যারা বঙ্কিমবাবুর কপালকুণ্ডলা পড়েছেন, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই, ও এমনভাবে মনে দাগ কেটে থাকার কথা যে, সে দাগ ঘঁষে তোলে কার সাধ্যি। তবে যারা কপালকুণ্ডলাকে জানেন না, তাদের সঙ্গে এর পরিচয় হওয়া উচিত বৈকি।এখানে একটি কথা আগে ভাগেই স্বীকার করে নিচ্ছি, এই কপালকুণ্ডলা কিন্তু একুশ শতকের। এই দু’হাজার আট সালে তার বয়স, এই ধরুন গিয়ে ছত্রিশ বছর।
কিন্তু বয়স ছত্রিশ হলে কি হবে, কপালকুণ্ডলা দেখতে এখনও কিশোরী, চোখ তার এখনও স্বপ্নালু, তার দীঘল চুল, সবুজ ধান ক্ষেতের বিস্তীর্ণ শান্তিদায়ী দৃশ্যের মতো তার মুখাবয়ব।মাঘের শেষের গতর-জুড়োনো বাতাসের মতো তার চলাফেরা, আষাঢ়ের নবীন জলের শব্দের মতো তার হাসি, কার্তিকের জ্যোছনায় নাও ভাসালে তার গায়ে জলের আছড়ে পড়া যেমন কিংবা যেমন করে সোনার অলংকারে স্যাঁকড়ার হাঁতুড়ি টুং-টাং বাজে তেমনই তার চলার ছন্দ; জলাঙ্গীর কুমারী-গন্ধ তার সমস্ত শরীরে।
কপালকুণ্ডলার জন্ম ইতিহাসটাও আপনাদের জানা দরকার; সে ইতিহাসের শুরু অবশ্য হাজার বছর আগে। কিন্তু আমরা ন’শো পঞ্চাশ বছর বাদ দিয়ে কপালকুণ্ডলার জন্মের পঞ্চাশ বছর আগের কথাই শুধু জানবো। কপালকুণ্ডলার মা ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী, কয়েক হাজার বছর ধরে তার রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি। তিনি যেমন ছিলেন রূপবতী, তেমনই বিদুষী, তেমনই ঊর্বরা; যে কারণে তাকে হরণ করতে চতুর্দিক থেকে রাবণেরা বার বারই এসেছে প্রাণসংহারক রূপ ধরে।আর বরাবরই তারা এসেছে উত্তর হতে, কখনও হিম-প্রভাবে শরীর সাদা হয়ে যাওয়া শিকারীর বেশে; কখনও মরুভূমি থেকে রক্ত-পিপাসু তলোয়ার হাতে।
বহু যুদ্ধের, বহু রক্তপাতের স্বাক্ষী তিনি, দেখেছেন অনেক, যদিও শিশুকালেই শুনেছিলেন তিনি ভবিষ্যদ্বাণী, “উত্তর দিক হতে সাবধান, এই দিক থেকে যারা আসবে, তারাই তোর সংহারক, তারাই হবে তোর হন্তারক”। ছত্রিশবার তার শরীর থেকে অলংকার ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এই উত্তর থেকে আসা এক ডাকাত সর্দার। তারপর একটু একটু করে উত্তরা-পথ ধরে আসা ওরা তার এক একটি অঙ্গের দখল নিয়েছে, ব্যবচ্ছেদ করেছে হৃৎপিণ্ড। সে বড় করুণ ইতিহাস। কিন্তু তারপর সাগর পার হয়ে যারা এলো তারা, কুৎসিৎ, আরও ভয়ংকর। শুধুই লুটে-পুটে খেয়ে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টায় ছিল ওরা।
এবার আর তিনি চুপ করে থাকেননি। ততোদিনে অবশ্য তার সন্তানেরাও বেশ স্বাবলম্বী হয়েছে। নিজ হাতে সন্তানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মারণাস্ত্র, বারুদ এবং আগুন তিনি নিজ শরীর থেকেই উৎপন্ন করেছেন, জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন দখলদারীর সিংহাসন। দু’শ বছর পর ওরা কুকুরের মতো পেছনের দু’পায়ের ফাঁকে লেজ সেঁধিয়ে চলে যেতে যেতে শেষ বারের মতো বিষদাঁত তার শরীরে বিঁধিয়ে যায়, তিনি আক্রান্ত হন গ্যাংগ্রিনে।
আহারে, তার আর্ত চীৎকারে তখন আকাশ কাঁদে, মাটি শুকিয়ে কয়লা হয়ে যায়, বাতাসে ভেসে থাকা শবগন্ধে উত্তরেরই পাহাড় থেকে নেমে আসতে থাকে দলে দলে গৃদ্ধকূট। তারপরও শেষ রক্ষা আর হয় না, ধোয়া ছেড়ে কলের গাড়ি ভর্তি লাশ তার এক হাত হতে আরেক হাতে আসে, এদিক থেকেও গাড়ি বোঝাই হয়ে যায় নরমুণ্ডু, খুবলে রাখা স্তনহীন নারী-শরীর; তিনি আর সইতে পারেন না এসব, তিনি বিদীর্ণ হন, একদা সীতা যেমন পাতাল প্রবেশ করেছিলেন, সে অবশ্য সত্য যুগের কথা, এতো ঘোর কলি, তাই তিনি পাতাল-প্রবেশের আগেই তাকে দু’টুকরো করে ফেলা হয়।
তিনি লাশ হয়ে যান; তার লাশের কথা বলি। তাকে ব্যবচ্ছেদকারীরা শরীরের মাঝের বিশাল অংশটি একদিকে, আর অন্যদিকে রেখে দেয় মাথার দিককার উষর-ধূসর খন্ডাংশ এবং একেবারে পায়ের দিককার সাগর-মেখলা ছোট্ট এক টুকরো। লাশকাটা ঘরের ডোমও মানুষের শরীর ব্যবচ্ছেদে কিছু নিয়ম মেনে চলে, অথচ সেই রাজনীতির ডোমকূল কোনও নিয়ম না মেনেই তার শরীর কেটে টুকরো করে। ভাগাভাগি করে তার কোমল পেলব মগজ জরায়ু অস্থি সব, সবকিছু।
তারপর. . . .
তার লাশের ওপর দিয়ে আরও যুদ্ধ হয়, আরও রক্তের নদী বয়। তিনি আর কী করবেন, তিনি তো লাশ। তারপরও, এই লাশের একটি অংশে কেমন করে যেনো খানিকটা সবুজের চিহ্ন ছিলো, ছিল মরুদ্যানের জল। পাখিরা দীর্ঘ উত্তরাপথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসে জল খুঁজতো, ক্লান্ত পথিক এখানে খুঁজতো শীতল ছায়া। যেহেতু তার পায়ের কাছে ছিল সমুদ্র, শিয়রে হিমালয়, মাঝে তার নরোম কবোষ্ণ বুক ধুকপুক করে যেতো, প্রাণের চিহ্ন কেবল এখানেই ছিল, ও অংশতো সেই বারশ মাইল দূরে, পাথুরে মাটির প্রাণচিহ্নহীন কংকালের হানাহানি আর ষড়যন্ত্রীদের দখলেই ছিল, কখনওই মুক্তি পায়নি ওটুকু, অভিশাপ এতো সহজে ধুয়ে যাবে কি করে? সন্তানের সামনে মা’কে পিতার সামনে কন্যাকে বলাৎকার করার পাপ কি এতো সহজে যায়? যায় না।
কিন্তু ওদের লোভও যে সীমাহীন। ওদিক থেকে হাড্ডিসার কংকালেরা বার বারই এই সবুজ স্নিগ্ধ পেলব বুকের ভেতর ধুকপুক করা প্রাণটি হরণ করার চেষ্টা করে। তবে তার আগে ওরা কেড়ে নিতে চায় প্রাণ নিঃসৃত শব্দ, হৃদয়ের কুলকুল ধ্বনিরাশি। ওরা এখান থেকে রসদ নিয়ে ইমারত গড়ে, নতুন শহরের পত্তন করে, এখানে শষ্যের ক্ষেত উপছে যায় ফসলে তবুও অনহারে থাকে নবজাত, আর ওখানে ফসল ফলে না, পাথুরে জমি শত কর্ষণেও বন্ধাত্য ঘুচাতে পারে না, তবুও ওখানে কংকালেরা বাঈজীর আসরে বইয়ে দেয় সুরার নহর – আর দিনে দিনে এদিকের হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি ক্রমশঃ ম্রিয়মান হতে থাকে।
“পঁচিশ বছর নগ্ন চিতায় প্রজ্জ্বলন, তবে তার আগেই তোর জঠরে বেড়ে উঠতে থাকবে এক রাজকুমার; যদিও সে তোর নয়, তোর মাটির সন্তান।সিংহের অমিত সাহস তার বুকে, বজ্রের ধ্বনি তার কন্ঠে, রাজনীতির প্যাঁচে তার হাতেখড়ি খোদ্ চানক্যের কাছে, এই জল মাটি বাতাসের কাছে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ঋণশোধের। সে জন্মাবে, সে বেড়ে উঠবে, তারপর একদিন হাতে নেবে অর্জুনের মতো তীর-ধনু, তার কৃষ্ণ-সারথি নেই, নেই তার পাশে দণ্ডায়মান সুদর্শণ চক্রধারী কেউ, তবুও সে বিজয়ী হবে, কারণ তার যাদুকরী বাঁশি ঘুম ভাঙাবে জনপদ নদী আকাশ ও বাতাসের। তারপর তারা একত্রিত হয়ে রক্তচোষা কংকালকে রুখবে, কংসের কারাগারে জন্মে কৃষ্ণেরই মতো সে কংসবধ করবে, কলিতে তবে সেই-ই কৃষ্ণ, এই জনপদের। তোর শাপমুক্তি ঘটবে তখন, যদিও অনেক রক্তপাত, অনেক ত্যাগ, অনেক ঋণশোধ, তোর মাটির অযুত নারী আব্রু ছেনবে ওই কংকাল পশুরা, তারা হাসিমুখে সইবে সেসব, রাখাল রাজা যে তাদের শুনিয়েছে অমৃত-ধ্বণি – স্বাধীনতা। তারপর তোর শাপমুক্তি, পুনর্জন্ম হবে তোর, তবু তুই-ই হবি কপালকুণ্ডলা; একজন নয়, দু’জন নয়, অসংখ্য কাপালিক তোকে. . . .” নতুন এই ভবিষ্যদ্বাণীর বাকিটুকু আর শোনা যায় না, তার আগেই আমরা দেখতে পাই, বিজয় রথে রাখাল রাজার হাতে নবজাত এক কন্যাশিশু। আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি, গোলাপ জলের ধারা, মুহুর্মূহু হর্ষধ্বণির মাঝে ইতিহাসের মহানায়কের প্রবেশ নতুন-তর ইতিহাসের পাতায়।
স্মৃতি বড় প্রতারক, তারপরও কপালকুণ্ডলা মনে করতে পারে সেই সব সোনালী দিনের কথা, শাল্ব-বৃক্ষের মতো মানুষটির হাত ধরে সে হেঁটেছে এই জনপদের প্রতিটি আলপথে। মোষের ঘাঁড়ের মতো শক্তিশালী সেই পথচলা, শিশু তখনও সে, তারপরও মনে আছে সব, সবকিছুই।
সংবেদনশীলতা আর ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে বশ করার অসীম ক্ষমতাধর সেই মানুষটির মাথায় গিজ গিজ করতো পরিকল্পনা স্বপ্ন। সাধ আর সাধ্যের সীমানা প্রায়শই অতিক্রান্ত হতো, তাতে কী? চারদিকে ধ্বংসস্তুপের মাঝ থেকে অঙ্কুরিত হচ্ছে বীজ, পোড়ামাটির ভেতরকার নীর্যাস জাগিয়ে তুলছে প্রাণ, ডানা ভাঙা পাখি সবেমাত্র উঠে দাঁড়াতে শিখছে, তার পুড়ে যাওয়া পশশে সামান্য নীলাভ রেখা দেখা দিয়েছে কি দেয়নি, তখনই হঠাৎ শোনা যায় এক কাপালিকের গলা। রক্তের হবি দিয়ে ধুনী জ্বালিয়ে কাপালিক বসে যায় যেখানে এক সময় কপালকুণ্ডলার মায়ের হৃদয়টি প্রোথিত ছিল ঠিক সেখানেই।
এবার কাপালিক-কথন।
রক্তগন্ধ, মড়ার খুলির ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস যেনো মানুষশাবকের করুণ কান্না, পাঁজড়ের হাঁড় নিয়ে কাড়াকাড়ি শকুন-শকুনির, আর তাদের শাবকেরা তীব্র অপেক্ষায় থাকে কখন তাদের বাবা-মা মুখ গহ্বরে করে নিয়ে আসবে তাজা মাংস মগজ চোখ কিংবা খুবলানো স্তন টেনে বের করে আনা সন্তানসমেত জরায়ু – আর এদেরই রাজা সেজে সাম্রাজ্য সাজিয়ে বসে কাপালিক বিজাতীয় মন্ত্র আওড়ায়। তার দেহটা ভয়ঙ্কর এক জন্তুর আর মাথাটা খানিকটা মানুষের, খানিকটা হায়নার, তবে সেখানে অনেকগুলো মুখ, আর মন্ত্র আওড়ানোর সময় একেক মুখ থেকে একেক ধ্বনি নিঃসৃত হয়।
“পরাজয়ের প্রতিশোধ চাই। রক্ত চাই তার। ছিন্ন ভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ চাই ভেট”।
“এনে দাও তার হৃৎপিণ্ড, যেখানে সারাক্ষণ একটিই নাম-ধ্বনি যপিত হয়”।
“আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ধ্বংস করবো এই মাটি, এই আকাশ, এই বাতাস, এই জনপদ। রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবো এখানে”।
“এই বিধর্মী উপত্যকায় প্রতিষ্ঠিত হবে নতুন রক্ত, তাই এদেরকে পবিত্র করতে হবে। পবিত্র ও প্রধান ধর্মের বীর্য ঢেলে দিতে হবে এই জনপদ-নারীর জরায়ুতে, তাতে উৎপন্ন হবে নতুন ফসল, নতুন জাত, ধর্মের শৌর্য যাদের হাতে প্রতিষ্ঠিত হবে এইখানে”।
“একবার হেরেছি, যার কারণে, তাকে ধ্বংস করো, সেই সাথে তার নতুন সৃষ্টিকে, যাকে নিয়ে তার এতো গর্ব, এতো ভালোবাসা, তাকে ধ্বংস করতেই হবে”।
“সে আমাদের বঞ্চিত করেছে, ক্ষমতা দেয়নি, দেয়নি সুখ, দেয়নি চুরি করার সুযোগ, সে আমাদেরকে ভোগ করতে দেয়নি এ মাটির সম্পদ। তাকে আমাদের খুন করতেই হবে। তাকে খুন করার অর্থই হচ্ছে সম্পদ আমাদের একচেটিয়া, যথেচ্ছা ভোগ”।
“তাকে খুন করলেই শুধু হবে না। তাকে আগে বদনাম করতে হবে, করতে হবে গণবিচ্ছিন্ন, তারপর ধীরে ধীরে চারদিক থেকে শত্রুদের এনে জড়ো করে একদিন তুমুল রক্তপাতের হোলি খেলা হা হা হা হা হা হা হা”।
“এ মাটির মানুষ কোনওদিন স্ব-শাসন পায়নি, এখন কেন পাবে, এদের শাসন করবো আমরা, শোষণ করবো আমরা, এদের পশ্চাৎদেশ, এদের তৈল, শুধু লিঙ্গটা আমাদের, যতো সুখ করে নেওয়া যায় ততোই লাভ, সেটাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য”।
“সবাই সব কিছু সহ্য করতে পারে না, এরাও পারবে না, অধিকার, স্বাধীনতা এদের জন্য নয়, এরা অস্ত্রের ভাষা বোঝে, এরা বোঝে ডান্ডার মহিমা, তোমাদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে সে জন্যই, তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা আছি, যেমনটি ছিলাম, তেমনই থাকবো, তোমরা সামনে আর আমরা পেছনে, তোমরা শাসন করবে, আর আমরা শক্তি হয়ে পেছনে থাকবো, এইতো চাই, এমনি করেই বাড়াতে হবে জমি, দখল করে নিতে হবে মূর্তি উপাসকদের ভূমি, টেনে আনতে হবে তাদের পবিত্র ধর্মে, বাধ্য করতে হবে ধর্ম পরিবর্তনে, তাদের নারীদের ওপর জোর প্রয়োগ করতে হবে, উপগত হয়ে ঢেলে দিতে হবে পবিত্র বীর্য – তবেই মোক্ষ, তবেই মুক্তি, তবেই পরপারে অনন্ত শান্তি, অনন্ত সুখভোগ”।
কাপালিক তার সামনে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে একবার রুধির হবি ঢেলে দেয়, আর তার একেক মুখ থেকে উচ্চারিত হয় এসব মন্ত্রাদি। তারপর আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে কাপালিক হাসতে থাকে। তখন ঝড় ওঠে চারদিকে, তার সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে সমস্ত অমাঙ্গলিক জন্তু জানোয়ার পাখি। বিদ্যুৎ চমকে এফোড় ওফোড় করে দেয় আকাশ এবং পৃথিবী দুই-ই।
তারপর একদিন সময় আসে, রাতের আঁধারে কাপালিক বেরিয়ে পড়ে শিকারে, চোখ তার জ্বলে প্রতিহিংসায়, রক্ত পিপাসায়, তার পরনে জলপাই রঙের পোশাক, তার দাঁতে গোখরোর বিষ, রাত বিদীর্ণ হয়, মাইলের পর মাইল রক্তরেখা পড়ে থাকে, আর নিহত হতে থাকে কপালকুণ্ডলার সমস্ত আশা আকাঙ্খা আর স্বপ্নেরা। চারদিকে মাতম ওঠে, তীব্র হাহাকার ভাঙতে থাকে বহু ইতিহাসের পলিতে তৈরি আবাসভূমির জমিন।
সে রাতের রক্ত-ইতিহাসের সেলুলয়েডে দ্যাখা যায়, সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ছে শাল্ব বৃক্ষের মতো শরীর; শয়নঘরে রক্তের ভেতর শুয়ে থাকে নিষ্প্রাণ শিশু, অন্তঃস্বত্ত্বা নারী; বসার ঘরে যুবক, তরুণ, বণিতা-বধু।আর কাপালিক তখন বিজয়ের নগ্ন উল্লাসে ফেটে পড়তে পড়তে ফিরে আসে রাতের আঁধারে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে যেমন হায়েনারা ফেরে দল বেঁধে, যখন ওদের দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকে তারা মাংস, পাকস্থলিতে তরুণাস্থি, ঠোঁটের কোণে উষ্ণ রক্ত। তবে তার চেয়েও বড় কথা হলো, কাপালিকের হাতে ধরা লোহার খাঁচায় দ্যাখা যায় একটি ছোট্ট পাখি, পাখা ঝাপটায় ক্রমাগত সে পাখি, ছোট্ট মাথাটি বার বার ঠুকতে থাকে খাঁচার শিকে, চোখদু’টো তার রক্তাভ, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর, নিষ্ফল ক্রোধে পৃথিবীকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার মতো তার দৃষ্টি; কিন্তু সে তো বন্দী।
কপালকুণ্ডলা বন্দী হয় সে রাতে। জলপাই রঙের কারাগারে, যেখানে বন্দী সে, সেখানেও রক্তপাত ঘটে। রাতের আঁধারে মানুষের রূপ ধরে কাপালিকের হয়ে ওরা আসে। তারপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটায়।মানুষের রক্ত চেটে-পুটে খেতে থাকে জেলখানার ইঁদুর, পিঁপড়ে কিংবা তেলাপোকারা।
চারদিকে তখন ভয়, শুধুই ভয়; শিশু ভুলে গেছে কাঁদতে, কিশোরী হাসতে, তরুণী উচ্ছল হতে; শুধু ক্ষণে ক্ষণে কাপালিকের হা হা রক্ত হিম করা হাসির শব্দ। গাছের পাতা ম্লাণ হয়ে ঝরে যায়, পাখিরা গান থামিয়ে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে কেবল বেঁচে থাকে, ফুল থেকে সব গন্ধ-বাস রাতারাতি উধাও। শুধু মানুষ, কেবল মানুষ মরে যেতে যেতে বেঁচে থাকার কসরত করে যায়, এছাড়া তার যে আর কোনওই উপায় নেই, বেঁচে থাকার জন্যই কেবল বেঁচে থাকা।
“আজ থেকে এই দেশের সকলেই প্রতিবাদের ভাষা ভুলিয়া যাইবে। যাহারা ভুলিতে পারিবে না, তাহাদের জন্য রহিয়াছে চরমতম শাস্তি”।
“এইখানে কেহ তাহার নাম উচ্চারণ করিবে না। তাহাকে এই দেশে নিষিদ্ধ করা হলো। যাহারা তাহার কথা বলিবে তাহাদিগকে হত্যা করা হইবে”।
“এই দেশের সংবিধানের সহিত অদ্য হইতে যোগ হইলো নুতন এক বাক্য, যাহার অর্থ হইতেছে ইহার উপর যাহাদের আস্থা থাকিবে না তাহারা অন্যত্র চলিয়া যাইবে, এই দেশে তাহাদিগের কোনওই স্থান নেই”।
“যাহারা এই দেশে থাকিতে ইচ্ছুক তাহারা নিশ্চুপ থাকিবেন, অথবা শুধুমাত্র যাহা শিখাইয়া দেওয়া হইবে তাহাই বলিবেন।নিজ ইচ্ছা হইতে কিংবা অন্য কোনও উৎস হইতে প্রাপ্ত কিছুই বিশেষ ছাঁকুনির ভেতর দিয়া পরিচালিত না করিয়া উচ্চারণ করা যাইবে না। যাহারা ইহার ব্যতিক্রম করিবেন, তাহাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করিতে হইবে”।
“আমার নির্দেশনামার প্রতি আনত থাকিলে পরিণামে অশেষ শান্তি ও আরাম-আয়েশ উপভোগ করিতে পারিবেন। ইহার জন্য যতো অর্থের প্রয়োজন যোগান দেওয়া হইবে। অর্থ কোনও সমস্যাই নহে”।
দিকে দিকে এই ফরমান ঘোষিত হয়। কাপালিক তার পারিষদকূল নিয়ে ধুনি জ্বালিয়ে বসে এইসব নির্দেশ দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে তা পালিত হয়। যারা এর বিরোধিতা করে তৎক্ষণাৎ তাদেরকে হত্যা করা হয়, কেউ জানতেও পারে না সেই সব নামের কোনও মানুষ এই পৃথিবীতে কোনওদিন ছিল।
চারদিকে অর্থ ছড়িয়ে কাপালিক মানুষের মতো দেখতে অনেক পশু কেনা হয়। আসলে তারা নিজেদেরকে বিক্রি করার জন্য নিজেরাই হাট বসিয়ে নিজেদেরকে মাটিতে পুঁতে রাখা বাঁশের খামের সঙ্গে বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল, কাপালিক বেছে বেছে তাদের তুলে এনে তার পারিষদে, নিজস্ব বাহিনীতে এবং তারপর তার দলে ঠাঁই করে দেয়। রাতারাতি এইসব পশুরা মানুষের মুখোশ কিনে নিজেদের মুখে লাগিয়ে, তাদের পশুত্বকে গোপন করে সত্যিকার মানুষের ভিড়ে মিশে যায়।
কাপালিক প্রতিদিন নতুন নতুন প্রকল্প দিয়ে মানুষকে প্রলোভণ দেখাতে থাকে। যাকে যেভাবে কেনা যায়, কেনা না গেলে ভয় দেখিয়ে কাজ হলে তাই-ই সই, কাপালিক দেশব্যাপী নিজের মানুষ দিয়ে একটা ব্যুহ বানিয়ে ফেলে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি যেমন পাঁচশালা পরিকল্পনা গ্রহণ করে তেমনই কাপালিক তার পরিকল্পনা মাফিক ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে নদীপথে ভ্রমণে বের হয়, তারপর তাদের কানে কানে অনেক কথা বলে, গোপনে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় অস্ত্র। কাপালিক জানে, একদিন এই কিশোর বড় হবে এবং তারপর তার পরিকল্পনাকে তারা সফল করে তুলবে। কাপালিক মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য নিজের বেশভুষা বদলায়, জলপাই রং-এর কাপড়, চোখে রোদ-চশমা, কাপালিককে দেখতে মানুষের মতোই লাগে। যে কোনও মানুষই কাপালিককে দেখে ভুল করে, শিশুরা তো করবেই। তারা কাপালিককে গান শোনায়, নাচ দেখায়, কবিতা শোনায়; আর তখন রোদ-চশমার আড়ালে কাপালিকের চোখ শ্বাপদের চোখের মতো জ্বল জ্বল করে লোভে লালশায় হিংসায়।
ভূখণ্ডে তখন রক্তপাত যেন খেলামকুচি ঘটনা, যত্রতত্র যখন-তখন ঘটে, মানুষ মারা যায়, আর মানুষের রক্তে কাপালিকের ধুনি জ্বলে। পোড়া মাংস কিংবা রক্তের গন্ধে চারদিক কেমন ভারি হয়ে থাকে। মানুষ স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়, মানুষ তার মন-মগজে অসম্ভব এক কষ্ট নিয়ে বিছানায় যায়, রাতভর আকাশ থেকে মন খারাপ করা তারারা ঝরে পড়ে মাটিতে, তারা আর এই দেশের আকাশে থাকতে চায় না, অন্য কোথাও চলে যেতে চায় কিন্তু পারে না বলে তারা মনের দুঃখে নিজেরাই ঝরে ঝরে পড়ে যায়, মিশে যেতে চায় এই মাটির সঙ্গে।
গভীর রাতে নিশুতি যখন শহরকে তার চাদরের ওম্-এ ঘিরে রাখে তখন তারা, গাছ, পাখি, ফুল, নদী, রাজপথ, ভাস্কর্য একে একে জড়ো হয় শহরের গোপন এক জায়গায়। নাহ্ তারা কোনও ষড়যন্ত্র নয়, শুধু মনের কথা, যা তারা দেখেছে, যা তারা শুনেছে তাই-ই সবাই সবাইকে শোনানোর জন্য তারা একত্রিত হয়। চাঁদ ইচ্ছে করেই সেদিন মেঘের আড়ালে চলে যায়, যাতে এই সমবেত হওয়া কেউ দেখতে না পারে, যেন কাপালিকের রাত-বাহিনী এর খবর না পায়।
প্রথমেই তারা কথা বলে, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে কপালকুণ্ডলার জন্য। কপালকুণ্ডলাকে এরা বন্দী করেছে।তার চুল উঠে যাচ্ছে, সে ক্ষুধার্থ, তার পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন, তার হাতে পায়ে আঘাতের চিহ্ন।কতোদিন হলো সে সূর্য দ্যাখেনি, দ্যাখেনি চাঁদ, আর আমাকে তো দেখার প্রশ্নই আসে না। অথচ আমরা তার কতো প্রিয় ছিলাম। জানি না কোন্ অন্ধকার কুঠুরিতে তাকে আটকে রেখেছে ওরা, হাওয়া আমাকে বলেছে সেখানে রক্তের গন্ধ, প্রতিদিন সেখানে অসংখ্য নরবলি হয়। আহ্ আমি আর বলতে পারছি না… বলতে পারবো না”।
“আহারে, কষ্ট পেয়ো না। কপালকুণ্ডলাতো না হয় সর্বসংহা, কিন্তু এই ভূখণ্ডের মানুষেরা? তারা? ভেবে দ্যাখো একটিবার তাদের অবস্থা।আমি রাজপথ, কাপালিক প্রতিদিন আমার ওপর দিয়ে দাপিয়ে তার বাহিনী নিয়ে আসা-যাওয়া করে। আমার দু’পাশে দীর্ঘ দিনের পুরোনো যসস্বী বৃক্ষ, যারা নিজে সুর্যকে আমাকে আর আমার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষকে ছায়া দেয়, কাপালিক তাদেরকে কেটে ফেলেছে, তার বিশ্বাস এই গাছের আড়াল থেকে তাকে হত্যা করা হবে। আমার বুকের ওপর মানুষকে পিশে মারছে কাপালিক, লেলিয়ে দিচ্ছে তার পোশা বাহিনী, তারা রাত-বিরেতে মানুষ ধরে নিয়ে যাচ্ছে কাপালিকের কাছে। তারা শুধুই যায়, আর ফিরে আসে না- বুঝলে আর ফেরে না” – রাজপথের গলা বুজে আসে।
তারপর দীর্ঘক্ষণ নীরবতা শেষে ছোট্ট পাখিটি তার ক্ষুদে ঠোঁট ফাঁক করে বলে, “ভাই রাজপথ, যারা তোমার ওপর দিয়ে যায়, আর ফিরে আসে না, তারা তো গিয়ে বাঁচে কিন্তু যারা বেঁচে আছে তাদের কী হবে? তাদের ভাগ্য নিয়ে কাপালিক যেভাবে খেলছে তাতে তাদের কিংবা পরবর্তীদের অবস্থাটা কী হবে একবার ভেবে দেখেছো? কাপালিক এখন নিজেকে আর নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য উত্তরের সেই পরাজিত দেশ হতে এই ভূখণ্ডে নিয়ে আসছে তাদের যারা একদিন এই দেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, তুলে দিয়েছে সেই কদর্য বাহিনীর হাতে যারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে, পুড়িয়ে যখন যেভাবে পেরেছে সেই ভাবে এই ভূমির মানুষকে হত্যা করেছে, এখানকার নারীকে নারকীয় বর্বরতায় ধর্ষণ করেছে, এখানকার শিশুকে হত্যা করেছে নিষ্ঠুরভাবে যাতে পরবর্তীতে ওদের বিরোধিতায় কেউ বুক চেতিয়ে দাঁড়াতে না পারে; কাপালিক এখন আবার তাদেরকেই ফিরিয়ে আনছে এই দেশে; আমিতো ভাবতেই পারছি না কপালকুণ্ডলার কী হবে? কী হবে এই দেশের মানুষের? কারণ যারা আসছে তারা রক্তবীজের ঝাড়, তাদের মৃত্যু নেই, ধ্বংস নেই, তারা বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে, তারা খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে, পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাময়ের অযোগ্য রোগের জীবাণু হচ্ছে এরা, একদিন এরা কপালকুণ্ডলাসহ এই দেশের প্রতিটি মানুষ, ধূলিকণা, পশুপাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গকে তাদের ধ্বংসাসী লালা দিয়ে অসুস্থ করে ফেলবে। কাপালিক আজ তাদেরকে বন্ধু হিসেবে আনছে, দীর্ঘদিন তারা এই কাপালিক ও তার অনুসারীদের সঙ্গে থাকবে এবং তারপর একদিন এদেরকে ফেলে দিয়ে তারা একাই শক্তিশালী হয়ে এই ভূমি দখল করবে”- শেষদিকে পাখির সুর কেমন করুণ শোনায়। তার গলা বুজে আসে। চারদিকে সব চুপচাপ হয়ে যায়।
নদী তখন তার কলকল ধ্বণি শুনিয়ে চারপাশের নীরবতা ভাংতে চায়, বাতাস ঝিরিঝিরি শব্দ দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করতে চায়, ফুল তার গন্ধ ছড়িয়ে দিতে চায় চারদিকে, যাতে সবাই কষ্ট ভুলে ফুলের গন্ধেই মজে থাকে কিন্তু কেউই সফল হয় না। একসময় রাজপথ নীরবতা ভেঙে বলে, “এই ভূমি থেকে তার আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। আমি তার নীরব সাক্ষী, আমি দেখেছি কী করে পুরোনোপন্থী বলে তাদের ধনসম্পদ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তাদের নারীদের যথেচ্ছা ধর্ষণ করা হচ্ছে, তাদের জমির ফসল কেটে নেওয়া হচ্ছে; এখন তারা একে একে চলে যাচ্ছে এই দেশ ছেড়ে অজানার দিকে, আমারই ওপর দিয়ে, আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়, আমার অন্তর ফুঁড়ে বেরুতে চায়, আমি কিছুই বলতে পারি না, আমি শুয়ে থাকি চুপচাপ, নিথর, শুধু ওরা যখন আমার ওপর দিয়ে হেঁটে এই ভূমি ত্যাগ করে তখন আমি যতোটা পারি কোমল হই, আমি পেলব হয়ে থাকি ওদের পায়ের তলায়, যেনো ওরা এই ভূমির কোমলতাটুকুই মনে রাখে, সব কঠোরতা ভুলে যায়”- রাস্তার দু’চোখ বেয়ে জল ঝরে, আকাশও কাঁদে, সব ভিজে একাকার হয়ে যায় তখন।
কান্না থামে না, তারপরও রাজপথ বলে যায়, “এইতো সেদিন, মাত্র সেদিন একসঙ্গে কয়েকশ মানুষকে হত্যা করা হলো, তাদের অপরাধ কি জানো?”
কী? সবাই জানতে আগ্রহী।
“তারা একদিন এই ভূমির জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিল। তারা চেয়েছিল এই ভূমির মানুষেরা সবাই সমান হবে। সনাতন ধর্মকে কোনও নুতন ধর্ম ও তার অবলম্বীরা হত্যা করবে না, গুম করবে না, দখল করবে না তাদের জমি জিরেত বাড়ি ঘর নারীকে; এখানে মানুষ কাল নিরবধি সুখে ও শান্তিতে বাস করবে। কিন্তু তাদেরকে কাপালিক মিথ্যে অজুহাতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তারপর লোকদেখানো বিচারের রায়ে হত্যার নির্দেশ দেয়। লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়, যেমনটি পশ্চিমের বর্বররা করেছিল”।
তারপর একটি ন্যাড়া গাছ, যার শরীর থেকে হাতপামাথা সব কেটে ফেলা হয়েছে সে অস্ফুট স্বরে বলে, “এই যে আমাকে কেটে ফেলছে, এই যে পুরোনোপন্থী বলে নতুন ধর্মের ওরা যাদেরকে এই ভূমি থেকে বের করে দিচ্ছে, এই যে চারদিকে রক্তের নদী বইয়ে দিচ্ছে, এই যে বিপুল অর্থ ছড়িয়ে মানুষ কিনছে, যাদেরকে পারছে না তাদেরকে হত্যা করছে তার কেন করছে জানো?”
কেন? – সবাই ফিস্ফিসিয়ে জানতে চায়।
“কারণ এই ভূমির মানুষ যেনো ভীত হয়ে পড়ে দ্রুত, তারা যেনো আর কখনও সাহসী না হয়, কখনও যেনো প্রতিবাদের ভাষা শিখতে না পারে, কখনও যেনো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে না পারে কারণ তারা এসব শিখে গেলে কিংবা জেনে গেলে আবার সেই জনরাজকুমারের মতো এই ভূমি থেকে এই ব্যবচ্ছেদকারীদের উচ্ছেদ করবে, নির্বাসনে পাঠাবে, তাই চারদিকে কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ভয়ের সংস্কৃতি, বুঝতে পারছো তোমরা ভয়াল এক সংস্কৃতি, যেখান থেকে বেরিয়ে কেউ কোনও দিনও পারবে না মুক্তির কথা বলতে, মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে”।
“তবে কি জানো? এই কাপালিকের দিন শেষ হয়ে আসছে। সে নিজেও জানে না যে, তার চারদিকে নিজের অজান্তেই সে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য কাপালিকের। এদের মধ্য থেকে যে শক্তিশালী সেই-ই নতুন কাপালিক হবে, অভিষিক্ত করবে সে নিজেই নিজেকে আজকের কাপালিকের জায়গায়। আর সে হবে আরও নিষ্ঠুর, আরও ভয়ঙ্কর, আরও চতুর, আরও লোলুপ”।
“থাক আর বলো না, আর ভয় দেখিও না, আজকাল আর এই জনপদের মায়েরা শিশুকে ঘুম পারানোর জন্য দৈত্যের গল্প করে না, শিশুরা এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়ে অথবা প্রচণ্ড ভয় নিয়ে মড়ার মতো পড়ে থাকে বিছানায়।এদেরকে আর ভয় দেখিয়ে কী হবে। তার চেয়ে যা হচ্ছে হতে থাকুক, একদিন এই রক্তযজ্ঞের অবসান হবে, অবসান হবেই, কী বলো?”
“হয়তো হবে, হয়তো একদিন, আমাকে তোমরা বহু কালজ্ঞ আর ভবিদর্শী বলে থাকো, আমিও জানি না সেদিন কবে আসবে” – কথাটি বলে আকাশ নিজের শরীরে মুখ গুঁজে গুমরে কাঁদতে থাকে, তার ইচ্ছে করে এই ভূমির ওপর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়, মানুষের মতো আকাশও চাইলেই সব পারে না।
তারপর একদিন আসে সেই রাত, যে রাতে কাপালিককে হত্যা করা হয়। আবারও রক্তনদী থৈ থৈ করে। রক্তপচা দুর্গন্ধে এই ভূমির মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাস আঁটকে যেতে থাকে। কপালকুণ্ডলা তখনও বন্দী।
অবশ্য ততোদিনে এই ভূমির জনমানসের মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষ তখন সবকিছুরই বিচার করে অর্থ দিয়ে। নিহত কাপালিক মিথ্যে দিয়ে প্রখর সূর্যালোকের মতো সত্যকে ঢাকার প্রচেষ্টায় এতোটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিল যে, মানুষ তার মিথ্যেকেই সত্যি বলে ভুল করতে শুরু করেছিল।
একটি মিথ্যেকে একশবার উচ্চারণ করলে তা খানিকটা হলেও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে, অথবা কারো কারো কাছে তা সত্যের মতো শোনায়। মানুষের ভেতর পশুর মুখোশে ঘাপটি মেরে থাকা কাপালিকের পাণ্ডারা মানুষকে ভুল বুঝিয়েছে, ভুল বিশ্বাসে বিশ্বাসিত করেছে, মানুষের অন্তরে ও বাইরে বুনে দিয়েছে ঘৃণা বিদ্বেষ হিংসা রীরংসার বীজ, ততোদিনে সেব বীজ থেকে অংকুরই শুধু নয়, নির্লজ্জতার মহীরূহ সেই সব সতেজ সবুজ গাছকে ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেক ওপরে, অনেকটাই ওপরে। তাই নতুন কাপালিককে আর খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি, খুব সহজেই কপালকুণ্ডলাকে তার নুতন বন্দীশালায় নিয়ে যেতে পেরেছে এবং সেই সঙ্গে এই ভূমের মানুষকেও।
দুই.
এই কাপালিক বেশভুষায় চটকদার, রোদ-চশমার আড়ালে তার চোখ ঢাকা নেই, সে খোলা চোখেই ভেতরের নোংরামি প্রকাশিত করে শাসন করে এই ভূমি ও তার মানুষকে।
চারদিকে বানের জলে গৃহহারা ক্ষুধার্থ মানুষ যখন শ্যাওলার মতো ভাসে কাপালিক তখন হাঁটু অবধি রাবারের জুতো পরে পানিতে নেমে ক্ষুধার্থ মানুষের সামনে অন্ন তুলে ধরে আর সেই দৃশ্য রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে দেখানো হয়, দৃশ্যের পেছনে বাজে অপূর্ব মোহময় সঙ্গীত।
কাপালিক সপ্তাহের বিশেষ দিনে ধর্মবাদীদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রার্থণা করে, তারপর শরীরে ঈত্বর লোবান ঢেলে হাতে জুঁইয়ের গোড়ে ঝুলিয়ে যায় একের পর এক প্রেয়সী দর্শনে। রাষ্ট্রের প্রচারযন্ত্র অবশ্য শেষের দৃশ্যটি প্রচার করে না কিন্তু প্রথমটি অর্থাৎ সুদৃশ্য পোশাকে ধর্মাশ্রয়ীদের কাতারভূক্ত হয়ে দাঁড়ানোর দৃশ্যটি প্রদর্শণে কোনও কার্পণ্য করে না। যদিও তারই নির্দেশে এই ভূমের আদি নিবাসীদের সনাতন ধর্মালয়কে ভেঙে চুরমার করা হয়, কচুকাটা করা হয় সনাতন ধর্মবিশ্বাসীদের – বলাই বাহুল্য সে দৃশ্যও ঠাঁই পায় না রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে।
গরীব ভূমিহীন মজুর শিক্ষক কিংবা নৌকোর মাঝির শরীর শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়; শুধু খেয়েদেয়ে ধাঙড়দের শুয়োরের মতো মোটা হতে থাকে কাপালিকের জন্য, কাপালিকের হয়ে, কাপালিকের পক্ষে, কাপালিকের নির্দেশে কাজ করে যারা তারা; শুধু তারাই বংশবৃদ্ধি করে যারা প্রথম কাপালিকের পক্ষে কাজ করার জন্য পশ্চিমের শত্রুদেশে পলায়ন অবস্থা থেকে ফিরে এসেছিল; এই ভূমের মানুষেরা যেনো বংশবৃদ্ধির কৌশল ভুলে যায়, তারা সন্তান উৎপাদন করে সত্য কিন্তু তারা মনে-মানসে শীর্ণ, জীর্ণ, চলচ্ছক্তি-রহিত।তাদের জমি যায়, তাদের যুবতী মেয়েরা রাস্তায় বেরুলেই টেনে নিয়ে যায় ধর্মের টুপি পরা পুরুষেরা, তাদের যু্বকেরা চাকুরি পায় না; কারণ তারা মরুভূমির ধর্মে বিশ্বাস করে না, তারা সনাতন ধর্মের অনুসারী।
শুধু কি সনাতন ধর্মবিশ্বাসী? কাপালিকের হাত থেকে মুক্তি পায়নি কেউই। গণতন্ত্রকে হত্যা করে তার কবর রচিত হয়, ছাত্রের হাতে ওঠে পিস্তল গুলি; মরুধর্মবাদীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় রগ কাটার তরবারি। মাৎস্যান্যায় বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে তাই-ই ঘটে এই ভূমে। আবার মানুষের পিঠ এসে ঠেকে দেয়ালে, আবার মানুষ মৃত্যুকূপে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ঘুরে দাঁড়ায়। কাপালিক তার বাহিনী লেলিয়ে দেয়, পাখির মতো গুলি করে কিংবা মানুষের মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করে মানুষ। কপালকুণ্ডলা তাকিয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তার।যদিও তখন মানুষেরই জয় হয়; আজীবন, এই ধরা ইতিহাসে তাই-ই হয়েছে।
কিন্তু কপালকুণ্ডলা তাকিয়ে দ্যাখে, তারই বুকের ওপর আবার মানুষের জয় কী ভাবে হাতছাড়া হয়ে যায়। আবার কী করে ছাগচর্ম পরিধান করে নেকড়ে এসে মানুষের বিজয় ছিনিয়ে নেয়। গণতন্ত্রকে কী করে জলপাই রঙ উর্দির পকেটে পুরে রেখে দাঁত কেলিয়ে হাসে, উদ্বোধন করে মরুধর্মালয়, মানুষের ঘর ভেঙে দিয়ে সেখানে গড়ে তোলে গৃহপালিত মারু’র (মানুষ ও গরুর শংকর) খামার। কপালকুণ্ডলার ইচ্ছে করে আত্মহত্যা করে মরার, কিন্তু আত্মহত্যার কৌশল সে শেখেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ যুগটা আর সেই সত্যযুগ নেই যে, কপালকুণ্ডলা বলবে, ধরণী দ্বিধা হও, আমাকে তোমাতে আশ্রয় দাও; এখন ঘোর কলি, আর কলি বলেই কপালকুণ্ডলা বেঁচে থাকে, যন্ত্রণা সয়ে, কষ্ট নিয়ে, নষ্টামি দেখতে দেখতে, ধর্মের তরবারির তলে বার বার রক্তাক্ত হতে হতে।
এই কপালকুণ্ডলার ইতিহাস তাই চলমান। এর শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই; অনাগত পৃথিবী এই ইতিহাসের সাথে পথ হাঁটবে এবং তাতে নতুনতর সংযোজন ঘটাবে; যদিও এই ইতিহাসের সবটাই বিয়োগান্তক।
লন্ডন্। আগস্ট, ২০০৮।
(লেখাটি অসম্পূর্ণ। কবে শেষ করতে পারবো জানি না। তারপরও সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হলো)
মন্তব্য
মাসুদা আপা, মিথের আশ্রয়ে বাংলার ইতিহাস টানলেনই যখন আরেকটু রয়েসয়ে তাড়াহুড়ো না করে চালাতে থাকুন।
ভেতরে আরেকটু ডিটেলস দিতে পারেন। পর্বও ভাগ করে ফেলতে পারেন।
উপন্যাসের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে ভালো হয় ভূখণ্ড বা সময়কে সম্পূর্ণ প্রতীকী পর্যায়ে নিয়ে গেলে। একটা বিশাল আপেক্ষিক সময়কে এতো ছোট পরিসরে ধরা সম্ভব নয়। তবু আমি আশ্চর্য হই আপনি গোটা বিষয়টাকে এতো অল্পের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন কীভাবে ! আরো কিছু মালমশলা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে টেনে আরেকটু লম্বা করে দিলে মনে হয় খারাপ হবে না।
আপনি পারবেন বলেই আপনাকে বলা।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
পরিকল্পনা ভালো।
তবে একটু বেশীই সাধারণ - পুণরাবৃত্তি মনে হলো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন