অন্ধকারের একশ বছর : আনিসুল হক

মেঘ এর ছবি
লিখেছেন মেঘ (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৯/২০০৭ - ১২:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অন্ধকারের একশ বছর : আনিসুল হক

তখন কত বয়স আমার? সতেরো। কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। কিশোরী আমি একঢাল চুল নিয়ে দুই বেণী ঝুলিয়ে কলেজে যাই। বন্ধুদের সাথে শেয়ারের বেবীট্যাক্সিতে যাবার পথে ফান্ডামেন্টালিস্ট আর ফ্যানাটিকদের নিয়ে গরম গরম কথা বলি। বিএনপির শাসন আর লীগের হরতালে কুপোকাত প্রাণ। তীব্র ঘৃণা নিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে আমি বারুদের মতো জ্বলি। তসলিমা নাসরিনের বিপদে মনে মনে ব্যথা পাই। কচি মনের নরম জমিন। দেশ নিয়ে ভাবি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কিছু করতে পারবে সেই স্বপ্ন তখনো দেখি। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাইনি। পড়াশোনা তেমন করে করা হয় না।টেক্সটের বাইরে যে কোনকিছু পড়তে আমার তীব্র আগ্রহ।

সেই সতেরোর পঁচানব্বই সাল। বইমেলা থেকে আনিসুল হকের ”অন্ধকারের একশ বছর” কিনে পড়ি আর শিউরে উঠি। বইয়ের প্রথম পাতায় লিখা ”দরিয়ার পাশে আওরাতের আসার নিয়ম নেই।” প্রতি পাতায় এক ভয়ংকর সময়ের হাতছানি। কক্সবাজারের লাবণী সৈকতের নাম লোবান। সপ্তর্ষিমন্ডল হয়ে যায় সাত আউলিয়া। দেশের চিকিতসাশাস্ত্রের অবস্থা খুবই খারাপ। ইনকিলাবের সময় বহু মেডিক্যাল কলেজের বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে। জেনানা আওরাতদের ঘর থেকে বেরুনো হারাম। কঠোরভাবে নিষেধ। কোরআন শরীফ হাদিস শরীফে কি আছে, আল্লাহ জানেন। এদেশটা কি আসলেই ইসলামী বিধান অনুযায়ী চলছে, না কি চলছে মওদুদী বিধান অনুসারে? এ দেশে নবী রসূলের ক্রিয়া কর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে কিন্তু মওদুদীবাদ নিয়ে নয়। যে কোনো সময় বদরিয়া বাহিনী যে কোনো কাউকে দাঁড় করিয়ে বলতে পারে, বলো হযরত আবু আলা মওদুদী ছাহেবের দস্তুরী তাজাবিজ গ্রন্থের ৬ পৃষ্ঠায় কি আছে? না পারলে কান ধরে ওঠ বোস।

অদ্ভূত আঁধার এক পৃথিবীতে নেমেছে আজ। বইএর অন্যতম চরিত্র নাসিমা মনে করতে পারেন তার শৈশবে এনএনপির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে মওদুদিয়ারা ঠিকই তাদের দলের জেনানাদের বোরখা পরিয়ে পার্লামেন্টে পাঠিয়েছে।

জিজিয়া কর ধার্য করা হয় অমুসলিমদরে উপর। কিন্তু এখন দেশে অমুসলিম কেউ আছে বলে মনে হয় না। হয় মারা গেছে অথবা জান নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। যেসব মুসলিম জামাতিয়া মওদুদিয়ার সদস্য নয় তাদেরও দিতে হবে জিজিয়া বা নিরাপত্তামূলক সামরিক কর। সিয়াসী কাশমকাশ গ্রন্থে মওদুদী ছাহেব বলেছেন, ”ইসলামের দৃষ্টিতে তারাই কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায় যারা ’গায়ের ইলাহী’ সরকার মিটিয়ে দিয়ে ইলাহী সরকার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের গড়া আইন কানুনের বদলে খোদাই আইন কানুন দ্বারা দেশ শাসনের জন্য সংগ্রাম করে। যে দল বা জামায়াত এরূপ করে না বরং গায়ের ইলাহী শাসন ব্যবস্থায় মুসলমান নামক একটি সম্প্রদায়ের পার্থিব কল্যাণ সাধনে সংগ্রাম করে তারা ইসলাসপন্থী নয় এবং তাদের মুসলিম সম্প্রদায় বলাও বৈধ নয়।

সবটাই জেহাদ। সত্য মিথ্যা বলতে কিছু নেই। কেতাবে আছে, তিনটি কারণে মিথ্যা বলা জায়েজ। এক. দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষা করা, দুই. নিজের জীবন রক্ষা করা এবং তিন. যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে বিভ্রান্ত করা। সেই কেতাবী কথায় ভর করে বদরিয়া বাহিনীর প্রধান আতিউর রহমান মিজানী ছাহেব এনএনপির বেগম ওয়ালিদাকে রোজার দিনে শরবতে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন।

ফতোয়ার তো মাথামুন্ড খুঁজে পাই না। সুবিধামতো হাদিস শরীফ থেকে আওড়ানো হচ্ছে। নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। মওদুদী ছাহেবের বাণী, কোরআন করিম হেদায়াতের জন্যে যথেষ্ট কিন্তু নাজাত বা মুক্তির জন্য নয়? এই মারাত্মক কথা বলেছেন মওদুদী ”তাফহিমাত” গ্রন্থের ৩১২ পৃষ্ঠায়।

আতিউর রহমান মিজানী ছাহেবকে পাকিস্তান ভাঙ্গার গন্ডগোলের সময় এক মেজর জেনারেল খুব পেয়ার করতো। সেই তাঁকে বেশ কদিন মদ্য পান করিয়েছে। ছেলেবেলায় মদের নেশার ঘোরে এক ফর্সা ছেলেকে জড়িয়েও ধরেছিলেন।

আজ থেকে তিন যুগ আগেও দেশে অনৈসলামিক কান্ড কারখানা চলতো দেদার। এই অন্ধকার যুগে নূর জ্বালালেন একজন মহান আলেম। তার নাম হযরত স্যালোয়ার হোসেন দাউদী।

বইয়ের শেষে আমরা দেখি কওমীলীগার , এনএনপি কর্মী এমন কী দরত্যাগী জামাতিয়ারা ঐক্যবদ্ধ হয়। ধর্মের নামে রাজনীতিকে মোকাবিলা করবার অভিপ্রায়ে। নারী পুরুষের সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রভাগে থাকে নারীরা।

বইএর অন্যতম চরিত্র শফি আকবর মুক্ত হয়ে ভাবেন মুক্তির আস্বাদ অন্যরকম। প্রিয়জনের কাছে যাবার অনুভূতিটাও তাতপর্যপূর্ণ। আর আছে দীর্ঘদিন জামাতিয়া শিবিরে বন্দী থাকবার এবং অত্যাচারিত হবার অভিজ্ঞতা। একসময় বিজয়ের সূর্য ওঠে।

এভাবেই বইটি এগিয়ে গেছে। আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন আনিসুল হকের গদ্যকার্টুন দারুণ এক জিনিস। রিয়েল স্যাটায়ার বলতে যা বোঝায়। আফসোস একটাই এত বছর আগে আনিসুল হকরা যা টের পেয়েছেন তার বিরুদ্ধে কিছুই করেননি। আতিউর রহমান মিজানীরা আমাদের ভবিষ্যত। স্যালোয়ার দাউদীরা আমাদের ইসলামী চিন্তাবিদ, মোহাম্মদ বিড়াল নিয়ে দেশে আগুন দেবার ব্যবস্থা করছে। বদরিয়া বাহিনীর মতোই আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক বলে দাবীদার অলিভার টুইস্টরা অষ্টপ্রহর বিরুদ্ধবাদীদের কতলে ব্যস্ত। তত্ত্ববোধীনি তালুকদাররা কোট স্যুট পরে দিব্যি জিকির করে বেড়াচ্ছে মওদুদীর ভাষায়।

৯৫ পেরিয়ে এখন ২০০৭। একযুগের ব্যবধানে দেশের যে চেহারা তার সাথে এই বইকে মিলিয়ে নিতে পারেন নতুন করে পাঠক মাত্রই। এমন কী ভবিষ্যত কর্তব্য স্থির করার চিন্তা মাথায় এলে অবাক হব না।


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে "অন্ধকারের একশ বছর" বইটা পড়ার ইচ্ছে জেগে উঠলো। দেশ থেকে আনিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

"গদ্যকার্টুন" সত্যিই একটা মাস্টারপীস। যদিও আনিসুল হকের ইদানিংকালের লেখা আর আকর্ষণ করে না। বিশেষ করে মোহম্মদ প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয়তে তাঁর "আমিত্ব" সর্বস্ব লেখাগুলো বড়োই গাত্রদাহী।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

শিরোনাম দেখলে মনে হয আনিসুল হকের লেখা।
পরে বুঝা গেল আনিসুল হকের লেখা সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সৌরভ এর ছবি

বইটা পড়েছি।
বাস্তব চরিত্রগুলোকে একটু বদলানো নাম দিয়েই আনিসুল হক অন্ধকারের সম্ভাব্যতা কিংবা আশংকা নিয়ে সাবধান করে দিয়েছিলেন।
দেশের শাসনক্ষমতা অন্ধ, কূপমন্ডুক ধর্মীয় মৌলবাদীরা দখল করে ফেলেছে, প্রগতিশীল সব মানুষের বিচার করা হচ্ছে - বিষয়বস্তু এরকম ::

প্রথমবার পড়ি সম্ভবত ৯৮ এ, এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে চুপচাপ সময় কাটানো কোন এক রাতে।

আপনার শেষ লাইনটাই আমি বলতে চাচ্ছিলাম। খুব একটা তো পাল্টায়নি এই কল্পউপন্যাসের পট।
আমি বছর খানেক আগে একটা লেখায় এই বইটার রেফারেন্স দিয়েছিলাম।
(প্লিজ, আমাদের আর স্বপ্ন দেখাবেন না।)


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

পড়ার আগ্রহ জাগলো। ধন্যবাদ।

মেঘ এর ছবি

মেঘ
ধন্যবাদ। যদিও জানি আমার লিখাতে বাংলাদেশের কারও চরত্রি একটুও বদলাবে না:(

মেঘ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।