আজ মারলং কাকার গল্প বলি, উনার নাম মারলং না অন্য কিছু আমি জানি না, উচ্চারণটা কেমন তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করিনি। মানুষটা লম্বায় ছ’ফুট বা তার চেয়েও বেশি হবেন। খুব ছোট্টবেলার কথা, যখন সবকিছু দেখতে বিশাল মনে হতো। মারলং কাকার গায়ের রং “পাটনাই গমের” মতোন; আমাদের ওদিকে কেউ ফর্সা হলে তাকে গমের মতো ফর্সা বলে তুলনা করা হয়। চোখে সুর্মা টানা, লম্বা আলখাল্লা পরনে, কোঁকড়া চুল, পায়ে চামড়ার চটি, সঙ্গে একটি চামরার “মিশক”-এ ভর্তি জল, একটি লম্বা ব্যাগ ভর্তি নানান সামগ্রী – মারলং কাকা আসেন, গভীর রাতে। আমরা তখন গভীর ঘুমে। সকালে উঠে দেখি, আমাদের বাড়ি ভর্তি মানুষ, মারলং কাকাকে ঘিরে বসে আছে। আমরা চোখ ডলতে ডলতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, মারলং কাকার জলদগম্ভীর স্বর, “চোখ ধুইয়ে আইসো”। আমরা দ্রুত সামনে থেকে সরে যাই, চোখ ধুতে গিয়ে, গোটা মুখ ধুয়ে ফেলি।
মারলং কাকা বছরে একবার বা দু’বার আসেন, আমাদের ওখানে। সারা বছর তিনি মক্কা-মদীনা-সিরিয়া’য় ঘোরাঘুরি করেন।তিনি আমাদের দেশে আসেন কোরআন বিলাতে। কেউ কেউ বলেন, মারলং কাকা মক্কাবাসী, কেউ বা বলেন মরোক্কান, কেউ বা বিশ্বাস করেন যে, তিনি সিরিয় বা মিশরীয়। কিন্তু মারলং কাকা যেখানেই যান বিনামূল্যে কোরআন ফেরি করার সঙ্গে সঙ্গে একটি বিয়েও করেন। আমাদের গাঁয়েও তার একটি স্ত্রী ও সন্তান ছিল। তারা সারা বছর এর ওর বাড়িতে কাজ করে, কিংবা বেশিরভাগ সময়ই আমাদের বাড়িতে এসে থাকতো। আমরা মারলং কাকার স্ত্রীকে ডাকতাম “ছিরার মা”, আসলে তার ছেলেটির নাম রাখা হয়েছিল ছিরাযদ্দি, সিরাজউদ্দিন-এর গ্রাম্য উচ্চারণ। আমাদের ওখানে নাম বিকৃত করার এক অদ্ভূত প্রচলণ আমাকে আশ্চর্য করতো খুব।
যাহোক, মারলং কাকা যে বারই আসতেন, সেবারই তাকে ঘিরে আমাদের বাড়ি ভর্তি হয়ে যেতো মানুষে। কেউ আসতেন কোরআন শরীফ নিতে, কেউ বা আসতেন জল পড়া নিতে, কেউ তাবিজ-কবজ বা সুতো পড়া নিতে। আমাদের বাগানের সামনে কাচারি ঘর, সেই ঘরে মারলং কাকা জমিয়ে বসতেন। আমার বড় কাকার সঙ্গে মারলং কাকার ঘনিষ্ঠতা চরম প্রকৃতির। আমার বড় কাকার যে ছড়িটি ব্যবহার করেন, যে গুলদানি থেকে তিনি নষ্যি নেন, যে চামড়ার খড়মটি তিনি পরেন, যে রুপোর গড়গড়ায় তিনি তামাকু সেবন করেন, যে লোহার ইস্ত্রিটি দিয়ে তার পাজামা-পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করা হয় – সবই মারলং কাকার দেয়া। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো বড় কাকা নিজেও মারলং কাকারই দান বুঝি। আমাদের বাড়িতে আমার বড় কাকার কথার ওপর কথা নেই। আমার পিতা ও বাকি দু’ই খুল্লতাত বড় কাকার কথায় ওঠেন এবং বসেন। তাদের স্ত্রী’রা তো হুকুমের বা’দী।
যাহোক, বড় কাকার সঙ্গে মারলং কাকা সারাদিন বসে গুঁজগুঁজ ফুস ফুস করেন, তিনি এলে ডেক্চি ভর্তি করে রান্না হয়, খাসি জবাই হয়, মারলং কাকা মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। কাবুলিওয়ালার মিনি রামদয়াল কাক-কে “ক্যাওয়া” বলে হেসেছিল, আর আমরা হাসতাম মারলং কাকা মাছকে “মাছ্ছি” বলেন বলে। ততোদিনে যেহেতু কাবুলিওয়ালা পড়া হয়েছিল সেহেতু মারলং কাকাকে আমার কাবুলিওয়ালাই মনে হতো, মক্কী-মাদানী কিছু মনে হতো না। অবশ্য এর পেছনে আমার মায়ের কথাও কানে এসে থাকবে, সেটা একটু পরে বলছি।
মারলং কাকা থাকতেন বড় জোর তিন রাত, কোথাও নাকি তিন রাতের বেশি আতিথ্য নেয়াটা ধর্ম-বিরোধী। এই তিন দিন বাড়ি ভর্তি মানুষজন এবং সেই সঙ্গে কোরআন পাঠের আসর, মারলং কাকার বয়ান, তাও মাত্র এক সন্ধ্যা। এই সন্ধ্যার জন্য অবশ্য যে বিশাল আয়োজনটি হতো তার কথা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। কিন্তু অনেক বড় গল্পকে ছোট্ট করে বলতে গেলে এভাবে বলা যায় যে, মারলং কাকার আসা উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে যে সব রান্না হতো সারা বছর এমনকি দুই ঈদেও সেরকম রান্না হতো না।
আমার স্মৃতিতে মারলং কাকা বসে আছেন চোখ বন্ধ করে, তার চারদিকে মানুষজন, বেশিরভাগই পুরুষ, আর নারীরা কেউ বাটি হাতে, কেউ সুতো হাতে কেউ বা শুধু শুধুই শরীর থেকে বাড়তি কাপড় বেড় করে তা দিয়ে মুখ ঢেকে। গ্রামের মহিলাদের এই দাঁড়ানোর ভঙ্গীটি আমাকে ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করতো। আমিও এক সময় ওইভাবে দাঁড়াতাম, ক্রমশঃ শহুরে হয়ে আমি এখন হয়তো আর ওভাবে দাঁড়াতে পারবো না। সে জন্য আমার কষ্টের সীমা নেই।
মারলং কাকার দাড়ি নেই, তার মুখ মেয়েদের মতো, মসৃন, ঠোঁট দু’টো বেশ পাতলা। চোখ বন্ধ করলেও তার সুর্মা টানা কোটরে যাওয়া চোখ দু’টোকে আমার কেন যেনো খোলা মনে হতো। যেহেতু আমাদের বাড়িতেই উনি উঠতেন সেহেতু আমরা পেতাম খেজুর, বাদাম, পেস্তা এইসব শুকনো ফল, যার মধ্যে আখরোট খেলে আমার বমি পেতো। এখনও পায়। আর সবচেয়ে খারাপ লাগতো, মারলং কাকার গাল টিপে দেয়া, প্রচণ্ড জোরে উনি গাল টিপে দিতেন, ব্যাথা পেতাম, মাকে গিয়ে বলতাম, মা বলতেন, সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না আর। কিন্তু আমাকে টানতো খুব উনার চারপাশের মানুষজন, উনাকে ঘিরে বসে থাকা মানুষগুলির মুখ। সবাই আমার চেনা কিন্তু উনি এলে কেমন অচেনা মনে হতো মুখগুলো।
মারলং কাকা আসতেন চৈতালি ফসল অর্থাৎ রবিশষ্য উঠার ঠিক পরে পরে।ফালগুন শুরু হতে হতে। তখনও গরম পড়েনি তেমন, পড়বো পড়বো করছে। কেন যেনো তখন অমাবশ্যাও থাকতো, কিংবা আমার স্মৃতিতে শুধুমাত্র অন্ধকার রাতগুলির কথাই আছে। সেই সব রাতে আমার মা আমাদের তাড়াতাড়ি ঘুমুতে বলতেন। কিন্তু যেহেতু ঘুমুতে বলেছেন, তাই আমার ঘুম আসতো না। এ অভ্যেস আমার আজও গেলো না, কেউ কিছু বলেছে কি সেই কাজটি আর আমাকে দিয়ে হবে না। এমনিতে আমি সন্ধ্যে না লাগতেই ঘুমে ঢলতাম।আর সেই সব রাতে আমাদের বাগানের কাচারি ঘর থেকে এক ভয়ঙ্কর গোঙানির শব্দ আসতো। মাকে জিজ্ঞেস করলে ঠাস্ করে এক চড় দিয়ে মা বলতেন, “তোকে না ঘুমুতে বলেছি? অসভ্য মেয়ে কোথাকার”। এরপর আর প্রশ্ন করা যেতো না, আমি গোঙানি শুনতে শুনতে হয়তো ঘুমিয়ে পড়তাম ঠিকই।
মারলং কাকা এলে “ছিরার মা” সেই যে এসে আমার মায়ের পাশে বসতেন, আর উঠতে চাইতেন না। বাড়ির অন্যান্য বউ-ঝিরা তাকে নানা খোঁচা দিয়ে আদি-রসাত্মক দুষ্টুমি করতেন, কিন্তু তিনি যেনো ক্রমশঃ চুপসে যেতেন।সবশেষে আমার বড় চাচির শরণ নিতেন।সেখান থেকেও তাকে গভীর রাতে বের হয়ে আসতে হতো মারলং কাকার কাছে। সেসব অবশ্য আমি আরও অনেক পরে জেনেছি। অতো ছোট বেলায় সেসব জানার কথা নয়, কিন্তু গ্রামের বাচ্চারা বড় মুখরা ছিল, তারা পরদিন সকালেই এইসব নিয়ে ছড়া বানাতো, অথবা আগে থেকেই প্রচলিত ছড়া তারা মারলং কাকা চলে যাওয়ার পর ইনিয়ে বিনিয়ে বলতো। সেই ছড়াগুলো ছিল এমন,
“গম্ভীর রাইতে
ছিরার মা কান্দে
ছিরার মা কান্দে ক্যা (আসলে য-ফলা আর এ-কার এর মিশ্রনে অদ্ভূত উচ্চারণ)
বিদেশি বিটায় তারে যাতে ক্যা??”
এরকম ছড়া। তখন বুঝতাম না, পুরোপুরি; আবার কিছুই যে বুঝতাম না তাও নয়।আমি শেষবার যখন মারলং কাকাকে দেখি, তখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ি।আরও পরে, বহু রক্তকাণ্ড ঘটার পর বড় কাকার খবরদারি থেকে সংসার আলাদা হওয়ার পর, মায়ের মুখে অনেক কথার সঙ্গে শুনেছিলাম, মারলং কাকার কথাও। মারলং কাকার মতো অনেকেই নাকি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ইসলাম প্রচার করতেন আর প্রতিটি গ্রামে একটি করে বিয়ে করে ইসলামের প্রসার ঘটাতেন, বাঙালি নারীর গর্ভে খাঁটি মুসলমান পয়দা-করণ প্রকল্প। তবে দুঃখজনক ভাবে মারলং কাকাকে যে বার শেষবার দেখি, সে বছরই চৈত্র মাসে কলেরায় “ছিরা” মারা যায় ।চৈত্রের এই কলেরার গল্প আমার এই বালিকার ঋতু-দর্শণে বিস্তারিত বলবো, আমার জীবনে তার ছাপ ভয়াবহ বলেই তা আমাকে বলতে হবে।
আর “ছিরার মা” সে বছরই পাগল হয়ে যায়, আমাদের গ্রামের ভাষায় “ডাকের পাগল”; শরীরে কাপড়-চোপড় রাখে না যে পাগল, সেরকম।মারলং কাকার খাঁটি মুসলমান প্রকল্পের বংশধর আমাদের গ্রামে আর নেই, কিংবা থাকলেও তা প্রকাশ্য নয়।
মন্তব্য
চমৎকার লাগলো আপনার লেখা।
লেখার ধরনটা যেমন ভালো লেগেছে, তেমনি ছুঁয়ে গেছে কাহিনীটাও। ধন্যবাদ জানবেন।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
--ধর্মের নামে অনাচার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এর জন্য মৌলবাদী অশিক্ষিত মোল্লারা যেমন দায়ী তেমনি ভাবে ধর্ম বিমুখ শিক্ষিত সমাজ ও সমভাবে দায়ী। আমরা শুধু সমালোচনাই করে যাই, সংস্কারের কোন দায় নিতে চাইনা।
খুব ভালো লাগলো আপনার লেখাটি।
ছুঁয়ে যাওয়া গল্প
আশা করছি এখানেই শেষ করে দেবেন না। মনে হচ্ছে একটা উপন্যাসের পটভূমি পড়লাম যেন!
অসাধারণ লাগল !
আসলে মারলং কাকা আমার জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলেছিলেন, সেই ছোট্টকালে দ্যাখা, পরবর্তীতে "ছিরার মা"-এর পাগল হওয়া এবং তারপর আরও নানা ঘটনা, সত্যিই বড় উপন্যাস লেখার মতো ঘটনাবলী। এমনিতে আমার বিভিন্ন লেখায় ছিটেঁফোঁটা এসেছেও এইসব কথা, কিন্তু তারপরও মনে হয় "ছিরার মা" -কে নিয়ে বড় কিছু লিখি। কবে হবে কে জানে? জীবন সহজ নয়, আর বাংলা ভাষার লেখক-জীবনের কথা না হয় নাই-বা বলি।
ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে এভাবে উৎসাহিত করার জন্য।
মাসুদা - লেখাটা অসম্ভব ভালো লাগলো! প্লিজ, এখানেই থামাবেন না এই কাহিনী!
বাকিটুকু পড়ার অপেক্ষায় আছি।
আমিও স্নিগ্ধার সাথে গলা মেলালাম৷ এখানেই থামবেন না প্লীজ৷
-----------------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
লেখাটিকে বৃহৎ পরিসরে দেখতে চাই। এটা কিন্তু অনুরোধ না, এক প্রকার দাবি।
নতুন মন্তব্য করুন