একটু চুপ থেকে চিত্ররেখা বলল, আমাকে বিয়ের সময় চেতন সিং ছোট একটা মণ্ডপ করেছিল গড়ের মাঠে। আমার বাবা পবন সিং রান্ধাওয়া আর দাদা পরাগ সিং বিয়ের পুরোটা সময় চোখ মেলে তাকিয়েছিল। একটা কথাও তারা বলেনি, এমনকি চোখের পলক ফেলতেও তারা ভুলে গিয়েছিল। কেন জানেন?
কেন?
চিত্ররেখা মাথা এগিয়ে ফিসফিস করে বলল, কারণ চেতন সিং তাদের মাথা কেটে বল্লমে বসিয়ে মণ্ডপে রেখেছিল। কাটা মাথা কি কথা বলতে পারে?
আমি ভয়ানক থতমত খেয়ে গেলাম। এই মেয়ে বলে কী!
হ্যাঁ আমার বাবা, কাকা, দাদা সক্কলের কাটা মাথা মণ্ডপে সাজানো ছিল। মাথার পাগড়ি খুলে ফেলে দিয়েছিল দেখে লম্বা চুল বেরিয়ে গিয়েছিল। দাদা নিয়মিত চুলে তেল দিত, চকচক করছিল রোদে।
আচমকা প্রসঙ্গ পাল্টে পাশে বসা তারাবাঈর দিকে একবার তাকিয়ে কিছুই হয়নি এমন গলায় আমার দিকে ফিরে চিত্ররেখা বলল, থাক সে কথা। কিন্তু আপনার নাম কবুতর কেন?
আমি তারাবাঈর সাথে চোখাচোখি করে বোঝার চেষ্টা করলাম ঘটনা। এই মেয়ের মতলব কী? হলেও হতে পারে তাকে চেতন সিং পাঠিয়েছে। চেতন সিং একটা প্রকৃত হারামজাদা, সে যে মণ্ডপে বাপের মাথা কেটে মেয়েকে বিয়ে করার মত কিছু করতে পারে সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ নাই। কিন্তু পরমগড় দখলের পর কাটামুণ্ডের মণ্ডপ বসিয়ে বিয়ের আসর বসানো হলে তো আমার জানার কথা।
মতলবের মানুষ চেনার চোখ তারাবাঈয়ের অবশ্য আমার চেয়েও ভালো। সে আমাকে ডেকে এনেছে মানে চিত্ররেখার গল্প মিথ্যা নয়।
আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, এইতো ইয়ে। রাজা চোগান সিং আমার খেল দেখে খুশী হয়া নাম দিছিলেন কবুতর ফারুক। তখন থিকাই আর কি।
মুখ গম্ভীর করে চিত্ররেখা বলল, চোগান সিং বড় ভালো লোক তাইনা? তার ভাতিজা চেতন মেয়ের পরিবারের কাটামাথা বসায়ে তাকে বিয়ে করবে, দাবাখেলার সময় চারদিক ঘিরে ছোট মেয়েদের নাচাবে, রাতেরবেলা খাওয়ার সময় সুন্দরী মেয়েদের খালি পিঠে থালা রেখে খাবে আর বুড়োচাচা চোগান সিং এর জায়গীর থেকে নিয়মিত টাকা আসবে। চমৎকার কিন্তু। বড় ভালো বড় ভালো। হ্যাঁ?
আমি ঠাণ্ডা মাথায় শুনে গেলাম। চোগান সিং নিজেই যে আমাকে চেতনের ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করতে বলেছেন এত বিতং এই মেয়ের জানার দরকার নাই। আমি মাথা হেলিয়ে বললাম, জ্বী। চেতন সিং লোক ভালো না।
খিলখিল করে হেসে উঠল চিত্ররেখা এই কথা শুনে। লোক ভালো না হি হি হি হি। লোক ভালো না। কি মজার কথা।
চিত্ররেখার হাসি হঠাৎ থেমে গেলে আমি আর তারাবাঈ আবার একটু চোখাচোখি করলাম। পাশে মোম ধীরে ধীরে নিভে আসছে, সময় বেশী নেই। প্রাসাদের প্রায়ান্ধকার গোপন কক্ষে আমরা তিনজন কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর মৃদু গলায় তারাবাঈ বলল, আংটিটা নিয়া আসতে হইব বাদশার হাতে যাওয়ার আগেই। চিত্রর মায়ের সূর্যমূখী হীরার আংটি। আর চেতন সিং এর বিষয়টা...
আমি খসখস করে গাল চুল্কালাম একটু।
… … …
দুই দিন পরের কথা। ঝিল্লি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে একটু পেশাব করে নিলাম। হেঁটে এখন ঐ পাহাড়ে উঠতে হবে। পাহাড়ের অন্যদিকে সরুপথ, সেখান দিয়েই চেতন সিং যাবে ঘোড়া ছুটিয়ে। গলির মুখে ঢোকার সময় জায়গাটা একটু উঁচু, উপর থেকে তির ছুঁড়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলা যাবে সহজেই। সাথে তার কতজন পেয়াদা থাকবে বলা মুস্কিল, তবে সাত আটজনের দল হলে তেমন সমস্যা নেই। চেতন সিং সাধারণতঃ বড় বহর নেয়না আগ্রা যাওয়ার পথে। বাদশার ছেলের জন্মদিন, ব্যাপক উৎসবের আয়োজন হয়েছে শোনা যায়। খাসিই নাকি জবে হবে আঠারো হাজার! সকল মনসবদারদের দাওয়াত। চেতন সিং দোহাজারি, সে অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছে মনসব বাড়ানোর। ভেট হিসেবে কিছু দুর্লভ পাথর আর চিত্ররেখার হীরের আংটি।
চিত্ররেখার ব্যাপারটা আরেকটু বোঝা দরকার। তারাবাঈ আজকাল সমস্ত খুলে বলেনা, পেটের ভেতর কথা রেখে দেয়। চিত্ররেখা হল চেতন সিং এর পাসওয়ান অর্থাৎ রক্ষিতা, কিন্তু বলে তার বিয়ে হয়েছে। বিয়েই যদি হবে, তাহলে আমার সামনে পর্দা করলনা কেন? বিবাহিত সকলেই তো পর্দায়াৎ হবার কথা।
কথা আরও আছে। পাহাড়ে উঠতে উঠতে ভাবতে থাকলাম। যখন চেতন সিং অক্কা পাবে, তখন তার নাবালক ছেলে চেতক সিং গদিতে। চেতকের মাতা মমতা এক কষা বদমাইশ। ভয়ানক মেজাজ। সে মহিলা শোনা যায় কুসুম নামে মহলের এক দর্জিকে বাগানে নাঙ্গা করে রেখেছিল জামা ঢোলা বানিয়েছিল বলে। চেতক গদিতে থাকলে কলকাঠি নাড়বে মমতাই। চেতন সিং কে মেরে লাভ কী তাহলে? আস্ত গুষ্টিই নাশ করে দেয়া উচিৎ। চেতন সিং মরলে চিত্ররেখাকে মহলের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেবেনা মমতা কাউর।
পাথর বেয়ে বেয়ে পাহাড়ে উঠতে উঠতে একটা সমান জায়গা দেখে একটু বসলাম। বড় খাড়াই। সূর্য ফুটছে ধীরে ধীরে। চকিতে আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলাম, পাখির ডানার ঝাপ্টার শব্দ। আমাকে এখন পক্ষী পাঠায় কে?
ধীরে গুলজার নেমে আসলো কাছে। পায়ে বাঁধা ছোট কাগজটা খুলে দেখি লেখাঃ “যদি নাই কেউ, তবে মহীন্দরগড় থাকেন লালুজি।”
অ্যাঁ?
ফের পাহাড় বাইতে শুরু করলাম তারাবাঈর কাগজ নিয়ে ভাবতে ভাবতে। লালুজির তথ্য দিয়ে আমি কি করব? প্রথমতঃ লালুজি মহীন্দরগড় থাকেনা, সে থাকে মহেশ্বরী। তারাবাঈ সেটা ভালো করেই জানে। মহীন্দরগড় এখান থেকে আধা দিনের পথ। দ্বিতীয়তঃ, লালুজি মহেশ্বরী না মহীন্দরগড় তাতে কী এসে যায় আমার। আমারতো লালুজির সাথে কোন মাঠা নাই, সে আমার পরিচিত কাউকে লুট করে নাই। লালুজি থাকুক লালুজির মত। তবে, যদি নাই কেউ মানে কী? বুঝি নাই।
উপরে উঠে যুইৎ করে বসলাম। লালুজি সমস্যা পরে সমাধান করা যাবে। ভালোমত বসে নেই। যদি চেতন মাঝে থাকে, তাহলে সামনের দু-তিনজনকে প্রথমে ফেলে দিতে হবে। চেতন সিং হয় স্থির হয়ে যাবে ভয়ে অথবা উল্টোদিকে ছুট দিবে। উল্টোদিক ফিরা লোকের পিঠে তির সেঁধিয়ে দেয়া বড় সহজ। তবে, সে যদি সাঁ করে ডাইনে ছুট দেয় তাহলে গাছে আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবে, তখন তার পিছু নেয়া মুস্কিল অবশ্য। নিচে থাকলে দ্রুত পিছু নেয়া যেত।
কিন্তু পথ খাড়াই। নিচে থাকলে তির মারা অসুবিধা। উপরেই থাকি।
আরও কিছু সময় পরে হঠাৎ মনে হল কিছু মানুষের নড়াচড়ার শব্দ শুনলাম বুঝি! ঝুপ করে সরে খুব ঠাণ্ডা মাথায় পাহাড়ের ঢালের শেষ মাথায় গিয়ে নিচে কেউ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম। কাউকে দেখা যাচ্ছেনা, সব শুনশান, ফাঁকা। বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শব্দ আবছা। তাহলে কি কানের ভুল?
তাই হবে।
রাস্তা মাঠের ভিতর দিয়ে গিয়েছে অনেকদূর। নিচে দেখতে দেখতে হঠাৎ বুঝলাম দূরে রাস্তা দিয়ে কিছু ঘোড়সওয়ার আসছে। ওই বুঝি এসে গেল চেতন সিং এর দল। তাড়াতাড়ি ঘষটে ঘষতে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলাম। দ্রুত তির মারতে হবে পটাপট, সামান্য দেরী হলেই সব পণ্ড! আমি নিঃশব্দে তির টেনে প্রস্তুত হয়ে থাকলাম। ঐ দেখতে পাচ্ছি সামনে দুই সিপাই ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে, তির মারার এখনই সময়। আমি ধনুকের ছিলা টেনে ধরলাম।
মুহুর্তের ভেতর সাঁই সাঁই করে বল্লমের ঘায়ে দুই সিপাই মরে ঘোড়া থেকে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল। লাল জামা পরা চেতন সিং ভয়ে একটু সরতেই আরেক বল্লম এসে তাকে বিঁধে দিল সরাসরি। দলের বাকিরাও দ্রুত অক্কা পেল। কাজ খতম।
আমি আস্তে আস্তে তির নামিয়ে রাখলাম। বল্লম মারে কে রে ভাই?
ঘষটে ঘষটে আবার পাহাড়ের কোনায় গেলাম ভালো করে দেখতে কী হচ্ছে। দেখি পাশে থেকে কোথা থেকে উদয় হয়েছে হলদে জামা পরা কতিপয় লোক। হাতে খঞ্জর সড়কি খাণ্ডা তলোয়ার। মারাঠা মনে হচ্ছে, উপর থেকে কথা বোঝা যাচ্ছেনা মারাঠি বলছে কিনা।
এরাই কি লালুজির লোক?
… … …
ঝিল্লি নদীর উল্টা ধারে লালুজির তাঁবু। রাত।
আমি তির পরিষ্কার করার যন্ত্রপাতি পিঠে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিলাম, এমন সময় এক পেয়াদা হাত তুলে থামাল। মারাঠিতে বলল আবে কই যাস?
আমি বিনয়ের সাথে বললাম, রাত হইছে কাল সকালের জন্য তির শান দেওয়া লাগব না আপনাগোর? দশ তির এক পয়সা নিমু। বল্লম তিনটা এক পয়সা। আর ভাঙ্গা জহরত থাকলে সেইটাও পরিষ্কার করি।
ভাঙ্গা জহরত পরিষ্কার হা হা হা হা। হারামজাদা চোর।
না না ইয়া ভাগোয়ান চোর না তো। আপনেরা সামনেই থাকবেন।
এই কেডা রে, পাশ থেকে হেঁকে আরেক পেয়াদা আসল, কেডা কথা কয় তোর লগে?
প্রথম পেয়াদা বলল, বোঁচকা নিয়া হাটতেছিল এই বোকচোদ। কয় তির বল্লম শান করে আর ভাঙ্গা জহরত সাফ করে। চুরির মতলবে আইছে মনয়।
হাতের মশাল একবারে আমার মুখের সামনে এনে দ্বিতীয় পেয়াদা বলল এই হাউয়ার্পো, কইত্থে আইছস? বল্লম শান বাদ দে, বল্লম চালাইতে জানোস?
আমি বিনয়ে গলে গিয়ে বললাম হাঁ পারি তো বল্লম চালাইতে। বুরহানপুরে তারিফজির সাথে আছিলাম কয়দিন। ঘোড়া দিয়া তিরও চালাইতে জানি।
হা হা হা হা। শুয়োরের বাচ্চা চোরই। ঠিকই কইছস। এখন ঘোড়া চায় পলানোর লাইগা। এই হারামজাদা, ঘোড়া দিমু না। পায়দল যাবি বল্লম দিমু একটা ভোঁতা। তুই শান কারিগর বল্লম শান কইরা নিস নিজেরটা। ল আমার সাথে, সোময় নাই বেশি।
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম ভিতরে ভিতরে। সময় বেশি নাই মানে কি? আমাকে কি এখন যেতে হবে না সকালে? মারাঠারা ছোট দল নিয়ে বর্গিগিরি করে যখন তখন রাতে হামলা চালায় বটে মাঝে মাঝে, কিন্তু এখন বর্ষা মৌসুম। বাইরে যে প্যাককাদা এর মধ্যে অন্ধকারে হামলা করবে কিভাবে?
তার চেয়েও বড় কথা এখন খামোকা পায়দল যুদ্ধে গেলে লালুজির কাছ থেকে সূর্যমূখী আংটি আনব কখন? ধুরোযা। আমি আরও ইচ্ছা করে রাতে আসলাম যেন ঘুমন্ত তাঁবু থেকে আয়েশে একসময় চুরি করে আনা যায়। এরা যে রাতে হামলা করার ধান্দায় থাকবে এইটা তো হিসাবে আনি নাই। মহা ফ্যাসাদ!
মাঠের এক কোণায় দশটা মশাল জ্বলছে, সামনে সারি সারি অস্ত্রশস্ত্র। একপাশে পাইকপেয়াদারা দাঁড়িয়ে আছে, আমি সেইখানে দ্বিতীয় পেয়াদার সাথে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্যপাশে এক ছোটখাট গোঁফওলা কালো লোক চোখ পাকিয়ে চিৎকার করে কইল এই! পত্থমে সড়কিহাতে পায়দল। দুইপাশে ঘোড়সওয়ার। পিছে তিরহাতে পায়দল। কালা ঘোড়া সামনে, লাল ঘোড়া পিছনে। ঝিল্লি নদীর এইপার পজ্জন্ত এক কাতারে, নদী পার হইলে যে যার জায়গায়। বুজছস?
সবাই একসাথে হেঁকে চিৎকার করল, হয়!
বুজছস?
হয়! হয়! হয়!
এরপর সকলে অস্ত্র তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমি গোঁফওলা ব্যক্তি ও তার পিছনে দাঁড়ানো পেটা স্বাস্থ্যের অধিকারী লোকটিকে একটু ভালো করে দেখে নিলাম। হাবশি গোঁফওলা সম্ভবত লালুজির ডানহাত গফুর খাঁ, আর পিছনে কমলা জামা পরিহিত ব্যক্তি লালুজি স্বয়ং।
আমাকে দ্বিতীয় পেয়াদা একটা বল্লম ধরিয়ে দিলে আমি ধীরে ধীরে বাকি পায়দল সিপাইদের সাথে গিয়ে দাঁড়ালাম। সব মিলিয়ে সিপাই পঞ্চাশ/ষাটজন হবে। ঘোড়সওয়ার কতজন বলা যাচ্ছে না অন্ধকারে, কিন্তু বেশী বড় বাহিনী না। লালুজি কেন রাতে আক্রমণ করছেন সেটা বোঝা কঠিন নয়। প্রতিপক্ষ নিশ্চয়ই অনেক বড় এর চেয়ে।
অন্ধকারে কাতারে হাঁটতে হাঁটতে আমি পাশের সিপাইকে বললাম কত্তা। আমি নূতন। কার সাথে লড়াই গো?
আস্তে করে শ্বাস ছেড়ে সিপাই বলল, আমিও নূতন। গত সপ্তায় আসছি। পায়দল সক্কলেই নূতন। মাসখানেক আগে এক লড়াইতে লালুজির প্রায় সব সিপাই মইরা যায় সুলতান কাম বখশের গড় দখল করতে গিয়া।
ও বুঝছি। এখন কি সুলতান কাম বখশের সাথে লড়াইতে যাইতেছি? তার গড় তো মেলা দূর।
না এখন বাদশায়ী সিপাইদের তাম্বু আক্রমণে যাইতেছে শুনলাম। কোশ দুয়েক দূর। খাবার আর পানির বহর সবার পিছনে, সেইটা লুট করতে যাইতেছে শুনলাম।
আমি মনে মনে ঢোঁক গিললাম। এক আংটি দখল করতে গিয়ে কি বিখাউজ ভ্যাজালে পড়লাম রে ভাই। বাদশার সিপাইদের মোকাবেলা করতে হবে এখন ভোঁতা বল্লম দিয়ে? হায়রে আল্লা। বাদশার বাহিনী মানে তো রাজা রতন সিং এর লোক সব। ভয়ানক প্রশিক্ষিত, কয়দিন আগেই কান্দাহার জয় করে আসছে। প্যাককাদা না থাকলে আজকে খবরই ছিল।
নদী পার হতেই দূরে মশাল দেখা গেল। বাদশাহী বহর তাহলে এখানেই। প্রচণ্ড পিছল কাদা নদীর ধারে, জোরে হাঁটা মুস্কিল। তার মধ্যেই দ্রুত সকলে দৌড় শুরু করে দিল আক্রমণের জন্য, আমি কাদায় আটকে একটু পিছিয়ে পড়লাম। আরো দ্রুত হাঁটা চাই। কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই শুনি ভয়ানক গোলাগুলির শব্দ, সাথে মানুষের আর্তনাদ। এদের বন্দুকও আছে দেখি। সর্বনাশ। খরগোশের মত হামা দিয়ে একটা গাছের পিছনে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে। ভালোমত বুঝতে না পেরে বর্শা নামিয়ে রেখে গাছে উঠে গেলাম, আর তখনই পরিষ্কার হয়ে গেল আর্তনাদের শব্দের কারণ।
পরিখা!
বাদশাহী বহরের তাঁবুর ঠিক বাইরে গভীর পরিখা কাটা, সেইখানে পায়দল সিপাই আর কয়েকটা ঘোড়া পড়ে গিয়েছে, আর প্রতিপক্ষ ইচ্ছেমত উপর থেকে মেরে যাচ্ছে তাদের। অন্ধকারে পিছনে কেউ দেখতে পারছেনা তাই ঘোড়সওয়ারের দল এগিয়েই চলেছে নিশ্চিত মরণের দিকে।
আমি পিছু ফিরে দেখার চেষ্টা করলাম লালুজির বাহিনী কতদূর দেখা যায়। অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হয়না। আমি গাছ বেয়ে ফের নেমে পড়লাম। পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে দেখা যাক পরিখা কতদূর। হঠাৎ টের পেলাম প্রতিপক্ষের তিরন্দাজ কাজে নেমে পড়েছে, সাঁ সাঁ করে তিরের বৃষ্টি নেমে এল যেন। আমি নিচু হয়ে আরেক মোটা গাছের পিছনে অবস্থান নিয়ে বসে থাকলাম। অবস্থা কেরোসিন। লালুজির দলের কোন আশাই নেই এই লড়াইতে বেঁচে বের হতে পারার। বর্গিগিরির মূল শক্তিই হল আচমকা আক্রমণ প্রতিপক্ষ কিছু বোঝার আগেই। সেজন্যই রাতে বা দিনে হৈহৈ করে ছোট লুটদখল করে মারাঠিরা প্রতিপক্ষকে ব্যস্ত রাখে। খাবার পানীয়ের বহরে লুট করলে তো উপরি লাভ, আস্ত বাহিনীই না খেয়ে পরে কেটে পড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু লালুজির নতুন পায়দল সিপাইরা কিছু না বুঝেই তেড়ে আক্রমণ করতে গেছে আরে গভীর পরিখা খেয়াল করেনি, তাতে বাদশাহী সিপাইরা টের পেয়ে গেছে। বর্গিগিরির বারোটা। লড়াই শুরু হতে না হতেই শেষ!
আমি কী করব ঠিক করতে করতে তিরের বৃষ্টি কমে এল। আমি আস্তে করে আবার হামাগুড়ি দিয়ে ঝিল্লি নদীর দিকে যেই যাব অমনি শুনলাম এক ঘোড়ার ডাক। ভালোমত চেয়ে দেখি অল্প দূরে একটা লম্বা সাদা ঘোড়া। ডাকছে কেন, তির লেগেছে?
আমি ধীরে চারপাশ খেয়াল করলাম কেউ আছে কিনা। কাউকে দেখলাম না। সকলে পালিয়ে গেছে কিম্বা পরিখায় পড়ে গেছে বুঝি। আস্তে আস্তে ঘোড়ার কাছে গিয়ে দেখি পাশে পড়ে আছে ঘোড়সওয়ার, বিড়বিড় করে কি বলছে। কাঁধের একটি নিচে তির বিঁধে আছে। আমি আরো কাছে গিয়ে দেখি সওয়ার এক দীর্ঘদেহী ব্যক্তি, কমলা জামা পরিহিত।
লালুজি!
আমি দ্রুত কানের কাছে গিয়ে বললাম লালুজি। ভয় নাই। আপনের ঘোড়া ঠিক আছে, আপনেও ঠিক আছেন খালি একটা তির খাইছেন। এই আন্ধারে তির বাইর করতে গেলে আরো জখম হয়া পড়বেন। ভয় নাই। আমি আপনারে ঘোড়ায় উবুৎ করা বসাইতেছি, নদীর ঐপার নিয়া তির খুইলা দিতেছি খাড়ান। ভয় খায়েন না। আমি আছি।
তুই...কে র্যা? গফুর?
না কত্তা। গফুর না তো। আমি কবুতর ফারুক। বসেন ঘোড়ায়।
কবুতর?
দশ মণী লালুজিকে উবুৎ করে ঘোড়ায় বসাতে আমার হাগা ছুটে গেল। ভাইরে ভাই। তার উপর ঘোড়া কিছুতেই বসবে না, দাঁড়িয়েই রইল। ঘোড়া বসলে লালুজিকে শোয়াতে সুবিধে হত। যাহোক কোনমতে ঘাড়েপিঠে করে লালুজিকে উঠিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে নদীর ঐপারে যেতে থাকলাম। লালুজি কিসব বিড়বিড় করেই যাচ্ছে।
কিছুদূর গিয়ে একটা ঝিরি, সেখানে ঘোড়া বেঁধে আমি লালুজির তির পরীক্ষা করতে নিলাম। চাঁদের হাল্কা আলোয় তেমন দেখা যাচ্ছেনা, তবে তির এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছ। তিরের আগায় বাঁকানো ফলা, টান দিয়ে আসলে মাংসসুদ্ধা কেটে নিয়ে আসবে।
মুস্কিল হল।
ব্যথায় কুঁকড়ে লালুজি বলল, আ-হ! আ-হ। কে র্যা? গফুর?
না কত্তা গফুর না। আমি কবুতর ফারুক। আপনের তির বেকায়দা লাগছে, তয় মরবেন না। বাইন্ধা দিছি শক্ত কইরা। আরেকটু আলো থাকলে খুলন যাইত।
কে গফুর? মহীন্দরগড় নিয়া চল আমারে। গফুর শুনছস? গফুর?
এই বলে আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ল লালুজি। আমি শ্বাস ফেলে লালুজির কোঁচড় হাতড়ালাম। হ্যাঁ, ছোট একটা জহরতের পোঁটলা আছে ঠিকই। আমি খুলে চাঁদের আলোয় ভালো করে পরীক্ষা করলাম পাথর। ঐতো সূর্যমুখী আংটি। চাঁদের আলোয় ঝকমক করে উঠল বিজয়নগরের হীরে। যাক, আংটি তো পাওয়া গেল!
বেশ।
আমি বাকি জহরত লালুজির পোঁটলায় রেখে তার কোঁচড়ে ভরে রেখে দিলাম ফের। তারপর ঘোড়ায় উঠানোর আঞ্জাম করলাম, মহীন্দরগড় দূর নয়। টানাটানিতে আবার ব্যথা পেয়ে লালুজি বলল আ-হ। আ-হ। গফুর?
আমি ঘোড়ায় আমার পিছনে বসিয়ে তার কমলা জামা দিয়ে আমার শরীরের সাথে শক্ত করে বেঁধে লালুজির কানে পিছন ফিরে বললাম, হাঁ কত্তা। আমি গফুর। বসেন, মহীন্দরগড় নিয়ে যাইতেছি। ভয় নাই।
গফুরের নাম শুনেই হয়ত, ফিকে হেসে লালুজি আবার নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। আমি ঘোড়া ছোটালাম। দ্রুত মহীন্দরগড় পৌঁছানো চাই, খুব দ্রুত। বাতাসের বেগে নির্জন জঙ্গলের পথে হাল্কা চাঁদের আলোয় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকল লালুজির সাদা ঘোড়া।
(শেষ)
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ হিমু ভাই
মন্তব্য
ভালো লাগলো।
তবে চিত্ররেখার সিনগুলি আরেক্টু বড় হৈলে হেবি লাগতো
অজ্ঞাতবাস
খালি দুষ্টামি।
কিন্তু চেতন সিং অক্কা পাওয়ার পরে চেতক সিং তথা মমতা কাউর সত্যই গদিতে আসছিল কিনা আর চিত্ররেখার কী হইল সেইগুলা জরুরি পশ্ন। কবুতর ফারুক আহত লালুজিকে নিয়ে উল্টাদিক ঘোড়া না ছুটাইলে আমরা পকিত রহস্য জানতে পাত্তাম।
..................................................................
#Banshibir.
অজ্ঞাতবাস
চেতন সিঙের সাথে যারা বল্লম খেয়ে মরলো, তারা পেয়াদা নাকি সওয়ার? পেয়াদা লিখলে ব্যাপারটা "হাঁটিয়া চলার মর্দ ঘোড়ায় চড়িল" হয়ে যাবে।
পেয়াদা কেটে সিপাই করে দিলাম। বাদশার পুলার জম্মদিনে ঘোড়াসহ দলবলের দ্রুত যাওয়া চাই নাইলে পুলাউ শেষ হই যাবে। নো পেয়াদা বিজিনেছ।
মন্দিয়ে পড়বার জন্য আপনাকে ঈগলচক্ষু উপাধি দেওয়া হইল।
..................................................................
#Banshibir.
গল্পে অবশ্য মশাল ছিলো। কিন্তু মোমবাতি আঁকলাম।
একশোতে একশো ছবি হৈছে। মূল পোস্টে জুইড়া দিলাম অনুমতি ব্যতিরেকেই। মশাল কাইটা মোম করাও ইজি।
তিনোজনের আলাদা আলাদা পাটি পছন্দ হইছে। বিওয়াইওপি, ব্রিং ইয়োর ঔন পাটি। তবে কেবল তারাবাঈ পাশবালিশ পাইছে কেন জবাব চাই।
..................................................................
#Banshibir.
জোয়ান মেয়ে কেন মাদুর-বালিশ সঙ্গে নিয়ে ঘোরে, সে এক রহিস্যি বটে।
সে মহলের তহশীলদার। মাদুর বালিশ খেতা কম্বল সকল হিসাবই তারে রাখতে হয়।
..................................................................
#Banshibir.
ইয়ে, মোমবাতিজোড়া অমন অশ্বখুরাকৃতি চুম্বকের মতন কেন, মশাই?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
"মমতা কাউর" নাম শুনে তো মনে হয় মহিলা শিখ। চেতন সিং কি রাজপুত না শিখ?
কষা বদমাইশ মহিলা মমতা কাউর লিচ্চয় শিখ। কাউর আপারা শিখ হয়, ধরছেন ঠিক। চেতন সিং চোগান সিং এর ভাতিজা, এবং চোগান সিং রাজপুত। অতএব চেতন সিং রাজপুত আমি মোটামুটি শিউর। তবে সে বল্লমের ঘায়ে মইরা গেছে বিধায় জিজ্ঞাস করতে পারলাম না
..................................................................
#Banshibir.
মালিক অম্বরের উপর লেখার অপেক্ষায় ছিলাম। যা হোক একটা লেখা অন্তত পাওয়া গেলো আপনার অনেকদিন পর এটাও মন্দ না।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
কবি বলেছেন নগদ যা পাও হাত পেতে নাও ইত্যাদি। মন্দ না হলেই হইল।
মালিক অম্বর নিয়া ছোট লেখা দিব না আস্ত সিরিজ নামাব, প্রবন্ধ ফাঁদব না কিচ্ছা লিখব ভাবতে ভাবতে বয়েস বেড়ে গেল। মালিক অম্বর একটি বিস্ময়।
..................................................................
#Banshibir.
প্রবন্ধ আর কিচ্ছা এক সঙ্গেই দেন, আপনার অসাধ্য নাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ভালো লাগলো
মাহমুদুজ্জামান মাহমুদ
চমৎকার! ভালো লাগলেই হল। আছেন ভালো?
..................................................................
#Banshibir.
বাহ বেশ। এবার রাজহাঁস রশীদ আর বকপাখি মহিউদ্দিন লিখ্যালান!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বিজ্ঞানবিষয়ে গভীর কিছু লেখেন দেখি কিছু মনে আছে কিনা।
..................................................................
#Banshibir.
কতকাল বাদে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
হ টানা লিখলে ঘুম আসে। আস্তেধীরে লেখাই প্রশস্ত।
কোভিডের এই যুগে লেখালেখি আবার আরম্ভ করি দেন।
..................................................................
#Banshibir.
(শেষ) মানে কী? কবুতর ফারুক শেষ নাকি এই পর্ব শেষ? পর্বের নাম "চিত্ররেখার হিরার আংটি", নামকরণের সার্থকতা বর্ননা করলে ভাল হয়।
কেবল এই পর্ব শেষ। কুনো ভয় নায়।
..................................................................
#Banshibir.
হিরাকে হীরা বানাইয়া লইবেন।
"হিরা" লেখছি নাকি? খুঁইজা পাইলাম না, একটু দেখায় যায়েন কুঞ্জাগায় হিরা তইলে পাল্টায় দিবনে।
..................................................................
#Banshibir.
না জনাব, আপনি নন, আমি লিখেছিলাম হিরা।
শেষ ক্যান? চিত্ররেখা কই?
কইতে পারলাম না। কবুতর ফারুক শেষমেষ কিভাবে চিত্ররেখার হাতে আংটি পাঠাইছিল সেই ইতিহাস রয়ে গেল অজানা ও অধরা
..................................................................
#Banshibir.
নতুন মন্তব্য করুন