প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
০৪
আমরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেটা শাহজাহানপুর হলেও অনেক অনেক ভেতরে। বাড়ির কাছে রিক্সা আসারও রাস্তা ছিলো না। বাসাটা ছিলো সবুজ মামার, আমাদের লতায়-পাতায় মামা। তখনও বিয়ে করেন নি। তিনি ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের লেকচারার। তাঁরাই ছিলেন প্রথম ব্যাচ, যাঁরা বাংলাদেশ হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছিলেন। তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পিএইচডি করা যেতো না।
সবুজ মামা ১৯৭৩ সালে মারা যান বেরিয়াম এক্সরে করতে গিয়ে (ডেট এক্সপায়ার্ড বেরিয়াম খাওয়ালো হয়েছিলো তাকে)।
গত রাতে ইয়াহিয়া খান রেডিও ভাষণে বলেছেন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ। শেখ মুজিব নাকি সব সংকটের জন্য দায়ী এবং দেশের শত্রু। পাকিস্তানে এখন রাজনীতি অবৈধ। তারপর ইংরেজি আর উর্দুতে টিক্কা খানের জারি করা নির্দেশনামায় কী কী করা যাবে আর যাবে না, তার ফিরিস্তি দেওয়া হলো অনেক বার করে।
এ পাড়াটা আমি চিনি না, এখানকার কাউকে জানি না, আমার খেলার সাথীরা কে কোথায় আছে, কেমন আছে, তাও জানি না। তাই বিষণ্ণ মন নিয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে, বাড়ীর পেছনে একটা পেয়ারা গাছ ছিলো, সেই গাছ বেয়ে পেছনের প্রাচীরের উপর উঠে বসে ছিলাম।
“যাইবা এক জাগায়?”
আমিন আলী নিচে এসে জানতে চাইলো। আমিন আলী আমাদের বুয়ার ছেলে। ওর কাজ ছিলো আমার ছোট দুই বোনের সাথে খেলা করা আর কারণে-অকারণে দোকানে যাওয়া। কারণে-অকারণে বলছি এ জন্য যে, ওকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো, “কী রে, দোকানে নতুন পোলাও এর চাল উঠেছে?” ও এক দৌড় লাগাতো সেটা জানতে। “কত করে সের?” আবার দৌড়!
এক লাফে প্রাচীর থেকে নিচে নামলাম। না যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই ১০-১১ বছরের অসম্ভব বুদ্ধিমান ও দার্শনিক বালকটি ছিলো আমার ছেলেবেলার আদর্শ। জীবন সম্বন্ধে এমন পরিষ্কার ধারণা আমি অনেক বয়স্ক মানুষেরও দেখি নি। আমিন আলীর সাথে কোথাও যাওয়া মানেই একটা নতুন অভিজ্ঞতা। ওর পেছন পেছন কারো বাড়ির সদর আর কারো বাড়ির অন্দর পেরিয়ে যেখানে এসে পৌঁছলাম, সেটা ছিলো বিরাট কালো গেটওয়ালা উঁচু প্রাচীর ঘেরা একটা বাড়ি। বাড়ির সামনে বেশ কিছু লোক। বড় কালো বন্ধ গেটটার সাথে একটা ছোট্ট দরজা। ওটা দিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে অনেকটা জায়গা। ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট কাটা, নেটটা তখনো ঝুলছে। ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেক লোকজন দাঁড়িয়ে আছে।
আগরবাতির গন্ধ, নিচু স্বরে কান্নার শব্দ আর মৃদু কন্ঠে কোরআন খতমের আওয়াজই বলে দিলো এটা একটা মৃতের বাড়ী। বাগান পেরিয়ে পাঁচ-ছয়টা সিঁড়ির উপরে একটা লাল বারান্দা। বারান্দার মাঝামাঝি একটা খাটিয়ার ওপর লোকটা। আমি পায়ে-পায়ে সিঁড়ি বেয়ে খাটিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালাম। লোকটা অনেক লম্বা, খাটিয়া থেকে পা দুটো অনেকটা বের হয়ে আছে। একটা হাত খাটিয়ার বাইরে ঝুলছে। হাতটা মুঠো করা। খয়েরি প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরনে। শার্টের বুকের কাছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে রক্তের দাগ। কেমন যেন খয়েরি রঙের। লোকটার মুখটা খোলা, ভেতরে দাঁত দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটোও আধ খোলা, আর চোখের মণি দুটো ঠিক কুরবানি দেওয়া খাসির চোখের মতো ঝাপসা-ঝাপসা, ঘোলা-ঘোলা। লাশটা ঘিরে অনেক মাছি, বিশেষ করে বুকের উপরে। কয়েকটা মাছি বারে বারে উড়ে এসে বসছিলো তাঁর ঠোঁট আর চোখের উপরে।
লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন বয়স্ক দাড়িওয়ালা লোক, পাঞ্জাবির উপরে কোমরে গামছা জড়িয়ে একটা কাঁচি দিয়ে লোকটার প্যান্টটা কাটবার চেষ্টা করছিলো, তাঁর মুখ দিয়ে এক ধরনের হামিং-এর শব্দ আসছিলো। হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ এই রকম, ওটা কি কোনো দোয়া? কান্না? না বিলাপ?
আমি মৃতদেহটার খুব কাছে ঝুঁকে পড়ে দেখছিলাম। তিনি হঠাৎ হামিং থামিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "কী দেখ গো, মা? ওরা আমার সর্বনাশ করছে! দেখো, কেমন করে ওরা আমার ছেলেরে মারছে। ভুলবা না, কোনোদিন ভুলবা না এই কথা।” বলে ওপর দিকে দু’হাত তুলে “আল্লাহ! আমি বিচার চাই তোমার কাছে!” বলে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমিও কাঁদতে শুরু করলাম তার দেখাদেখি।
“দুলাভাই চুপ যান, চুপ যান।”
বলে একটা বেঁটে মতো লোক এসে তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে একপাশে নিয়ে গেলেন।
“এই, পোলাপান এইখানে কী করে?” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, “এসব দেখা ঠিক না, পরে ভয় পাইবা, যাও, বাসায় যাও।" বলে অন্য আর একজন লোক আমাদের বারান্দা থেকে নামিয়ে দিলেন।
পরে জেনেছি তিনি ছিলেন সেই সব হতভাগ্য ছাত্রদের একজনের বাবা, যাদের ২৫ মার্চের রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গুলি করে মারা হয়েছিলো।
সেদিনটা ছিলো ২৭শে মার্চ। তখন ভর দুপুর।
কিছুক্ষণের জন্য সান্ধ্যআইন উঠিয়ে দেওয়া হলে তার ছেলের লাশ ইকবাল হল থেকে নিয়ে এসে দাফনের ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো। প্রথমে সকাল ৭টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত সান্ধ্যআইন তুলে দেওয়া হয়েছিলো। পরে সেটা বাড়িয়ে ৫টা পর্যন্ত করা হয়েছিলো।
(এ লেখাটার পর্বগুলি বড় করার কথা বলেছে অনেকে, কিন্তু আমি এখানে শুধুমাত্র আমার দেখা কিছু কিছু ঘটনা, যেগুলি আমার মনে আছে, সেগুলিই লিখছি। সবগুলি ঘটনাই আলাদা বলে এক পর্বে একাধিক ঘটনা দিলে খাপছাড়া হবে বলে মনে হয়। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পর্বগুলিকে বড় করতে পারছি না।)
মন্তব্য
আপনার যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই লিখুন, খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।
"তাঁরাই ছিলেন প্রথম ব্যাচ, যাঁরা বাংলাদেশ হবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছিলেন।"
এ জায়গাটা ঠিক বুঝতে পারি নি।
"তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পিএইচডি করা যেতো না।"
এটাও ঠিক বুঝলাম না, মানে তখনকার নিয়ম কি ছিলো?
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
একটা শব্দ বাদ পড়েছিল। ঠিক করে দিলাম। 'তখন' বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি বাংলাদেশটা যখন পূর্ব পাকিস্তান ছিলো। পিএইচডি করতে চাইলে দেশের বাইরে অথবা পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে হতো। বাঙ্গালিদের দেশের বাইরে যাবার অনুমতি বা সুযোগ যাই বলা হোক না কেন, সহজে দেওয়া হতো না । পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের স্কুল-কলেজের সিলেবাস short এবং সোজা ছিলো। মানে মাথা মোটা পাকিস্তানিরা যাতে সহজেই পাশ-টাস করতে পারে তার সব ব্যবস্থাই করা হয়েছিলো ওদের জন্য।
লেখাটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------
--------------------------------------------------------------------------------
--------------------------------------------------------------------------------
ভাবী, আপনি আপনার সুবিধা মতো লিখুন। লেখার আকার খুব গুরুত্বপুর্ণ বিষয় না। শুধু খেয়াল রাখবেন যখন একটা ঘটনা বর্ণনা করছেন তখন দরকারী কোনো পয়েন্ট বা আপনার মতামতটি যেনো বাদ না পড়ে। বর্ণনার পাশাপাশি আপনার মতটিও পাঠককে জানানো দরকার, নয়তো কিছু কিছু বিষয় পাঠকের কাছে অস্পষ্ট রয়ে যাবে।
একটু কষ্ট করে নিয়মিত লিখে যান। আরেকটা "একাত্তরের দিনগুলি" বা "স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন" না হোক, একজন অপাপবিদ্ধ মানুষের চোখে দেখা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পড়ে যাচ্ছি জীবন্ত একাত্তর। আপনার সুবিধামতোই লিখুন ভাবী। অসুবিধা নাই।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সেই ঠিক ভাই, নিজের সুবিধামতো লিখি। তোমরা একটু সময় দাও আমাকে।
--------------------------------------------------------------------------------
................................
এই লেখাগুলো শর্মিলা বসু কখনো পড়বেনা।
এই বাবার হাহাকারে তার কোন বিকার হবেনা।
আপনার যেভাবে সুবিধা হয় সেভাবেই লিখুন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
স্মৃতিচারন খুব ভালো লাগছে। অনুসন্ধিৎসু মনের বর্ননা ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ
এই পর্বটা পড়তে গিয়ে ভাবলাম প্রথম পর্বটা পড়ে আসি। এরপর সবগুলো পর্বই পড়ে ফেললাম। অন্যরকম ভাল লাগছে। এটাও একসময় বই হয়ে বের হলে খুব খুশি হবো। এই লেখাগুলোর প্রয়োজন আছে।
ভুলবা না, কোনোদিন ভুলবা না এই কথা।
৩য় পর্বটা বাদ গিয়েছিল আজকে একসাথে পড়ে নিলাম। স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নাই, ঠিক না! যদি একদিন আপনার এই স্মৃতিকথা বই হয়ে বের হয়, তবে বইটা হাতে করে সরাসরি পৌঁছে যাবো অটোগ্রাফ নেবার জন্য। পাবো না ভাবী অটোগ্রাফ? এত মন কেমন করা ৩য় আর ৪র্থ পর্ব দুটো!
শুভকামনা।
পড়ছি, আপাতত আর কিছু বলতে পারছি না।
প্রিয় সিরিজ...
আপনি সুবিধামতো লিখুন... নিজের মতো করে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এই পর্বটা আগে পড়া হয়েছিল না...
আজকে রাতে খাওয়ার সময়ে আম্মা আমাকে আবারো গল্প বলছিলেন... তাদের সাথে বেড়ে ওঠা ক্লাস এইট-নাইনের দু'জন ভাইকে ২৫ মার্চ রাতে বাবা-মার চোখের সামনে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার গল্প... তাদের ফিরে না আসার গল্প...
অফটপিক: এই সিরিজটার ট্যাগে ১৯৭১ লিখে দিলে, আর কততম পর্ব তা শিরোনামে যোগ করে দিলে, পর্বগুলো সার্চ করে খুঁজে পেতে সুবিধা হত।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন