--------------------------------------------------------------- এক
রায়হান খুব মনোযোগ দিয়ে ফেসবুকে তার বন্ধু মাসুদের স্ট্যাটাস আর কমেন্টগুলো পড়ছিল। সকালেই রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস বদলেছে মাসুদের, সেটা নিয়ে তুমুল শোরগোল আর পঁচানি চলছে মাসুদের ফেসবুক ওয়ালে। পাশের ঘর থেকে মা আর কাজের বুয়ার আলাপ কানে আসছে; বুয়ার জামাই নাকি রিক্সা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছে গতকাল সন্ধ্যায়। ডাক্তার আর ওষুধপত্র বাবদ নাকি অনেক খরচও হয়েছে। তাই, এমাসের বেতনটা অগ্রিম চাচ্ছে বুয়া। মা দিয়ে দেবেন বলছেন। "যেই বাসায় সকালে কাম কইরা আসলাম, হেরা কইছে মাস পুরানের আগে দিবার পারবো না। এদ্দিন দুইজনের কামাইতে সংসার চলত, মাসের বাসার ভাড়া দেওনের পর কি খামু, কেডা জানে?" বুয়ার হতাশ গলা শুনতে পেল রায়হান।
বুক পকেটে খচখচে একটা অনুভূতি পেয়ে, সেখানে হাত দেয় রায়হান -টাকাগুলো তার একার না। পাড়ার সমবয়সী বন্ধুরা সবাই মিলে টাকা জড়ো করেছে, ব্রাজিলের পতাকা বানাতে হবে, অনেক বড় পতাকা! রায়হান ভাবে, এই টাকা দিয়ে হয়ত বুয়ার কয়েকদিনের খরচ চলত, জামাইটার জন্যও কিছু খাবার কিনতে পারত। কিন্তু, কিছু করার নেই, এটা বেশ কয়েকজনের টাকা -ওর একার না। ফেসবুকে সবার সাথে মিলে মাসুদকে ভার্চুয়াল ধোলাইয়ে মনোযোগ দেয় সে আবার।
---------------------------------------------------------------
---------------------------------------------------------------
--------------------------------------------------------------- দুই
ছাত্রহলের ক্যান্টিনে বসে সজল সকালের নাস্তার পরাটা-ডিমভাজির শেষ টুকরোটা মুখে পুরে চিবাচ্ছে, চা আসার কথা আগেই। এখনও আসছেনা দেখে বিরক্ত হয় সে। পাশের টেবিলে দোতালার মর্তুজা এসে বসে, মর্তুজা আর সজল একই ব্যাচের, অবশ্য ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে পড়ে ওরা। সজলকে দেখে মর্তুজা উল্লসিত হয়, খুব আনন্দের খবর দেবার আগে মানুষে চেহারায় একটা ঝিলিক আসে। মর্তুজার চেহারায় এখন সেটা দেখতে পাচ্ছে সজল।
-"কি খবর, সজল? দেখছো নাকি?"
-"কি জিনিস?"
-"বলো কি মিয়া? দ্যাখো নাই! চোখের ডাক্তার দেখাও তাড়াতাড়ি।"
-" জিনিসটা কি? যেইটা না দেখতে পাইলে আমারে ডাক্তারের কাছে দৌঁড়ানো লাগবে?"
-"আসলেই দ্যাখ নাই?"
-"বললাম তো, দেখি নাই"
-"আরে, চারতলা থেকে ঝুলানো আর্জেন্টিনার বড় ফ্লাগটা যে আমরা গতকাল রাতে লাগাইছি সেইটা দ্যাখোই নাই?"
-"না তো!"
-"বিরাট লম্বা, নাইলে কি আর চারতালা থেকে ঝুলাইলে মাটি পর্যন্ত হয়?"
-"ঐ জিনিস! আরে, আমরাও টাকা তুলছি, আনতেছি ব্রাজিলেরটা। ঐটা দ্যাখো, তারপর ফটফট কইরো"
-"আরে লাফালাফি পরে, আগে বানাইয়া আনো, টানাও; তারপর দ্যাখা যাবে।"
-"হুহ, দ্যাখায়ে দিব এইবার!"
সজল দেখতে পায় ক্যান্টিন বয় কালাম চা নিয়ে হেঁটে আসছে ওর দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সজল খেয়াল করে কালামের পুরোনো, জীর্ণ জামার পকেটটা আধাছেঁড়া; বোতাম পড়ে যাওয়ায় একটা সেফটিপিনের চকচকে ঝিলিকও দেখতে পায় সে একজায়গায়। আচ্ছা, ছাত্ররা সবাই মিলে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকার পেছনে যে পরিমাণ কাপড় খরচ করছে, সেসব কাপড় দিয়ে কালামের ক'টা জামা বানানো সম্ভব? কি জানি, অতসব ভাবতে তার অস্বস্তি হয়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেবাশীষকে ফোন দেয় সজল -ওদের দুজনের পতাকা বানাতে দিতে যাবার কথা, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
---------------------------------------------------------------
---------------------------------------------------------------
--------------------------------------------------------------- তিন
"কি সিলাই করতেছ, আব্বা?" ছয় বছরের মেয়েটার থেকে প্রশ্ন শুনে শামসুদ্দিন সেলাই মেশিন থামিয়ে ঘুরে তাকায়। বাজারের এক কোণায় ছোট একটা দর্জির দোকান চালায় সে। বাসা বাজারের কাছেই, মেয়ে একাই বাসা থেকে মাঝে মাঝে বাপের দোকানে চলে আসে।
-"পতাকা বানাই, আম্মা।"
-"এইটা কিমুন পতাকা? আমাদের ইস্কুলের মাঠে যেইটা উড়ে ঐটাই তো জানি পতাকা। এইডা তো দেখতে অন্যরহম লাগে!"
-"এইটা আমাগো পতাকা না, জার্মান দ্যাশের। হিটলারের দ্যাশ আছিল নাকি এক সুময়"
-"তুমি জার্মান দ্যাশের পতাকা ক্যান বানাও?"
-"সামনে ওয়াল্কাপ, যে সেই দ্যাশের ছাপোটার, তারা সেই দ্যাশের পতাকা বানায়া ছাদে টাঙ্গায়া রাখবো।"
-"তাতে কি লাভ?"
-"কোন লাভ নাই, মা। এইডা মনের শান্তি আর সবাইরে জানান দেওয়া যায়, কে কুন দ্যাশের ছাপোটার। চাইর বচ্ছর পর পর এমুনই হয়। আগেরবার তুমি ছোড আছিলা, তাই তোমার মনে নাই কিছু। "
-"আব্বা, তুমি কি খালি জার্মান দ্যাশেরটাই বানাবা?"
-"না, বেরাজিল আছে, আর্জেন্টিনা আছে, আবার ইংল্যান্ড-ইস্পেনও আছে দুইএকটা। আমার সব ডিজাইন মুখস্থ। যেইটা দরকার, বইলা দিলেই আমি সেইটা বানাইতে পারি।"
-"বাংলাদেশেরটা কেউ বানায় না?"
-"না গো মা, আমরা ওয়াল্কাপে চান্স পাই নাই। তাই, বাংলাদেশেরটা কম বানায়, বিক্রিও হয় না অতডা।"
-"বুচ্ছি, কিন্তু বাংলাদেশের বিজয় দিবসে ডিসেম্বর মাসে তো কিছু বাংলাদেশি পতাকা বিক্রি হয়। কিন্তু, সেইগুলা তো এইটার মত বড় না।"
-"বাংলাদেশের জন্য যেই লোক ৫ ইঞ্চি পতাকা কিনে, সেই লোকই ওয়াল্কাপের সময় পাঁছফুট পতাকা বানায়া নিয়া যায়।"
-"ক্যান আব্বা?"
-"ডিসেম্বর মাসে যার মনে চায়, সে ছাদে পতাকা উড়ায়, গাড়িতে লাগায়। ঐখানে কারটা বড়-এইটা নিয়া কুনো কম্পিটিশন নাই। কিন্তু, ওয়াল্কাপের সুময়ে কম্পিটিশন লাইগা যায়। সবাই পর্মান করতে চায় যে, সে বড় ছাপোটার "
-"তাইলে তো, এই জার্মান পতাকা কিনতে কাস্টোমার বেশি টাকা খরচ করে বাংলাদেশেরটা কিনার চাইতে!"
মেয়ের অবাক হয়ে থাকা চেহারাটা ভালো করে খেয়াল করে শামসুদ্দিন। জবাব দেবার আগে মনে পড়ে, ফুটবল ওয়ার্ল্ডকাপের সময়গুলোতে যত টাকার বিদেশি পতাকা বিক্রি করেছে, তার চেয়ে অনেক কম টাকাই সে পেয়েছে বাংলাদেশের পতাকাগুলো সেলাই করে। কোন বছর কি উল্টোটা হয়েছে? বাংলাদেশের পতাকা সেলাই করে বেশি টাকা আয় হয়েছে বিদেশি পতাকার চেয়ে? ভালো করে মনে করার চেষ্টা করে শামসুদ্দিন দর্জি। এমন কোন বছর তার মনে আসে না!
------------------------------------_______________________
আমরা কি আসলে জানি আমরা কত টাকা, বিদেশি পতাকার ছদ্মবেশে বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছি?
আমরা কি ছাদে উঠে গুনে দেখেছি আর্জেন্টিনা/ব্রাজিল/স্পেনের যতগুলো পতাকা আমাদের দৃষ্টি ঢেকে দেয়,
ষোলই ডিসেম্বরে এসব বাসার ছাদে কতগুলো পতাকা ওড়ে?
আমাদের মনের খেয়াল মেটাতে কত লক্ষ গজ কাপড় খরচ করি আমরা?
আমি সাধারণ একজন মানুষ, তবুও আমার ক্ষুদ্র কন্ঠে ডাক দিয়ে যাই। আসুন, আমরা পতাকার জন্য যে টাকাটা বরাদ্দ করি, সেটা দিয়েই কোন দুস্থ্য শিশুর পরনের কাপড়ের ব্যবস্থা করুন; ঐ সামান্য টাকাটা নিয়েই কোন বিপদগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ান। আশেপাশের কারও সাথে পতাকার আকারে পাল্লা না দিয়ে, টাকাটা পরোপকারে অন্য কোন খাতে ব্যয় করুন।
ছাদে/ বারান্দায় ভীনদেশি পতাকা না টাঙিয়েও যে খেলার আনন্দ কানায় কানায় উপভোগ করা সম্ভব
--প্রমাণ করে দেখান এবার বন্ধুদেরকে!
ফুটবলের উত্তেজনায় মেতে উঠুন সবাই!
শুভেচ্ছা সবাইকে
মন্তব্য
পুরো লেখাটি পড়ে একটা অনেক লম্বা নিঃশ্বাস নিলাম। চোখটাও হালকা মুছতে হলো। শেষ গল্পটি হৃদয়ের একেবারে নরম স্থান টিতে আঘাত হেনেছে। যে আঘাত একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক সইতে পারে না। আসলেই তো আমরা বিদেশী পতাকার জন্য খরচ করছি। অথচ যে পতাকার জন্য এতো রক্ত এতো জীবন বিসর্জন। সেই পতাকার প্রতি কোন মায়া নেই। আমরা এমনই জাতি, যে জাতিকে আইন করে ভিনদেশি পতাকা বহন করতে নিষেধ করা হয়। হায়রে দূর্ভাগা দেশ আমার। -সাখাওয়াৎ।
হয়ত খেয়াল করিনি আমরাই, উন্মাদনায় আকাশ ঢেকে ফেলেছি বিদেশি পতাকায়। তবুও, আশা রাখি একসময় আমরা বুঝতে পারব অনেক কিছুই। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, সাখাওয়াৎ। শুভেচ্ছা
কি আর করবে, মেঘলা? ওদের দেশপ্রেমও যে ৫ ইঞ্চি! অন্যদিকে বিদেশপ্রেম ৫ ফুট এর চেয়ে কম নয় এক ফোঁটা!
এমন আত্মবিস্মৃত, আর আত্ম-মর্যাদাহীন মানুষ পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ!
কার্যতই কয়েক দশকের অব্যাহত পাকি-চাষ নতুন জেনারেশনের একটি অংশের মধ্য থেকে দেশপ্রেম শব্দটিকে মুছে দিয়েছে!
বেশীদিন যায়নি, পাকি আর ভারতি পতাকা নিয়ে কম রতিক্রিয়া হয়নি আমাদের দেশে! এখন শুরু হয়েছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা নিয়ে মেহন!
খেলা দেখতে ভালবাসি, রাত জেগে খেলা দেখিও, কিন্তু অন্যদেশের পতাকা নিয়ে নাচানাচি? বলতে কি, এই প্রজাতির চেতনা কিসের তৈরি, নির্নয় ন জানি!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ, আপনাকে দীনহিন -এই ধারলো মন্তব্যের জন্য।
শুভেচ্ছা
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমার দেশের স্বাধীন নীল আকাশে কোন ভিন দেশের পতাকা চাই না, চাই না চাই না। আপনার টাকা আপনি কিভাবে ব্যবহার করবেন তা আপনার ব্যাপার। কিন্তু ভিন দেশের পতাকা চাই না। যদি এক ফোঁটা বা এক ইঞ্চি জায়গা আপনার হৃদয়ে দেশের জন্য থেকে থাকে তবে পিলিজ ভিন দেশের পতাকা উড়াবেন না।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত
কে কতো বড় "ছাপোটার" এইটার প্রমান দেশি পতাকা দিয়ে হয় না। তখন অজুহাত হয় ছোট হোক বড় হোক দেশি পতাকা। অতয়েব -----
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
আমি মানি যে, এটা খুবই 'স্থূল' একটা মাপকাঠি।
আবার এটা ভেবে দেখলাম, কেউ ব্রাজিলের (বা আর্জেন্টিনার) ৩ ফুট পতাকা লাগায়, তাকে টেক্কা দেবার জন্য একই ছাদে আরেকজন ব্রাজিলের ৫ফুটি পতাকা লাগায়। এর পেছনে একটা বড় অনুপ্রেরণা বৃহত্তর "ছাপোটার" হিসেবে নিজেকে জাহির করা।
একই সাথে, বাংলাদেশের পতাকা কেনার সময় যে লোকটা 'ছোট' আকারেরটা কিনে বাসায় ফেরে (দাম কম তাই) , সেই লোকটাই বিদেশের পতাকা কেনার সময় অতটা হিসেবি থাকেন না।-এটাই বলতে চেয়েছিলাম।
ভাল থাকুন, শুভেচ্ছা
লেখাটা আগে চোখে পড়েনি। খুবই দরকারি লেখা। এই কথাগুলো বলতে হবে। বারবার বলতে হবে।
পড়ার ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
লেখাটা পড়ব পড়ব করে পড়া হয়নি তখন, এবার হল!
অল্প করে হলেও বদল আসছে। ক্রিকেটে ভারত পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে এসে প্রতিবাদের ঘটনা নিজের চোখে দেখা। এটা বাড়তেই থাকবে, এক সময় দেখা যাবে পুরো স্টেডিয়ামে আমাদের ছাড়া আর কারো পতাকা নেই, এমন কি অন্য দেশের খেলাতেও। চার বছর তো, সময় কম না!
২০১৮ আসতে আসতে অন্য দেশের পতাকা উড়ানোর হিড়িক কমবে। জেনে বুঝেই হোক, অন্যদের দেখেই হোক, লজ্জা পেয়েই হোক- কমবে। ২০১৪ তে ২০১০ এর চেয়ে কম, ২০১৮ তে আরো অনেক কমে না আসাটাই অস্বাভাবিক হবে।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
সেটাই আশা রাখছি।
শুভেচ্ছা
এই লেখার আবেদন সব সময় থাকে। ভাল লাগা রইল। ভাবছি সময় করে আপনাদের আগের লেখাগুলো পড়ে ফেলবো। ভাল থাকুন।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
আমি গল্প লিখতে পারি না, আমার সবলেখাই প্রবন্ধ মার্কা। লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা
নতুন মন্তব্য করুন