অসংলগ্ন

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: সোম, ২৬/০১/২০০৯ - ৮:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
একটি মাত্র শপথের জন্য বেঁচে আছি
থাকবোও, আরও কিছু কাল
কেউ দানছত্র থেকে অনন্ত ভালোবাসা বিলোতে পারে না
অর্থনীতির রেভিন্যু সম্পর্কেও সমান প্রযোজ্য

যদি কাঁদি কখনও, ধরে নিও তা যে কোনও শিশুর
জানোইতো মেয়ে শিশু বেশি কাঁদে
আমার জীবন, আমি, সেতো এক খেলনা, কিংবা পুতুল
দম দিয়ে দিতে পারো, সময়মতো
ধরে নিতে পারো আমি তোমার এক ধরনের ব্যাথা
যা তোমাকে জানায় যে, তুমিও বেঁচে আছো।

২.
আমি দাঁড়িয়ে আছি দুই ভিন্ন পৃথিবীর মাঝখানে। আমার সামনে পঁচা গলা মরদেহের মতো সমুদ্র, কৃষ্ণকায় বিশাল গহ্বরের আকাশ।আর বিস্তীর্ণ ভূমি যেনো দীর্ঘ বছর তুষারাবৃত থাকার পর শুকিয়ে সিঁটিয়ে থাকা বল্গা হরিণের শরীর। এর মাঝে একমাত্র প্রাণচিহ্ন দেখা যায় মড়া গাছটায়, স্বর্গের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে যার কংকালসার শাখা, পুরোনো কবরের কাঁদামাখা হাঁড়ের মতো।প্রাগৈতিকাহিসক পোকারা এই সব গাছের সব স্মৃতি শুষে খেয়েছে, এখন এই আঁধারে তাই তাদের আর গাছের মতো লাগে না মোটেও।
তারপরও তারা কথা বলে, “আমি আমার পাতায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, ভালোবাসাও পুড়ে গিয়েছিল ছাই হয়ে”।কথাগুলো কেমন স্বীকারোক্তির মতো শোনায়, “ এবং সেই ছাই-এর ভোজ ছিল অপূর্ব, বলরুমের উজ্জ্বল আলোয় পেয়ালায় রাখা ছাই, স্মৃতির মতো জ্বলজ্বলে ছিল।অথচ এখন আমি কেমন পরিত্যক্ত” – যেনো গাছেরা কিংবা তার শাখাপ্রশাখারা আগেই জানতো, তারা একদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, একা সঙ্গহীন এমনকি অলখে।
আমি ঘুরে তাকালাম আমার পেছনের পৃথিবীর দিকে। আকাশ সেখানে উজ্জ্বল, সমুদ্র শক্তিময়, বাতাসে জীবনের সুগন্ধ ভাসছে; আমি এগোই, পেছনের এই পৃথিবীর দিকে। দূরে একজন স্বর্ণাভ মানুষকে দেখি, দাঁড়িয়ে আছেন, আমার সামনে যে পৃথিবী ছিল তার দিকে তাকিয়ে, তাকে প্রশ্ন করি, কী হয়েছে? সে চোখ বন্ধ করে,তার চোখের পাতা ভাঙাচোরা, সে ওই গাছেদের মতো স্থবির, অথচ তার শরীরে প্রাণ আছে বোঝা যায়, ধুক্ পুক্ ধুক্ পুক্।সে শ্লেষা জড়ানো গলায় বলে, “স্বত্ত্বায় নরক রেখে, আমি বেঁচে আছি যদিও”।
এবার আমি তার চারপাশে তাকানোর চেষ্টা করি, দেখি, তারমতো আরও অসংখ্য মানুষ, মৃতের মতো, তবু মৃত নয়, এতোক্ষণ যা সুগন্ধ মনে হয়েছিল তা যেনো সুগন্ধ নয়, পুরাতন পুঁজের সাথে তার মিল রয়েছে। এইসব মানুষেরা চলছে ফিরছে প্রার্থণা করছে, সেও এক মৃত ঈশ্বরের, মরা গাছে যার শরীর পেরেক দিয়ে আঁটকানো রয়েছে। এই প্রথম আমার মনে হয়, আমার সামনে ও পেছনে, এই দুই পৃথিবীতে কোনও পার্থক্য নেই, কেবল গাছ আর মানুষ ছাড়া, যদিও দুই-ই মৃত।

৩.
এই যে হেঁটে যাওয়া, বন্ধ্যা পৃথিবীর পথ ধরে
একি পথ হাঁটা নাকি প্রতি পায়ে একটি ঝাঁকুনির জন্ম দেয়া
যার অসংখ্য যোগফল হতে পারে ভয়াবহ এক ভূমিকম্প
চোখের সামনে দাঁড়ানো বিশাল দালান
ইঁট কাঠ লোহা লক্করের স্তুপ বৈ তো কিছু নয়
মাথার ভেতর প্রশ্ন, লালসা সবই বাস্তব, নাকি মূল্যহীন সবই তা
মানুষ আমি, প্রাণময়, বুদ্ধিদীপ্ত অথবা হতে পারে পথের ধুলোকে অযুত নিযুতবার ভাঙলে যে অনু কিংবা পরমাণু পাওয়া যাবে তার চেয়েও মূল্যহীন।পৃথিবীকে সম্পূর্ণ বন্ধ্যা না করা পর্যন্ত আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অবিরাম চেষ্টায় আমরা কর্কট কিংবা আমাশয়ের জীবানুর মতোই, লোভাতুর।

৪.
জীবনের বৈয়ামে হাত দিয়েছিলাম, সন্তর্পণে, হাত তুলে দেখি হাত ভর্তি কালো রং, সেই শিশুকালে একবার বাবার কালির দোয়াত ঢেলে কালি খেয়েছিলাম; এখন আমি হাতের এই কালো রং দিয়ে সারা শরীরে ছবি আঁকি, বিচিত্র প্রাণের ছবি; কালির বৈয়াম উল্টে দিয়ে তার ভেতর সাঁতার কাটি দিনের পর দিন, আয়নায় নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখি কালো স্তুন, নাভির ভেতর কালিদীঘি, দু’পায়ের শুরুতে কালো ঘূর্ণি ঘুরে ঘুরে ওপরে তলিয়ে যাচ্ছে কবিতার মতো; আমার কালো সন্তান, আমার কালো কবিতারা।

৫.
সারা পৃথিবীজুড়ে এতো কবর, এতো ধ্বংসপ্রাপ্ত নগর সভ্যতা
একা ওবামা কি করবেন?
মানুষ যদিও বলে মানবতার জন্য তিনি এক শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি
অথচ সত্যটা কি কঠিন!


মন্তব্য

অপ্রিয় এর ছবি

সারা পৃথিবীজুড়ে এতো কবর, এতো ধ্বংসপ্রাপ্ত নগর সভ্যতা
একা ওবামা কি করবেন?

তেমন কিছুই করতে পারবেন না মানুষকে কিছুদিন ভূলিয়ে রাখা ছাড়া। "ওবামা বাম" শুধু মলম হিসাবেই জনপ্রিয় হবে, দুনিয়াব্যাপি ছড়িয়ে পড়া ধনতান্ত্রিক ক্যন্সারটা সে কিভাবে সারাবে?

এরিখ ফ্রম খোলাখুলিই বলেছিলেন "আমরা পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদেরকে সভ্য ভাবি এবং সেই সভ্যতা সারা দুনিয়াব্যাপি রপ্তানী করি অথচ গত হাজার বছরে অন্তত হাজারটা বড় ধরনের যুদ্ধ আমরা বাধিয়েছি এবং গত পঞ্চাশ বছরে দু দুটো ব্যাপক যুদ্ধে সারা পৃথিবীকে জড়িয়েছি। অথচ ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে দেখুন, গত হাজার বছরে তারা ব্যাপক কোন যুদ্ধে জড়ায়নি। সভ্যতার সংজ্ঞা আমাদের ফিরে লেখা উচিত্।"

+++++++++++++++++++++++++++++
ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এই পাপীর, তবে বিশ্বাস করি এই আমি বিশ্বাসীদেরই প্রার্থনার ফসল

+++++++++++++++++++++++++++++
ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এই পাপীর, তবে বিশ্বাস করি এই আমি বিশ্বাসীদেরই প্রার্থনার ফসল

রণদীপম বসু এর ছবি

কবর থেকে তো মানুষগুলো উঠে আসবে না ফের ! তবে মধ্যপথে অসময়ে যেনো অনিচ্ছুক কবরে যেতে না হয়, সেই আশাবাদ মানুষের চিরায়ত চাওয়া বলেই হয়তো একজন মাটিলগ্ন মানুষ ওবামার প্রতি এতোটা আস্থা রাখতে চায়। এক ওবামা হয়তো যথেষ্ট নয়। কিন্তু প্রতীক ওবামা তারচে' অনেক বড় কিছু হয়তো।

আপনার লেখাটি পড়ে যে বোধটা আবারো নাড়া দিলো, হতাশার গোপন গভীরে আসলে চিরায়ত আশার সুরই বাজে...

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ওবামা নিশ্চিতভাবেই আশাবাদী মানুষদের আরেক দীর্ঘশ্বাসের নাম ।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

দুর্দান্ত !

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

মুগ্ধ !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।