আজকের এই লেখাটি একটি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করার লেখা; দীর্ঘ ১৩/১৪ বছর ধরে টিভিতে কাজ করার ফলে, বিশেষত ইংলন্ডে টানা প্রায় ১০ বছর কাজ করার সময় অগুনতি মানুষের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি পুরো ইয়োরোপ জুড়ে। তাদের সকলের কাছে, যারা দিনের পর দিন আমাকে মতামত জানিয়ে সাহায্য করেছেন, যারা অন্তত একদিন হলেও আমার যে কোন অনুষ্ঠান দেখেছেন, আমার সহকর্মিরা যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে পর্দার আড়ালে থেকে আমাকে পরিচিত মুখ করেছেন ইয়োরোপে, তাদের সবার কাছে আমি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি ২০১১ সালে ইষ্ট লন্ডনের বৈশাখী মেলা চলাকালে মঞ্চে আমার আচরণের জন্যে।
বৈশাখী মেলা ২০১১: বদলে দিল সবকিছু
২০১১ সালে ইষ্ট লন্ডনের বৈশাখী মেলা উপস্থাপনার সময় অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন আমার চোখে-মুখে এত রাগ কেন? আমার কিছু-কিছু কথা এত উদ্ধত শোনাচ্ছে কেন? আমি কিছু বলিনি, চুপ করে ছিলাম।
আজ সবার সাথে শেয়ার করতে চাই সেদিনের ঘটনা!
মূল ঘটনা:
ঠিক বারটার দিকে মঞ্চে ওঠার আগে এক বাংলাদেশি তরুণী শিল্পী (?) আমার পথ আটকে বললেন, আমার টাইম কখন? আমার হাতে রানিং অর্ডার, আমি নাম মিলিয়ে দেখি তার নাম সেখানে নেই। তাকে জানাতেই সে বলল ‘‘ঐসব আমি বুঝি না, আমি গান গাব ষ্টেইজে’’।
আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমি উপস্থাপক, রানিং অর্ডার আমি তৈরি করি না; শিল্পীর (?) একই উত্তর আমি ঐসব বুঝিনা। আপনি জানেন আমি কার গেস্ট? এইসব কথা শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায়, শুধু বলেছিলাম, “I don’t know and I don’t care”.
মঞ্চ থেকে নামতেই দেখি দুইজন গণ্যমান্য (??) ব্যক্তি সেই তরুণীকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পর আবারো সেই শিল্পী (?) মঞ্চে ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়ানো, তর্ক করছেন আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক “dedicated media personal”-এর সাথে, “ আরে **** ভাই আপনি বুঝেন না ক্যান, গান গাইতে না দিলে আমি তার সাথে আজকে বিছানায় যামুই না; গান না গাইয়া রাত্রে কাম সারলে আমারে তারা আর চান্স দিবে? আপনি বলেন দিবে? আর এত্ত বড় মেলায় চান্স না পাইলে আমার আর কি লাভ? আমিতো তাদেরে আসার আগেই বলসি, আপনাদের যা ইচ্ছা করবেন, কিন্তু বড় মেলায় আমারে গান গাইতে দিতে হবে, তারাতো রাজি হইয়াই আমারে আনসে!” হাসি দেখে বুঝলাম আমার ঘনিষ্ঠ মিডিয়া বন্ধুটিও এর সাথে জড়িত!
ঘটনার এখানেই শেষ না। সেই তরুণী আমার কাছে এসে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের অত্যন্ত প্রভাবশালী দুই ব্যক্তির নাম করে বললেন, ওনারা বলেছেন আমি যেন মঞ্চে সেই শিল্পীর নাম ঘোষণা করি এখন! সেই দুই ব্যক্তিকে ব্যক্তিগতভাবে চেনার সাহস থেকে বলেছিলাম ওনারা এটা বলতে পারেন না আর যদি বলেও থাকেন, তবে অনাদের গিয়ে বলুন আমি না করে দিয়েছি।
অন্য এক পারফরমেন্স চলাকালীন সময়ে আমি গিয়েছি হাত-মুখ ধুতে, হটাত শুনলাম সেই শিল্পীর নামের ঘোষণা দেয়া হয়েছে মঞ্চে, তিনি গান গাইবেন! অন্ধ আক্রোশে বাথরুম থেকে বের হতেই হিন্দি রেডিওর কাছে বৈশাখী মেলার স্পন্সরশীপ বেচা কর্তাব্যক্তি আর আমার মিডিয়া বন্ধু (!)কাছে এসে বললেন, “শোন রাগ কোর না, ঐ বদ মেয়েটার লজ্জা-শরম নাই দেখ না এইখানেই সবার সামনে বারগেন করা শুরু করসে (বলেই আমাকে একটা চোখ টিপ দিলেন!) এরে সুযোগ না দিলে অসুবিধা আছে”
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাথে আমার ব্যক্তিগত একটা আইনি চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ছিল- আমি পুরো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করব এবং অনুষ্ঠানের কন্টেন্ট-এর ব্যাপারে যদিও তারা আমার সাথে আলোচনা করবেন কিন্তু এই ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। শুধুমাত্র এই আইনি চুক্তির কারনে সেইদিন রাগ সামলাতে না পেরেও অনুষ্ঠান চালিয়ে গিয়েছি; অন্ধ আক্রোশ আমার চেহারায় ফুটে উঠেছিল সেইদিন। যারা আমার ঐ বিষাক্ত চেহারা দেখে বিরক্ত হয়েছেন তাদের কাছে আমি আবারো ক্ষমা চাইছি কিন্তু আমার আর কিছু করার ছিল না।
আমাকে পরে বোঝান হয়েছিল, তুমি তো শুধু একজন প্রেজেন্টার, এইসব পাওয়ারফুল মানুষদের যদি নিজেদের একটু পার্সোনাল চয়েসের আগে তোমার কথা ভাবতে হয়, তাহলেত তোমারে আর ডাকবে না।
জি আমি একজন সামান্য প্রেজেন্টার ছাড়া আর কিছুই না; কিন্তু আমি মানুষ। আপনারা ডাকবেন না এই ভয়ে আমি সঙ্কুচিত হয়ে থাকবো? গত ১৩/১৪ বছরে মিডিয়াতে আমি সৎভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করেছি; ছিটকে পরেছি, পিছিয়ে পড়েছি, কিন্তু অসৎ হইনি একবারের জন্যেও, একমূহুর্তও ভাবিনি বাঁকা পথ বেছে নেয়ার। মিডিয়াতে লোকজন দ্রুত বড়লোক হয়; তাদের ব্যবসা থাকে, অন্যান্য ‘ইন্টারেস্ট’ থাকে, আমার ছিল শুধুই এক প্রেজেন্টারের চাকরি; এই সামান্য বেতন দিয়েই নিজে চলেছি, সংসার চালিয়েছি, দেশে টাকা পাঠিয়েছি; টাকা ফুরিয়ে গেলে না খেয়ে থেকেছি; দিনের পর দিন পাঁচ পাউন্ডের লাঞ্চ শেয়ার করেছি সহকর্মিদের সাথে, কিন্তু “বারগেন করিনি” সততার প্রশ্নে, একবারও না।
আমার ক্ষমা চাওয়ার ব্লগের এইখানেই সমাপ্তি; তবে যদি কারো রুচি থাকে তো বাকি ঘটনাগুলোও পড়ে নিতে পাড়েন এখানে:
ঘটনা দুই: বৈশাখী মেলার ঠিক পিক আয়ারে পাঁচ হাজার পাউন্ডের স্পন্সরশীপের বিনিময়ে হিন্দি এক রেডিও ষ্টেশনকে পাকাপাকিভাবে ৩০ মিনিটের একটি স্লট দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় খুব সম্ভবত ২০০৮ সালের এক মিটিং-এ (অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ২০০২ সালে ইটিভি ইউকের কিছু কর্তা ব্যক্তি এই ‘‘বুদ্ধি’’ দেন আয়োজক আর কাউন্সিল অথরিটিকে এবং ২০০৩ সালে সর্ব প্রথম দর্শকের জুতা সহ তারা এই ধারার প্রচলন করেন)! শুধু তাই না যে ফন্ট তৈরি করা হয় বাংলা ও ইংরেজিতে “বৈশাখী মেলা” লেখার জন্যে সেই ফন্টের স্টাইল হচ্ছে সম্পূর্ণ হিন্দি অক্ষরের স্টাইল!!! ২০০৬/২০০৭ সালে প্রথম এই পাকাপাকি ব্যবস্থার কথা তোলা হয় আর সেই মিটিং-এ থাকার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার ছিল এবং বার-বার আমি এই দুটি বিষয়ের তীব্র প্রতিবাদ করি। পরের বছর থেকে আমাকে আর ঐ মিটিং-এ যেতে দেয়া হয়নি (এমনকি টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের যে কর্মকর্তা মেলা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, এই সব বিশয়ের প্রতিবাদ করার কারনে পরবর্তীতে তাকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে মুল পদ থেকে!!!)! আমরা ধরেই নিয়েছি এইসব চলতেই থাকবে, ভারতীও ভাংরা দল পাঁচ হাজার পাউন্ডে গরু-ছাগলের দল বাঙ্গালিদের এভাবেই কিনে নিতে চাইবে আর আমরাও (চ্যানেল- এস-এর কয়েকজন সহকর্মি) আমাদের মত করেই ওদেরকে থামানোর চেষ্টা করব। কিন্তু ভাংরার কাছে মঞ্চ বেচে দেয়া ব্যক্তি যখন এসে বলে “কই মিয়া তোমার উদিচিফুদিচি করা আর ‘‘ছায়ানটিতে’’ রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বন্ধুরা দেখি বলে মাল্টি কালচারের দেশে ৩০মিনিট হিন্দি-পাঞ্জাবি গাইলে অসুবিধা নাই, তোমাদের এত লাগে কেন? ওরাতো মিটিং-এ বলল তোমরা কয়জন বেশি বুঝ”- তখন মনে হয় এই মানুষগুলোই কি রাত জেগে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে যায়? এরাই কি কথায়-কথায় সাহিত্য, কৃষ্টি আর আদর্শের কথা বলে? বুকে পিঠে “একুশ মানে মাথা নত না করা” লিখে ঘুরে বেড়ায়? ব্যান্ডের গান বাজানোর অপরাধে আমার অনুষ্ঠানই ব্যান্ড কড়ে দিতে চায়? সবচেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে এরা আমাদের সামনে দেশের কথা বলে আর পিছনে গিয়ে বলে মাল্টি কালচারের নামে বৈশাখী মেলায় ভাংরা আর হিন্দি সিনেমার গানকে জায়েজ করার কথা বলে! এদের প্রাপ্তিও কিন্তু খুব বেশি না, সামান্য একটু সুযোগ-সুবিধা, সামান্য কিছু আর্থিক সুবিধা ‘হতে’ পারে, সেই আশায় এরা একাজগুলো করে ফেলে বিষ-দাঁত কেলিয়ে! অন্যান্য কালচারের মানুষদেরকে যখন ব্রিটিশ সরকার বা লন্ডন মেয়র অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানায় তখন বাঙ্গালিদেরকে তাহলে এরা মাল্টি কালচারের নামে সুযোগ দেয় না কেন? কেন বারবার ভাংরা-ওয়ালারা বলে বাঙ্গালিদেরকে “Eid in Trafalgar Square”-এ আমন্ত্রণ করলেই হবে? ধর্মিও/ইসলামিক কালচার হিসেবে আমাদের প্রমোট করতে এদের এত উৎসাহ কেন? এর উত্তর কে দিবে?
পরিশিষ্ট:
২০১১-এর পর থেকে আমাকে নাকি অ-লিখিতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিছু-কিছু যায়গা থেকে। আরে বুদ্ধিমানের দল, আমিতো কিছুইনা, আমি ছিলাম “জাস্ট একটা প্রেজেন্টার” ইংলন্ডে এখন আমাদের হাজার-হাজার ব্লগার, চাকুরীজীবী, ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা ঠিকই এসবের প্রতিবাদ করবে। ঐদিন এখন আর নেই যে আমরা ভাববো, পড়তে এসেছি, কাজ করতে এসেছি, তাই তোমাদের কিছু বললেই, তোমাদের কথার প্রতিবাদ করলয়েই দেশে চলে যেতে হবে- আমরা আর অত বোকা নই এখন। দেশ থেকে দেশ বুকে করেই নিয়ে এসেছি, তাই আজ বলে যাই আমাদের ভালোমানুষি দেখে ভুল বুঝবেন না, আমরা এত সহজে ‘নেই’ হয়ে যাব না; আমরা ফ্রেশির দল, এখনো পুরোপুরি ভোগবাদী হয়ে উঠতে পারিনি তাই সময় হলয়েই হাজির হয়ে যাব হাজারে হাজারে প্রতিবাদ জানাতে!
মিডিয়াভিজ্ঞতা ০১: http://www.sachalayatan.com/mirzaair/47313
মিডিয়াভিজ্ঞতা ০২: http://www.sachalayatan.com/mirzaair/44735
মন্তব্য
মিডিয়াভিগ্যতা > মিডিয়াভিজ্ঞতা
Tried a few times to correct the spelling with no luck; will copy paste yours as soon as I'm home; thanks.
সব ধরনের ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় - নিজেদের পরিচয়, সম্মান, আত্মমর্যাদা, সম্পদ, ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়গুলো সব সময় খুব কম দামে বেচা হয়ে যায়। পরে এগুলো কিনতে অনেক বেশি দাম দিতে হয়। কখনো রক্ত দিয়েও দাম শোধ করতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন