একাকী পাপাড়ু গিয়ে হাসানাবাদ পৌঁছালেন, যে গ্রাম তার নিজেরই পত্তন করা। সেখানে এক তাড়ির দোকানে জুত করে বসে তিনি বললেন, “এই আমায় ভালো তাড়ি দে”। পলাতক পাপাড়ুর ছদ্মবেশ ছাপিয়ে সেই গম্ভীর কন্ঠ তাড়িওলার কানে ঠং করে গিয়ে বাজল। চোখ তুলে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল সে খদ্দেরের মুখ। হ্যাঁ, এই লোক অবশ্যই পাপাড়ু!
.............................................
১৬৩৬ থেকে ১৭০৭ সালে মৃত্যু অবধি আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য জয়ের স্বপ্নে জীবনটা কাটিয়ে দেন। মোগল ভারতের লেজে দাক্ষিণাত্য যুক্ত করার ইচ্ছে তার সারাজীবনের, তাই দাক্ষিনাত্যেই তিনি কাটিয়ে দেন চল্লিশটি বছর। ১৬৮৭ সালে অবশেষে তার হাতে আসে গোলকোন্ডা, তার এক বছর পরে বিজাপুর। হায়দ্রাবাদে মোগল সুবাদার খাড়া করিয়ে দেয়া হল, আর গোলকোন্ডার শেষ শাসক আবুল হাসান কুতুব শা হলেন দৌলতাবাদ দূর্গে বন্দী।
ব্যাপক ঘষামাজা শুরু হয় এরপর পুরো এলাকা জুড়ে। নগদে কারবার চালু হল মোগল মতে, সোনা বাদ দিয়ে চালু হল রূপার মুদ্রা। উঁচুপদের যাবতীয় ব্রাহ্মণকে খেদিয়ে বসানো হল তুর্ক-আফগানি-ইরানি বংশোদ্ভূত মোগল পেয়ারা লোককে। সকল প্রদেশের দুর্গ কমান্ডার আর বেশীরভাগ সামরিক নেতা (ফৌজদার) বসানো হল “পশ্চিমা” লোক। আর সবচাইতে বড় কথা, তেলুগু “নায়েক” যারা কিনা স্থানীয় উচ্চপদস্থ লোক, তাদের মোগলেরা নামিয়ে আনল জমিদার লেভেলে। কেউ কেউ অবশ্য মনসবদারি পেয়েছিল।
এইসব রাজনৈতিক পদের রদবদলের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও রাতারাতি পরিবর্তন আনতে চাইলেন আওরঙ্গজেব। তার ফল হল ভয়াবহ। শস্য ব্যর্থতা, দুর্ভিক্ষ আর কলেরায় লোকে পালে পালে ছাড়ল দেশ। এককালের পয়লা নম্বুরি বন্দর মসলিপত্তমের দাম পড়ে গেল। কেউ আর জাহাজ ভিড়ায় না সেথায়। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমনই খারাপ অবস্থা হল যে ১৭০২ থেকে ১৭০৪ এর মধ্যে কোন সওদাগরি কাফেলাই হায়দ্রাবাদে যেতে পারত না লুট ডাকাতির যন্ত্রণায়। মোগল সদর হায়দ্রাবাদের পথে এইরকম দুর্দান্ত ডাকাতিতে মোগলেরা ভয়ানক চাপের মুখে পড়ে গেল।
দাক্ষিনাত্যের মোগলদের হালুয়া টাইটকারি এই সমস্ত দুর্দান্ত ডাকাতদের একজনের নাম পাপাড়ু।
পাপাড়ুর জন্ম সম্ভবত তাড়িকোন্ডা গ্রামে। তার জাত ছিল নিচু, তাড়িওলার জাত। তালের রস পচিয়ে তাড়ি বানানোই ছিল সেই জাতের পেশা। গাঁয়ে গাঁয়ে চালু লোককথা অনুসারে, ছোটবেলা থেকেই পাপাড়ু ছিলেন ঘাড় ত্যাড়া। তিনি ভাবলেন দুত্তোর তাড়ি চোলাইয়ের গুষ্টি কিলাই, আমি বরং মস্তানি আরম্ভ করি।
শুরু হল পাপাড়ুর মস্তানি। ১৬৯০ এর দিকে তিনি তার নিজের বোনকে পিটিয়ে ডাকাতি করে তার যাবতীয় টাকাপয়সা নিয়ে চম্পট দেন। সেই বোন ছিল মালকড়িওলা বিধবা রমণী। সেই মালকড়ি বেচা পয়সা দিয়ে তিনি কিছু সাকরেদ জোগাড় করে নিয়ে একটা গিরিকোট তৈরি করেন তাড়িকোন্ডায়। শুরু হয় সড়ক ডাকাতি। ওয়ারাঙ্গাল আর হায়দ্রাবাদের কানেকশন রোডে তিনি সওদাগর পেলেই ধরে লুট করে ছেড়ে দিতেন। স্থানীয় ফৌজদার আর জমিদারেরা প্রথম খেয়াল করে পাপাড়ুর এই বজ্জাতি। তারা হৈ হৈ করে পাপাড়ুকে ধাওয়া দিলে পরে তিনি প্রায় একশ মাইল দূরের আরেক গাঁয়ে গিয়ে থানা গাড়েন আর সেখানকার জমিদারের জমাদারের কাজ নেন। জমিদারের হয়ে মস্তানি করার কাজ আর কি। সেই জমিদারের নাম ছিল ভেঙ্কট রাও।
কিন্তু স্বভাব যায়না ম’লে এবং ইজ্জত যায়না ধুলে। পাপাড়ুর বদমাইশির কীড়া আবার চাগিয়ে উঠল। তিনি জমাদারের কাজের পাশাপাশি পার্ট টাইম ডাকাতি বহাল রাখলেন। এই খবর শুনে ভেঙ্কট রাও ব্যাপক রেগে পাপাড়ুকে জেলে ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু পাপাড়ুর কপাল ভালো, ছেলে অসুস্থ হবার পর জমিদার ভেঙ্কট রাওয়ের বউ ভগবানের নামে সকল বন্দী মুক্ত করে দিলেন। সকল বন্দীর একজন আমাদের হিরো পাপাড়ু। তিনি চিকনে সটকে পড়লেন। তার প্রাক্তন বস ভেঙ্কট রাও ততদিনে মোগলদের ভজিয়ে মনসবদারী জোগাড় করে ফেলেছেন।
যাহোক, পাপাড়ু এইবার আস্তানা গাড়লেন শাহপুর বলে এক জায়গায়। তাড়িকোন্ডার কাছেই বলা চলে। নিজের এলাকায় উঠতি মস্তান জোটাতে তার কোন কষ্টই হলনা, সহসা দাঁড়িয়ে গেল তার নিউ অ্যান্ড ইম্প্রুভড ডাকাত দল। পোক্ত দেখে একটা দূর্গ তৈরি করে পাপাড়ুর দল মুসলমান ও হিন্দু রমণীদের ডাকাতিতে মন দিল।
এইবার সইতে না পেরে লোকাল সুশীলের দল গিয়ে আওরঙ্গজেবের কাছে দিল নালিশ। হুজুর আমাদের মহিলাগণের এরূপ অপমান তো সইতে পারিনে। কুছ তো কিজিয়ে আলামপনা। বাদশা আওরঙ্গজেব হায়দ্রাবাদে খবর পাঠালেন। সেই তারে লাফ দিয়ে উঠে শাহপুরের কাছে কুলপক বলে এক জায়গার মোগল ফৌজদার কাসিম খাঁ বিপুল বিক্রমে পাপাড়ুর মুকাবিলা করতে গিয়ে গুলি খেয়ে গেলেন মরে!
মহা বজ্জাত তাড়িওলার পুত পাপাড়ু মিশনে এইবার নামলেন ডেপুটি গভর্নর রুস্তম দিল খাঁ। ১৭০২ এর কথা। দুই মাস টেরম টেরম যুদ্ধের পর পাপাড়ু আর আর তার সাকরেদ সর্ব পালালেন। পাপাড়ুর দুর্গ উড়িয়ে দিয়ে হায়দ্রাবাদ ফিরে গেলেন রুস্তম দিল খাঁ। তখন পাপাড়ু ফিরে গিয়ে ভাঙাচোরা দূর্গ মেরামতি করে আরো শক্ত পাথরের দূর্গ তৈরি করলেন একই জায়গায়, আর বাইরে বসালেন এক বিখাউজ কামান। এই পাথরের দূর্গ আজো আছে। রুস্তম দিল খাঁ হায়দ্রাবাদে বসে যুদ্ধজয়ের আনন্দে বসে বসে তখন হুক্কা খাচ্ছেন আর হেরেমের বালিকাদের দিয়ে হাত পা টেপাচ্ছেন। পাপাড়ু যে ব্যাক ইন বিজনেস এই খবর তার কানে যায়নি। তাকে এও কেউ বলে দেয়নি যে, পাপাড়ু স্থানীয় সমর্থন পাচ্ছেন তখন। এলাকার লোকে পাপাড়ুকেই দাম দিত বেশী পশ্চিমা মোগলদের বদলে। ধীরে ধীরে পাপাড়ু হাত শক্ত হতে থাকল।
১৭০৩ থেকে ১৭০৫ অব্দি রুস্তম দিল খাঁ হায়দ্রাবাদ থেকে দূরে কাটান, সম্ভবত নিজ এলাকার ডাকাতি নিয়ন্ত্রনে আনার অক্ষমতার কারণে। ১৭০৬ এ হায়দ্রাবাদ ফিরে তিনি আওরঙ্গজেবের মন পাবার বাসনায় পাপাড়ু কিলিং মিশন নাম্বার টু হাতে নেন। এই মিশনে সাহায্য করার জন্য তিনি ডাকেন তেলেঙ্গানার আরেক বদমাইশ ডাকাত রিজা খাঁ কে। বিষস্য বিষমৌষধম্— বিষের ওষুধ বিষ। ডাকাতে ডাকাত মারুক, তাও যদি বাদশার মন গলে। কিন্তু রুস্তমের এই দ্বিতীয় মিশনও ব্যর্থ হল।
গ্রীষ্মকাল, ১৭০৭। রুস্তম দিল খাঁ নিজে মোগল ফৌজ নিয়ে আগে বাড়লেন পাপাড়ুর সানডে মানডে ক্লোজ করার লক্ষ্যে। ধূলা ছুটিয়ে মোগল ঘোড়সওয়ারের দল শাহপুরে পাপাড়ুর দূর্গ অবরোধ করে রাখল। ইঁদুর বিড়াল কাটাকুটি চলল দুই তিন মাস। শেষে পাপাড়ু কিন্তু বেঁচে গেলেন ঠিকই, তবে অস্ত্র দিয়ে নয়। পয়সা দিয়ে। মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ পেয়ে সন্তুষ্ট রুস্তম দিল খাঁ ফিরে গেলেন হায়দ্রাবাদ।
এইবার পাপাড়ুর দল মিশন ইম্পসিবলে নামল। ১৭০৮ এর এপ্রিলে ঠিক হল ওয়ারাঙ্গাল লুট করা হবে। ওয়ারাঙ্গাল কোন গ্রাম নয়, এর দূর্গও পিচ্চি নয়। ওয়ারাঙ্গাল বিরাট শহর, হায়দ্রাবাদের পরেই তার নামযশ। চতুর্দিকে পরিখা, পঁয়তাল্লিশ কেল্লা, একদিকে পাথরের দেয়াল আরেকদিকে মাটির খাড়া দেয়াল...ওয়ারাঙ্গাল এক দুর্ধর্ষ শহর বটে। ভেতরে প্রচুর দোকানপাট বাজারসদাই, চারদিকে টাকা আর টাকা। সেই রমরমা টাকার শহর ওয়ারাঙ্গালে পাপাড়ুর নজর পড়ল।
দুইটি জিনিস পাপাড়ু মাথায় রাখলেন। প্রথমত হায়দ্রাবাদে তখন অস্থির সময় যাচ্ছে, স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়েই গ্যাঞ্জাম। ১৭০৭ এর ফেব্রুয়ারিতে বাদশা আওরঙ্গজেবের ইন্নালিল্লা হয়ে গিয়েছিল, তারপর শুরু হয় ব্যাপক বুটাবুটা। জুন মাসে আওরঙ্গজেবের বড় ছেলে তার এক ভাইকে খতম করে গদিতে বসেন, আর টাইটেল নেন বাহাদুর শা। তার আরেক জীবিত ভাই কাম বখশ কে বিজাপুর আর হায়দ্রাবাদের সুবাদারের পদ অফার করেন তিনি। কাম বখশ তখন এমনিতেই হায়দ্রাবাদের সুবাদার, তাই তিনি ভাইয়ের পদ প্রত্যাখ্যান করে নিজেই নিজেকে গোলকোন্ডার রাজা উপাধি দিয়ে বসেন। দুই ভাইয়ের কাইজ্যায় হায়দ্রাবাদের বাতাস তখন গরম। হট ওয়েদার।
এই হট ওয়েদারের সুযোগে পাপাড়ু মনস্থির করেন ওয়ারাঙ্গাল লুট করার এই ই সময়।
সময়টা ডাকাতির জন্য ভালো ছিল দ্বিতীয় আরেকটা কারণে। ওয়ারাঙ্গালে শিয়া উপলক্ষ্য আশুরা তখন এগিয়ে আসছে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে তখন আশুরা উদযাপন করত, কারবালার ঘটনা নিয়ে গান বাদ্য চলত দিনভর। পাপাড়ু ঠিক করলেন এই ধুমধাড়াক্কার সুযোগ নেয়া যাক।
এপ্রিলের এক তারিখ আশুরা। মার্চের ৩১ তারিখ রাতে পাপাড়ুর দুই তিন হাজার পায়দল সিপাই আর পাঁচশ অশ্বারোহী ওয়ারাঙ্গালের দেয়ালের কাছে চুপিসারে জমায়েত হল। তাদের কয়েকজন রাস্তা আটকে রাখল, আর এক পার্টি দড়িদড়া ঝুলিয়ে দেয়াল বেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দ্রুত দরজা খুলে দেয়া হল, আর পাপাড়ুর পুরো দল হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ল শহরে। ভেতরের শহরবাসী তখন আশুরার প্রস্তুতিতে ক্লান্ত। তিনদিন ধরে লুটপাট চলল। টাকা পয়সা সোনামোতি মূল্যবান কাপড়...সমস্ত লুট করে নিল পাপাড়ুর দল। মোটা কার্পেট নিয়ে যাওয়া কঠিন দেখে কেটে পিস পিস করে নেয়া হল। আর বেঁধেধরে নিয়ে যাওয়া হল শহরের বড়লোকের দল, যেন তাদের মুক্তির বিনিময়ে পয়সা আদায় করা যায়। সেই বন্দীদের মধ্যে ছিল প্রচুর নারী ও শিশু। এমনকি শহরের কাজিসায়েবের বউবাচ্চাও ছিল তার মধ্যে। সে এক তুলকালাম কাণ্ড!
ওয়ারাঙ্গাল লুটের পয়সা পাপাড়ুর খোমাই পাল্টে দিল। তাড়িওলার ছেলে ডাকাত পাপাড়ু দুই হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিনতে থাকল, তার মধ্যে ছিল ৭০০ দুইনলা বন্দুক। এইসব অস্ত্র তাকে বিক্রি করেছিল মসলিপত্তমের ইংরেজ আর ওলন্দাজ। সে নিজেকে মোটামুটি রাজার আসনে নিয়ে গেল। তাকে ঘাড়ে করে পাল্কীতে নিয়ে যায় চার বেহারা, ঘোড়ায় চড়ে তার বডিগার্ড ঘোরে চতুর্দিকে। ব্যাপক কারবার।
পাপাড়ু এইবার ঠিক করলেন ভঙ্গীর লুট করতে হবে। শাহপুর আর হায়দ্রাবাদের মাঝামাঝি শহর এই ভঙ্গীর। আবারো পাপাড়ু একটা দিন বেছে নিলেন, নবী মুহম্মদের জন্মদিন পয়লা জুন, ১৭০৮। তবে এইবার পয়সাকড়ি অনেক কম এল। শহরে ঢোকার ঠিক আগে পাথরে বেঁধে দড়ি যখন দেয়ালে মারা হয়, একটা পাথর গিয়ে পড়ে ভিতরে এক প্রহরীর ছাদে। সে ব্যাটা আওয়াজ করে সকলকে জাগিয়ে দেয় আর পাপাড়ুর দলের জন্য খুব মুস্কিল হয়ে যায়। তারা মাঠে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় যেন দূর্গের কামান তাদেরকে না দেখতে পায়, তবে যাবার সময় তারা কিছু উচ্চবংশীয় বন্দী নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই। বিপুল পয়সা আদায় করা হয় সেইসব বন্দীর বিনিময়ে। পাপাড়ু ঘোষণা করেছিলেন মেয়ে ধরে আনতে পারলে, রূপোর টাকা, আর উচ্চবংশীয় মেয়েমহিলা ধরে আনলে সোনার মোহর!
হায়দ্রাবাদে চোখ ফিরাই। পাপাড়ুর দিকে তখন কারুরই মন দেবার সময় নাই, সেখানে তখন এমনই মহাগ্যাঞ্জাম। “গোলকোন্ডার রাজা” কাম বখশকে তক্তা করতে দিল্লী ছেড়ে দক্ষিণে রওনা দিলেন বড় ভাই বাহাদুর শা। ১৭০৯ এর জানুয়ারিতে তাদের পিটাপিটি শুরু হয় হায়দ্রাবাদের কাছে। কাম বখশ যান মরে।
বিজয়ী বাহাদুর শা এর রাজকীয় আগমনী অনুষ্ঠানে একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে। চৌদ্দ লাখ রূপী ভেট নিয়ে মোগল বাদশার দরবারে হাজির হন পাপাড়ু, সাথে থাকে মোগল ফৌজের জন্য আরো নানা মিষ্টান্ন ও অন্যান্য জিনিস। এই জমকালো উপহারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট বাদশা বাহাদুর শা পাপাড়ুকে পরিয়ে দেন সম্মানসূচক খিলাত অর্থাৎ রাজকীয় পোশাক।
দীর্ঘ বাইশ বছর পর হায়দ্রাবাদ শহরে পা রাখলেন হিন্দুস্তানের কোন বাদশা, আর শহরবাসী আশ্চর্য হয়ে দেখল সেই বাদশার সর্বোচ্চ সম্মানসূচক খিলাত পরে নিল কোন তেলুগু নায়েক নয়, কোন সম্মানিত ব্রাহ্মণ নয়, এমনকি কোন পশ্চিমাও নয়। খিলাত পরে নিল নিচুজাত তাড়িওলার ডাকাত ছেলে পাপাড়ু।
বাদশার মন বদলাতে সময় লাগল না অবশ্য। স্থানীয় তালেবরেরা যখন দল বেঁধে গিয়ে নালিশ দিয়ে আসল পাপাড়ুর প্রকৃত চেহারা জানিয়ে, বাদশা আদেশ দিলেন একে নিকেশ করতে। দিলওয়ার খাঁ নামে এক আফগান পাপাড়ু নিধনে বেরুল।
১৭০৯ এর জুনে পাপাড়ু তখন কাছে এক দূর্গ আক্রমণে ব্যস্ত। তার কানে গেল দিলওয়ার খাঁর কথা। পাপাড়ু ঠিক করলেন ঘরে গিয়ে দিলওয়ারের মোকাবিলা করবেন। কিন্তু পাপাড়ুর দূর্গে তখন ঘটনা ঘটিতং। তার কারাগারের ভিতরে তালা কেটে সকলে বেরিয়ে এসেছে, আর তাদের হাতে চলে গেছে পাপাড়ুর দূর্গ! অতএব শাহপুরে পাপাড়ু যখন নিজের দূর্গের দিকে অগ্রসরমান, তখন তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলেন তার দিকে তার দূর্গ থেকেই মুহুর্মুহু কামান দাগা হচ্ছে। ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে তিনি কাঠের দরজায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেই গনগণে আগুনের মধ্যে দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করলেন, আর সেই সময় আরেকদিক দিয়ে এসে গেল দিলওয়ার খাঁর ফৌজ।
কোণঠাসা হয়ে পাপাড়ু শাহপুর ছেড়ে তাড়িকোন্ডা পালিয়ে গেলেন। সেইখানে তাদের দুর্গ ঘিরে রইল মোগল ফৌজ দিনের পর দিন। পাপাড়ুর লোককে পয়সা অফার করা হল, যদি তারা দূর্গ থেকে হটে যায়। অনেকেই চলে গেল। এরপরে একদিন পাপাড়ুর বারুদ গেল ফুরিয়ে। মহা সর্বনাশের কথা। পাপাড়ু মাথা ঠাণ্ডা করে চম্পট দেবার ভাও করলেন। তিনি পোষাক বদলে সাধারণ কাপড় পরলেন, তারপর নিজের স্যান্ডেল আর হুক্কা দরজার সামনে রেখে দূর্গের পিছনে এক গোপন দরজা দিয়ে গেলেন পালিয়ে।
টানা দুই দিন তিনি পালিয়ে বেড়ালেন, ছদ্মবেশে, লোকচক্ষুর আড়ালে। তার পায়ে তখন বুলেটের দগদগে ঘা। কেউ জানত না তিনি কোথায়, এমনকি তার ছেলেরাও না। তারা তখনো দূর্গে যুদ্ধ করছে।
ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে পৌঁছুলেন হাসানাবাদ। এসে বসলেন এক তাড়িওলার দোকানে। তিনি ভেবেছিলেন সেখানে তিনি নিরাপদ, হাজার হোক গ্রামটা তারই শুরু করা। আর তার বাপদাদা চৌদ্দ গুষ্টি তাড়িওলা, তাই সেই পরিবেশে তিনি নিশ্চিন্ত বোধ করবেন বইকি।
তবে তিনি ছদ্মবেশ ছাড়েননি। সেইভাবেই বসে গম্ভীর গলায় হুকুম করেন একপাত্র ভালো তাড়ি দিতে। ছদ্মবেশে সমস্যা ছিলনা, পোষাকেও নয়। কিন্তু সেই দুই সেকেন্ডের গম্ভীর হুকুমে তাড়িওলা বুঝে গেল এই লোক পাপাড়ু। দুর্ধর্ষ ডাকাতসর্দার মোগল ফৌজের বুকে কাঁপন ধরানো নেতা পাপাড়ু নিজেও বোঝেননি নিজের গলার ওজন। সেই গলাই তাকে চিনিয়ে দিল।
তাড়িওলা পাছদুয়ারে ভালো তাড়ি আনতে যাবার কথা বলে গিয়ে নিয়ে আসল ফৌজদারকে, সাথে তিনশ সিপাই। তারা পাপাড়ুকে বেঁধে নিয়ে গেল শাহপুর, আর কয়েকদিন ধরে অত্যাচার চলল পাপাড়ুর উপর লুকোন ধনের সন্ধান পাবার জন্য।
তারপরে পাপাড়ুর কল্লা কেটে ঝুলিয়ে দেয়া হল হায়দ্রাবাদ শহরের সদর দরজায়।
ছবিঃ অজ্ঞাত শিল্পীর তুলিতে পাপাড়ু।
**রিচার্ড ইটনের "এইট ইন্ডিয়ান লাইভস" এর সপ্তম অধ্যায় অবলম্বনে। ছবিটিও একই বই হতে নেয়া।
মন্তব্য
একটু তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন নাকি? একথা কেন বললাম সেটা পরে বলছি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কিঞ্চিৎ। সেটা লেখায় ফুটে ওঠার জন্য দুঃখিত।
..................................................................
#Banshibir.
নামটা মনে হয় পাপাড়ু, পাপাডু নয়। নাকি আমি চোখে ভুল দেখছি।
কোন কোন এলাকা?
আগে সোনার মুদ্রা ছিল, মানে কারবার আগেও নগদে ছিল?
তেলুগু, তেলেগু নয়। মনসবদার > জমিদার > স্থানীয় পাণ্ডা। সুতরাং আপনার বাক্যটা সংশোধন করতে হবে।
* ইটন সা'বের বই নাকি?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ড এ শুণ্য ড় দিয়াই লিখলাম বস, কিন্তু ছাপার পরে কেমনে জানি সব ড ড লাগে
আগে ইন কাইন্ড ছিল, পরে স্ট্রিক্টলি ক্যাশে কারবার শুরু হয়, এ ই বলা আছে। আগেও নগদ ছিল নিশ্চয়, তবে সব কারবার নগদে ছিল না মনে হয়। আর সোনা রূপার বিষয়টা সোনা ভিত্তিক বনাম রূপা ভিত্তিক, তর্জমা ঠিক হয়নাই।
মনসবদার সর্বোচ্চ র্যাঙ্ক। আমি যতদূর বুঝলাম নায়েক ও খুব উঁচু র্যাঙ্ক, স্থানীয়ভাবে দাক্ষিণাত্যে। মোগলেরা সেইটা বাদ দিয়ে নিজেদের মত জমিদার লেভেলে নামিয়ে আনে। শব্দ চয়নে "পাণ্ডা" কথাটা হয়তো ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, পাল্টে উচ্চপদস্থ করে দিলাম। তেলুগু ও করা হইল। ধন্যবাদ।
ইটন সাবে সন্দেহজনক লুক নাকি? তার বই ভালু পাই।
..................................................................
#Banshibir.
বার্টার আসলে সব সময়ই ছিল। ইন ফ্যাক্ট, এখনো বন্ধ হয় নাই। আওরঙ্গযেব আসলে যেটা করে সেটা হচ্ছে আমলাতন্ত্রে তার ফার্সী মামাগোষ্ঠীকে নিয়ে আসা। এতে বিদ্যমান নানা প্রকার সিস্টেমের বদলে ফার্সী কায়দার ভূমি, রাজস্ব, মুদ্রা, অর্ডার অভ প্রিসিডেন্স, জনপ্রশাসন ইত্যাদি অনেক কিছু ইনট্রোডিউস করা হয়। মুদ্রা ব্যবস্থা ও মুদ্রা নীতির পরিবর্তন তার অংশ।
নায়েক উঁচু পদ সন্দেহ নেই, তবে রাজ্য মুঘলদের দখলে আসার পর সেটা কত উঁচু হিসেবে বিবেচিত হবে তা পূর্বতন রাজ্যের সাইজ আর গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে।
ইটন সা'ব খুব সন্দোজনক তা বলছি না। তবে কলোনিয়াল ঐতিহাসিকদের কথাবার্তা ভেরিফাই করা ছাড়া তাতে সরাসরি ঈমান আনা ঠিক না। এখন ইটন সা'বেরে কলোনিয়াল ঐতিহাসিক বলা যাবে কিনা সেটা নিয়া তর্ক করা যাইতে পারে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মছলিপত্তম নয়, মসলিপত্তম। কারণ, নামটা মছলি বা মাছের সাথে সম্পর্কিত নয়, মসলিন ট্রেডের সাথে সম্পর্কিত।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আগেও এক লেখায় এই কথা স্মরণ করায় দিছিলেন, মনে থাকে না
ঠিক করা হইল।
..................................................................
#Banshibir.
মসলিপৎনম না? ভারতীয়রাও দেখি মাছিলিপৎনম বলে।
পৎনম বা পাৎনাম সঠিক। যে আমলে এই বন্দরের সাথে বাংলার সরাসরি বাণিজ্য যোগাযোগ ছিল সেই আমল থেকে বাংলায় বলার সময় এটা পট্টম হয়ে গেছে। ভাষিক বিবর্তনে হিন্দী বা তেলুগুভাষীরা মসলি-কে মছলি বা মাছিলি বলে। তবে মছলি বললে এটাকে মাছের সাথে সম্পর্কিত করে ফেলার একটা সরল প্রয়াস পাঠক করে ফেলতে পারে।
মসলিন ট্রেডের সাথে সম্পর্কিত আরেকটা বন্দর হচ্ছে বর্তমান ইরাকের মসুল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কাহিনী বরাবরের মতই সুস্বাদু, পরম তৃপ্তি সহকারে গলধকরণ করা গেল। তবে কাহানী মে কুছ কালা ভি হায়! যথা-
তিনদিন ধরে লুটপাটের এই করুন আউটকাম? মুক্তিপণ দেয়ার মত রুপেয়া রয়ে গেল ক্যামনে, পাপাডুর সার্চিং সিস্টেম তো দেখা যায় পুরাই ফকফকা।
এইটা একটা ভাইবা দেখার মত কথা বটে। কিন্তু মনে করেন আমাগো ম্যাডাম বালু ট্রাক দিয়া ঘিরাও থাকে, আর তার এক পুলা লন্ডন আরেক পুলা মালয়শিয়া চুরিচামারি কইরা পলায়। এই কথা তৎকালেও প্রযোজ্য হইতারে। হয়তো এইসব নামী লুকের বাইরের আত্মীয়স্বজন পয়সা দিত মুক্তিপণ।
..................................................................
#Banshibir.
আপনার লেখায় না রাখাটা অন্যায় হবে।
শুনলাম আপনি বাড়ি বানাচ্ছেন
বেচারা পাপাডু, রাজবংশে জন্মালে এই লোক বহুদূর যেতে পারত।
এক লুকে ম্যাট্রিক ফেল। সে ইস্কুলের ঘন্টিবাদক পদে ইন্টারভ্যু দিতে গিয়া শুনে, মিনিমাম ম্যাট্রিক পাস লুক চাই। মনের দুঃখে সে বিড়ির দুকান দিল পথের মোড়ে। দুই বছর পরে আরেকটা। তার এক বছর পরে আরো তিনটা। দশ বছর পরে সে একটা বিড়ির কারখানা দিল নীলফামারিতে। দিন যায়। সে বুড়া হয়। এন্টিভি থিকা সুন্দরী সুভাষিণী উপস্থাপিকা টক শোতে জিজ্ঞাসা করেন, ও ওয়াও! আপনি ম্যাট্রিক ফেল তাতেই এরকম কোটিপতি ব্যবসায়ী, আর পড়াশুনার ডিগ্রি থাকলে আপনি কতদূর ই না যেতেন!
বৃদ্ধ লোকটি হেসে উত্তর দেন, হ্যাঁ ডিগ্রি থাকলে আমি হতাম হাইস্কুলের ঘন্টিবাদক।
...তাড়িওলার পুত পাপাড়ু উচ্চবংশে জন্মালে ডাকাতের বদলে আজাইরা ঘন্টিবাদকই যে হইত না তার গ্যারান্টি কি?
..................................................................
#Banshibir.
লেখা আর মন্তব্য থেকে জানলাম অজানা কিছু।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
হ্যাঁ আমার লেখায় ট্যাগ দেওয়া উচিৎ "কত অজানারে" হাহাহা।
..................................................................
#Banshibir.
ট্যাগ হিসেবে 'তাড়ি' -ও খারাপ না
এত বড়ো ডাইতের এত ছোট কাহিনি? আরেকটু দিতেন; সে কোনো ইয়ে টিয়ে করত না?
মুক্তিপণের আশায় উচ্চবংশীয় মহিলা গাপ কইরা সে কি আর তাগো লগে গপ করত? তাদের নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার অবশ্যই করত নিজ দূর্গে। এগিলি ডাকাইতির ফ্রিঞ্জ বেনিফিট। মিয়াভাইর বিরুদ্ধে ধর্ষনের অভি্যোগও আছে।
..................................................................
#Banshibir.
উপমহাদেশের ইতিহাস চর্চ্চায় ডাকাতদের ওপর আলাদা এবং ব্যাপক পাঠ থাকা দরকার। কিছু কিছু গোষ্ঠী যুগের পর যুগ ধরে কেবল ডাকাতি করে গেছে। ডাকাতদের উপদ্রবে ইতিহাসের অনেক গতিধারা পালটে গেছে। মারাঠাদের বড় অংশ, পিণ্ডারী আর মেওয়াটিদের পুরোটা বিশুদ্ধ ডাকাত ছিল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হ ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে মনে করেন একটা চ্যাপ্টারই থাকুক ডাকাইতের উপরে। সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস শিক্ষিকা ক্লাসে এসে গম্ভীর স্বরে বলবেন, "ছেলেরা আজকে আমরা পড়ব নবম অধ্যায়ঃ ভারতের ডাকাত" হা হা হা হা!
..................................................................
#Banshibir.
উচিত শিক্ষা হয়েছে। নিজের বোনকে ডাকাতি করে, ব্যাটা বদ্মাইশ
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
দুনিয়াভর্তি বজ্জাত পাব্লিক মনে করেন। এদের গল্প পড়তে মজা অবশ্য।
..................................................................
#Banshibir.
সেইরকম সাহসী লোকের কাহিনি জানা হইলো কিন্তু গলার আওয়াজে মাইর খাইয়া গেলো। তবে সার্থকতা হইলো
কল্লা কাটার কারণে হায়দ্রাবাদ শহরের লোকেরা সহ আরো অনেকেই ভাল/মন্দ হিসাবে তারে মনে রাখব।
অপর্ণা মিতু
পাপাড়ু বিরাট হিরু সাউথ ইন্ডিয়ায়। তার নামে নানান উপকথা প্রচলিত, সে নাকি ছিল গরীবের বন্ধু রবিনহুড। এদিকে মুছলমান আধিপত্য ঠেকানির জন্য হিন্দু শিবিরের চক্ষের মণি। পচুর পলিটিকছ
..................................................................
#Banshibir.
কত অজানারে
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সবই জানা হইল এখন। এইবার শান্তি।
..................................................................
#Banshibir.
ভাই অনেকদিন সচলে আসিনি। আজ অনেকদিন পর এসে আনন্দের সাথে আপনার অনেকগুলো ঐতিহাসিক গল্প পেলাম। এটা দারুন লাগলো। আগেরগুলো পড়ে বিস্তারিত মন্তব্য করব।
নতুন মন্তব্য করুন