একুশে ফেব্রুয়ারী ২০০৯. সকাল এগারোটা। শ্রদ্ধানিবেদনে আগত বাঙালীদের মিছিল দুর দুরান্ত পর্যন্ত দেখা যায়। সমাবেশ আশ্চর্য রকম নিশ্চুপ। কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও সাহস নেই খুব বেশির। শিশুরা অবুঝ, তাদের স্বাভাবিক কলরোল মিছিলের স্বাভাবিকতা ধরে রাখছে, কোনমতে।
মাত্র দু’মাস আগে ডিসেম্বরে আশংকিত কিন্তু অনাকাঙ্খিত ভাবে এখন মসনদে জলপাই-টুপির জলসা। মানুষের অন্তর ভয়ে আরো নীল হয়ে যায়। প্রতি সপ্তাহেই নীরবে একেকটা অধ্যাদেশ পাস হয়। বেশিরভাগেরই উদ্যোক্তা দেলো সাঈদী। ভাষ্কর্যগুলির অপসারন, পরিবর্তন করে আইন হয়েছে সেই জানুয়ারীর শুরুতেই। এ’বছর পহেলা বৈশাখ আয়োজকদের ওপর আগেই প্রচ্ছন্ন হুমকির আবহ দেখে বাঙালী আরো সন্দিহান, কি হয়, কি হয়!
এরি মাঝে একুশে ফেব্রুয়ারী এলো। নির্বাচনের ফলাফলে হতচকিত বাঙালীর আতংক সবেমাত্র ফিকে হতে শুরু করেছে, অথবা হয়তো আতংকের সাথে বসবাসের বাধ্যতাকে মানিয়ে নেবার হতাশায় সে ম্রিয়মান দিনে দিনে।
পুরো ফে্ব্রুয়ারী মাস বইমেলা আর শহীদ মিনারের আশেপাশে বেশ কিছু উগ্র অচেনা যুবকের নিয়মিত মহড়ার মাঝেও বাঙালী চেষ্টা করেছে দারিদ্র জর্জরিত বইমেলায় প্রাণ আনতে। এ বছর বাংলা একাডেমী কোন এক অজানা কারনে কোন নতুন বই প্রকাশ করেনি। একাডেমী প্রধানের সাম্প্রতিক পদত্যাগের সাথে সরকারী কিছু বিতর্কিত বই প্রকাশের চাপের সম্পর্ক থাকতেও পারে। বাঙালী আজকাল কানাঘুষাতেও ভয় পায়। কিসের যেন এক আশংকা তাদের ঘুনের মতো খাচ্ছে, খেয়ে যাচ্ছে।
কাল রাত ঠিক বারোটায় রাষ্ট্রপতি আসার কথা থাকলেও কোন এক অজানা কারনে সরকারের এক সচিব দায়সারা ভাবে একুশের প্রথম প্রহরে শ্রদ্ধ্যার্ঘ অর্পন করেন। সেই অচেনা যুবকের দলকে তখন পাশেই সামরিক কায়দায় দলবেধে কিসের যেন অপেক্ষায় দেখা যায়। সরাসরি প্রচারিত সেই অনুষ্ঠানে অনেক কিছুরই খামতি বাঙালীর পোড়া চোখে পড়েছে।
মিছিল আসছে, ফুলের স্তুপ গুছিয়ে সরিয়ে রাখছে একদল বালক। দেখলে মাদ্রাসার নূরাণী বালকের কথা মনে পড়ে। সবাই আশ্চর্য হবার চেষ্টা করছিলো, ফুলগুলি ঠিক আগের বছরগুলির মতো রাখা হচ্ছে না। বেদীর আশে পাশের যায়গাটা আশ্চর্য রকমের ফাঁকা রাখা হচ্ছে।
বন্দীত্বের, হতাশার ভারে নুব্জ্য বাঙালী ‘যতটুকু পারি করছি’ ভঙ্গিতে আত্মধিক্কারের বোধ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। ফুল নিয়ে এসেছে। যদিও বাতাসে উড়ো খবর…. ‘আজ কিছু একটা হতে পারে’।
হঠাৎ, শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত সামরিক জওয়ানেরা সচল হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে মিছিলের গতি রূদ্ধ হয়ে গেলো। শহীদ মিনারের আশেপাশে থাকা সবাইকে কেন যেন খুব দ্রুত সরিয়ে দেয়া হলো বেশ দুরে। বাঙালীর পোড়ামনে একটা সন্দেহ দোলা দিয়ে গেল। নানান ছলছুতোয় তারা জটলা পাকাচ্ছে।
জওয়ানেরা এখন বেদীর চারপাশে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। নিশ্চল, নিশ্চুপ। তাদের অস্ত্র কোন এক অজানা প্রস্তুতিতে ব্যাবহারের জন্য চুড়ান্ত প্রস্তুত হয়ে শোভা পাচ্ছে তাদের হাতে। তাদের কোমরে এমুনিশনের স্বাভাবিকের অতিরিক্ত সম্ভার দেখে কারো কারো ভুরু কুঁচকে উঠেছিলোও হয়তোবা! কে বলবে!
আশ্চর্য শীতল আবহ। কোথাও যেন একটা কিছু ঠিক নেই, সবাই বুঝতে চেষ্টা করছিলো খুঁতটা কোনখানে। জমে থাকা বাঙালী বুকের ভেতর হঠাৎ একটা আতংক নিয়ে খেয়াল করলো, বেদীর পাশে দাড়ানো যুবকের দলকে মিলিটারী জওয়ানেরা সরিয়ে দেয় নি তো! তারা ওখানে কি করছে!
জটলায় গুঞ্জন বাড়ছিলো। যুবকের দল হঠাৎ সচল হলো। পেছনে রাখা কিছু বাক্স খুলে গেল। হাতে দেখা গেল বড় হাতুড়ি আর গাঁইতি। তীব্র আতংক নিয়ে দেখলো সবাই এক যুবকের হাতে মশাল জ্বলে উঠেছে। মশাল নিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে মিনারের পেছনে কাপড়ে বানানো বিশাল লাল সূর্যটার দিকে।
একটা অস্থিরতা হঠাৎ ছড়িয়ে পড়লো জওয়ান-দেয়ালের বাইড়ে দাড়ানো বাঙালীর সমুদ্রে। জওয়ানের দল কোন এক অজানা নির্দেশে ঘুরে দাড়ালো জনতার দিকে মুখ করে। হাতের অস্ত্রটা কি একটু ওপরে উঠে এলো? থেমে গেলো হঠাৎ শুরু হওয়া গুঞ্জনটা। ওদিকে লাল সূর্য সত্যিকার সূর্যের মতো গনগনে আগুন হয়ে পুড়তে শুরু করেছে। নারায়ে তাকবীর… আল্লাহুয়াকবার….! ধ্বনি ভেসে এলো বেদীর গোড়া থেকে।
চোখের সামনে এতোদিনের চেপে রাখা আতংকের সমূর্তি উপস্থিতি দেখেও কিছু করতে চাইছিলো না বাঙালী। রাষ্ট্রের জওয়ানেরা এখন সীমান্ত পাহাড়া দিচ্ছে। সেই সীমান্ত আসলে কিসের?
কারো কারো মাথা ঘুরে উঠছিলো। কেউ উচ্চস্বরে কেঁদে উঠতে গেলো হয়তো। শাট্-আপ্… গর্জন বেরিয়ে আসলো কোন এক জওয়ানের গলা চিরে।
ধুপ ধুপ আওয়াজ শুনতে পেলো সবাই এবার। গাঁইতি চলতে শুরু করেছে এবার। জনা বিশেক যুবক মাথায় হিজবুতের সবুজ জমিনে সাদা আরবী হরফের পট্টি বেঁধে নিয়েছে মাথায়। হাতে গাঁইতি, হাতুড়ি।
গোড়ায় আঘাত করছে তারা। কনক্রীট ভেঙ্গে ফেলবে প্রথমে। এখনো সবাই নীরবে দেখছে। দুরেই আরো শক্তিশালী যন্ত্র প্রস্তুত হচ্ছে।
শুয়োরের বাচ্চা! জনতার ভেতর থেকে হঠাৎ একটা হুঙ্কার শোনা গেল। নাকি সুরের সেই শব্দ শুনে জওয়ানের দল সক্রিয় হয়ে উঠলো। ধরে নিয়ে আসা হলো ছেলেটাকে। সাথে ছুটে এলো একটা সমবয়সী মেয়ে। কাঁদছে, প্রাণ ভিক্ষা চাইছে ছেলেটার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের হবে বয়স দু’জনেরই!
ছেলেটা আশ্চর্য শান্ত! ‘শুয়রের বাচ্চা তোরা, দেশের খেয়ে দেশেরই সাথে গাদ্দারী করিস?’
এতো ক্রোধ কোত্থেকে পেলো এইটুকু একটা ছেলে! সবাই হতচকিত! বুকের ভেতরে ভেঙে পড়ছে বাঙালীর। বেচারার দশা কি হবে ভেবে সবাই আতঙ্কিত হলেও তারা যে এখনো নিরাপদ সেটা ভেবে স্বস্তি বোধ করলো।
লাঠি দিয়ে অবিরত পেটানো হচ্ছে ছেলেটাকে।
হাতুড়ি আর গাইতিও চলছে একটু দুরে।
পাশের ফুলের স্তুপের ওপর কনক্রিট ভাঙা ধুলোর স্তর পড়ছে। ফুলগুলো রং হারিয়ে ধুসর হয়ে পড়ছে।
আরো ‘শুয়রের বাচ্চা’ উচ্চনাদ ভেসে এলো ভীড়ের ভেতর থেকে। ছেলেটার বন্ধুরা কেউ হবে।
ওদিকে ছেলেটার গলা থেকে এখনো ভেসে আসছে ‘শুয়রের বাচ্চা… দুর হ তোরা আমার বাংলা থেকে…’
ভীত বাঙালীর ভেতরে আরো কয়েকটা জটলা থেকে অনুচ্চ ‘শুয়রের বাচ্চা’ ভেসে এলো।
একটা হুজুরটাইপের লোক বলে উঠলো… ‘ভালো হইছে, এইসব বেদাতী মুর্তি রাখনের কোন কাম নাই’!
তার পাশে দাড়িয়ে থাকা নিপাট মধ্যবয়ষ্ক লোকটার চোখে হঠাৎ কিসের যেন একটা আগুন জ্বলে উঠলো। ডান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে সজোর চপোটাঘাতে হুজুরটা ছিটকে পড়লো জটলার ওপর।
সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখলো কেউ হুজুরটাকে ধরতে গেলো না। আরো অবাক বিষ্ময়ে দেখলো হুজুরটাকে কেন যেন সবাই পা দিয়ে মাড়াতে শুরু করলো। ‘আল্লারে… আল্লারে…’ লোকটার চিঁ চিঁ গলা বেশিক্ষন শোনা গেলো না। তার আগেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকা জটলাগুলো দুলতে শুরু করলো। বিচলিত জওয়ানেরা খেয়াল করলো বাঙালী আর নিজের স্থানে চুপ দাঁড়িয়ে নেই। সবাই কেন যেন সামনের দিকে এগিয়ে আসছে।
ওদিকে ছেলেটা নিথর হয়ে গেছে। উচ্চস্বরে কাঁদছে নাম না জানা মেয়েটা।
হাতুড়িগুলো কেন যেন স্লথ হয়ে গেলো। শেয়ালের পাল কি যেন টের পেয়েছে? জওয়ানেরা আগুয়ান বাঙালীকে পিছিয়ে যাবার নির্দেশ দিলো। ‘শুয়রের বাচ্চা’ বেলাভুমিতে আছড়ে পড়া বিশাল ঢেউয়ের গর্জনের মতো মিছিলের সম্পূর্ণতা ধরে ভেসে এলো শব্দদুটো। জটলাগুলি এক হয়ে একটা বিশাল অস্তিত্ব নিয়েছে। গতিময় নিশ্চয়তা নিয়ে ধেয়ে গেলো সেই স্রোত জওয়ানদের দিকে।
ট্যাট্ ট্যাট্ ট্যাট্ ট্যাট্….
এসল্ট রাইফেলের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সাথে গুলির শব্দ মিশে অদ্ভুত বাস্তবতার সৃষ্টি হলো। বাঙালীর স্রোতের দুদ্দাড় শব্দের নিচে সেই বাস্তবতা ঢাকা পড়লো, জওয়ানের দল এখন পায়ের নিচে।
হাতুড়ি গুলো পড়ে আছে। মাথায় সবুজ পট্ট বাধা যুবকের দল মেডকেলের দিকে পালানোর সময় ধৃত এবং আপ্যায়িত হলো। ভাগ্য ভালো যাদের তারা হাঁটতে পারবে না কোন দিন। কিছু হাতুড়ির সৃষ্টিশীল ব্যাবহার হয়েছিলো বোধকরি তাদের ওপর।
মুখে মুখে, মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো বাঙালীর গর্জে ওঠা । সরকার দ্রুত মোবাইল নেটোয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েও সুবিধা করতে পারলো না। সন্ধ্যা নামার আগেই সব রাস্তায় শুন্যতা, শুধু সাঁজোয়া যানের মন্থর টহল।
এলাকায় এলাকায় গলির ভেতরে কোন এক অজানা কারনে সাঁজোয়া যান গুলি যাচ্ছে না।
একুশে ফেব্রুয়ারীর শেষ লগ্নে বাঙালীকে আজ চেনা যাচ্ছে না। আগামীকাল ২২ ফেব্রুয়ারী, ভয়কাতুরে বাঙালী কি করবে!
সে কি জানে?
মন্তব্য
- হুমম
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
হুমম...। অবস্থা এর চেয়েও খারাপ হতে পারে।
দেখা যাক....
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
একটা বিরাট অভিনন্দন !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আপনার লেখা পড়ে কেমন রক্ত টগবগিয়ে উঠলো। ধন্যবাদ ভাই।
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
এই ফিকশন বাস্তবতা পেয়েছিলো একাত্তুরে । শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
বিদ্যমান অবস্থার চাইতে বরং আপনার কল্পিত অবস্থা অনেক ভালো হত, তার পরের দিন গুলোর কথা ভেবে। তাতে যদি আজকের ঘটনাগুলো থামে।
ধন্যবাদ আরিফ চমত্ কার এই লেখাটির জন্য। এক নি:শ্বাসে পড়েছি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যেন পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে দেখছি ... রাগ, ক্ষোভ, আক্রোশ সবকিছু নিয়েও তোমার বর্ণনার 'জমে থাকা বাঙালী'র অনুভূতিটা নিজের মধ্যে স্পষ্টভাবে টের পাচ্ছিলাম। মনে প্রশ্ন জাগছে, আমিও কি সেই 'জমে থাকা বাঙালী'র একজন? বুঝতে পারছি না। তবে অনেক যুক্তি তর্কের চাইতেও নি:সন্দেহে এ লেখা যে অনেক শক্তিশালী তা বুঝতে পারছি । অভিনন্দন তোমাকে!
লেখা ভালো লেগেছে ।
তবে একটু বন্ধুত্বপূর্ণ পাকনামি করি ,
কাঁচা গন্ধটি রয়ে গেছে লেখায় । দুএকটি শব্দ বা ডায়ালগের পরিবর্তনের মাধ্যমে আরেকটু পরিনত ভাব আনা যেত । ব্যাক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, এটা যেহেতু ফ্যান্টাসিই, সেহেতু আরেকটু তীব্র হলেও মন্দ হত না ।
যাই হোক
ভালো থাকুন ।
সাড়ে চার বছর পরে আজকে পড়ে মনে হলো একটানে লিখে ফেললেও একটু মাজাঘষা করা যেতো।
তামাদি হয়ে যাওয়া ধন্যবাদ, পাকনামোর জন্য।
I do not wish that this may ever happen.
You know why? When a Bangladeshi writes, fears, concerns in this way from far away from home, it attests we are not alone.
Thank you Arif.
গেরিলা হতে ইচ্ছে করে।
সুন্দর লেখা। লেখাটা পড়ে ভয় পাচ্ছি। যদি সত্যিই এই দিন দেখতে হয় তবে কি করবো ভাবছি?
নতুন মন্তব্য করুন