এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি, যে দেশে বানভাসি মানুষ না খেয়ে মরে আর সেই দেশেই কোটি টাকা খরচ করেই বিল্ডিং ভাঙা হয় মহা সমারোহে। এমন দেশটি কেউ কি দেখাতে পারবেন, যেখানে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে যেদিন গ্রেফতার করে সকাল দশটার পরিবর্তে সকাল আটটায় আদালত বসিয়ে মানুষ জেগে ওঠার আগেই দ্রুত কারাগারে পাঠানো হয়, অন্যদিকে সদ্য বিদায়ী আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী যার কারণে দেশটি প্রায় গৃহযুদ্ধের প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল তাকে প্রায় একই ধরনের মামলায় আদালতে হাজিরার তারিখ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এমন কথাও কি কেউ শুনেছেন যে, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রী দু’জনেই অবৈধ অর্থ বৈধ করে নেওয়ার সুযোগ পান জরিমানা দিয়ে অথচ অপর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যাংক-হিসেব বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই দেশ সেই দেশ যেখানে একই ধরনের মামলার আসামী হয়ে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী হন কারাবন্দী; আর স্বাধীনতা-বিরোধী, রগ-কাটা রাজনৈতিক দলের নেতা যান বিদেশে প্রমোধ ভ্রমণে। আমরা সেই দেশ নিয়ে গর্ব করি যে দেশের রাজধানীতে মুহুর্মূহু গ্রেনেড হামলায় একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রাণ বিপন্ন হয়, মারা পড়ে কয়েক ডজন মানুষ, আহত হয় কয়েক হাজার, অথচ তার তদন্ত হয় না, দায়ের করা মামলা এগোয় না কিন্তু সেই দেশেই আবার নেতার জীবন রক্ষার জন্য উপহার দেওয়া গাড়ি রাখায় দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নামে মামলা দায়ের করা হয়। এখানে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার ছেলের শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিকীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান, অন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার মুমূর্ষ স্বামীকে দেখতে যাওয়ার সুযোগ পান না। এখানে মুখে বলা হয় বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে জাতি ভুল করেছে, অপরদিকে তাকে ন্যাক্কারজনক ভাবে হত্যার দিনটিকে দলীয়ভাবে পালনের অনুমতি পায় না তার অনুসারীরা। এটা সেই দেশের কথা বলা হচ্ছে যেখানে এক পতিত স্বৈরাচার মাথার ওপর দুর্নীতির কয়েক ডজন মামলা নিয়ে রাজধানীতে দাপিয়ে ফেরে, অন্যদিকে দেশবাসীকে কম দামে চাল খাইয়ে, দুস্থ ভাতা চালু করে, পাবর্ত শান্তি চুক্তি করে একজন প্রধানমন্ত্রী একের পর এক মামলার আসামী হয়ে কারাবন্দী থাকেন। আমরা সেই দেশের কথা বলছি, যেখানে এরকম হাজারো অনিয়ম ঘটে, ঘটানো হয় সুশাসনের নামে, দুর্নীতি দমনের নামে, রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিবাজ প্রমাণের নামে, রাজনৈতিক সংস্কারের নামে এবং গণতন্ত্রের দুর্নাম রটিয়ে স্বৈরতন্ত্র কায়েমের নামে।
একটা প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই মাথায় ঘুরপাক খায়, প্রশ্নটি হচ্ছে, মাইনাস টু থিওরি কি করে মাইনাস ওয়ান-এ বদলে গেলো? প্রশ্নটি করেও ফেলি বাংলাদেশের এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার কাছে, বর্তমানে যিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন কিছুদিনের জন্য। তিনি বলতে চান না প্রথমে, তারপর কথায় কথায় বলেন খানিকটা। তার মতে, ওয়ান-ইলেভেনের পট পরিবর্তনের পর পরিবর্তনের নায়কেরা ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু দেশের সর্ববৃহৎ এবং জনপ্রিয় (ওয়ান ইলেভেনের সময়কার বাস্তবতায়, কারণ জনগণ আওয়ামী লীগের দাবীকে যৌক্তিক ধরে নিয়েছিল বলেই ওয়ান ইলেভেন বাস্তবায়নকারীরা ক্ষমতা হাতে তুলে নিতে পেরেছিলেন) রাজনৈতিক দল, সেহেতু একে নিয়েই তাদের চলতে হবে এবং সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, পরিকল্পনা ও সমর্থনকারী শক্তি-বলয়ের ভেতর যে, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা কখনওই তাদের কথামতো চলবে না। যদিও আমেরিকা যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা কথা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে এই সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেবেন। কিন্তু তারা তার এই প্রতিশ্রুতির পরও মনে করেছেন যে, শেখ হাসিনাকে দিয়ে তাদের অনেক কর্মকাণ্ডকে মানাতে পারবেন না। যে কারণে একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। শেখ হাসিনা অবশ্যই এর প্রতিবাদ করেন এবং বিদেশে অবস্থান করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঝড় তোলেন। তখন পরিকল্পনাকারীরা ওই শক্তিবলয়কে বুঝিয়ে দেন যে, শেখ হাসিনাকে ভেঙে-চুরে মচকানো তো দূরের কথা, তাকে বশে রাখা কোনও মতেই সম্ভব নয়। অপরদিকে খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানকে বন্দী করে, তাকে কার্যতঃ গৃহবন্দী করে, বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে, কিছু মামলা দায়ের করে, তার মন্ত্রীসহ তার একান্তজনকে গ্রেফতার করেও তার মুখ দিয়ে ওই শক্তিবলয় সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য বের করা সম্ভব হয়নি। এদিক দিয়ে বেগম জিয়ার বাস্তব-বুদ্ধি অত্যন্ত পাকা, তিনি জানেন, বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে, প্রধানমন্ত্রী হতে হলে এই শক্তি-বলয়কে চটিয়ে কোনও ফল পাওয়া যাবে না। কিন্তু শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ক’টবুদ্ধি নেই, তিনি সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতে চান, সেটা দেশবাসীকে জানিয়েও দেন জোর গলায় যে, গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে দেশ চালানো যায় না। ফলে ওয়ান-ইলেভেনের পরিচালক ও শক্তিবলয়টিও সহজেই বুঝে যায়, কে সাদা, কে কালো, কে তাদের সহকারী আর কে তাদের বিরোধী। তাই খুব দ্রুত বদলে যায় মাইনাস টু থিওরি, তৈরি হয় মাইনাস ওয়ান ফর্মূলা। আর ওপরে দেশের যে তেলেসমাতি কাণ্ডকারখানার কথা তুলেছি তার সারকথা ওই মাইনাস ওয়ান ফর্মূলার বাস্তবায়ন ছাড়া কিছু নয়।
আসলে এসব ফর্মূলা-টর্মূলা বাংলাদেশ বা বাঙালির কাছে নতুন কিছুই নয়, সেই পাকিস্তান আমল থেকে, আইয়ুব শাহী যে ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্বোধন করেছিল, মাঝে ইয়াহিয়ার হাত থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু সেই ক্ষমতা নয়, গোটা ভ’খণ্ডই কেড়ে নিয়েছিলেন এবং সেই দোষে তাকে সপরিবারে হত্যা করে পঁচাত্তরে আবার সেই ক্ষমতা হাতে নেয় জেনারেল জিয়া, তাকে হত্যা করে জেনারেল এরশাদ তারপর জনগণের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে এরশাদের সাময়িক বিদায় ঘটলেও ক্ষমতা কিন্তু তাদের হাতেই থাকে। সামান্য ভাগ দেওয়া হয় সিভিলিয়ানদের, ছিয়ানব্বইতে এসে এই ক্ষমতা-কেন্দ্রকে সরাতে গিয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন শেখ হাসিনা, যে কারণে দু’হাজার এক সালের নির্বাচনে তার জয়লাভ সম্ভব হয় না, কারণ এই ক্ষমতা-বলয় তাকে নিরাপদ মনে করে না মোটেও ফলে একটি আধা-সামরিক ও মোল্লাবাদী শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো হয় কিন্তু ফলাফল নানা রকম বিশৃঙ্খলা এবং এই শক্তি-বলয়ের সহযোগিতায় তথাকথিত রাজনীতিবিদদের লুটপাট Ñ অর্থাৎ বাংলাদেশের গত ছত্রিশ বছরের ইতিহাসে এই ক্ষমতা-বলয়ের বাইরে দেশকে নিয়ে যাওয়া সম্ভবতো হয়ইনি বরং যিনিই সেই চেষ্টা করেছেন, তিনিই বেঘোরে প্রাণ দিয়েছেন কিংবা দিতে বসেছেন।
একটি গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি। পরিচিত এক তরুণ ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সেনা বাহিনীতে ভর্তি হয়ে কমিশন পাওয়ার পর তার বাবাকে সালাম করার পর গর্বিত বাবা ছেলের মাথায় হাত রেখে দোয়া করছেন, “বাবা, একদিন তুমি প্রেসিডেন্ট হবে, আমি দোয়া করছি”। সেই থেকে ছেলে তার বাবার স্বপ্ন-বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যায় এবং গ্রহ-নক্ষত্র মেলাতে থাকে স্বপ্ন-পূরণের; একটি শক্তি-বলয় তাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে চলে কাঙ্খিত তিথি মেলাতে অথচ বাঙালি জাতি পেছাতে থাকে, মানুষ মরে, রক্তপাত ঘটে, অর্থনীতি রসাতলে যায়; আর গণতন্ত্র? গণতন্ত্রের শরীরে ধরে পচন।
লন্ডন\ ৯ আগস্ট, বৃহষ্পতিবার\ ২০০৭\
(রচনাটি দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত)
মন্তব্য
মেঘ
কি হয় লিখে? কিছু বদলায় না। ইন্টার পাশদের হাতেই আমাদের ভাগ্য বন্দী।
মনটা খারাপ। তসলমিার উপর ভারতেও হামলা হলো! মেয়েটা কোথায় গিয়ে একটু শান্তি পাবে...আহ্
মেঘ
বাস্তব কৌতুক... দীর্ঘশ্বাস!
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
অলৌকিক হাসানঃ
ঠিক কেনো, কোন পয়েন্টগুলোকে আপনার কাছে এ লেখা অন্তঃসারশুন্য মনে হয়েছে সেটা ফিগারআউট করলে আমাদের মতো পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হতো । মাসুদা ভাট্টি যে ঘটনা পরম্পরা'র উল্লেখ করেছেন,তার কোনটাকে আপনার কাছে আপত্তিকর মনে হলো?
রাজনৈতিক দলের বাইরে অবস্থান করেই লিখতে হবে এমন কোনো দিব্যি ও তো নেই । মাসুদা তো তার লেখায় স্পষ্ট করেই দেন কোন পক্ষে তার অবস্থান ।
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক আজকে (শুক্রবার) এলেখার বিপরীতে একটা লেখা লিখেছেন । আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন ।
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
তাই ভালো ।
আশা করি মাসুদা ভাট্টি ও আরো বিস্তারিত লিখবেন তার যুক্তির সপক্ষে ।
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
হুম ।
নাইমুল ইসলামের খানের লেখা পড়লাম । হাসিবকে ধন্যবাদ লিংক দেয়ার জন্য ।
তবে কেনো জানি মনে হলো, নাইমুল ইসলাম সামরিক বাহিনীর বিরাগভাজন হওয়া থেকে বাঁচতে,নিজের পিঠ বাঁচাতে এই লেখাটা লিখেছেন ।
এতে অবশ্য নাইমুল ইসলাম খানকে গালমন্দ ও করা যায়না । আমরা জানি যে ,যেকোন সামরিক শাসনামলেই (কারো কি আপত্তি আছে যে, দেশে এখন সামরিক শাসন চলছে?)পত্রিকার সম্পাদকের উপর বিভিন্নমুখী চাপ থাকে ।
হয়তো দেশে থাকলে মাসুদা ভাট্টি ও এইলেখা লিখতে পারতেননা , আমরা ও এরকম সরাসরি সামরিক শাসন বিরোধী মন্তব্য করতে পারতাম না ।
দেশের ভিতরে থেকে নাইমুল ইসলাম খান নিজের পিঠ বাঁচানোর ধান্দা অবশ্যি করতে পারেন । মাসুদা ভাট্টি নিশ্চয়ি খান সাহেবের এ লেখার আরেকটা পালটা লেখা পাঠাবেন । দেখা যাক, সে লেখা প্রকাশের সাহস সম্পাদক সাহবের হয় কিনা?
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
হাসিনার সাথে করা আচরণ ভুল হতে পারে কিন্তু কেন ভুল তা বোঝা গেল না লেখা পড়ে। নিশ্চয়ই খালেদার সাথে কি করা হয়েছে তা হাসিনার অপরাধ মাপার মানদন্ড নয়। লেখাটার মাঝে আমাদের পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রকট। শুধুমাত্র হাজারি বা শামিম ওসমান এর মত অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়ার জন্য হলেও হাসিনার বাকি জীবন কারাগারে থাকা উচিত। তাঁর আমলে বিদ্যুত খাতের দুর্নীতির অভিযোগ গুলোরও তদন্ত হওয়া উচিত। হয়তো তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে দুর্নীতিতে যুক্ত নন কিন্তু শপথ নিয়ে দায়িত্বে অবহেলাও বড় অপরাধ।
আবারো বলছি, খালেদার বিচার হচ্ছে না, এর প্রতিবাদে উপযুক্ত দাবি হলো তার বিচার চাওয়া, হাসিনার মুক্তি চাওয়া নয়।
মেঘ
ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়...কোরেশী নামক খোদার খাসি আমাদের শুদ্ধ রাজনৈতিক...হাহ্ হাহ্
মেঘ
অফটপিক মন্তব্য
এইখান থেকে নিচের লাইনটা তুলে নিলাম...
আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমের, চাঁদ ফুল জ্যোছনার গান আর নয় -
আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমের, চাঁদ ফুল জ্যোছনার গান আর নয়
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
The dream is killing now Bangladesh
নতুন মন্তব্য করুন