এক.
আমার মাতাকে সকলেই পাগল বলিয়া থাকেন। আমি যতোদিন ধরিয়া বুঝিতে পারি ততোদিন ধরিয়াই দেখিতেছি মাতা বিছানায় শুইয়া দিন কাটান। কদাচিৎ তিনি বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া বসেন, তাহার পর বিছানার পাশেই রক্ষিত পাদুকা যুগল পায়ে গলাইয়া অতি ধীরে ধীরে জানালার পাশে আসিয়া দাঁড়ান, দাঁড়াইয়াই থাকেন, দাঁড়াইয়াই থাকেন।
আমি যখন খুবই শিশু তখন হইতে মাতাকে জানালার পার্শ্বে এই ভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিলেই আমার মনটা খুশীতে ভরিয়া যাইতো। মনে হইতো, এই বুঝি মাতা আমার নাম ধরিয়া ডাকিয়া উঠিবেন, তাহার পর আমাকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইবেন। আমাকে কখনওই কেহ বেড়াইতে লইয়া যায় না। ইহা আমার জন্য খুবই কষ্টের, কিন্তু কাহাকে বলিবো এই কষ্টের কথা? আমি জানি না।
আমার পিতার সহিত আমাদের খুব একটা সাক্ষাত হয় না। তিনি কখন বাড়িতে আসেন, কখন বাহির হইয়া যান তাহা এখন বুঝিতে পারি কিন্তু আমার বয়স দশ হওয়া অবধি ইহা কখনওই টের পাই নাই।আমাকে প্রথম স্কুলে লইয়া গিয়াছিলেন আমার ভগিনী পুষ্পা, ইনি আমাদের সকলের বড়। আমরা তিন জন, পুষ্পা, পয়া এবং আমি, নন্দা। প্রায়শঃই আমাদের নামের উচ্চারণ আমি করিতে পারি না। ইহার জন্য আমি আমার বড় ভগিনীকে পি-ওয়ান, পি-টু আর আমাকে উহারা ন্যানি ডাকিয়া থাকেন। পি-ওয়ান অর্থাৎ আমার বড় ভগিনিই আমাকে বড় করিয়াছে। শুনিয়াছি খুব শিগ্গিরই তাহার বিবাহ হইয়া যাইবে। পিতা তাহাকে আগামি গ্রীষ্মে দেশে লইয়া যাইবেন, তাহারপর সেখানেই তাহার বিবাহ হইবে, তাহার জন্য একখানি যুবক ঠিক করিয়া রাখা হইয়াছে।
তবে শিশুকাল হইতেই আমাকে দেখাশোনা করিবার জন্য একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী আমাদের বাড়িতে সকালে এবং সন্ধ্যায় আসিয়া থাকেন। তাহার নাম গ্যাবি।শুনিয়াছি আমাকে দেখাশোনা করিবার জন্য তিনি অর্থ লাভ করিয়া থাকেন। আমার মাতা পাগল বলিয়া আমাকে দেখাশোনা করিবার নিমিত্তে এই দেশের সরকার তাহাকে নিয়োগ করিয়াছে। মজার কথা হইতেছে, গ্যাবি আমাকে খুবই আদর করিয়া থাকে এবং আমাকে লেখা চিঠিগুলিতে সে আমাকে ‘আমার প্রিয় কন্যা’ বলিয়া সম্বোধন করিয়া থাকে। আমি ভাবিয়া পাই না যে, গ্যাবি কেন আমাকে কন্যা বলিয়া সম্বোধন করে, আমি তো তাহার কন্যা নই।
সকাল বেলা গ্যাবি আসিয়া আমাকে ঘুম হইতে জাগাইয়া বিদ্যালয়-যাত্রার জন্য প্রস্তুত করাইয়া আমার সম্মুখে একবাটি দুধের সহিত কয়েক চামচ সেদ্ধ গম মিলাইয়া তাহার ওপর একটুখানি চিনি ছিটাইয়া দিয়া আমার হাতে একখানি চামচ ধরাইয়া দেয়। আমি প্রতিদিনকার নিয়মানুযায়ী উহা মুখের ভেতর পুরিতে থাকি এবং সঙ্গে সঙ্গেই গিলিয়া ফেলি। নাস্তার টেবিলে এই ঘটনাসমূহ ঘটিতে মাত্র মিনিট দশেক ব্যয় হইয়া থাকে। তাহার পর আমি তাহার হাত ধরিয়া ঘরের দরোজা টানিয়া বাহির হইয়া যাই। প্রতিদিন ঘর হইতে বাহির হইবার সময় গ্যাবি আমাকে আমার মাতার সম্মুখে নিয়া গিয়া দাঁড়াইয়া বলে, “তোমার মাতাকে বিদায় বলিয়া লও”। বলিয়া নিজেই বলে, “বাই মিসেস মনোয়ার”।
আমিও আমার “প্যা-পু” পুতুলের মতো মনে মনে বলি, “বিদায় মাতা”।
আমার মাতা তখনও গভীর ঘুমে অচেতন হইয়া থাকেন, পি-ওয়ানের কাছে শুনিয়াছি, মাতা অধিক পরিমাণে নিদ্রার বড়ি সেবন করিয়া থাকেন বলিয়া দিন এবং রাত্তিরের বেশিরভাগ সময় তিনি ঘুমাইয়া থাকেন। কিংবা জাগিয়া থাকিলেও তাহার চোখের পাতা বন্ধ করিয়া রাখেন। আমার ইচ্ছা করে আমি জোর করিয়া মাতার চোখের পাতা খুলিয়া দেই এবং তাহার কর্ণ-গহ্ববে চিৎকার করিয়া বলি, “বিদায় মাতা”।
কিন্তু বেশিরভাগ সময়ের মতোই আমি আমার মনের ভেতরকার কথা মনের ভেতরেই রাখিয়া দেই। এবং গ্যাবির হাত ধরিয়া বিদ্যালয়ের পথে হাঁটিতে থাকি।
আমাদের বাড়ি হইতে বিদ্যালয় খুব বেশি দূরে নহে। হাঁটিয়া যাইতে দশ মিনিট সময় ব্যয় হয়। এইটুকু সময় ধরিয়া গ্যাবি আমাকে নানা রকম গল্প শুনাইয়া থাকে। তাহার মুখে আমি সমস্ত উদ্ভট গল্প শুনিয়াছি। তাহার উদ্ভট গল্পসমূহের ভেতর সবচাইতে ভয়ংকর হইতেছে সেই গল্পটি যাহাতে একটি কৃষ্ণাঙ্গ শিশুকে ক্ষুদে ক্ষুদে জন্তুরা ধরিয়া লইয়া গিয়া কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া তাহার পর বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়াইয়া দিয়াছিল।মানুষের মতো দেখিতে সেইসব জন্তুদের শরীরের রং উজ্জ্বল, তাহারা বিজাতীয় এক ভাষায় কথাও বলিতে পারে।সেই শিশুটিকে ওইভাবে টুকরা টুকরা করিয়া ছড়াইয়া দিবার পর হইতেই নাকি গ্যাবি যেখান হইতে আসিয়াছে সেই দেশের মাটির রং লাল হইয়া গিয়াছে, ইহার পূর্বে সেইখানকার মাটির রং মাটিরই মতোন ছিল।
গ্যাবির গল্প শুনিতে আমি ভয় পাইতাম, কিন্তু মুখে কিছুই বলিতাম না। তাও গ্যাবি বলিতো, গল্প শুনিতে আমারও খারাপ লাগিতো না। আমার তো আসলে তেমন কিছুই করিবার নেই; খাওয়া, নিদ্রা যাওয়া, বিদ্যালয়ে যাওয়া এবং ফিরিয়া আসা- ইহা ছাড়া আমি সারাদিন বসিয়া থাকি, কখনও আমাদের টিভিখানি ছাড়িয়া দিয়া, কখনও শোবার ঘরের জানালার ধারে বসিয়া বসিয়া কাটাইয়া দেই। তবে আমাদের ভগিনীরা মিলিয়া মাঝে মাঝে গল্পগাছাও যে হয় না তাহা নহে, কিন্তু সে নিতান্তই আঙুল গণিয়া বলা যাইবে।
“ন্যানি তুমি অতি দ্রুত বড় হইয়া যাইতেছো”- আমার বড় ভগিনি আমার চিবুক নাড়িয়া দিয়া বলে।
আমি চুপ করিয়া থাকি, ঠোঁটদু’টো সামান্য বাঁকাইয়া হাসার চেষ্টা করি। হাসি বাহির হয় না। আমি বিদ্যালয়ে গিয়াও কাহারও সঙ্গে কথা কহি না। ইহার জন্য আমাকে পৃথক ভাবে বসিতে হয়, আমার জন্য বিদ্যালয়েও পৃথক ব্যবস্থা। আমার শিক্ষক পৃথক, আমার পুস্তক ভিন্ন, আমি কাহারও সঙ্গে কথা কহি না বলিয়া আমার সঙ্গে সর্বক্ষণ একজন শিক্ষক থাকেন।তাহার নাম মিস সিম্পসন। তিনিও আমারই মতোন গোমরামুখী, আমরা দুইজন সারাদিন চুপচাপ কাটাই, কেহই কাউকে কথা বলিয়া উত্তক্ত করি না। তবে আমার ক্ষিদা পাইলে কিংবা “১ নং বিপদ” হইলে তিনি বুঝিয়া লন এবং অতি দ্রুত আমাকে যেইখানে লইয়া যাওয়া প্রয়োজন সেইখানে লইয়া যান। এমনকি আমি যাহা যাহা খাইতে ভালোবাসি দুপুরের খাবার সময় মিস সিম্পসন আমার ট্রে-তে তাহাই সাজাইয়া লইয়া আসেন। সবচাইতে মজা পাই ইহা ভাবিয়া যে, মিস সিম্পসন যখন নিজে আমাকে বসাইয়া রাখিয়া কোনও কাজে অন্যত্র গমন করেন তখন তিনি কোনও কিছুই উচ্চারণ না করিয়া শুধু আমার দিকে তাকাইয়া থাকিয়া তাহারপর চলিয়া যান। আমি যথার্থই বুঝিয়া লই, “আমি অল্পক্ষণ পরেই ফিরিয়া আসিবো। তুমি লক্ষি মেয়ের মতোন বসিয়া থাকিবে কেমন? তুমিতো জানোই আমি তোমাকে কতোখানি ভালোবাসি”।
মিস সিম্পসন চলিয়া যাইবার পর আমি হাসিয়া ফেলি, একা একা এই হাসি কাউকে কখনওই দেখাই নাই। শুধু আমার মাতা ছাড়া। তাহা কেমন করিয়া সম্ভব হইয়াছিল এইবার তাহাই বলিতেছি।
আমরা ভগিনীগণ মিলিয়া একদিন গল্প করিতেছিলাম। প্রথমে পি-ওয়ান বলিলো যে, “আমি যখন চলিয়া যাইবো, পি-টুর উপর তোমার দায়িত্ব দিয়া যাইবো। তুমি ভীত হইও না”। মনে হইতেছিল পি-ওয়ান তক্ষুণি কাঁদিয়া ফেলিবে।
“তোমার কি না গেলেই চলিবে না? তুমি কেন পিতাকে বলিতেছো না যে, তুমি যাইতে চাহ না। ওই দেশ হইতে একজন যুবককে এই দেশে লইয়া আসিতে হইবে কেন? এই দেশে কি কোনও যুবক নাই? যাহার সহিত তোমার বিবাহ হইতে পারে?” – পি-টু রাগান্বিত হইয়া বলিতে থাকে। তাহার গলার স্বর কেমন যেনো শোনায়।
“তুমি বুঝিবে না। তবে আমার সহিত যাহা ঘটিতেছে তোমার সহিত যেনো তাহা না হয় আমি সেদিকটি নিশ্চিত করিবো। আমাকে যাইতেই হইবে। না হইলে পিতা আমাদের মাতাকে মারিয়া ফেলিবে। আমাদের মাতাকে বাঁচাইয়া রাখিতে হইলে আমাকে যাইতেই হইবে”- পি-ওয়ানের গলার স্বরও কেমন যেনো শোনায়, সে আমাদের ঘর হইতে বাহির হইয়া যায়।
তাহার পর আমি আর পি-টু বলিয়া থাকি। কিছুক্ষণ পর পি-টুও আমার দিকে একখানি অদ্ভূত দৃষ্টিপাত করিয়া বাহির হইয়া যায়। কোথায় যায় আমি বলিতে পারিবো না। তবে পিতা ফিরিবার পূর্বেই সে ফিরিয়া আসিবে তাহা জানি। তাহার পর সে তাহার ঘরের দরোজা বন্ধ করিয়া দিবে। কিছুই খাইবে না। পি-ওয়ান তাহাকে জোর করিবে, কাঁদিবে কিন্তু সে শুনিবে না।
সেইদিন আমাদের গল্প শেষ হইবার কিছুক্ষণ পর বাড়িটা কেমন নীরব হইয়া গেলো। বুঝিলাম আমার ভগিনীদ্বয় বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গিয়াছে। আমি চুপি চুপি আমার মাতার ঘরের দরোজার সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। দেখি বিছানা খালি। আমার বুকের ভেতর ঝাপাইয়া পড়ে কান্না, আমি চিৎকার করিয়া উঠি। কারণ আমি বহুবার স্বপনে দেখিয়াছি, এইরকম মাতার দরোজার সামনে দাঁড়াইয়া আছি আর বিছানায় মাকে পাইতেছি না; আমি চিৎকার করিয়া কাঁদিতেছি কিন্তু আমার কান্না কেহই শুনিতে পাইতেছে না। তাহার পর অনেক কষ্টে আমার নিদ্রা ভাঙিয়া যাইবার পর আমি বুঝিতে পারিতাম যে, আমি নিদ্রায় থাকিয়া স্বপনে মাতাকে হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম।
কিন্তু সেইদিন আমি যখন কক্ষে ঢুকিয়া বিছানায় মাকে খুঁজিতেছি আর চিৎকার করিতেছি, তখন পেছন দিক হইতে একখানি হাত আসিয়া কখন যে আমার মাথার উপর থামিয়া গেলো আমি ঠিক বুঝিতে পারিতেছিলাম না। তাহার পর সেই হাত আমার মাথা হইতে নামিয়া আমার চোখ মুছাইয়া দিল, তাহার পর আমাকে বুকে জড়াইয়া ধরিলো, আমি সেই-ই প্রথম এক অন্যরকম সুগন্ধে বুক ভরিয়া শ্বাস লইলাম।
“তুমি কান্দ ক্যান মা? কান্দে না।এইতো আমি, আমিতো আছি, মরি নাইগো মা। এইযে চোখটা খোলো মা, দ্যাখো আমারে”- আমি এই ভাষাটা ঘরে শুনিয়া শুনিয়া বিশেষ করিয়া পিতার মুখে শুনিয়া শুনিয়া কিছুটা বুঝিতে পারি কিন্তু আমি মোটেও বলিতে পারি না।
“তুমি স্কুলে যাবার পথে আমারে বিদায় কইয়া যাও, আমার যে কী ভালো লাগে, আমি কইবার পারুম না। মনে অয় তুমারে জড়াইয়া ধইরা চুমা দেই, কিন্তু মারে আমি বিছানা থিকা উঠতে পারি না। শরীর আমারে উঠতে দেয় নারে মা। কী করুম কও”।
আমি মাতার মুখের দিকে অবাক হইয়া তাকাইয়া থাকি। কিছু বলিবার চাইলেও আমি আমার মনে কিংবা মুখে কোনও ভাষা খুঁজিয়া পাই না। জানি না কী বলিবো।
“তুমি আমার দরোজার সামনে আইস্যা দাঁড়াইয়া থাকো, তোমারে যে ডাইক্যা কাছে আনুম, মাগো, সেই শক্তি আমার থাকে না। তুমি আইসো মা, ঘরে কেউ না থাকলে আইসো আমার কাছে, আমার পাশে বইসো, আমার চুলের মইদ্যে হাত বুলাইয়া দিও।কী দিবা না মা?”
আমি মাথা নাড়িয়া সম্মতি জ্ঞাপন করি। আমার মনে হইতে থাকে যে, আমি সকল ভাষা ভুলিয়া গিয়াছি।
আমি অনুভব করি, আমার মাতা আমাকে তাহার বুকের সঙ্গে জড়াইয়া রাখিয়াছেন। আমি শুনতে পাইতেছি তাহার বুকের ভেতরকার ধ্বক ধ্বক শব্দ। আমার ইচ্ছা করে আমি চিৎকার করিয়া কথা কহি, কিন্তু কোনও ভাষা খুঁজিয়া পাই না।
কিন্তু সেই দিনের পর হইতে আমি বাড়িতে কেহ না থাকিলে মাতার কক্ষে গিয়া দাঁড়াইয়া থাকি, হঠাৎ একেক দিন মাতা তাহার হাত বাড়াইয়া আমাকে টানিয়া বসান তাহার বিছানার ওপর, কোলের কাছে, তাহারপর নানাবিধ গল্প করিতে থাকেন। আমি তখন কথা বলি না, তাহা সত্য, কিন্তু আমি হাসিতে থাকি। মাতা আমার দিকে তাকাইয়া থাকিয়া নিজেও হাসিয়া ওঠেন, বলেন, “ওরে আমার মারে, তুমি হাসলে মাগো, চাঁদ গইল্যা যায়”। আমি আবার হাসি, আবারও হাসিয়া উঠি।
আমার মাতার সবচাইতে প্রিয় গল্পটি হইতেছে, “এক দ্যাশে একটা মেয়ে আছিলো বুঝলা? তারে জোর কইরা এক কসাইর কাছে বিক্রি কইরা দিছিলো মেয়েডার বাবায়। তারপর কসাই তারে কাইটা ফালাইতে গিয়াও কাডে নাই, বুঝলা? কিন্তু তার সামনে কতো যে প্রাণীরে কাইট্যা ফালাইতো কসাইয়ে, কী কমু মা!”
এই গল্পও আমাকে হাসাইতে হাসাইতে মারিয়া ফেলিতে পারে।
দুই.
আমি পয়া। আমার নামটি পয়া রেখেছে কে? পয়া নামের অর্থ কি? আমি জানি না। জানতে চাইও না। জেনে কী হবে?
আমাদের জীবন আর দশটা পরিবারের মতো নয়। আমরা আলাদা। কারণ আমার মা পাগল, আমার মায়ের মাথা খারাপ। আমার মা জেল খেটেছে, আমার মা পাগলখানায় ছিল, কিন্তু তারপর তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আজ প্রায় দশ বছর যাবত আমার মা বিছানায়। খুব কমই সে বিছানা ছেড়ে ওঠে, কিংবা উঠলেও আমরা দেখতে পাই না।মাকে দেখতে, বাড়ির কিছু কাজ করে দিতে প্রতিদিন তিনবেলা সরকারী খরচে মানুষ আসে। কাজ করে দেয়। আমরা ভালোই আছি বলতে গেলে।
আমার বয়স আর কিছুদিনপ পরেই আঠের হবে। তারপর আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। যেতে আমাকে হবেই। কেন থাকবো? কার জন্য থাকবো? আমার মনে হয়, আমি ভুল করে এই বাড়িতে চলে এসেছি। এখানে আমার আসার কথা নয়।
যেমন আমার প্রায়ই মনে হয়, যে লোকটি বলতে গেলে প্রতিদিনই গভীর রাতে শরীরে তরকারির গন্ধ নিয়ে বাড়িতে ঢোকে তারপর নানা কারণে এবং অকারণে চেঁচামেচি করে সেই লোকটিকে আমি চিনি না, চিনতে চাই না। যদিও লোকটিকে আমরা বাবা বলে ডাকি।
মানুষ কতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে খুব ছোটবেলা থেকে বার বার তার উদাহরণ এই লোকটি আমাকে বুঝিয়েছে। আমার তখন কতইবা বয়স হবে, বড়জোর চার বছর। তখন আমার মায়ের উঁচু পেট থেকে বের হলো ফুটফুটে নন্দা। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে মা বাড়িতে এলো একদিন পরেই। হাসপাতালের গাড়ি থেকে মা একাই নামলো ওকে কোলে করে। সঙ্গে পুষ্পা।ওর হাতে বিশাল এক ব্যাগ।
আমি দরোজায় দাঁড়িয়েছিলাম। মা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আমার চুল ধরে নেড়ে দিলো। ঠিক তখনই পেছন থেকে ওই লোকটা, যাকে আমরা বাবা বলে ডাকি, সে এসে মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মা নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে গেলো টেবিলের ওপর। মায়ের হাত থেকে ছিট্কে পড়ে গেলো কাপড়ের পুঁটলির ভেতর থাকা ছোট্ট মেয়েটা। লোকটা খুব নোংরা ভাষায় মাকে গালাগাল করতে করতে মেরেই গেলো, মেরেই গেলো, যতোক্ষণ না তার নিজের শক্তি ফুরুলো। কেন মারলো, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
হঠাৎ খেয়াল হলো, মায়ের হাত থেকে ছিট্কে পড়ে যাওয়া কাপড়ের পুঁটলির ভেতর থাকা মেয়েটার কথা, সেখান থেকে কোনও শব্দও বেরুচ্ছে না। পুষ্পা দৌঁড়ে গিয়ে কাপড়ের পুঁটলিটাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর চিৎকার দিয়ে বললো, “ওমা দ্যাখো দ্যাখো, খুকু কেমন নীল হয়ে গ্যাছে। খুকুর নাক দিয়ে রক্ত বের হয় মা, ওমা, দ্যাখো না”।
আমার মা তখনও মেঝেতে শুয়ে।ব্যাথায় মুখ কুঁচকে গেছে, কয়েক গোছা চুল মায়ের মাথা থেকে একটু দূরেই পড়ে আছে।আমি কী করবো বুঝতে না পেরে থম ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর মা উঠে বসে পুষ্পার কাছ থেকে কাপড়ের পুঁটলিটা নিয়ে, ব্লাউজটা একটু ফাঁক করে, কালো একটি বোঁটা বের করে খুব ধীরে ধীরে কাপড়ের পুঁটলিটাকে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে দিল।মায়ের চোখ থেকে একটি ধারা নেমে মুখের ওপর একটি দাগ করে নেমে গেছে কোথাও। মার চোখে সবসময় কাজল দেখেছি, ফর্সা মুখের ওপর পানি আর কাজলের দাগকে এরপর অনেকবার আমার কাছে নদীর মতো মনে হতো।
আমার চোখের সামনে কাপড়ের পুঁটলিটা কেমন করে যেনো ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়ে গেলো। আমি প্রথম প্রথম কোলে নিতে পারতাম না।এরপর আরও অনেকবার আমরা যাকে বাবা বলে ডাকি সেই লোকটি মাকে মেরেছে এবং তারও বেশ কিছুদিন পর থেকে মা যেনো কেমন হয়ে গেলো। বাড়িতে কেউ এলে তাদের সামনে হা হা করে হেসে ওঠে, শরীরের কাপড় ঠিক থাকে না, প্রায়ই আমাদের জন্য রান্না করতে ভুলে যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, মায়ের কী যেনো হলো, কাপড়ের পুঁটলির ভেতর থেকে বের হওয়া ওই ছোট্ট মেয়েটাকে আর মা কোনওদিন কোলেই নিলো না। কেন কে জানে? সে সম্পূর্ণ পুষ্পা আর তারপর সোস্যাল সার্ভিস থেকে আসা গ্যাবির হাতেই বড় হলো। কিন্তু বড় হলে কী হবে? সে এখনও কোনও কথা বলে না। সব বোঝে, সব শোনে, কিন্তু বলে না, এমনকি হাসেও না। আমরা ওকে দিয়ে কতো কথা বলানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ও কখনওই মুখ খুলবে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, ওকে ধরে মারি, বেদম মারি, যদি মার খেয়ে মুখ খোলে?
পুষ্পাকে ওই লোকটা আগামি বছর দেশে নিয়ে যাবে। ওই লোকটার বড় ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে পুষ্পার বিয়ে হবে। তারপর সে এই দেশে আসবে। আমাদের সঙ্গেই নাকি সে থাকবে।আমরা বছর কয়েক আগে দেশে বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম, ছেলেটা কেমন যেনো দেখতে, মনে হয় সারাক্ষণ নেশা করে। আমি এখন বুঝি কেন তাকে অমন দ্যাখাতো। আমি নিজেওতো নেশা করি। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আমি আমাদের সেই ভাইয়ের চেহারাটা চোখের সামনে আনতে পারি। কিন্তু পুষ্পাকে বললে বলবে, “অসুবিধা নাই, তোর যাতে ভালো জায়গায় বিয়ে হয়, আমি সেই চেষ্টা করবো, বুঝলি?”
আমার বয়েই গেছে বিয়ে করতে। আমি বিয়ে করবো না, কোনওদিন করবো না। আমি স্যাম,ট্রেসি, ইওনেস, ইভন আর স্ট্যানলি মিলে প্রতিজ্ঞা করেছি, আমরা কোনওদিন বিয়ে-টিয়ে করবো না। আর কিছুদিন পর যখন আমাদের বয়স আঠেরো হবে, তখন আমরা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আলাদা বাড়িতে উঠবো। সেখানে আমরা নানা ধরনের নেশার জিনিস এনে রাখবো, যার যখন যেটা ইচ্ছা সে তখন সেটা খাবো কিংবা শরীকে ঢুকিয়ে নেবো, ব্যস।
আমাদের এখন একটা ছোট্ট ফান্ড আছে, সেই ফান্ড থেকে আমাদের নেশার জন্য জিনিস কেনা হয়। অবশ্য আমি সেখানে খুব কম পয়সাই দিতে পারি। আমাকে তো কেউ আর কোনও পয়সা দেয় না। মাঝে মাঝে পুষ্পা কিছু দেয়। ওই লোকটির সঙ্গে শেষ কবে কথা বলেছি আমার মনে নেই। তবে মাঝে মাঝে ওই লোকটির কেমন যেনো ভাই হয়, সেই চকোলেট-কাকা আমাদের বাড়িতে আসে।বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশ থেকে এসে আমাদের এখানে কয়েক মাস থেকে তারপর চলে গিয়েছিল। যে রেস্টুরেন্টে তার কাজ হয়েছিল তা ছিল অনেক দূরে। সে যখন এখানে ছিল তখনও এবং তারপরও যখনই আমাদের এখানে আসতো তখনই আমাদের জন্য হাতে করে চকোলেট নিয়ে আসতো, যে কারণে তাকে আমি চকোলেট-কাকা বলি।
আমি জানি না কেন, পুষ্পা কোনওদিন তার আনা চকোলেট মুখে তোলে না। আমাকে চকোলেট দিলে আমি না করতে পারি না।আমার চকোলেট খেতে খুব ভালো লাগে। প্রথম প্রথম কোলে বসিয়ে আদর করে আমার মুখে চকোলেট ঢুকিয়ে দিতো। আমি চুকচুক করে খেতাম আর তার হাতটি তখন আমার বুকের ওপর ঘুরতো-ফিরতো। আমি কিছুই বলতাম না, কেন বলবো? আমার চকোলেট খেতে ভালো লাগে, আমি চকোলেট খাই, বাকি যা ইচ্ছে তাই হোকগে, আমার কি?
আমাদের সেই চকোলেট-কাকু এখনও প্রায়ই আসে। এখন শুধু চকোলেটে চলে না, এখন আমার প্রয়োজন হয় টাকার। আমি তার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেই। সেও অনায়াসে আমাকে টাকা দেয়, বেশ ভালোই দেয়। কিন্তু বিনিময়ে সে আমার কাছ থেকে যা চায় তা তাকে আমি এখনই দেবো না। আমি তাকে সুযোগ দেই, অনেক সুযোগ। আমার ক্লাশমেইট সুজান আমাকে শিখিয়েছে কী করে ছেলেদের ঠেকিয়ে রাখতে হয়, সুযোগ আদায় করতে হয়। আমি সেসবের যথার্থ প্রয়োগ করি। এবং এখনও পর্যন্ত চকোলেট-কাকুকে আমার বুকেই শুধু হাত দিতে দিয়েছি। ঠিক করেছি শেষ পর্যন্ত তাকে পৌঁছুতে দেবো না, তার আগেই পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবো। কিন্তু ততোদিন পর্যন্ত যা কিছু আদায় করা যায়, তাই-ই লাভ।
আমার ভবিষ্যৎ? ওসব ভাবি না, কী হবে ভেবে? আঠের বছর বয়স হলে বেরিয়ে যাবো বাড়ি থেকে। তারপর, এরকম চকোলেট-কাকুরা তো সব জায়গাতেই আছে এবং থাকবে, তাই না?
তিন.
আমার নাম পুষ্পা। তিনবোনের মধ্যে আমি সবচেয়ে বড়। আমার বয়েস যখন আট বছর তখন এই দেশে আসি, আমাদের বাবা আগে থেকেই এখানে থাকতেন। তিনি এসেছিলেন অনেকদিন আগে, যখন এই দেশে আসতে কোনও ভিসা লাগতো না, বাবার বয়স তখন ত্রিশ, এখন তিনি প্রায় ষাটের ওপরে। দেখতে তিনি বৃদ্ধ প্রায় কিন্তু তার শক্তি এখনও আমাকে অবাক করে।
শুনেছি আমার মাকে বিয়ে করে বাবা মাত্র দু’দিন থেকে চলে এসেছিলেন। তারপর চার বছর পর আবার দেশে গেলে পয়া জন্মায়। চার বছর পর বাবার সঙ্গে আমাদের দ্যাখা হয় আবার। বলতে গেলে এই নয় বছর আমরা সবচেয়ে ভালো ছিলাম। আমার নানী আমার নাম রেখেছিলেন পুষ্পা।আমার বোনের নাম রেখেছেন পয়া। পয়া মানে নাকি ভালো, ভাগ্যবান। ভাগ্যবান না ছাই, আমাদের আবার ভাগ্য, তার আবার ভালো কিংবা মন্দ।
মায়ের কথা বলি। আজকে আমাদের মাকে সবাই পাগল বলে। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই মা বিছানায় শুয়ে থাকেন। একমুঠ ওষুধ খেতে হয় তাকে প্রতিদিন। মাথা খাড়া রাখতে পারেন না ওষুধের কারণে। মাথার সব চুল উঠে গেছে, বুকের পাজড় গুনে গুনে বলে দেয়া যায়। কেয়ার ওয়ার্কার সকালে এসে মাকে টয়লেট করিয়ে কাপড়-চোপড় পরিয়ে দেয়, মাথার চুলগুলো একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে আঁটকে দেয়। তারপর চামচে করে মাকে খাইয়ে দেয়, মা চোখ বন্ধ করে যা মুখে তুলে দেওয়া হয় তাই গিলে ফেলেন। আমি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারি না। তাই কেয়ার ওয়ার্কার এলে আমি কখনওই সামনে যাই না। কারণ এই দৃশ্যের সঙ্গে আমার দ্যাখা মাকে আমি মেলাতে পারি না।
একটা সময় ছিল যখন মা কথা বলতেন খুব সুন্দর ভাষায়। মা অসংখ্য বই পড়তেন, তার পোশাক, তার কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুই ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমরা যখন দেশে থাকতাম তখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে মাকে যেনো ঠিক মানাতো না। মা যেনো গ্রামে থেকেও যে কোনও শহুরে মেয়ের তুলনায় স্মার্ট। খুব একটা লেখাপড়া করেননি শুনেছি, কিন্তু এতো বই জীবনে পড়েছেন যে, যে কোনও আলোচনায় তিনি অংশ নিতে পারতেন। এই দেশে এসেও অতি দ্রুত মা ইংরেজি শিখে নিয়েছিলেন। এখন তো কথাই বলেন না, অথচ একটা সময় ছিল মায়ের হাসি আর কথা ছাড়া আমাদের বাড়িতে আর মনে হয় কিছুই শোনা যেতো না।
প্রথম বছরটা আমাদের কেটে গিয়েছিল অন্যরকম এক আনন্দে। আমাদের বাড়ি ভর্তি থাকতো আত্মীয়-স্বজনে, বাবার বন্ধু-বান্ধবে। আমার মা সবার সঙ্গে হেসে কথা বলতেন। শুধু রাতে বাবা ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই মা কেমন যেনো বদলে যেতেন। বাবা তখন এই বদলে যাওয়া মাকে বেদম মারতেন, কেন মারতেন প্রথম প্রথম বুঝতাম না। পরে বুঝলাম যে, বাবা মায়ের এই উচ্ছল, হাস্যজ্জ্বল স্বভাব মেনে নিতে পারেন না। মা বাইরে যান, বাবা চান না; মা ইংরেজি শেখেন, বাবা চান না; মা চাকুরি করতে চান, বাবা চান না; আত্মীয়-স্বজন এলে মা নানারকম রান্না করে আপ্যায়ন করেন, হাসেন, কথা বলেন, বাবা সেসব চান না; বাবার বন্ধুরা এলে মা কথা বলেন, বাবা তখন কিছু বলেন না কিন্তু তারা চলে গেলে তার বন্ধুদের সঙ্গে মাকে জড়িয়ে নোংরা ভাষায় গালাগাল করেন, আর সেই সঙ্গে ভয়ংকর ভাবে মারতে থাকেন। মারের চোটে মায়ের পরনের কাপড় ভিজে যায়, চোখমুখ ফেটে যায়, কালচে নীল দাগ পড়ে থাকে সমস্ত শরীরে। তারপরও মা আমাদের সঙ্গে হাসেন, খেলেন, গল্প করেন।
তারপর এলো সেই দিন। আমার মনে আছে দিনটির কথা কিন্তু আমি মনে রাখতে চাই না। একেবারেই মনে রাখতে চাই না।ভুলে যেতে চাই সেই দিনটির কথা কিন্তু ভুলতে চাইলেই তো ভোলা যায় না, বরং আমার সারাক্ষণ মনে পড়ে, বাবার কথাগুলো, আমি পাশের ঘরে পয়াকে নিয়ে খেলছিলাম, বাবা বলছেন, “কয়সর জানে কেমনে ছেলে হয়। তোমার মেয়ে হওয়ার ধাত। কয়সরেরও প্রথম মেয়ে হয় তারপর এক হুজুরে তারে শিখাইয়া দিছে কেমন ছেলে হইবো। কয়সর আইবো রাইতে, তুমি শুধু সে যা চায় তাই করতে দিবা, তাইলেই হইবো”।
মা’র গলা শুনতে পাই, “এটা আপনি কী বলছেন? কেউ ইচ্ছা করলেই ছেলে কিংবা চাইলেই মেয়ে জন্ম দিতে পারে না। এটাতো আল্লাহ্র ইচ্ছা। যদি এরকম হতো তাহলে তো সবাই ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওষুধ খেয়ে ছেলে চাইলে ছেলে বা মেয়ে চাইলে মেয়ে জন্ম দিতে পারতো, তাই না?”
বাবার মুখে তখন পুরোনো সেইসব গালি শোনা যায়। আমি সব মনে করতে পারি না। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা গালিটি দিয়ে বাবা হয়তো মাকে মারতে থাকেন কিংবা আমি জানি না। এই ঘরে পয়া কেঁদে ওঠায় আমি তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর বাবা আমাদের ঘরে এসে বলেন, “আজকে বিকেলে তোমাদের কয়সর চাচা আইবো। তোমরা কেউ ওই ঘরে যাইবা না। যদি যাও তাইলে আছাড় দিয়া গু বাইর কইরা দিবো কইলাম”।
বাবার এই সতর্কবাণী আমরা খুবই ভালো করে চিনি। একদিন সত্যি সত্যিই পয়াকে আছাড় দিয়ে গু বের করে দিয়েছিল, পয়া কেন সারাদিন কাঁদে, সে জন্যই তাকে দু’হাত ধরে ওপরে তুলে ধপাস করে কার্পেটের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বাবা। আমরা সেই যে রুমের ভেতরে বসে থাকি, আর বের হই না। কখন বাড়িতে কে আসে, আর কে চলে যায় আমরা জানি না। কিন্তু পরের দিন সকালে সবকিছু অন্যরকম হয় যায়। একেবারেই অন্যরকম।
মা সেদিনের পর থেকে ধীরে ধীরে বদলাতে থাকেন। তারপর নন্দা জন্মাবার পর থেকে পুরোপুরি বদলে গেলেন। নন্দার বয়স তখন কয়েক মাস মাত্র। একদিন হঠাৎ দেখি মা নন্দাকে গলা টিপে মেরে ফেলছেন। নন্দার চোখ দু’টো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মা খুবই শান্ত ভঙ্গিতে দুই হাত দিয়ে নন্দার ছোট্ট গলাটা চেপে ধরে আছেন। মুখে মা কি কি যেনো বলছেন, আমি বুঝতে পারছি না। আমি দৌঁড়ে গিয়ে পাশে রাখা একটা কোকের বোতল দিয়ে মায়ের হাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করি, মায়ের হাত শিথিল হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে আমি নন্দাকে সরিয়ে নেই। ওর মুখ নীল হয়ে গেছে, কাঁদতে পর্যন্ত পারছে না।আমি খুব দ্রুতই হাসপাতালে ফোন করি, এ্যাম্বুলেন্সের লোকেরাই পুলিশ ডেকে আনে, মাকেও হাসপাতালে নিয়ে যায়, নিয়ে যায় নন্দাকে।
তারপর অনেকদিন নন্দা ছিল চাইল্ড সাপোর্ট এজেন্সির তত্ত্বাবধানে। আর মা ছিলেন মানসিক হাসপাতালে। নন্দাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমিই আবেদন করেছিলাম। তারা নন্দাকে দিয়ে যাওয়ার বছর খানেক পরে মাও ফিরে আসেন আমাদের কাছে। কিন্তু এলে কী হবে, আমাদের মা পাগল, পাগল মাকে নিয়ে আমরা তিনবোন, আর আমাদের একজন বাবা, যাকে মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, তিনি মানুষ নন, মানুষের মতো দেখতে তিনি, কিন্তু কোনও মানুষের পক্ষে এমনটি হওয়া সম্ভব নয়, যেমনটি তিনি।
আজকাল তিনি মাকে বাদ দিয়েছেন, পড়েছেন আমাকে নিয়ে। হঠাৎ হঠাৎ একেকজনকে নিয়ে আসেন আর তার সঙ্গে আমাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমি কোনওটিতেই না বলি না, বলে লাভ নেই জানি। তিনি নিজেই কেন যেনো সেসব নাকচ করে দেন, বলতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত তিনি তার বড় ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছেন আমার। আগামি বছর আমরা দেশে যাবো, বিয়ে হবে এবং তাকে নিয়ে আসবো এই দেশে।
তার সম্পর্কে অনেক কথাই শোনা যায়, আমি নিজেও দেখেছি তাকে, কিন্তু আমি কিছুই বলবো না।যা বলবে তাই-ই শুনবো, সে অনুযায়ী কাজও করে যাবো। শেষে কী হবে তা শেষেই দ্যাখা যাবে।
আমার খুব ইচ্ছে করে মাকে গিয়ে সব কথা বলি, কিন্তু বলে মাকে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না আমার। আমার চোখের সামনে দেখছি পয়া কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে। বোঝা যায় স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে নেশাটেশা করে, এই বছর স্কুল ছেড়ে বেরুবে। কিছু বলতে গেলে ফোঁস করে ওঠে, আমি যতোটা পারি চুপ করে থাকি, মাঝে মাঝে খুব চেষ্টা করে বুঝিয়ে বলতে গেলে শোনে। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে থাকে।একদিন শুয়ে থাকতে থাকতে আমাকে পয়া বললো, “জানো পি-ওয়ান, আমি একটা জায়গা থেকে চাইলেই পয়সা আনতে পারি। তোমার পয়সা লাগলে বলো আমাকে, এনে দেবো”।
আমি জানতে চাই, কোত্থেকে এনে দিবি তুই পয়সা?
ও চুপ করে যায়। আমি বুঝতে পারি, এখন বোমা ফাটালেও সে বলবে না কিছু। আমিও চুপ করে যাই। আমি সোস্যাল সার্ভিসের একটি প্রজেক্টে কাজ করি। আমাদের মতো কিংবা আমাদের চেয়েও ভয়ংকর পরিবারের সঙ্গে আমাকে কাজ করতে হয়। যা বেতন পাই তা থেকে জমাই, পয়াকে দেই, বাকি সব কিছু বাবাই দ্যাখেন-শোনেন। বাইরেও আমি পাগল কিংবা পাগলামিতে ভরা পরিবারগুলোর সঙ্গে মিশি, ঘরে ফিরে আসি আমার পাগল মা, কথা বলতে না পারা নন্দা আর অদ্ভূত এক উৎস থেকে পয়সা নিয়ে আসতে পারা পয়ার কাছে এবং সেই সঙ্গে একজন মানুষের মতো দেখতে ভয়ংকর দানবকে ডাকি বাবা।
নিজেকেও আমার পাগলই মনে হয়।আমাদের ম্যানেজারতো বলেন, পৃথিবীর সবাই-ই নাকি কমবেশি পাগল; কে জানে, হবে হয়তো।
মন্তব্য
বহুদিন পরে আপনার গল্প পড়লাম
প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল গল্পটা পাঁচটা কোন
তিনটা কোণ থেকে তিন বোনের কথা শুনলাম
বাকি দুইটা কোণ মা আর বাবা
ওই দুইটা কোণও যেন পড়তে ইচ্ছা করছিল কিংবা মনে হচ্ছিল ওই দুইটাও আসবে..
আহ্, আপনাকে আশাহত করলাম। দুঃখিত।
মনে হয়েছে, তিন বোনই মুখ্য, বাবা এবং মায়ের কথা অন্য কোথাও, অন্য গল্পে হবে। ভুল করলাম নাকি?
শারদ শুভেচ্ছা।
অদ্ভুত ভাল লেগেছে আপনার এই গল্পটি। অসাধারণ। সমাজটিকে আপনি একেবারেই ঠিক চেহারায় তুলে ধরেছেন। আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই।
ছোট মেয়েটি বাঙলা জানে না বলে তার মুখে সাধু ভাষা শোনানোর অভিনব পন্থা আপনার হাতে সুচারু শিল্পকর্ম হয়ে ফুটে উঠেছে। আমি অনেকটাই বাকহারা!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
তীরু'দা,
বাংলা না জানা মুখে সাধু ভাষা বসানো আপনার কাছে অভিনব মনে হলো কেনো? সৈয়দ হকের বেশ কিছু উপন্যাসে কিন্তু এই তরীকা আছে । এই মুহুর্তে মনে পড়ছে ' বালিকার চন্দ্রাভিযান' । '৭০ দশকের লন্ডনের পটভূমিতেই লেখা । পড়েছেন হয়তো
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
হাসান মোর্শেদ, বহুবছর ধরে দেশের বাইরে, এত পড়াশোনার সুযোগ কোথায়! আপনি মনে করিয়ে দিলেন বলে ধন্যবাদ। নিজেরও কিছুটা আবছা মনে পড়ছে। হয়তো কেন ঈদ সংখ্যা পত্রিকায় পড়েছিলাম।
আপনার পরের মন্তব্যটির সাথেও একমত। একটি লেখার প্রতিটি ছত্রে ছত্রেই যেখানে লুকোনো উত্তেজনা, নাটকীয়তা, ঘটনাকে আরো বিস্তারিত করে সে উত্তেজনারকে বাড়ানোর প্রয়োজন আছে কি আদৌ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অসাধারণ! পড়তে পড়তে নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে!
এই গল্পের নীচেই লিঙ্ক আছে দেখে আরও একটি গল্প পড়লাম ৷ সেটিও অদ্ভুত ভাল লাগল৷ আপনার গল্পগুলি টানটান৷ চমত্কার
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
১
ধন্যবাদ আপা, কিছু চমৎকার বিষয়কে উপজীব্য করার জন্য।
২
প্রথম অংশের সাধুরীতির মধ্যে হয়তো আপনার অজান্তেই কথ্যরীতির কিছু কিছু ক্রিয়াপদ রয়ে গেছে। আশা করছি আপনার চোখেও পড়বে তা।
৩
গল্প চমৎকার হয়েছে। যদি এখানেই গল্পের শেষ হয়, তবে শেষে কিঞ্চিৎ নাটকীয়তা যোগ করলে বোধয় খারাপ হবে না।
৪
আপাত শেষ কথা হচ্ছে, আমাদেরকে বঞ্চিত না করে মাঝে মাঝে এরকম কিছু প্রসাদ নিশ্চয়ই নিয়মিত বিতরণ করে যাবেন।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আপনার লেখা পড়লে ভয়ে ভয়ে থাকি একটা ভয়ংকর কিছুর জন্য। কিন্তু এ গল্পটাতে সেটা না পেয়ে হতাশ হলাম, একটা ভয়ংকর কিছু ঘটে যাওয়াই বোধ হয় ওদের জন্য ভালো হতো।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ভয়ংকর কিছু ঘটে যাওয়াকে কেনো ভালো মনে হয় তানবীরার?
দৈনন্দিনতা কি গল্প হতে পারেনা?
ভয়ংকর কিছু ঘটে যাওয়া ও গল্প হতে পারে অবশ্যই
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
দৈনন্দিনতা হলো বাস্তব হাসান ভাই। এই গল্পটা / ঘটনাটা আমার চোখের সামনে ঘটছে হাসান ভাই। আমি নিজে কাউকে কাউকে রিকোয়েষ্ট করেছি তোমার বাবার নামে পুলিশে রিপোর্ট করে দাও। কিন্তু জীবন সেই এইভাবেই চলে নাক মুখ ফাটানো রক্ত মাখা মায়ের মুখ নিয়ে। তাই মনে হয় অনন্ত গল্পে কিছু ঘটুক, কোন সমাধান আসুক, সে ভয়ংকরই হোক।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
বাঃ
সুন্দর লেখা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
যথার্থ নামকরণ।
একটি জনপদের মানুষের জীবন-কাহিনীর নির্মোহ প্রামাণ্য এই লেখা।
বিপ্লব।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন... ...সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
বড় মেয়েটি তো সোশাল সার্ভিসে কাজ করে! সে পুলিশ ডেকে ঐ দানবকে ধরিয়ে দিক। এতোবড়ো অপরাধী পার পেয়ে যাবে?
সুন্দর একটা গল্প... অনেক সুন্দর...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হুম.................. দারুন লাগল ।
নিবিড়
'কালো তিতির কাঁদে' (নাম ভুল হতে পারে) দিয়ে আপনার লেখার সাথে পরিচয়। এখনো সমান ভাবে আলোড়িত হই। প্রতিটা লেখার মতই এই লেখাতেও মুগ্ধ।
অসাধারণ! অনেক সুন্দর লেখা। আমিও লীলেনদার মত বাকি দুইটা কোণ আশা করছিলাম। খুব ভাল্লাগছে।
------------
শিকড়ের টান
নতুন মন্তব্য করুন