আজিমপুর গেইট দিয়ে নিউ মার্কেট ঢুকে হাতের ডান দিকে গ্যালে চার-পাচটা দোকান পরই ছিল পর-পর দুটা খেলনার দোকান। আমার ছোটবেলার স্বপ্নের সব খেলনা পাওয়া যেত ঐ দুটো দোকানে। মায়ের ব্যাগ থেকে একবার পাচটাকা চুরি করে ঐ দোকানে গিয়েছিলাম ২৫ টাকা দামের একটা গাড়ি কিনতে। মশা তাড়ানোর মত তাড়া খেলাম দোকানির কাছ থেকে।
শেষ পর্যন্ত এ্যারোপ্লেনের আকৃতির এক প্লাষ্টিকের কৌটার এক কৌটা টিক-টিকির ডিম কিনলাম*
খুব ভাল করেই জানতাম আমার সরকারি চাকুরে বাব-মা’র পক্ষে হুট-হাট করে দামি খেলনা কিনে দেওয়া সভব না, জানতাম কিন্তু মাঝে-মাঝেই মানতে পারতাম না। একদিন নিউমার্কেটে গিয়েছি বাবার সাথে বাজার করব বলে। হঠাত করেই একটা রিমোর্ট কন্ট্রোল গাড়ি আমার অসম্ভব পছন্দ হয়ে গেল! এতই পছন্দ যে আমি কিভাবে কিভাবে সেই গাড়ি দিয়ে খেলবো সেটাও মনে মনে সাজিয়ে ফেলে বাবাকে বললাম, গাড়িটা আমার চাই!
বাবা নানাভাবে আমাকে বোঝায় আমি বুঝি না। (সেই সময়-১৯৮৩-৮৪, একটা রিমোর্ট কন্ট্রোল গাড়ির দাম আমার বাবা’র বেতনের প্রায় সমান কেন বা কি করে হয় এত জটিল হিসাব আমি জানার ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী ছিলাম না)
সাধারণত আমার এই ধরনের জেদের একপর্যায়ে অধারিত ছিল মা বা বাবার হাতের প্রচন্ড এক থাপ্পর! কিন্তু এইবারে বাবা কিছু না বলে শুধু বললেন আজ আর বাজার করব না, বাসায় চল। সেই মূহুর্তে আমার মনে হচ্ছিলা আমাকে খেলনাটা না কিনে দেওয়ার জন্যে এটা বাবার একটা নিষ্ঠুর ফন্দি। বাবার এই অন্যায় জুলুমের কারনে তখন আমার মধ্যে এক তীব্র আক্রোশ, বলা যায় ঘৃনার কাছাকাছি সেই আক্রোশ! পুরো রাস্তা বাবা চুপ করে থাকলেন।
রাতে শুনলাম বাবা মা-কে বলছেন, ‘‘এত খারাপ লাগলো আজকে সারদিন, ছেলেটা একটা রিমোর্ট কন্টোল গাড়ি কিনতে চাইলো অথচ দিতে পারলাম না!’’ মা বাবার পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘থাক মন খারাপ কোর না, ওর অনেক খেলনা আছে’’ আমি তাও জিদে মরি-হেহ, গাড়ি কিনে না দিয়ে এখন মা-কে বাবা এটা বলছে, সত্যিই যদি তার খারাপ লাগতো তাহলে কিনে দিলেই হত!
যেদিন থেকে আমার ‘বোধ’ হয়েছে সেইদিন থেকে আমি আমার বাবার সেই অপূর্ন-দুঃখিত মুখটা ভুলতে পারি না! কি-যে বিষাদমাখা সেই মুখ!
আরিফের পানচিনিতে ওর বউর শাড়ির কিনতে গিয়ে ছবির গাড়িটা দেখে হঠাত পুরো ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। কি-নে নিয়ে আসি আমার ছোট বেলার কল্পনার থেকেও অনেক বড় এই গাড়িটি।
পৃথিবীর সমস্ত শক্তি আর ক্ষমতা দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, বাবা দেখ আমি রিমোর্ট কন্ট্রোল গাড়ি কিনেছি-অনেক বড় অনেক সুন্দর। প্লিজ বাবা তুমি মন খারাপ করে থেক না, প্লিজ!
মন্তব্য
ভাল লাগল।
অফ টপিক: আজিমপুর কলোনীতে থাকতেন নাকি ?
না ভাই আমি পিওর সিলেট।। শুধু মাঝখানে কিছুদিন বনানিতে...
আমার ছোটবেলায় একটা রেসিং সাইকেলের (গিয়ারওয়ালা) শখ ছিল। অনেক কান্নাকাটি করেও এই দাবিটা বাবা-মার কাছ থেকে পাশ করাতে পারিনি। তাই পণ করেছিলাম অর্থ উপার্জন করতে পারলে দেখে রেসিং সাইকেল কিনে ছাড়ব। কিনেছিলামও যখন প্রথম ইনকাম করি। আজও গ্যারেজে পড়ে আছে জিদ করে কেনা সাইকেলটি। কেউ চড়ে না এখন। তবে কেনার জন্য আফসোস লাগে না।
এতোটা মিলে যাবে ভাবিনি! আমার একটা "বাবার হাত ধরে ঝুলে পড়া " কান্নার স্টাইল ছিল। আমি খেলনা বা অন্য কিছু বাগাতে ব্যর্থ হলেই ঐ স্টাইলে ঝুলে পড়তাম, অনেকটা নিজের ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে নির্দিষ্ট দোকানটার সামনে বাবাকে আটকে রাখার উদ্দেশ্যেই। বাবা আমাকে ঝুলন্ত অবস্থাতেই বয়ে নিয়ে যেতেন। আর ঐ সময় আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতো অগুণতি শব্দাবলী যার অধিকাংশই মফস্বলে থাকাকালীন পাড়াতো পোলাপাইনের কাছ থেকে শেখা। বাবাকে তখন বলা বাহুল্যই, আরেক হাতে আমার মুখটাও চেপে ধরতে হতো
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
আমার মাংসপুতুল বইয়ের একটা কবিতা। ৯৮ এ লেখা। হয়তো মিলে যায় এই পোস্টের সাথে...
শেষ চারটা লাইন খচ্ করে বুকে গেথেঁ গেল ।
কবিতাটা খুব সুন্দর। শেষ লাইনে এসে কষ্টটুকু একেবারে বুকের ভেতরে গিয়ে লাগে।
কি মাঝি? ডরাইলা?
lilen vai kobitata oshadharon. lab e boshe tai bangla nai tao montobbo na kore parlamna.
*জানিনা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা টিক-টিকির ডিম চেনে কি-না বা চিনলেও তারা কি নামে ডাকে। কিছুদিন আগে আমার এক ভাতিজিকে কিছুতেই হাওয়াই মিঠাই বোঝাতে পারছিলাম না (দেশে) শেষে ওর বাবা, আমার অপদার্থ ভাই, বলল, মা তুমিতো ক্যাণ্ডিফ্লস্ক চেন, তোমার চাচা সেই ক্যাণ্ডিফ্লস্কের কথাই বলছে!!! হারমজাদা তুইতো সারাজিবন হাওয়াই মিঠাই-ই বলতি তোর কি অসুবিধা হাওয়াই মিঠাইকে হাওয়াই মিঠাই বলতে?
হা : হা : হা : !
সবাই জাতে উঠতেছে । হাওয়ায় ভর করে উঠা যায় না তাই ক্যন্ডিফ্লসের কাঠি ধরে ধরে উঠে ।
পড়তেন আমার বাবার হাতে। দেখিয়ে দিত কত ধানে কত চাল।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
একেবারেই ব্যাক্তিগত প্রশ্ন রনি , বার দু'য়েক দ্যাখা হলে ও জিঙেস করা হয়নি ;লেখক মির্জা আব্দুল হাই কি আপনার আত্মীয় ?
---------------------------------------------------------
নীল সার্ট নেই বলে কেউ আমাকে নাবিক বলেনি !
অথচ সমুদ্রে-ই ছিলাম আমি
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
সবার ছোটবেলাটা একই।
ছোটবেলা থেকেই কেন জানি মুখ বন্ধ করে রাখতে শিখে গিয়েছিলাম। একজোড়া জুতার খুব শখ ছিল। হাঁটার সময় জুতোর নীচে জুড়ে দেয়া চকমকি আলোকবিন্দুগুলো জ্বল জ্বল করবে। একটু বড় হবার পর শখ হল একটা রেসিং সাইকেল কিনবো। বুঝতে পারতাম বাবার সেই সামর্থ্য নেই। হয়তো বা কিনে দিতে পারবেন। কিন্তু তাতে করে পরিবারের মাসিক খরচের একটা বিশাল ঘাটতি দেখা দেবে। আর তাইতো মুখ বন্ধ করে থেকেছি। এখন হয়তো চাইলেই কিনে ফেলতে পারি একজোড়া জুতা বা একটা রেসিং সাইকেল। কিন্তু এখন স্বপ্ন গুলো মরে গেছে। তাই আর কেনার ইচ্ছাগুলো জাগে না নতুন করে।
হায়রে মানবজন্ম ! আমার কত স্বপ্ন পুরণ হল না।
কি মাঝি? ডরাইলা?
- স্বপ্নরা মরে না কখনোই। হেফাজতে থাকে। কখনো সখনো ভুল সময়ে উথলে উঠে কেবল। মির্জার লেখাটার শেষের কয়েকটা লাইনই দেখুন না। স্বপ্ন'রা মরে গেলে তাঁর আর গাড়িটি কেনা হতো না। বাবার চোখে হাসি ফোটাতে ঝলমলে চোখ নিয়ে বলা যেতো না, বাবা দেখ আমি রিমোর্ট কন্ট্রোল গাড়ি কিনেছি-অনেক বড় অনেক সুন্দর। প্লিজ বাবা তুমি মন খারাপ করে থেক না, প্লিজ!
অসম্ভব ভালো লাগলো মির্জা, আপনার লেখা।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
মনটা খুব খারাপ ছিল...আপানাদের সবার মন্তব্য ভাল লাগলো----কাউকে ধন্যবাদ দিচ্ছি না......কারন আমরা সবাই-ই আমি বা আপনি।
@ধুসর গোধুলিঃ স্বপ্নেরা মরে না...... দ্রোহি'র কথা ঠিক-----আজ পর্যন্ত ঠিকভাবে গাড়িটা চালাই নি---এই শনিবার গাড়িটা নিয়ে বের হচ্ছি ধুমসে চালাবো...আসবেন না-কি কেউ ছোটবেলার স্বপ্নের গাড়ি চালাতে?
ভালো লাগলো
রাকিব হাসনাত সুমন
দারুণ !
আগে পড়া হয়নি কেন কে জানে।
ভীষন ভাল লাগলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
খুব ভালো লাগলো। ছোটবেলায় টিভিতে addvertise দেখতাম কত পুতুলের আর বলতাম আব্বু এটা কিনে দিবা আর সাথে সাথে আব্বুও বলত "হ্যা কিনে দেবো" কখনও না বলতনা, আর আমি ওতেই খুশি, খেলনা পাওয়ার আশায়, কিন্তু কখনও কিনে দেয়নি বা কেনা হয়ে ওঠেনি। ঐ বলা পর্যন্তই। এখন joke কোরে আব্বুকে বলি তুমি ছোটবেলায় কত কিছু promise করতা তারপর আর মনে রাখতানা
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
নতুন মন্তব্য করুন