কাঠি দিয়ে বাটি থেকে কালচে খয়েরি রঙের খাবার মুখে দিয়ে চাবাতে লাগল লাও বাঙ। লালু কাঠি হাতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আছে দেখে লাও বাঙ বলল, ইট ইট। দিস ডাক ইন্সাইড। টেস্টি।
ডাক ইন্সাইড, মানে নাড়িভুঁড়ি? লালু একটু চিন্তায় পড়ে গেল। সে নাড়িভুঁড়ি আগে খেয়েছে বটে তবে সে অভিজ্ঞতা তার সুখকর নয়। সে একটু ইতস্তত করে বলল, ইউ হ্যাভ ডাক আউটসাইড?
এই আশ্চর্য প্রশ্নে লাও বাঙ খাওয়া থামিয়ে বলল, ডাক আউসাইড?
ডাক মিট, গলা খাঁকারি দিয়ে লালু বলল দ্রুত, ইজ দেয়ার ডাকমিট?
নো মিট। দিস ডাক ইন্সাইড। ভেরি টেস্টি।
কাঠি দিয়ে তুলে লালু খাওয়া শুরু করে দিল। যা থাকে কপালে। খাবার নিয়ে সে খুঁতখুঁতে নয়, সবই চলে। তবে দেশে থাকতে ভুঁড়ির তরকারি খেয়ে একবার তার ব্যাপক পেট নেমে গিয়েছিল। এক কোন বড় সাহেবের আগমন উপলক্ষ্যে ফ্যাক্টরিতে খানাপিনার আয়োজন হয়, সেখানে কিচেনে চাকরেরা নিজেদের জন্য ভুঁড়ি রান্না করে। তার মা সেই ভুঁড়ি পায় পরদিন, গন্ধ হয়ে গিয়েছিল তবু স্বাদ ছিল ভাল।
এই খাবারেও কিছু গন্ধ আছে আর ঠিকমত সিদ্ধ হয়নি, শক্ত শক্ত। কপ কপ করে খেয়ে লালু পানি খেয়ে নিল একটু।
সকাল।
একটা উঁচু দেয়ালের এইপারে বসে খাচ্ছে লালু আর লাও বাঙ। ভিতর থেকে কে এসে দিয়ে গেছে, আর বলেছে অপেক্ষা করতে। কিসের জন্য অপেক্ষা লালু সঠিক জানে না, দেয়ালের ওপারে কি তাও সঠিক জানা নেই। সে আপাতত লাও বাঙ এর সাথে আছে। রাইন্সবার্গ যেতে হবে কোনভাবে রাসেল হর্নক্লিফকে ধরার জন্যে।
দেয়ালের ওপাশে পানি। ধীরে দেয়ালের ওদিক থেকে একটা ছোট কাঠের নৌকা এসে পাশে ভিড়ল। ব্যাপক কাজ করা নৌকার কাঠ, বোঝা যায় বেশ দামী। তার ওপর লম্বা সিড়িঙ্গে এক ছোকরা বসা, সে হাত উঁচিয়ে ইশারা করতেই লাও বাঙ খাবার রেখে দুই ছুটে গিয়ে নৌকায় উঠল। লালুও হুড়মুড় করে তাই করল। লম্বা ছেলেটি আবার নৌকা ছেড়ে দিল ধীরে। আর নিচু গলায় চীনে ভাষায় বলল, একে বাঁধার কথা ছিলনা?
লাও বাঙ উদাস কণ্ঠে বলল, নাহ দরকার নেই। থাকুক। যাবে কোথায়।
নৌকা ধীরে ধীরে ডাইনে প্রবেশ করল। লালু তাকিয়ে দেখল এলাহি ঘাট। দুইতলা বাড়ি, একপাশে লম্বা জামা গায়ে এক চাকর লাঠি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাটের একটু সামনে ছায়ায় বসে এক চিকন বৃদ্ধ পায়ের উপর পা তুলে বসে স্থির দৃষ্টিতে তাদের নৌকার দিকে তাকিয়ে। গলায় লম্বা মালা, জামায় ফুল লতা পাতার নকশা কাটা।
নৌকা থেকে নেমে লালু লাও বাঙ এর পিছন পিছন এসে বৃদ্ধের সামনে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতা, তারপর বৃদ্ধ ইংরিজিতে বললেন, দে হ্যাভ ওপিয়াম ইন শীপ?
লালু বলল, ইয়েস।
ইংলিশ শীপ?
আমেরিকান।
আমেরিকান। নিউ কান্ট্রি। আই সি। হু ইজ ক্যাপ্টেন?
স্যামুয়েল হর্নক্লিফ।
হর্নক্লিফ? বৃদ্ধকে বিভ্রান্ত দেখাল। তিনি লাও বাঙ এর দিকে চেয়ে চীনে ভাষায় বললেন, জাহাজের ক্যাপ্টেন মেরেছে তোর মা কে?
লাও বাঙ বলল, না তো। এ ছোকরা তো গতরাতে আমাকে বলল রাসেল হর্নক্লিফ মেরেছে।
বৃদ্ধ আবার ইংরিজিতে লালুকে বললেন, রাসেল হর্নক্লিফ কে? ক্যাপ্টেনের ছেলে?
ক্যাপ্টেনের ভাই।
ক্যাপ্টেনের ভাই। আচ্ছা।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর বৃদ্ধ আবার বললেন, হাও মেনি পিপল অন শীপ?
মনে মনে হিসাব করে লালু বলল, থার্টি পিপল।
থার্টি?
থার্টি। অর ফর্টি।
ভুরু কুঁচকে বৃদ্ধ বললেন, থার্টি অর ফর্টি?
ঢোঁক গিলে লালু আবার হিসাব করতে থাকল। সিপাই কতজন পনেরোজন না? না বিশ? সব গুলিয়ে যাচ্ছে। বাটাভিয়া থেকে জনা পঞ্চাশ উঠেছিল কিন্তু পরে জাহাজ ভিড়িয়ে নেমে গিয়েছিল কে কে যেন। নিচু গলায় লালু বলল, আই থিঙ্ক ফর্টি।
বৃদ্ধ জোরে হাততালি দিয়ে উঠলেন আর পাশ থেকে ছুটে এল এক তরুণ। তাকে চীনেভাষায় বৃদ্ধ বললেন, এদের জাহাজে আফিম আছে। ইংরেজ নয় আমেরিকান জাহাজ। আফিম খালাসের কাজ কে পেয়েছে?
তরুণটি বলল, তাও চীয়ে।
আচ্ছা। তাকে খবর পাঠাও। এদের একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। এসেছে আফিম চোরাচালান করতে আবার আমাদের মানুষও মারা শুরু করেছে। খুনিটাকে ফাঁস দিব আর তার ভাই ক্যাপ্টেনকে ভাতে মারব। বুঝবে এরা কত ধানে কত চাল। তাও চীয়ে আসুক, তার চালানের ব্যবস্থা বিনেপয়সাতেই করার ব্যবস্থা করব।
মাথা ঝুঁকিয়ে তরুণটি আবার ছুটে বেরিয়ে গেল।
… … …
রাত।
অন্ধকারে রাইন্সবার্গ জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে কেইলেব বুঝতে পারল চীনেরা আসছে। কেইলেব পিছন ফিরে হাঁক ছেড়ে কইল, গেট রেডি বয়েজ। টাইম টু গেট টু ওয়ার্ক। লোডার্স আর কামিং।
বুটের খটাখট শব্দ তুলে সকলে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল মাল খালাসের কাজে। নৌকা কাছে আসতেই দড়ি বেঁধে আফিমের বাক্স নামানো শুরু হয়ে গেল। ওদিকে মই বেয়ে উঠে আসলেন স্থানীয় সওদাগর তাও চীয়ে, তার পেছনে দুই চীনে, তার পিছনে লাও বাঙ আর সবার পেছনে লালু। লালুর গায়ে চীনে পোষাক, অন্ধকারে হঠাৎ তাকে চেনা যায়না।
তাও চীয়ে মাঝবয়েসী শক্ত গড়নের লোক। কাছে এসে বললেন, কুইক কুইক। নো টাইম।
কেইলেব শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ইয়েস হ্যোয়ার ইজ সিলভার?
সিলভার কামিং। কুইক।
লোকটির ভাবগতিকে কেইলেবের কেমন খটকা লাগল। কুইক কাজ করতে বলা স্বাভাবিক, আফটার অল স্মাগলিং বলে কথা। কিন্তু তবু কেইলেবের মনে হল কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। সে একটু সরে গিয়ে ক্যাপ্টেনকে বলল, ক্যাপ্টেন। সাম্থিং ইজ রঙ। এরা টাকা না দিয়ে ভাগার তালে আছে মনে হয়।
স্যামুয়েল হর্নক্লিফ চোখ কপালে তুলে বললেন, হায় হায় বল কি! তুমি না বললে তুমি এদের সাথে আগে ডীল করেছ। টাকা না দিয়ে ভাগার তালে আছে কিরকম?
হ্যাঁ এর সাথে আগে কাজ করেছি বটে। কিছু একটা ব্যাপার আছে। তুমি কড়া নজর রাখো নৌকার দিকে। আমি একে চোখে চোখে রাখছি।
এদিকে অন্ধকারে চুপিসারে সরে পড়েছিল লালু আর লাও বাঙ। তারা কোন শব্দ না করে জাহাজের পেছন দিকে চলে যায়। লালু এ জাহাজ ভালো চেনে, সে জানে পেছনে একটা অব্যবহৃত মই আছে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য। রাসেল হর্নক্লিফ ডেকে নেই, সে নিচে আছে মনে হয় কোথাও।
নিচে নেমে পাশ দিয়ে এগুতে থাকল দুই জন। পাশে শব্দ করে সবাই বাক্স উঠাতে ব্যস্ত, এদিকে কেউ খেয়াল করছে না। লালু জায়গামত ঘাপটি মেরে বসে দেখতে থাকল রাসেলকে দেখা যায় কিনা। নেই। সে কি তবে কামরায় ঘুমাচ্ছে?
লালু একটু চিন্তা করল। ক্যাপ্টেনের ভাই বলে রাসেল প্রচুর ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যায় বটে, কিন্তু মাল খালাসের মত গুরুত্বপূর্ণ রাতে তাকে ছাড় দেওয়া হবে এইটা মনে হয় না। যদিনা রাসেল অসুস্থ হয়ে থাকে। রাসেল কি অসুস্থ?
লাও বাঙ এর দিকে তাকিয়ে লালু আবার বিড়ালপায়ে পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল অন্ধকারে। রাসেলের কামরা আরেকটু সামনে, সেইদিকে আলো রয়েছে অল্প।
লালু একটু এগুতেই আচমকা পাশ থেকে কে বলে উঠল আরে লালু!
চমকে ফিরে লালু দেখে চ্যান বাহাদুর। হাতে এক পোটলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অবাক হয়ে। কিছু বোঝার আগেই লাও বাঙ এক লাফে পিছন থেকে সামনে এসে চ্যান বাহাদুরের মুখ হাত দিয়ে ধরে তাকে কোণে শুইয়ে দিল। ধুপধাপ আওয়াজে সামনে থাকা এক গোরা সিপাই আলো নিয়ে এসে হাঁক দিল এই। হুজ দেয়ার?
মুহুর্তের মধ্যে পাশ থেকে আরও জনা তিনেক সিপাই এসে হাজির হল। লালু লাও বাঙ আর চ্যাংদোলা করে থাকা চ্যান বাহাদুরকে দেখে তার খানিকটা অবাক হল বটে, কিন্তু তা সামলে উঠে দ্রুত কোমরে গোঁজা অস্ত্রে হাত দিতেই লাও বাঙ তিন লাফে পাশের কাঠে খাম্বা ধরে উঠে বাদুড়ের মত উল্টো হয়ে ঝুলে লাফিয়ে পড়ল চার সিপাইয়ের ঘাড়ের উপর। এই আচমকা উড়াল আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলনা কেউই। এক সিপাই পাশের খাম্বা ধরে কোনমতে টাল সামলাল আর বাকি তিনজন হুড়মুড় করে পড়ে গেল মাটিতে। বাতাসের গতিতে লাও বাঙ সকলের ঘাড়ে সাঁ সাঁ করে কোপ দিতে থাকল আর কাটা কলাগাছের মত একে একে চার লাশ শুয়ে পড়ল সটান।
হাঁফাতে হাঁফাতে লাও বাঙ বলল, হু রাসেল?
ফিসফিস করে লালু বলল, আই ডোন্ট সি হিম।
উপরে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে। মারামারির শব্দে কেউ আসছে মনে হয়। দ্রুত সরে যেতে যেতে লাও বাঙ বলল, ফাইন মি রাসেল। পাশে থাকা চ্যান বাহাদুর আচমকা বলে উঠল, রাসেল হর্নক্লিফ? আই স হিম ইন দ্যা ব্যাক।
পটাং করে ঘুরে লাও বাঙ চ্যান বাহাদুরের হাত শক্ত করে ধরে বলল, ওকে হ্যোয়ার রাসেল?
তিনজনে আবার কোন শব্দ না করে অন্ধকারে দৌড়ল জাহাজের অন্য প্রান্তে। একবারে শেষ মাথায় গিয়ে চ্যান বাহাদুর আঙুল তুলে কোণায় নির্দেশ করল। জাহাজের এদিকটা ফাঁকা, কিছু ব্যারেল ব্যতীত। কোণায় একটা খালি ব্যারেলে দেখা গেল রাসেল হর্নক্লিফ পেশাব করছে।
আলো বেশি নেই এদিকে। লাও বাঙ সরে দাঁড়াল একটু, জামার ভিতর থেকে একটা ছুরি বের করে। তারপর একটু কাছে গিয়ে কোন শব্দ না করে নিখুঁত নিশানায় ছুরির ফলা ধরে ছুঁড়ে মারল রাসেলের দিকে, আমূল বিঁধল গিয়ে সেই ছুরি পিঠে। যেন দেহের ভিতরের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেছে সেইরকম করে রাসেল একটা ঝাঁকি দিয়ে পড়ে গেল, চোখ মুখ বিকৃত। পিছনের পায়ের আওয়াজ তখন বেড়ে চলেছে, উঁচু কণ্ঠে আওয়াজ ভেসে এল হেই হুজ দেয়ার? হেই?
চ্যান আর লালু জাহাজের এই দিক ভালো করে চেনে। এই দিকে একটা পাটা খোলা যায়, সেই দিক দিয়ে কিচেনে যাওয়া সম্ভব। কিচেনে উপরে ওঠার মই আছে। তারা দ্রুত সেই দিকে গিয়ে পাটা খুলে ধরে দিল ছুট। কিচেন খালি এই সময়, সকলে বাক্স বহনে ব্যস্ত। মই দিয়ে উঠে তারা ডেকের পারে গিয়ে পানিতে দিল ঝাঁপ।
এদিকে উপরে হাঁফাতে হাঁফাতে সাইমন উঠে গিয়ে হর্নক্লিফ আর কেইলেবকে বলল, স্যার! দি চাইনিজ আর অ্যাটাকিং আস। রাসেল হর্নক্লিফ ইজ ডেড অ্যান্ড দে অ্যাটাকড আওয়ার সোলজার্স ডাউন্সটেয়ার্স।
হাঁ হয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল হর্নক্লিফ এই খবরে। চীনেরা খামোকা তার মালের জাহাজ আক্রমণ করতে যাবে কেন? আর রাসেল ডেড? ডেড??
অল্প দূরে দাঁড়ানো চীনে সওদাগর তাও চীয়ে পিছন ফিরে ইশারা করলেন আর নিচে চীনে ভাষায় হাঁক দিয়ে মাঝি বলল কিছু। আমেরিকানেরা খেয়াল করেনি এই বাক্স বদলের ডামাডোলে সন্তর্পনে জাহাজের ওদিকে নৌকা এসে হাজির হয়েছে গোটাকয়। তাদেরই একজন জাহাজ বেয়ে উঠে গিয়ে দড়ি ছেড়ে দিল নিচে, আর একে একে চীনেরা উঠে পড়তে লাগল জাহাজের ডেকে।
শুরু হল লড়াই। জাহাজের মার্কিন সিপাইরা অপ্রস্তুত অবস্থায় যে যেভাবে পারল গোলাগুলি আরম্ভ করে দিল। স্যামুয়েল হর্নক্লিফ লাফিয়ে উঠে তাও চীয়ের দিকে গুলি ছুঁড়ল গুড়ুম! তাও চীয়ে তার আগেই সরে গিয়ে এক খাম্বার পিছনে লুকাতে তখন ব্যস্ত। দুদিক থেকে চীনেরা ততক্ষণে জাহাজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, আগুনের আলোয় তাও চীয়ে দেখেন এগিয়ে আসছে ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল এদিকেই। পিছনে তার বন্ধু কেইলেব। হং সওদাগর ছাও ইয়ানের সাথে রফা হয়েছে দুই ভাই রাসেল আর স্যামুয়েল হর্নক্লিফকে জীবিত ধরে নিয়ে যেতে হবে। রাসেলকে ধরার দায়িত্ব লাও বাঙ এর, স্যামুয়েলকে কব্জা করার কথা তার। স্যামুয়েলকে ধরতে হবে এখন। জামার ভিতর থেকে তাও চীয়ে অস্ত্র বের করলেন।
… … …
সাঁতরে নৌকায় উঠে লালু, লাও বাঙ আর চ্যান বাহাদুর দম নিতে থাকল একটু। পাশে জাহাজে আগুন তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে। লাও বাঙ ভাবল উত্তেজনার বশে রাসেলকে একবারে খতম করে দেয়া মনে হয় উচিৎ হয়নি, ছাও ইয়ান বলেছিল রাসেলকে জীবিত ধরে আনতে যেন ফাঁস দেয়া যায়। কিন্তু চোখের সামনে মায়ের হত্যাকারীকে দেখে তার মাথা ঠিক ছিলনা তাই সে ছুরি মেরে বসে।
একটু দম নিয়ে লালু বলল, হোয়াট ডু উই ডু নাও?
লাও বাঙ কি একটা বলতে গেল, এমন সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে গেল রাইন্সবার্গে। আগুন গিয়ে নিচের পাউডার রুমে লাগতেই সম্ভবত বারুদের বিস্ফোরণ। শব্দে কানে তালা লেগে গেল তিনজনের, আর তারা ভয়ার্ত চোখে দেখল তাদের চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছে রাইন্সবার্গ।
পিপীলিকার মত ডেক থেকে সকলে তখন ঝাঁপ দিতে ব্যস্ত, লাও বাঙ উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল তাও চীয়েকে দেখা যায় কিনা, কিংবা কোন আমেরিকানকে দেখা যায় কিনা। কেউ কেউ সাঁতরে এদিকে আসছে দেখা গেল। চীনেরা জানে উল্টোদিক আঁধার হলেও দ্বীপ সেদিকেই, সুতরাং যারা নৌকার দিকে আসছে তারা ফিরিঙ্গি হবার সম্ভাবনাই বেশী। দ্রুত নৌকা সরিয়ে ফেলতে হবে। নিচে পাটাতনে আফিমের বাক্স ভরে নৌকা একটু ভারি হয়ে আছে, ঘুরাতে সময় লাগবে। সে এই নদী তার হাতের তালুর মত চেনে, সামনে ডাইনে মোড় নিলেই একটা চিকন নদীপথ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে নিরাপদ দুরত্বে।
হাঁক ছেড়ে নৌকার চালককে সে চীনে ভাষায় বলল, এদিক দিয়ে ঘুরিয়ে নাও এখনই। ডাইনে বড় পাথর আছে বেশি কাটিও না।
চালক ইতস্তত করে বলল, আপনার হুকুমে? তাও চীয়ে বা শিয়েমিন আসুক।
ঝট করে ছুরি বাগিয়ে চালকের গলায় ধরে লাও বাঙ বলল, জাহাজ ডুবে যাচ্ছে দেখিসনি? তাও চীয়ে মরে গেছে, আমিই এখন তোর মালিক। যা বলছি সেইমত চালা।
কাঁপতে কাঁপতে অনিচ্ছুক চালক নৌকা ঘোরাল।
বাকী দশ/বারো চীনে তখন চুপ করে বসে আছে, কিছু বলছেনা। পাশে কয়টা আফিমের বাক্স, নিচে জায়গা হয়নি তাই উপরেই আছে। তার একটার উপরে জুইৎ করে বসে লাও বাঙ বলল, লালু দিস ইয়োর কান্ট্রি ওপিয়াম। বেঙ্গল ওপিয়াম। য়ু নো বেঙ্গল ওপিয়াম?
লালু মাথা নেড়ে উত্তর দিল, দিস ইজ মালওয়া ওপিয়াম।
নট বেঙ্গল ওপিয়াম?
নট বেঙ্গল ওপিয়াম।
লাও বাঙ কিছু ভাবল, ভেবে বলল সো দিস ওপিয়াম ব্যাড? বেঙ্গল ওপিয়াম ভেরি গুড।
গলা খাঁকারি দিয়ে লালু বলল, দিস ইজ গুড অ্যাজ ওয়েল। জাস্ট নট সোল্ড বাই ইংলিশমেন। বেঙ্গল ওপিয়াম ইজ ইংলিশ মনোপলি।
আঙুল দিয়ে ছুরির ধার পরীক্ষা করতে করতে লাও বাঙ বলল, য়ু নো লট ওপিয়াম। য়ু গুড। কাম জয়েন মি, আই নিড এক্সপাট। য়ু অ্যান্ড আই মেক লট অফ মানি। কাম জয়েন মি লালু। উই বিকাম স্মোক মার্চেন্ট হাহাহাহাহাহাহা।
স্মোক মার্চেন্ট, লালু হেসে দিল। ধূম সওদাগর।
নৌকা ধীরে এগিয়ে চলল পানি কেটে ছলাৎ ছলাৎ।
… … …
সেই সময় অল্পদূরে অন্ধকারে এক টুকরা কাঠ আঁকড়ে ধরে ভেসে ছিলেন ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল হর্নক্লিফ। ধারের জাহাজ রাইন্সবার্গ ডুবে গেছে। ভাই চাইনিজদের হাতে নিহত। কেইলেব বা অন্য মার্কিন কে বেঁচে আছে কে জানে।
চোয়াল শক্ত করে ক্লান্ত স্যামুয়েল হর্নক্লিফ চোখ বুঁজলেন একটু।
(উপক্রমণিকা সমাপ্ত)
মন্তব্য
আমি তো ভাবলাম গল্প শেষ, লাস্টে "উপক্রমণিকা সমাপ্ত" দেখে কিছুটা ভরসা পাইলাম।
তবে একটা ব্যপার,
"ওকে" শব্দটা মনে হয় ১৮৩৯ সালের আগে ইংরাজি চলিত ভাষায় ব্যবহার শুরু হয় নাই। সুতরাং ওই বৃদ্ধের "ওকে" বলার কথা না।
আপনি সঠিক। সাহেবী ডিকশনারি কইতেছে ওকের প্রচলন মধ্য-ঊনবিংশ শতাব্দী। সুতরাং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে হং সওদাগর ছাও ইয়ান (যার ইংরাজির সম্ভাব্য উৎস বিটিশ লুকের বোলচাল) ওকে বলার কারণ নাই। পাল্টে দিলাম।
গল্প শেষ হইছে। সিরিজ শেষ হয়নাই। পরের গল্পে একখান নয়া ভারতীয় ক্যারেক্টার আনা যায় কিনা জামশেদজী ঝিঝিভাই টাইপের ভাবতেছি।
..................................................................
#Banshibir.
এইটা শেষ পর্ব হয় কেমনে? সওদাগরি তো শুরুই হইল না
ব্যবসা প্রি-রেভিন্যু পর্যায়ে আছে। কিক্সটার্টার ফেইজ। এখন ডিস্ট্রিবিউশন খুঁজা লাগব। সওদাগরির পথে পয়লা ধাপ মনে করেন।
..................................................................
#Banshibir.
উপক্রমণিকাতো শেষ এখন পরের অংশের অপেক্ষা। শেষপর্ব বলে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আফিমদুনিয়া ব্যাপক ও বিপুল, তাই পুরা শেষ করলামনা। আরেকটু বুঝার তালে আছি।
..................................................................
#Banshibir.
"স্মোক মার্চেন্ট, লালু হেসে দিল। ধূম সওদাগর।" - আমিও
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
..................................................................
#Banshibir.
ঠিক,
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
- এখানে 'নিউ কান্ট্রি' কথাটায় দ্বিমত করছি। গল্পের সময়কালটা ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে অথবা অষ্টাদশ শতকের একেবারে শেষের দিকে। ঐ সময়ে একজন ক্যান্টনিজ বা হঙ সওদাগরের কাছে আমেরিকা মোটেও নতুন দেশ না। ক্যান্টন সিস্টেমের (১৭৫৭-১৮৪৪) আওতায় বলুন আর তেরো ফ্যাক্টরির আমল (১৬৮৪-১৮৫৬) বলুন উভয় কালেই আমেরিকার সাথে দক্ষিণ চীনের তো বটেই পূর্ব চীনেরও ভালো ব্যবসা ছিল। গল্পের সময়কালে
চীনে আমেরিকান ফারের তো রমরমা ব্যবসা চলছে। ১৮৪৪ সালে আমেরিকার সাথে চীনের আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রিটি অভ ওয়াংশিয়া স্বাক্ষরিত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে ট্যারিফ ভ্যালু, কাস্টমস ডিউটি'র হার ইত্যাদিও নির্ধারণ করা হয়ে যায়। সুতরাং তারও ৫০ বছর পরে আমেরিকাকে 'নিউ কান্ট্রি' বলার উপায় নেই। অবশ্য হঙ সওদাগর যদি আফিমের উৎস হিসেবে আমেরিকাকে নতুন দেশ বলে থাকে তাহলে ঠিক আছে; কিন্তু কথোপকথনের দৃষ্টে তা তো মনে হচ্ছে না।
হিসেবে একটু ভুল হচ্ছে কোথাও। এইটে ১৮৪৪ এর ৫০ বছর পরের গল্প নয়, ১৮৪৪ এর বছর চল্লিশেক আগের গল্প। ওয়াংশিয়া ট্রিটী আফিম যুদ্ধ ক্যান্টন/পূর্ব চীনে রমরমা মার্কিন বাণিজ্য সেসব কিছুই তখনো আসেনি।
১৭৮৪ এর অগাস্টে পয়লা মার্কিন জাহাজ ভীড়ে ম্যাকাওতে। এইটা তখন থেকে ১৫/২০ বছর পরের কথা। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক। চীনেরা ফিরিঙ্গি বণিকদের ডাকত বিদেশী শয়তান (ফরেন ডেভিল), আর মার্কিনদের নাম দিয়েছিল নিউ পিপল। আমি নিউ পিপল কথাটাই হং সওদাগরের মুখ দিয়ে একটু পাল্টে বলালাম।
..................................................................
#Banshibir.
ওয়াংশিয়া ট্রিটি অবশ্যই এখানে আলোচ্য হতে পারে না, যেহেতু সেটা অনেক পরের ব্যাপার। যেহেতু আমেরিকা দেশটার জন্মই ১৭৭৬ সালে সুতরাং তার বছর ২৪/২৫ পরেও তাকে 'নিউ কান্ট্রি' বলা যেতে পারে। এটা ঠিক যে প্রথম মার্কিন বাণিজ্য জাহাজ 'এমপ্রেস অভ চায়না' ১৭৮৪ সালে কুয়াঙচৌ (ক্যান্টন) বন্দরে ভিড়ার মাধ্যমে চীনে মার্কিনী জাহাজ চলাচল শুরু হয়, তবে ক্যান্টন সিস্টেম চালু হয়েছিল ১৭৮৩ সাল থেকেই। ফারের ব্যবসা বা তেরো ফ্যাক্টরির সাথে ব্যবসা চলছিল আমেরিকার জন্মের আগে থেকে। সুতরাং আমেরিকার সাথে চীনের বাণিজ্য ১৮০০ সালে নতুন কিছু নয়, তবে দেশ হিসেবে আমেরিকা তখনো নতুনই ছিল। হঙ সওদাগর ভুল কিছু বলেনি।
অতিথি ভাইয়া/ আপা, সাধারণত মন্তব্যের শেষ লাইনে নিজের নাম/নিক লিখে দেবেন। তা না হলে আমরা ঠিক বুঝতে পারবো না, একই ব্যক্তি কথা বলছেন কি না। আপনার মম্তব্যগুলো আগ্রহোদ্দীপক।
শুভেচ্ছা
ধূম নিয়া ধুন্ধুমার!
আপনার এই গল্প নিয়া বলিউড ধূম-৪ নামে মুভি নামায়ে ফেলতে পারে।
আশ্বস্ত এবং আনন্দিত হলাম কারন ক্ষুদ্র অংশটি সমাপ্ত হয়েছে, বৃহৎ অংশটি যন্ত্রস্থ।
নতুন মন্তব্য করুন