছেন যে, “নাইপলের সঙ্গে আমি যা করেছি তা অন্য কারো সঙ্গে আমি অসুস্থ বোধ করতাম কিন্তু আমি তারপরও নাইপলের জন্য অপেক্ষা করতাম; আমার শরীরে নাইপল যে ক্ষতচিহ্ন করতো অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে আমি তা উপভোগ করতাম; একবার নাইপল আমাকে দু’দিন ধরে এমনভাবে পিটিয়েছিল যে, নাইপলের নিজেরই হাত ফুলে গিয়েছিল, আমার মুখ-চোখ ফুলে গিয়েছিল, আমি মানুষের সামনে বেরুতে পর্যন্ত লজ্জা পেতাম”।

মার্গারিট তার তিন সন্তান এবং স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন এই আশায় যে, নাইপল তাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু নাইপলের জন্য প্যাট তখনও অত্যন্ত প্রয়োজনের। তার সাহায্য ছাড়া নাইপলের টিকে থাকাটাই অসম্ভব ছিল। যে কারণে তিনি প্যাটকে সব সময় এই ভয়ও দেখাতেন যে, তিনি ইচ্ছে করলেই মার্গারিটের কাছে চলে যেতে পারেন। দু’জন নারীর মাঝে হিংসের এক দেয়াল খাড়া করে নাইপল নিশ্চিন্তে সেই দেয়াল ধরে হেঁটেছেন সামনের দিকে, যা প্যাট্রিসিয়াকে ক্রমশঃ ক্ষয়ের দিকে টেনে নিয়ে গেছে, ক্রমশঃ নিঃশেষ করে চলেছে এই যাতনা। নিজের এই অবস্থাকে প্যাট তার ডায়েরীতে লিখেছেন “মূর্খামি” হিসেবে। অতিথিদের সামনেই নাইপল তাকে আক্রমণ করেছেন, কাঁদিয়েছেন কিন্তু একই সঙ্গে চেয়েছেন প্যাট্রিসিয়া তার সাজগোজের আড়ালে এই কান্নাকে ঢেকে রাখবেন। নাইপল অবশ্য অকপটেই মার্গারিটের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের কথা প্যাটকে জানিয়েছিলেন, প্যাট কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু তার ডায়েরীতে নাইপলকে তারপরও ভালোবাসার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন নাইপলকে “জিনিয়াস” হিসেবে উল্লেখ করে।

মার্গারিট তিন তিনবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। প্রথমবার নাইপল তাকে একটি চেক পাঠিয়েছেন গর্ভপাত করার জন্য। কিন্তু পরের দু’বারে নাইপল কোনো অর্থ পাঠানোর মতোও পদক্ষেপ নেননি, যেনো সন্তানধারণের সমস্ত দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণই মার্গারিটের একার। মার্গারিট নিজেকে এ জন্য “একজন খুনী” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, যখন শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে খানিকটা মানসিক বিকৃতি দেখা দেয়, তখন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ভি এস নাইপলের মতো একজন নোবেল বিজয়ী লেখক, যিনি এতোকাল যাবত কেবলই অন্য লেখক, অন্য দেশ এবং আদর্শের কট্টর এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে কদর্য সমালোচনা করেছেন তিনি কেমন করে তার জীবনের এইসব অন্ধকার দিকগুলি সহ তার জীবনী প্রকাশের অনুমতি দিলেন? এরকম প্রশ্ন নাইপলকে অনেকেই করেছেন কিন্তু তিনি একেবারে চুপ, কোনও উত্তর দেননি। এমনকি এই বই এবং এর লেখকের বিরুদ্ধে কোনও মামলাও ঠুকে দেননি। এখানেই নাইপলের বিশেষত্ব এবং এটাই এখন পশ্চিমের সাহিত্য-জগতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ শুধুমাত্র নাইপলের জীবনের ঘটনাবলীই লেখেননি, সঙ্গে সঙ্গে নাইপলের জীবনের এসব ঘটনাবলীর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও হাজির করেছেন।যেমন নাইপলের জন্ম, মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে বেড়ে ওঠা, ভারতে তার জন্মসূত্রে পাওয়া ব্রাক্ষ্মণ্যত্যের বড়াই আদৌ সত্য কি সত্য নয় ইত্যাদির সঙ্গে নাইপলের জাত্যাভিমান এবং কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে প্রচণ্ডরকম ঘৃণা এবং বিদ্বেষ পোষণের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। নাইপল ভারতবর্ষ সম্পর্কে অভিযোগ করতে গিয়ে একদা লিখেছিলেন যে, ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষ খোলা যায়গায় মলত্যাগ করে, ট্রেনে ভ্রমণকালে তিনি জানালার ধারে বসে ভারতের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক শোভার বদলে দু’পায়ের মাঝে মাথাটি গুঁজে দিয়ে কদাকার পশ্চাৎদেশটি দৃশ্যমান করে মলত্যাগের দৃশ্যই বেশি দেখেছেন। অথচ কিন্তু তার শৈশবে তিনি যেখানে মানুষ হয়েছেন সেখানে অবারিত আঁখ ক্ষেতের মাঝেই তিনিও মলত্যাগ করেছেন, এমনকি তার পরিবার যে বাড়ির চৌহদ্দিতে শৌচাগার নির্মাণের বিরোধী ছিল কারণ তাতে বাড়ির পবিত্রতা নষ্ট হয়, সেটাই হয়তো শিশু নাইপলের মনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল যে কারণে বিখ্যাত হওয়ার পরে ভারত ভ্রমণে গিয়ে প্রথমেই ট্রেনের জানালা দিয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে পড়ার আগে তার দৃষ্টি পড়েছিল মলত্যাগরত ভারতবাসীর ওপর। আবার এও হতে পারে যে, তার কলোনিয়াল মানসিকতা মূল ব্রিটেনকে অনেক উঁচুতে বসানোর লক্ষ্য নিয়ে ব্রিটেনের ছেড়ে আসা ভারতকে খাঁটো করার উদ্দেশ্য নিয়েই এসব লিখিয়েছিল তার কলম দিয়ে।

প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চের বইটি প্রকাশের পর নাইপলের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পরবর্তীতে যাকে নাইপল একেবারেই দেখতে পারতেন না সেই বিখ্যাত ভ্রমণ-বিষয়ক লেখক পল থেরো এক রচনায় নাইপল সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য প্রকাশ করেছেন, যা পাঠকের মনে নাইপল সম্পর্কে যথেষ্ট ঘৃণার উদ্রেক করে বলে মনে হয়। নাইপলকে তিনি একবাক্যে একজন মর্ষকামী এবং যৌন-প্রতারক বর্ণবাদী হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।তবে ২৫ বছর আগে একদিন কেনিয়ার রাজধানী মোম্বাসায় নাইপল এবং পল থেরো একসঙ্গে ভ্রমণকালে নাইপল আকন্ঠ পানরত অবস্থায় বলেছিলেন, “ইংরেজি ভাষায় আমিই শ্রেষ্ঠ লেখক। আমি এখন একজন নতুন মানুষ, যেমনটি মন্টেইন ছিলেন” – পল প্রশ্ন তুলেছেন, মন্টেইন কি প্রতিনিয়ত বারবণিতার কাছে শারীরিক শান্তি খুঁজতো কি? মন্টেইন কি রেস্টুরেন্টের খাবার পরিবেশনকারীদের অপমান করতো? না মন্টেইন তার রক্ষিতাকে বেধড়ক পেটাতো?

পল থেরো নাইপল সম্পর্কে লেখা বইটি জমা দিয়েছিলেন প্রকাশের কাছে কিন্তু প্রকাশকের আইনজ্ঞরা ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন, “মাথা খারাপ? এই বই প্রকাশিত হলে নাইপল কোটি কোটি পাউন্ডের মামলা ঠুকে দেবে”। এমনকি বইটি প্রকাশের পূর্বে সমালোচকদের কাছে পাঠানোর পর তারা বলেছিলেন, “বন্ধুত্বের সঙ্গে বেঈমানি” এবং “অমূলক প্রতিচ্ছবি”, এবং এসব কারণেই পল থেরোর বইটি তখন প্রকাশিত হয়নি। এখন প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ লিখিত নাইপলের জীবনীকে পল থেরো তাই জীবনীগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ, তিনি এই গ্রন্থকে বরং আত্মম্ভরিতার কেস-স্টাডি বা উদাহরণ হিসেবেই বর্ণনায় আগ্রহী, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছেন নাইপল, লেখক নাইপলের অবস্থান যার থেকে যোজন দূরত্বে। এই গ্রন্থের নাইপল একজন বেশ্যাগামী অসুস্থ যৌনতাক্রান্ত পুরুষ; যিনি একজন অসুস্থ স্ত্রীকে মৃত্যুসয্যায় রেখে নারী-শিকারে বের হন, যে স্ত্রী কিনা তার প্রতিষ্ঠার মূলে; যিনি নিকৃষ্ট মানসিকতার অধিকারী; বদরাগী; দুঃখ-বিলাসী; বর্ণবাদী এবং সব দিক দিয়ে ধংসাত্মক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পল থেরো মনে করেন যে, এই গ্রন্থ প্রকাশের ফলে একজন নোবেল বিজয়ী লেখক হিসেবে নাইপলকে আর কেউ মনেই রাখবে না, বরং তাকে তার উপরোক্ত চরিত্র-গুণের কারণেই মানুষ মনে করবে।

পল থেরো তার এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন, একজন লেখকের জীবনী পাঠ করতে গিয়ে পাঠক সাধারণতঃ অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ, ব্যক্তি এবং চরিত্রের কথা জানতে পারেন যা সেই লেখককে নানাভাবে অনুপ্রাণিত বা ভাবিত করেছিল। কিন্তু নাইপলের জীবনীতে আমরা তেমন কিছুই পাই না। আমরা শুধু জানতে পারি যে, নাইপলের পিতার মধ্যে লেখক গুণাবলী ছিল। আর বাকি সবাই যেমন জেমস জয়েস, ডিকেন্স, ই এম ফস্টার, জেন অস্টিন, এ্যান্থনি পাওয়েল, ডেরেক ওয়ালকটসহ আরও অনেকেই অ-লেখক, তাদের কোনওই সৃষ্টি নেই, যারা এদেরকে পাঠ করেন তারা বোকা কিংবা সাহিত্য সম্পর্কে তাদের কোনও জ্ঞান নেই। তবে হ্যাঁ প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ লিখিত নাইপলের এই জীবনী নির্ঘাত নাইপলকে সবার চেয়ে আলাদা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে, যেমনটি নাইপল নিজেই দাবী করে থাকেন।

তবে আশ্চর্যের যে, নাইপল কী করে তার এই জীবনী প্রকাশের অনুমতি দিলেন? পল থেরো’র মতে, “হয় নাইপল এই বই প্রকাশের আগে একবারও এটি পড়ে দেখেননি, তার পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত স্ত্রী নাদিরার তো পড়ে দেখার প্রশ্নই আসে না কারণ তিনি ডাইলেক্সিয়াতে ভোগেন; তার মানে এটাই হতে পারে যে, নাইপল এই বই সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিস্সৃহ এবং তিনি এর দিকে পেছন ফিরিয়ে রেখেছেন, যেমনটি তিনি আজীবন করেছেন, জীবনের অনেক কিছু থেকেই তিনি পেছন ফিরে আছেন”।

আশ্চর্যের যে, নাইপল আফ্রিকান কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানসিকতাকে দাসবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার দায়ে দায়ী করেছেন। নাইপল কোনও রকম রাখঢাক না করেই বলেন, “প্রিন্সেস ডায়ানার কবরের ওপর নিগ্রোরা উপুর হয়ে কাঁদছে” অথবা “লন্ডনের রাস্তায় নিগ্রো শিশুদের চিৎকার এবং দৌঁড়-ঝাঁপ আমার চিন্তাকে বাঁধাগ্রস্ত করে”। নাইপলের এই বর্ণ বিদ্বেষের পেছনেও কারণ খুঁজতে গিয়ে প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ আবিষ্কার করেন, নাইপলের মায়ের লেখা এক চিঠি, যেখানে তিনি বলেছেন, “আমি তোমার কাছে একটিমাত্র ভিক্ষে চাই, দয়া করে কোনও শ্বেতাঙ্গ মেয়েকে বিয়ে করো না, কখনওই না”। নাইপল অবশ্য তার মায়ের এই “ভিক্ষে”-কে পাত্তা দেননি, তিনি বিয়ে করেছেন শ্বেতাঙ্গ প্যাট্রিসিয়াকে, যাকে তিনি তার গৃহপরিচারিকা হিসেবে ব্যবহার করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত বাধ্য করেছেন একজন মাদকাসক্ত এবং ক্যান্সারাক্রান্ত রোগী হিসেবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে পাকিস্তান ভ্রমণের সময় নাইপল পরিচিত হন তার বর্তমান স্ত্রী নাদিরার সঙ্গে। এবং নাইপল প্যাট্রিসিয়ার মৃত্যু অবধি অধীর এবং ক্ষিপ্ত মন নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন কখন প্যাট মারা যাবেন, যা তিনি প্রায়শঃই প্যাটের সামনে প্রকাশও করতেন, যাতে তিনি নাদিরাকে বিয়ে করতে পারেন। আগেই বলেছি, প্যাটের মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিনের মাথায় নাদিরা এসে ওঠেন নাইপলের উইল্টশায়ারের বাড়িতে।

আসলে প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ নাইপলের জীবনের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে খুঁজে ফিরেছেন এসব ঘটনার অন্তরালে থাকা মনস্তাত্ত্বিক কারণ, যা নাইপলকে অনেকাংশেই বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে অনেক সমালোচকই মনে করেন। সত্যিই কি তাই? যে পুস্তক প্রকাশিত হওয়ার পর নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক, কলোনিয়াল যুগান্তের শেষ দিককার ফসল নাইপল পাঠকের চোখে একজন অস্মিতাপূর্ণ গৃহ-স্বৈরাচারী ও আত্মপীড়ণকারী ব্যক্তিত্বের মাত্রায় নির্মিত হন তাকে আর কতোটা মনস্তাত্বিকতা দিয়ে ঢাকা সম্ভব? তবে ভরসা একটিই, নাইপল কিন্তু এরপরও নিরুত্তর, নিস্পৃহ, বরং এর ব্যতিক্রম হলেই বুঝি এই জীবনী-বর্ণিত নাইপলের সঙ্গে সত্যিকার নাইপলের মিল হতো না।


মন্তব্য

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

রচনাটির সামান্য একটু ইতিহাস আছে। তাহলো, লেখাটি বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত দু’টি দৈনিক প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, অশ্লীলতার দোহাই পেড়ে। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে

s-s এর ছবি

স্বনামখ্যাত দৈনিকগুলোকে বেশি পাত্তা না দেয়াই ভালো। নাইপলের লেখনী আমার বেশ প্রিয় কিন্তু তাঁর উগ্রবাদী রচনা / মনস্তত্ত্ব খুবই উদ্বিগ্নকর। মালগুড়ি ডে'জ এও ছোট ছোট করে অনেক কিছুই ছিলো বোধ করি, স্মৃতি প্রতারণা না করলে। অভিনন্দন আপনাকে, লেখাটির জন্য।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যতদূর জানি "মালগুড়ি ডে'জ" আর, কে, নারায়ণের লেখা। ১৯৮২ তে প্রকাশিত এবং ১৯৮৬ তে দূরদর্শনে চিত্রায়িত। এর বাইরে ভি, এস, নাইপলও কি "মালগুড়ি ডে'জ" নামে কিছু লিখেছেন? জানি না তো।

===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সবজান্তা এর ছবি

হুম মালগুড়ি ডেইজ নারায়ণ এর লেখা।


অলমিতি বিস্তারেণ

s-s এর ছবি

@ ষষ্ঠ পান্ডব: হ্যাঁ আর কে নারায়ণেরই লেখা, স্মৃতি প্রতারণা করেছে অবশ্যই। আমি গল্পটা/ গল্পগুলো মনে করতে পারছি কিন্তু নামটা মনে করতে পারছিনা কিছুতেই, ববি ও লিন্ডা নামে দু'টিচরিত্র আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা যারা আর্মি দ্বারা নির্যাতিত হয় ভ্রমণ পথে, এবং আরও দু'টি গল্প যেখানে এক গৃহভৃত্য তার প্রভুর সাথে ওয়াশিংটন ডিসিতে যেয়ে অবৈধ অভিবাসী হয়ে যায় কিন্তু ভয় ও শঙ্কা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় , সুতরাং লিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট হওয়ার আশায় সে ভিনদেশী এক মহিলাকে বিয়ে করার চিন্তা করে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
মনে করিয়ে দেবেন কি কোন্ বই?
ধন্যবাদ ও শুভাশীষ।

s-s এর ছবি

ভি এস নাইপলের সেই বইটির নাম ইন আ ফ্রি স্টেট ।

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

রেজওয়ান এর ছবি

ধন্যবাদ লেখাটির জন্যে।

বিষয়টি আমাকে ভাবায় যে আমরা কেন লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার রচনার বিচার করতে চাই। আর তার সামাজিক প্রেক্ষাপট আমাদের সমাজের মত না হতেও পারে। কাজেই আমরা কিসের সাথে কিসের তুলনা করছি সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।

গুন্টার গ্রাসের 'এস এস' এর সাথে সম্পৃক্ততার খবর সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত হবার পরও এরুপ সমালোচনার তুফান শুরু হয়। সাম্প্রতিক কালে হুমায়ুন আহমেদকে নিয়েও এমন বিতর্ক হয়েছে।

আমার মনে হয় রচনার প্রতি সৎ থাকাই একজন লেখকের নৈতিকতা হওয়া উচিৎ। একজন পলিটিক্যালি কারেক্ট চরিত্রের লেখকের দ্বারা যদি কোন জনপ্রিয় কিছু প্রকাশিত হয় যা অন্য কারো থেকে নকল করে লেখা তাহলে কি তাকে এরুপভাবে দেখা হবে?

নাইপল সত্যকে আড়াল করতে চান নি এজন্যে ওনাকে সাধুবাদ। বিচারের ভার অবশ্যই তার পাঠকের হাতে।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

তানবীরা এর ছবি

নোবেল প্রাইজ বেশীর ভাহ সময়ই বিতর্কিত। নাইপলের কাহিনী পড়ে অমরেশ পুরীর কথা মনে পড়ছে, ভয় লাগছে।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

নাইপলের Half a Life পড়েছিলাম হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে। আপনার লেখাটা পড়ে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। মানুষের পারসোনাল লাইফের সমালোচনা করা আসলে অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। বায়োগ্রাফি বলে যা প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে খাদহীন সত্যের দেখা পাওয়া দুষ্কর। কেউ সুযোগ পেয়েও চরিত্রবান, কেউ কেউ সুযোগের অভাবে। পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করে।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এখানে লেখক নাইপল নাই, ব্যক্তি নাইপল আছে। ব্যক্তির বিচারে লেখাকে মূল্যায়ন করতে গেলে আরো অনেককেই খারিজ করতে হয়।

কোনটা হলে ভালো হতো? তিনি যদি এই জীবনী প্রকাশে বাধা দিতেন? অথবা প্রকাশের পরে প্রতিবাদ করতেন?
কোনটা আসলে?

আমি কোনোভাবেই নাইপল-এর জীবনের এই দিকগুলিকে জায়েজ করতে চাচ্ছি না।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রাকিব হাসনাত সুমন এর ছবি

জানলাম অনেক কিছু। ধন্যবাদ চমৎকার লেখাটির জন্য।

রণদীপম বসু এর ছবি

স্যার ভিদিয়া প্রসাদ নাইপল, যিনি ভি এস নাইপল হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত,

মাসুদা আপা, ভি এস নাইপল এর পুরো নামটার ক্ষেত্রে একটু অস্পষ্টতামুক্ত হতে চাচ্ছি।
যে বইটার জন্য তাঁকে ২০০১ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় বলে কথিত, 'দ্য এনিগমা অব অ্যারাইভাল' এর প্রমিত হোসেন কর্তৃক একই শিরোনামে বাংলা অনুবাদকৃত বই এর ভূমিকায় তাঁর পুরো নামটি দেয়া আছে বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল। আরেকটু সংক্ষেপ করলে বাংলা উচ্চারণে মনে হয় ভিদিয়া প্রসাদ না হয়ে বিদ্যা প্রসাদ-ই হবে।
যাক, আমার প্রসঙ্গ ভিন্ন।
রেজওয়ান যে মন্তব্যটি করেছেন-

বিষয়টি আমাকে ভাবায় যে আমরা কেন লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার রচনার বিচার করতে চাই। আর তার সামাজিক প্রেক্ষাপট আমাদের সমাজের মত না হতেও পারে। কাজেই আমরা কিসের সাথে কিসের তুলনা করছি সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।

কেন লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার রচনার বিচার করতে চাওয়া হয় সেটা নিয়ে সম্ভবত সমালোচকদের মধ্যেই দৃষ্টিভঙ্গিগত দুটো ভাগ রয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে সৃজনশীল প্রতিটা সৃষ্টিই আসলে এক একটা মাস্টার পিস। হেমিংওয়ের ফেয়ারওয়েল টু আর্মস বা মার্কেজের হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড যেমন এর আগে আরেকটা লেখা হয়নি তেমনি নাইপলের এনিগমা অব অ্যারাইভালও আরেকটা লেখা হয়নি। আমাদের মতোই রক্ত মাংসের মানুষ হয়েও এরা যে এই ইউনিক সৃষ্টিগুলো করছেন তার উৎস কার্যকারণ সম্পর্ক প্রাণী ও বস্তু বিষয়ক বা জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত বিশেষ বা তীর্যক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রচনা কেন কী করে সম্ভব হলো এইসব বিষয়ে মানুষের চিরায়ত কৌতুহল তো থাকবেই। এজন্যেই তো এতো গবেষণা এতো আলোচনা এতো কচলানি হচ্ছে এবং হতেও থাকবে এবং তা থেকে নতুন নতুন আরো কতো বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিসচেতনতা খুলতে থাকবে। নইলে রবীন্দ্র নজরুল নিয়ে কাউকে আর থিসিস করতে হতো না, কোন পিএইচডি ধারীর দেখাও হয়তো আমরা পেতাম না বা জীবনানন্দ কি আত্মহত্যা করেছিলেন না কি দুর্ঘটনায় প্রয়াত হয়েছিলেন তা নিয়েও কোন কৌতুহল কারো থাকতো না এবং তার গদ্য বা কবিতা কীভাবে কিসের প্রভাবে এত বিষাদগ্রস্ততায় আক্রান্ত তার খোঁজখবরেরও প্রয়োজন হতো না। তাহলে কোন লেখক-স্রষ্টার জীবনী রচনারও প্রয়োজন পড়তো না।

দ্বিতীয়তঃ লেখকদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ তো হতেই পারে। তবে একজন ব্যক্তিমানুষের চরিত্র যখন একজনের কলমে ফেরেস্তা হয় বা আরেকজনের কলমে শয়তানের রূপ ধরে বা আরেকজনের কলমে জন্তু চেহারা পেয়ে যায়, সবগুলোই সত্য বলেই প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণে আসতেই হয় আমাদেরকে।
তবে একেক সমাজের প্রেক্ষাপট একেকরকম হলেও মানুষের কিছু চিরায়ত বোধ বা উপলব্ধি সমাজনিরপেক্ষ। ভালোবাসা কষ্ট আনন্দ দুঃখ ইত্যাদি ইত্যাদির চিরায়ত বোধটাকে কিভাবে অংকিত করা হচ্ছে তাও দেখার বিষয় বৈ কি।

প্রকাশ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মায়ের স্নেহ বা পিতার বাৎসল্য বা প্রেমাষ্পদের ভালোবাসার মৌলিক স্রোতের সাথে যদি স্রষ্টার জীবনাচারে ভিন্নতা দেখা দেয়, তাহলে এমন প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে লেখক কি আদৌ কি নিজস্ব কোন বিশ্বাস বা আদর্শ ধারণ করে তা লিখছেন, না কি মানুষ ও সমাজকে আরোপিত প্রতারণার মাধ্যমে ভণ্ডামী করছেন। যিনি এরকম ভণ্ডামীতে লিপ্ত থাকেন তাঁর সৃষ্টিকে দারুণ মেধাবী হয়তো বলা যেতে পারে, কিন্তু মহৎ বলার উপায় আছে কি ?

ধন্যবাদ মাসুদা আপা। চমৎকার একটি বিষয়ে পোস্ট দেয়ার জন্য। আর স্বনামখ্যাত দৈনিকের অশ্লীলতার দৃষ্টিভঙ্গিটা যে আসলে কী, তা এরা নিজেরাও বুঝেন বা জানেন কিনা সন্দেহ। পত্রিকায় সিনেমার রমরমা পোস্টার ছাপতে পারবে, সাণ্ডার তেলের উদ্দীপক বিজ্ঞাপন ছাপতে পারবে, সর্বরোগহরি সালসার মাধ্যমে ধাতুদৌর্বল্য দুরীকরণের মহৌষধের বিজ্ঞাপনও ছাপতে পারবে। এতে শ্লীলতার মানহানী ঘটে না। সমস্যা হয়ে যায় সাহিত্যে এসে। কী আর বলবো। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে মাথার উপরের দিকে নিতে চাইলে কী হবে, এরা জোর করে নিজেদের মতো করে আমাদের দৃষ্টিটাকেও কোমরে নীচে রাখতে চায়, কি জানি বেয়াদপি হয়ে যায় ! রুচিবোধ যাই হোক, বেয়াদব না হলেই হলো। হা হা হা !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

আহ্‌, ভুলে গেছি আমার নিজের কথা বলতে, নাইপলের আমি পাঠক, মুগ্ধ কি না বলা মুস্কিল। নোবেল পাওয়ার পর তার একটি সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছিলাম, ব্যক্তি নাইপলের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা খুব একটা সুখকর কিছু ছিল না। কিন্তু তাতে নাইপলের লেখক-স্বত্ত্বাকে কখনওই খাটো করে দেখিনি, কিংবা দেখার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।
লেখক একই সঙ্গে ব্যক্তি এবং লেখক, এই দু'য়ের মাঝে একটিকে গ্রহণ করবো আরেকটি ছেড়ে দেবো তা হয় না, তাকে গ্রহণ করলে দু'য়ের মিথস্ক্রিয়াতেই গ্রহণ করতে হয়- নাইপলের ক্ষেত্রে আমার অনুভূতিটা তেমনই।
ধন্যবাদ লেখাটি পাঠের জন্য এবং এ নিয়ে কথা বলার জন্য।

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

রণদীপ,
আপনিই ঠিক, বিদ্যাধর সূর্য প্রসাদ নাইপল, পুরো নাম, কিন্তু তিনি সমধিক পরিচিত ভিদিয়া প্রসাদ (বাংলা উচ্চারণে অবশ্যই বিদ্যাপ্রসাদ), বিশেষ করে তিনি অক্সফোর্ডের ছাত্র থাকাকালে তাকে বন্ধুরা ভিদিয়া বলেই সম্বোধন করতেন এবং পরবর্তীতে এটাই হয়ে যায় তার ডাক নাম।

আপনার পরবর্তী কথাগুলির সঙ্গে আমি প্রায়মত, তাই তা নিয়ে কিছু লিখছি না। ধন্যবাদ, দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।