২৬ মার্চ ২০০৯

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৩/২০০৯ - ৮:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
ছেলেটির হাসি থামিয়ে দিয়ে, মেয়েটি, “না হাসবে না, একদম হাসবে না। এখন হাসির সময় নয়”।
- এখন তবে কিসের সময়? হা হা হা দ্যাখো দ্যাখো আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
- আমি কি এমন হাসির কথা বলেছি? আমি বলেছি, চলো বিয়ে করি।আহা আমার বাড়ি থেকে চাপ আসছে না বুঝি?
- তাই নাকি? চারদিকে এতো চাপ? ইয়াহিয়ার চাপে এই রাষ্ট্র চিড়ে চ্যাপ্টা; বঙ্গবন্ধুর চাপে এই চ্যাপ্টা চিড়ে থেকে নতুন রাষ্ট্র বের করে আনার চাপ। এতো চাপ চারদিকে, সেই সঙ্গে নতুন একটা চাপ কি করে নেবো তাই ভেবে হাসছি।
- চোখ বন্ধ, করো, করোই না।
- নাহ্ চোখ বন্ধ করে রাখার সময় এ নয়, এখন সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকার সময়। নইলে তুমিও মরবে, আমাকেও মারবে। তারচেয়ে এসো, আমরা একটা খেলা খেলি।
- কি খেলা?
- দাড়াও বলছি, আমি যা দেখি তুমি তা দ্যাখো?
- তুমি কী দ্যাখো?
- আমি দেখি দু’টো চোখ, কাজল টানা, দু’টি যুগল ভুরু, একটি তীক্ষ্ণ নাক, তার ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম
- এই ভালো হবে না বলছি, তুমি আমার কথা বলছো।
- আহা শোনোই না, আমি দেখছি, লাল টিপ, সবুজ শাড়ি, এলোখোঁপা থেকে বেরিয়ে আসা চুর্ণ চুল, সিঁথি. ..
- এই থাক্ থাক্ আর বলো না, আমার লজ্জা লাগছে, ভীষণ লজ্জা।
- না না শোনো, শোনো, কোনও গয়না নেই শরীরের কোথাও, পায়ে শুধু আলতা, দুধে পা ডুবিয়ে এলো সে, সকল কাঁটা ধন্য ধরে
- কে সে? তার মানে সে আমি নই? অন্য কেউ?
- হা হা হা হা সে তুমিই, তুমিইতো, তুমি ছাড়া আর কে? তোমাতেই তো আমি দেখেছি আমার মাকে, আমার জন্মভূমিকে। এসো, সামনে এসে দাঁড়াও, তোমায় আরেকবার দেখি।
(মেয়েটি চোখ বন্ধ করে দাঁড়ায়। তারপর আলো-আঁধারে এক অদ্ভূত সুর বাজে)

২.
সুর থামতেই, যুদ্ধ। কিছু যুদ্ধের চিত্র। ধীরে ধীরে তা মিলিয়ে যাওয়ার পর, অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে আলো, মেয়েটি সেই সবুজ শাড়ি আর লাল টিপ পরা ঠিকই, শুধু তার কপালের টিপটি লেপ্টে আছে..আর সব ঠিক থাকে।

-তোমার দিকে তাকাতে পারছি না। আমার অন্ধ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
- কেন তাকাতে ইচ্ছে করছে না, এখনতো আরো বেশি করে তাকাবে। তুমি চেয়েছিলে স্বাধীনতা, পেয়েছো, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। তুমি আমাকে দিয়েছো। কিন্তু তুমি যা পেয়েছো তার তো বিনিময় হয় না। এ এক অমূল্য রত্ন। একে এখন সামলে রাখার দায়িত্বও তোমার।
- নাহ্ নাহ্ আমি তোমার মৃত্যুকে এই করুণ মৃত্যুকে নিতে পারছি না। আমার কিছুর প্রয়োজন নেই। কিচ্ছু না। তুমি ফিরে এসো। ফিরে এসো, ফিরে এসো আমার কাছে।
- পাগলামি করে না মানিক। এই যে তাকাও আমার দিকে, তাকিয়ে দ্যাখো, আমার সবুজ রং, লাল টিপ, তুমিই না এই স্বপ্ন দেখেছিলে? এখন স্বপ্নটা সত্যি হয়েছে, তোমরা একটি দেশ পেয়েছো। আমি নেই তো কি হয়েছে? এই দেশ তোমার, এই মাটি তোমার। এতে কারো ভাগ নেই, কোনও দখলদার নেই। শেষ যেবার দেখা হয়েছিল, সেদিন তুমি বলেছিলে, এসো আমার সামনে দাঁড়াও, তোমায় দেখি। আজকে আমি বলছি, এসো তোমায় দেখি। তুমি একটি দেশ এনেছো। তুমি সূর্যের কাছ থেকে রং এনে এবার আমায় সাজাবে।
- আমি তোমাকে মৃত দেখতে চাইনি। তোমার মৃত্যু চাইনি।
- কে বলেছে আমি মৃত? আমি এর চেয়ে জীবনময় আর কখনও ছিলাম না। সত্যিই ছিলাম না। তুমি আমাকে প্রাণ দিয়েছো, এবার আমাকে নির্মাণ করো শাখা-প্রশাখায়, সবুজে-সুন্দরে।
- না না এই স্বাধীনতা, তোমাকে হারানোর বিনিময়ে স্বাধীনতা, আমার দরকার নেই। আমি চাই না, চাই না। (ছেলেটি চুল ছেঁড়ে, পাগলের মতো আচরণ করে)
- (মেয়েটি এবার শক্ত, শান্ত ও দৃঢ় কন্ঠে বলে) অনেক হয়েছে, আর নয়। এসো, আমার হাত ধরো। উঠে দাঁড়াও। তুমি এমন করলে আমি আর আসবো না। তুমি যে পথ নির্মাণ করবে, যে পথে হাঁটবে, আমি তোমার সাথে যাবো, তোমার সঙ্গী হবো। শুধু কখনও যদি এই দেশের সঙ্গে, এই মাটি নিয়ে ছিনিমিনি খ্যালো, তবে যেনো, আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো, জন্মের তরে। এসো, হাতে হাত রাখো, চলো হাঁটি। আমাদের এখন হাঁটতে হবে মাইলের পর মাইল, নির্মাণ করতে হবে, নগর, বন্দর আর এই দেশমায়ের শরীর।
(ওরা দু’জনে হাঁটতে শুরু করে। আলো নিবে যায়)

৩.
- কতো বছর বয়স হলো আমাদের বলো তো?
- অনেক বছর। জানি না, জানতে চাই না। আমি ক্লান্ত। পরিশ্রান্ত। আমার আর ভালো লাগে না। তোমার কাছে যেতে চাই আমি। আমাকেও তোমার কাছে নিয়ে যাও, দয়া করো। বেঁচে থেকে এই অসহায়তা আর দেখতে পারছি না আমি।
- আমি জানি, আমি বুঝি তোমার কষ্ট। তুমি সইতে পারছো না, চারদিকে এই অনাচার। এই লুটপাটের রাজনীতি। অস্ত্রের ঝনঝনানি। তুমি ভাবছো, এর জন্য কি যুদ্ধ করেছিলাম? এর জন্যই কি আমি হারিয়েছিলাম আমার প্রেমিকাকে? কি ভাবছো না?
(ছেলেটি ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে)
মেয়েটি আবার বলে, “দ্যাখো, স্বাধীনতা খুব ছোট্ট একটি শব্দ, কিন্তু এর ব্যপ্তি মহাসাগরের মতো। একে পার হতে হলে কতো বড় জাহাজ প্রয়োজন জানো? তুমি জানো, জানো না?
- না জানি না।জানি না। আমি এ জন্য যুদ্ধ করিনি যে, স্বাধীনতা-বিরোধীরা দেশের মন্ত্রীত্ব নেবে। আমি এ জন্য যুদ্ধ করিনি যে জাতীয় পতাকাকে নিয়ে ওরা আবার মস্করা করবে। আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি যে, জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর কথা কেউ কখনও ভুলেও ভাববে। আমি জয় বাংলা শ্লোগানটি শুধু কোনও দলকে দিতে চাইনি। চেয়েছি সারা দেশের মানুষ এই শ্লোগানকে ধারণ করুক। এই বিভ্রান্তি, এই বিভেদ, আমি আর নিতে পারছি না। আমাকে নিয়ে যাও, আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। নইলে আমি নিজেই একদিন (ছেলেটি কথা শেষ করে না)
- কি তুমি কি? একদিন কি? বলো? বলতে হবে তোমায়। (মেয়েটিও উত্তেজিত হয়ে ওঠে) কি আত্মহত্যা করবে? নাহ্ তোমাকে আমি এতোটা দুর্বল ভাবিনি। আমি ভুল করেছিলাম। প্রচণ্ড ভুল। আমি তোমার ওপর আস্থা রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি পারবে, সে কারণে মৃত হয়েও আমি মরতে পারিনি। তোমার পাশে, কাছে সারাক্ষণ থেকেছি। কিন্তু তুমি? আজ তুমি এ আমায় কি শোনাচ্ছো? নাহ্, আমিও আর নেই, যাচ্ছি। থাকো তুমি। (মেয়েটি অন্ধকারে মিলিয়ে যায়)
এবার ছেলেটি একা।
- না না তুমি যেও না, প্লিজ যেও না। এই নতুন যুদ্ধ আমি একা লড়তে পারবো না। আমি ক্লান্তগো, আমি খুবই ক্লান্ত। আমার মাথায় হাত বুলোনোর কেউ নেই। আমার রুক্ষ চুলে সামান্য জল ঢেলে দিয়ে নরোম করার কেউ নেই, তুমি ছাড়া। তুমি আছো, তোমাকেই ঘিরে আছে সৌর রশ্মি, তোমাকে ধরেই তো বেচেঁ আছি, তুমি এসো, ফিরে আসো। প্লিজ, আমার এই বিপন্ন অস্তিত্বকে এভাবে ছিঁড়ে-খুঁড়ে তুমি যেতে পারো না। এসো, এসো. . . (ছেলেটি কষ্টে বিদীর্ণ হতে থাকে)

৪.
চোখ বন্ধ করে ছেলেটি পড়ে আছে। ধুলি-মলিন চেহারা। বয়স হয়েছে অনেক।
মেয়েটি ছেলেটির কাছে এসে বসে। “থাকতে পারলাম না। তুমি ডেকেছো আর আমি আসিনি কখনও, এমনটা হয়েছে কখনও বলো।হয়নি।আমি জানি, তুমি খুব ক্লান্ত। চলো আমি তোমায় ঘুম পারিয়ে দেই। এক গভীর ক্লান্তিহীন শান্তির ঘুম। এসো, আমার কাঁধে মাথা রেখে একটু জিরিয়ে নাও। তারপর তোমায় আমি নিয়ে ঘুমের দেশে”।
ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি ঘুমিয়ে গেলে কি হবে এই দেশের? এই মাটির? তুমিই না আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলে? বলেছিলে, এর কিছু হলে তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে?”
- হ্যাঁ, বলেছিলাম। এই মাটির কিছু হয়নি, শুধু কিছু মানুষ নামের অমানুষ এর ওপর অনাচার চালাচ্ছে। মাটি ঠিকই আছে, আর আমার কি মনে হয়েছে জানো? এই এতো বছরে আমি একটি কথাই বুঝেছি, মাটি নিজেই নিজেকে রক্ষার ভার নেয়। সে তার নতুন সন্তান উৎপাদন করে তার হাতে ভার তুলে দেয় তাকে রক্ষার। তুমি এই মাটিকে মুক্ত করেছো, তাকে পাহারা দিয়েছো এতোকাল, তোমার ভূমিকায় তুমি কখনও অবহেলা করোনি। যারা করেছে তারা মাটির সঙ্গে বেঈমানি করেছে। মায়ের সঙ্গে বেঈমানীর পাপে তারা মহা পাতক, তাদেরকে না এই মাটি, না এই মাটির ভবিষ্যত বংশধর, কেউই মনে রাখবে না। ঘৃণা ভরে থুথু ছিটাবে তাদের ওপর। কিন্তু এই মাটির ভবিষ্যত মানুষেরা তোমাকে ঠিকই মনে রাখবে। আজ থেকে একশ বছর পরে তারা তোমার সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, “এই যে দ্যাখো তোমরা, এখানে শুয়ে আছে একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের পূর্ব পুরুষ, এনেছিলো সূর্যের কাছ থেকে একখণ্ড জমি, লাল সবুজ পতাকা, যার নাম বাংলাদেশ”। তুমি এর চেয়ে বেশি আর কিছু চেয়েছো কি?
- না চাইনি।
- তবে? তবে চলো, এবার, তোমার মিশন শেষ হয়েছে। তুমি যা দেয়ার দিয়েছো, এখন একে রক্ষার দায়িত্ব তোমার পরবর্তীদের। মনে রেখো, প্রতিটি বাঙালি একেকজন একেক প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ কেবল একাত্তরেই হয়েছিল, একথা ভুল।হ্যাঁ, বলতে পারো যুদ্ধ শেষ হয়েছিল মাত্র, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা চলতেই থাকবে, অনাগত কাল ধরে। বায়ান্নতে তোমার পূর্ব পুরুষ শুরু করেছিল, তারা তুলে দিয়েছিল তোমার হাতে যুদ্ধের দায়িত্ব, তুমি নব্বইতে তুলে দিয়েছো আরেকজনের হাতে। এখন তারা বয়ে নিয়ে যাবে সামনে। এই রিলেরেস চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে, জন্ম থেকে জন্মান্তরে। এভাবেই একটি জাতি টিকে থাকে, নদী বহমান না থাকলে মরে যায়, জাতিকেও তেমনি আজীবন বহমান থাকতে হয়।
- তার মানে তুমি বলছো যে, আজকে যে কুলাঙ্গাররা স্বাধীনতা-বিরোধীদের হাতে পতাকাকে অপমান হতে দিচ্ছে, আগামিতে কেউ না কেউ সেই পতাকা এই দুশমনদের হাত থেকে কেড়ে নেবে?
- অবশ্যই নেবে। না নিলে তারা ভুগবে, পস্তাবে। আমি তোমাকে আজ ভালোবেসে আমার কাছে নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু ওদেরকে ভালোবাসার জন্য কেউ থাকবে না, ওদেরকে কাক চিল শকুনে খাবে; দেশের প্রতি এই অনাচারের জন্য আজীবন ধিক্কার দেবে। তুমি ভেবো না, জেনেশুনে কেউ এই ধিক্কার গ্রহণ করতে চাইবে না। তুমি এসো, তোমার সময় হয়েছে যাবার। তোমার দায়িত্ব শেষ, তুমি সামনের দায়িত্ব আগামির হাতে তুলে দিয়ে চলো।
- মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি; মুক্তির জন্য যুদ্ধ নিরন্তর; চলো
(ওরা হাঁটে; আলো নেবে. . . নাকি আলো জ্বলে, অন্ধকারভেদী তীব্র এক আলো!!)


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নাজনীন খলিল এর ছবি

তোমার সব লেখাই চমৎকার। কেমন আছো?

অনেক শুভেচ্ছা।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

চলুক স্বাতীর উঠোনের সবগুলি গল্প পড়ে শেষ করেছি । খুব ভাল লেগেছে ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

তানবীরা এর ছবি

চলুক
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।