মানব ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় ডাইনী নিধন। অবাস্তব মনগড়া অভিযোগের ভিত্তিতে অসংখ্য নারীকে পুড়িয়ে পিটিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় ডাইনী নাম দিয়ে। ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম হেনরী স্লিম্যান লিখিত “Rambles and recollections of an Indian official” বইতে পাওয়া যায় ভারতীয়দের ডাইনীবিশ্বাসের গল্প।
….............................................
জুবেরা ছেড়ে যাবার দিন পূর্ব জব্বলপুরের এক পুরান বন্ধু কেহরী সিংয়ের সাথে দেখা।
“ওহে সিং ভায়া”, বললাম আমি, “গন্ড১ এলাকায় জঙ্গলে শুনেছি লোকে মানুষ খায়, সত্যি নাকি?”
“একদম মিছা কথা, লোকে মানুষ খাবে কেন? তবে মেয়েলোকে খায়।”
“কোথায়?”
“সব জায়গায়। গন্ড এলাকায় একটা গ্রাম নাই যেখানে এরকম দুয়েকটা মেয়েলোক নাই।”
“ওরা ঠিক কেমনে মানুষ খায় বল দেখি?”
“ওরা মানুষের কলজে খায়।”
“ও বুঝছি, ডাইনী?”
“হক কথা। ডাইনী ছাড়া অন্যকেউ মানুষ খাবে কেন?”
“তোমার সত্যই মনে হয় ডাইনী বলে কিছু আছে?”
“অবশ্যই, আমরা তো হরবকত ডাইনীর বদমাইসি দেখতে পাই। তোমাদের সাদা লোকের দেশে ডাইনী নাই তাই তোমরা এখানেও ডাইনী নাই বলে হাউকাউ লাগাও। শিউনি জিলার মেজর ওয়ার্ডল সাহেব মেলাদিন অবিশ্বাস করে ছিল, তারপর একদিন ঠিক পেত্যয় হইছে।”
“কিভাবে?”
“তার বাহিনীর এক সিপাই একদিন লম্বা মার্চশেষে ভোরবেলায় উপরওয়ালার জন্য দুধ নিয়েছিল এক বুড়ির কাছ থেকে কিন্তু পয়সা দেয়নাই। মেজরসাহেব ব্রেকফাস্ট করার আগেই ঐ সিপাই ব্যথায় কুঁকড়ে কাতরাতে থাকে। আমরা তো সাথেসাথে বুঝছি মারণ-উচাটনমার্কা কিছু, তাই মেজর সাহেবকে বুদ্ধি দেই ঐ বুড়িকে বেঁধে নিয়ে আসার জন্য। সিপাইও বলেছিল এটা ঐ বুড়িরই কাজ। মেজর বুড়িকে ধরে আনতে হুকুম দিলেন। তাই করা হল, কিন্তু বুড়ি একদম অস্বীকার করলো যে এটা তার কাজ নয়। তবে তার ধারনা, তার ঘরের কোন জাগ্রত দেবতা সিপাই এর বদমাইসির শাস্তি হিসেবে কুপিত হতেও পারে। বুড়ির এইসব চালে লাভ হলনা, তাকে রোগী সারিয়ে তুলার হুকুম দেওয়া হল। বুড়ি নানাবিধ হাবিজাবি দিয়ে পূজায় বসলো, আর পূজা শেষ তো রোগও হাওয়া! বেটিকে কানে ধরে নিয়ে না আসলে সৈনিক বাবাজী ঐদিনই অক্কা পেত।”
“জব্বলপুরের ফ্রেজার সাহেবেরও এরকম কোন গল্প শুনেছি মনে হয়।”
“গল্প নয় কথা সত্য। তার এক চাপরাশিকে কোন চিঠি হাতে পাঠানো হয়। সে এক বুড়ি গন্ড মহিলার মুরগী দাম না দিয়ে মেরে দেয়। পরে সন্ধ্যাবেলা সেই আস্ত মুরগী ঝলসে খায় সে। মুরগী নিয়ে ফেরার সময় গন্ডবুড়ির বিড়বিড় করা সে দেখেছিল বটে, কিন্তু তাতে পাত্তা দেয়নি। যাইহোক, আস্ত মুরগী রোস্ট খেয়ে সে মহানন্দে ঘুমাতে যায়। ঘন্টা তিনেক পরেই পেটে তীব্র ব্যথায় সে জেগে উঠে, আর তার পেটের ভিতর সেই মুরগী ডাকতে থাকে শব্দ করে! তাকে ডাইনীর আওতার বাইরে জব্বলপুরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, আর তার পেটের উপর বিস্তর ওঝা ঝাড়ফুঁক দিতে থাকে। লাভ হয় নাই। সে মরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার পেটের মোরগ থেমে থেমে ডেকে যাচ্ছিলো।”
“ফ্রেজার সাহেব এটা বিশ্বাস করেছিল?”
“কি জানি। না করার কি আছে।”
“আচ্ছা মানুষের কলজেটা খায় কে? ডাইনী না তাদের সাথের বদ আত্মা?”
“বদ আত্মাই খায়, কিন্তু ডাইনীর সাহায্যে। মাঝে মাঝে এরা অল্পবয়সী বাচ্চাদের কবর খুঁড়ে বের করে আনে, আবার বাঁচিয়ে তোলে আর বদ আত্মাদের তাদের কলজে খাওয়ায়। সাহেবলোকে এসব বিশ্বাস করেনা, কিন্তু এগুলি অতি সত্য কথা।”
জঙ্গলের বাচ্চাদের একধরনের যকৃতের অসুখ হয় যেখানে তারা মরলে বাইরে কোন চিহ্ন থাকেনা। এই মৃত্যুগুলাকে ডাইনীর আছর ধরে নেয়া হয়, আর একটু ছিটওয়ালা বুড়ি যাদের বিড়বিড় করা স্বভাব তাদের দোষী করা হয়। যারা অষুধ তৈরী করে এদেরও জাদুকর ডাকা হয়, কারন যখন এরা দেখে পৌনে তিনদিন ঝাড়ফুঁক আর তন্ত্রমন্ত্র করে যার চোখ খোলা যাচ্ছেনা তাকে এরা একঢোক আরক খাইয়ে তাজা করে তোলে তখন ধরে নেয়া হয় নিশ্চই ব্যাটা শয়তানের পেয়াদা, তার হাতেই জন্মমৃত্যু। এই এলাকার বহু ঘটনার কথা জানি যেখানে বিশেষ করে শিশুদের বাঁচিয়ে না তুলতে পারার অপরাধে ডাক্তারমশাইকে কতল করা হয়েছে। আমি যখন ম্যজিস্ট্রেট ছিলাম তখন প্রায়ই কেস আসতো যে সন্তান মারা যাওয়ার সাথে সাথে পিতা ডাক্তারের গর্দান এক কোপে নামিয়ে ফেলেছে।
জব্বলপুর শহরে বিশ হাজার লোকের বাস, আর প্রত্যেকে বিশ্বাস করে পেটের ভিতরের মুরগীর গল্প। শহরের মানী লোক নাদু চৌধুরীকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এর কারন, সে বলেছিল যে ভারত ডাইনীর আড়ত বিশেষ, আর মধ্যভারতে তো এরা একদম গিজগিজ করছে। ইংল্যান্ডে ডাইনী নাই বলে আমাদের ব্যাপক উল্লাস করা উচিৎ বলে তার ধারনা। “উপরন্তু”, তার মতে, “মুন্দলা থেকে কটক একেবারে বিশ্রী অবস্থা। আমার মনে হয় ঐ এলাকার প্রত্যেক বুড়ি বাণ মারতে জানে। একবার আমি বিশেষ প্রয়োজনে রতনপুর গিয়েছিলাম, বিকালে বাজারে অতি মিষ্ট গেন্ডারি খেতে খেতে হাঁটছিলাম। ভীড়ে ভুলে এক বুড়িকে ধাক্কা দেই, ফিরে দেখি বুড়ি বিড়বিড় করে কিকিসব বলছে। চোখ ফিরিয়ে গেন্ডারির দিকে তাকিয়ে আমার চক্ষুস্থির, দেখি লাল রসের বদলে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এক মিনিটও কিন্তু পেরোয়নি। দ্রুত আমি চাকর বগলে নিয়ে বাজার থেকে দৌড় লাগালাম, কে না জানে ডাইনীদের দশ-বারো মাইলের বেশি ক্ষমতা থাকেনা।”
জংবার খান, শাগড় রাজার প্রতিনিধি, একদিন আমাকে বলেছিলেন তার নিজের চোখে দেখা ডাইনীর কথা। তিনি তখন রায়পুরের মেলাতে, দেখেন এক লোক দুই মাঝবয়েসী মহিলার সাথে গেন্ডারি নিয়ে মুলামুলি করছে। তারা কোন কারনে গেন্ডারির জন্য দ্বিগুণ দাম চেয়ে বসলো, তাই দেখে লোকটা খেপে একটা গেন্ডারি ধরে টান দিল। মহিলাও বিরাট সেয়ানা, সে গেন্ডারির আরেক মাথা ধরে ছিল। সে এক কান্ড, দুইজনে দাম নিয়ে তর্কাতর্কি করে গেন্ডারি টানাহেঁচড়া করছিল। এক সরকারি সিপাই, এই বড়া তলোয়ার হাতে, এসে লোকটাকে বিদায় হতে হুকুম দিল। লোকে তো আর গেন্ডারি ছাড়েনা, তার যুক্তি বিককিরির মাল মার্কেট প্রাইসেই ছাড়তে হবে, আজাইরা দাম সে চাইবে কেন। সিপাই বিরক্ত হয়ে তলোয়ার দিয়ে ঘ্যাচাং করে গেন্ডারি দিল কেটে। সবাই তখন শিউরে উঠে দেখল কাটা গেন্ডারির কানা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে, এই পুরোটা সময় মহিলা লুকিয়ে লোকটার রক্ত শুষে নিচ্ছিলো! এত রক্তপাত দেখে লোকটা মাথা ঘুরে দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল, শুনেছি সে দশদিন উঠে দাঁড়াতে পারেনি। আমরা সকলে গভর্নরের কাছে বিচার চাইতে গেলাম, মহিলা দুইটার শাস্তি দাবী করে। শাস্তি মঞ্জুর হল। বস্তায় বেঁধে দুইটাকেই নদীতে ফেলে দেয়া হল। ঐ এলাকার কোন গ্রামগঞ্জ নাই যেখানে একটা দুইটা ডাইনী থাকেনা। ডাইনী ছাড়া গ্রামে লোকে মেয়ে বিয়েই দিত না, ঐ মেয়ের গর্ভে নাতিনাতনি হলে তাদের অন্য গ্রামের ডাইনী থেকে কে বাঁচাবে বলেন দেখি?” এক অদ্ভুত ভয়ে ভরা দেশ ভারত।
সারা শরীরের তিরিশ কেজি রক্ত বের হয়ে যাওয়ার ভয়ে কারও দশদিন শয্যাশায়ী হওয়া বিচিত্র নয়, কিন্তু মেলা ভর্তি লোক গেন্ডারিকে স্ট্র বানিয়ে রক্ত চোষার গল্প কিভাবে বিশ্বাস করলো তা ব্যাখ্যার অতীত। জংবার মিয়া লোক ভাল, সে সত্য বলেছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। হয়তো গেন্ডারির রসই লাল ছিল, কিন্তু ঐ লাল রসের ঢিবিকে রক্ত বলে চালানোর গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস, এমনই শক্ত ছিল মানুষের ডাইনীর ভয়।
মন্তব্য
"বান" ব্যাপারটা আমিও লোকমুখে শুনেছি। এভাবে নাকি মানুষ মেরে ফেলা যায়, পাগলও বানিয়ে ফেলে নাকি। এসবের কি কোন যুক্তি/ভিত্তি আছে?
Sony TV ক্রাইম পেট্রোলে সত্যিকার ঘটনা দেখায়, ওখানে প্রায়ই এই ধরণের ডাইনি/পেত্নী ঘটনা দেখা যায়
সনি ক্রাইম পেট্রোলে পেত্নি দেখায়? বলেন কি? দুনিয়ার যত গাঁজাখোর মিডিয়াতে কাজ করে।
এসবের কোন ভিত্তি নাই, আমি "সত্য"পীর মানুষ আমার কাছ থেকে শুনে নেন, পীর ফকির ডাইনী জাদুটোনা বাণ মারা হাত দেখা রাশি গণনা ট্যারট সবগুলাই ব্যাপক ভন্ডামী।
..................................................................
#Banshibir.
আমি তো আকবরের সিক্যুয়েল আশা করেছিলাম।
যাহোক, লেখা বরাবরের মতই ভালো লাগলো
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
হাহা আকবরের সিক্যুয়েল...ওইরকম প্ল্যান নাই ভাইয়া। তবে মোগল শাসন নিয়ে আরও লিখবো তা ঠিক।
ধন্যবাদ।
..................................................................
#Banshibir.
. আপনি ইতিহাস নিয়ে একের পর এক মজার সব লেখা দি্যে যাচ্ছেন। ভালো লাগলো।
..................................................................
#Banshibir.
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
ডাকঘর | ছবিঘর
কোরান শরীফে সুরা নাস, এই বিষয়ে। তাহলে সত্যি আছে নাকি এমন জাদু টোনা?
ডাইনি অপবাদে এককালে মেয়েদের পুড়িয়ে মারতো।
ব্রুনো নামের বিজ্ঞানীকে পুড়িয়ে মারায় একটা কথা বুঝেছিলাম, সমাজের ধর্মের চোখে যেই হুমকি স্বরূপ তাকেই পুড়িয়ে মারাটা সহজ। মেয়ে হলে ডাইনি নাম দেয়াও সহজ।
লেখা ভাল লাগলো।
ঠিক কথা। ইচ্ছেমত সমাজের মাথারা যাকে তাকে পুড়িয়ে মারতো, এখন মারে হয়তো পুড়িয়ে না অন্যভাবে।
রেগুলার কাস্টমার হওয়ার জন্য
..................................................................
#Banshibir.
আপনার লেখার বিষয়গুলো ইন্টারেস্টিং, লেখাও মজার। চলুক, শুভ কামনা রইল।
ধন্যবাদ।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
..................................................................
#Banshibir.
অনেক ইনফোর্মেটিভ লেখা। ইদানীং ব্যস্ততায় লগিন করা হয়না যদি ও, তবু মাঝেমাঝে ঢু মেরে যাই। সেই সুবাধে আপনার লিখা পড়া হয়েছে, এবং বেশ ভালো লাগে , কেবল মন্তব্য করা হয়না এই যা।
পড়েন এই তো অনেক মন্তব্য হইলো বোনাস
..................................................................
#Banshibir.
তোফা লেখা, বেশ ঝরঝরে।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
লন এক কেজি
..................................................................
#Banshibir.
ভালো লাগল।
ইনিই কি সেই ঠগী দমনকারী কর্নেল স্লীম্যান?
ভাইয়া ধরেছেন ঠিক, ইনিই সেই স্লিম্যান। ওইটার গল্প আরেকদিন লিখার আশা রাখি।
..................................................................
#Banshibir.
এমন দারুন অনুবাদ করেন কি করে? মূল লেখা যদিও পড়িনি, তাই তুলনা করতে পারছিনা। তবে নিশ্চিত আপনার অনুবাদ মূল লেখার চেয়ে অনেক সরস।
পড়ে যেমন বুঝি তেমন লিখি...তাই অনুবাদ তত খারাপ হয়না। তবু সময় পেলে মূল লিখা পড়ে দেখবেন, সূত্র উল্লেখ করাই থাকে। কতশত লিখা বাদ দিয়ে যাই সময়ের অভাবে...পড়লে আরো মজা পাবেন।
..................................................................
#Banshibir.
আপনার অনুবাদ আমার ধারনা মূল লেখার চেয়েও অনেক সুখপাঠ্য হয়।
বড়ই শরমিন্দা হইতেসি আজকে। সম্ভবতঃ বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, অনুবাদ হল কাশ্মিরী শালের উলটো পিঠের মত...প্যাটার্ণটা ধরা পড়ে কিন্তু মূল রস মাঠে মারা যায়। তাই খেয়াল রাখি যেন মুল লিখার ইন্টারেস্ট বজায় থাকে।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
..................................................................
#Banshibir.
বান্দরবানে এরকম ডাইনী আছে শুনেছি। তান্ত্রিক বলা হয় ওদের।
লেখায়
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
নতুন মন্তব্য করুন